রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

উদ্বেগজনক একটি সংবাদ

মার্কিন সিনেটের প্রভাবশালী এক সদস্য এবং সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান রবার্ট মেনেন্দেজের একটি বিবৃতি ছাপা হয়েছে শনিবারের পত্রপত্রিকায়। বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, রানা প্লাজা ধসের এক বছর পরও তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার বাস্তবায়ন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ও বিজিএমইএ যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। শিগগিরই যদি তা না নেয়, তবে এমন আরও দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। আর যদি তা হয়, তবে শ্রমিকদের রক্তেভেজা পোশাক আর কিনবে না পশ্চিমা বিশ্ব। এ বিবৃতিটি এলো এমন এক সময় যখন সারা জাতি রানা প্লাজা হত্যাকা-ের এক বছর পালন করেছে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১১১৩ জন পোশাক কর্মী। ওই দুর্ঘটনাকে অনেকেই অভিহিত করেছেন হত্যাকা- হিসেবে। রানা প্লাজার হত্যাকা- নিয়ে সরকার ও বিজিএমইএ'র কর্মকা-ে হতাশ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এখানে বলা ভালো, রানা প্লাজায় পাঁচটি গার্মেন্ট থেকে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ওয়াল মার্টসহ বিশ্বের নামিদামি ২৯টি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পোশাক কিনত। প্রতি বছর তারা বিলিয়ন ডলারের পোশাক কিনত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, রানা প্লাজায় যারা নিহত বা আহত হয়েছিলেন, তারা ক্ষতিপূরণ পায়নি। এ নিয়ে দেশি-বিদেশি ফান্ড নিয়ে একটি বড় ফান্ড গঠিত হলেও নানা জটিলতায় তা আটকে আছে। যে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসনও করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা প্রধান দুটি মামলা এবং নিহত এক শ্রমিকের স্ত্রীর দায়ের করা আরেকটি হত্যা মামলার বিচার শুরু তো দূরের কথা আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত জমা দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ১৮ জানুয়ারির মধ্যে আদালত এসব মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিলেও তদন্তকারীরা দফায় দফায় আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। ফলে বহির্বিশ্বেও রানা প্লাজার হত্যাকা- নিয়ে বাংলাদেশবিরোধী একটি জনমত তৈরি হয়েছে। ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার বিষয়টিকে 'লজ্জাজনক' হিসেবে অভিহিত করেছে আইএলও। আর মার্কিন সিনেটের ক্ষমতাবান একজন সিনেটর বললেন, 'শ্রমিকদের রক্তেভেজা পোশাক আর কিনবে না পশ্চিমা বিশ্ব।' এটা আমাদের জন্য একটি এলার্মিং। এমনিতেই আমাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না নানা কারণে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবনতি হয়েছে। এটা প্রকাশ্যেই বলেছেন মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। এমনকি সিনেটর মেনেন্দেজের বক্তব্য যখন ছাপা হয়, তখন অর্থমন্ত্রীর একটি বক্তব্যও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ওয়াশিংটন ঘুরে এসে প্রকাশ্যেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বস্তিকর নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে বাংলাদেশ এরই মধ্যে সব শর্তই পূরণ করেছে। কিন্তু তাতে করে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট। 'সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন' এর দাবি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দিনের। কিন্তু তা হয়নি। এখন এলো সিনেটর মেনেন্দেজের হুমকি। যদি সত্যি সত্যিই সিনেটে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নিয়ে কোনো 'সিদ্ধান্ত' হয়, তা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বাজে সিগনাল পেঁৗছে দেবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির আলোকে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা গুরুত্ব দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়। যেহেতু এ অঞ্চলে ভারত একটি শক্তি, সেহেতু ভারতকে সঙ্গে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে মার্কিন নীতি-নির্ধারক, বিশেষ করে সামরিক নীতি-নির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের আগ্রহটা আরও বেড়েছে। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র একটি অক্ষ গড়ে উঠেছে। একদিকে চলতি ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে সেখানে যে 'শূন্যতার' সৃষ্টি হবে, মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা মনে করেন সেই 'শূন্যতা' পূরণ হতে পারে ভারতকে দিয়ে, যা চূড়ান্ত বিচারে তার স্বার্থকে রক্ষা করবে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত, যার পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার। ভারত সেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করছে। প্রচুর হাইওয়ে তৈরি করছে ভারত। এখানে সীমান্তবর্তী পাকিস্তান বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। আর ভারতের এ বিনিয়োগ সম্ভব হয়েছে মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের সম্মতি দেয়ার পরই। ধারণা করছি, ২০১৪ সালে মার্কিন বাহিনী সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হলে ভারতের তথাকথিত একটি 'শান্তিরক্ষী' বাহিনী সেখানে অবস্থান নেবে। অথবা ন্যাটোর একটি এশীয় সংস্করণ দেখতে পাব আমরা ওই সময়, যেখানে ভারতের একটি অংশগ্রহণ থাকবে। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো যখন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এ বাহিনী শুধু ইউরোপেই নিয়োজিত থাকবে। ন্যাটোর উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে 'ইউরোপের গণতন্ত্র'কে রক্ষা করা। ন্যাটোর সেই ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। প্রথমবারের মতো আফগান যুদ্ধে ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। যেহেতু ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্ররা আর আফগানিস্তানে 'ঝুঁকি' নিতে চাচ্ছে না, সেহেতু এ অঞ্চলকে ঘিরে ন্যাটোর এশীয় সংস্করণ (সেটা ভিন্ন নামেও হতে পারে) হবে এবং ভারত তাতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এ 'প্রক্রিয়ায়' বাংলাদেশও জড়িত হবে। মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের সুবিধা এখানেই যে, বাংলাদেশ সরকার 'ভারতের এ ভূমিকাকে', যা যুক্তরাষ্ট্র চাইছে সমর্থন করছে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে আরও দেখা যাবে, সম্প্রতি ভারত পারমাণবিক অস্ত্র বহনযোগ্য যে মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র (অগি্ন-৫) সাফল্যের সঙ্গে উৎক্ষেপণ করেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে যে নীতি গ্রহণ করেছে, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে তার সেই নীতি পরস্পরবিরোধী। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার মিত্র দেশগুলো ব্যবহার করছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে এ কাজটি করছে না। বরং ভারতকে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে এ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে পারমাণবিক চুক্তি রয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অত্যাধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই_ আর তা হচ্ছে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। একজন ডেমোক্রেট বারাক ওবামা হোয়াইট হাউসে ক্ষমতাসীন হয়েও দু'দেশের মধ্যকার সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। এমনকি নয়া চীনা নেতা শি জিন পিংয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরের পরও কোনো কোনো ইস্যুতে দু'দেশের মতপার্থক্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অতি সাম্প্রতিক ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে ছয়টি জাহাজ মোতায়েন করবে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। চীনের ওপর পরোক্ষ চাপ প্রয়োগ করা। চীন যাতে নৌশক্তিতে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, যুক্তরাষ্ট্র সেটাই চায়। আর এটাকে সামনে রেখেই যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সামরিক সখ্য গড়ে তুলছে। চীন এরই মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। এটাকে বিবেচনায় নিয়েই গড়ে উঠছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, যে অক্ষে বাংলাদেশও একটি অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এ স্ট্র্যাটেজি কিংবা শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে গড়ে ওঠা 'Containtment theory'র কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এ নীতি অবলম্বন করেছিল। এ কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। বাংলাদেশের সীমান্তে রয়েছে মিয়ানমার, যে দেশটির সঙ্গে চীনের কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। চীনের সীমান্তবর্তী দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে। সুচি এখন সংসদ সদস্য। অনেক পশ্চিমা দেশ এখন মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জেনারেল সেইন এখন তার সরকারকে একটি 'বেসামরিক অবয়ব' দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বাংলাদেশ ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে। এমনকি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৩ সালের পুরোটা সময়, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিলেন মারিয়া ওটেরো (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়-সম্পর্কিত ডেস্ক), রবার্ট ও'বেস্নক (সহকারী পররাষ্ট্র সচিব, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ডেস্ক), ভেন্ডি শেরম্যান (আন্ডার সেক্রেটারি, রাজনৈতিক বিষয়াদি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)। ১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তা শীর্ষক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব (রাজনৈতিক বিষয়াদি) টম কেলি। অত্যন্ত গোপনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিংবা কী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা সংবাদপত্রে জানানো হয়নি। নিরাপত্তা বিষয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু'দেশ আলোচনা করল, কিন্তু জাতি তা জানল না। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের কোনো মন্তব্যও আমার চোখে পড়েনি। তবে বাংলাদেশে মার্কিন সেনা মোতায়েনের একটি সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে! অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২ মার্চ (২০১৩) সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) কমান্ডার এডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের 'বিশেষ বাহিনী' মোতায়েন রয়েছে। এটা নিয়ে বাংলাদেশে গুঞ্জনের সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মজিনা এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কিছু সেনা রয়েছে, যারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্য আসে, আবার চলেও যায়। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, 'তথাকথিত সন্ত্রাসীদের মোকাবিলার' জন্য(?) ভিন্ন নামে ও ভিন্ন পরিচয়ে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর লোকজন বাংলাদেশে রয়েছে। এর একটা আইনি কাঠামো দেয়ার জন্যই ওই নিরাপত্তা শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও স্বীকার করে না যে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উৎকণ্ঠা কম। যুক্তরাষ্ট্র যা চায়, তা হচ্ছে গণতন্ত্র এখানে শক্তিশালী হোক। একটি মুসলমান অধ্যুষিত দেশেও যে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে, বাংলাদেশ তার প্রমাণ রেখেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের যে মূল কথা, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ, তা হয়নি। দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে। কিন্তু ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। তাই তোফায়েল আহমেদ যখন জিএসপি সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা করেন, তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আবারও বলেন, গণতান্ত্রিক সমঝোতার জন্য সংলাপের কথা। এটা অনেকটা এখন স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে দ্রুত একাদশ সংসদের নির্বাচন করা, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। কিন্তু একাদশ সংসদ নিয়ে সরকারি মহলে কোনো আলোচনা নেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না থাকলে তা মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধাটি প্রয়োজন। আর মার্কিন আস্থা ফিরে পেতে হলে বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই; কিন্তু সংলাপের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন; কিন্তু তারা মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের কতটুকু আশ্বস্ত করতে পেরেছিলেন, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে নীতি-নির্ধারকরা যে মার্কিনি ভূমিকায় খুশি নন, তা তাদের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। বাণিজ্যমন্ত্রী স্বয়ং এ উষ্মা প্রকাশ করেছেন। অর্থমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন, দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। পদ্মা সেতুর 'কাহিনী' আমাদের সবার জানা। বিদেশে আমাদের যে 'ইমেজ' সঙ্কট রয়েছে, তা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয় না। ঢাকায় ফিরে এসে ২৬ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের বিরোধিতা করে আসছে। (যুগান্তর, ২৭ এপ্রিল)। রাজনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যে ভালো নয়, তা স্পষ্ট করেই তিনি আমাদের জানিয়েছেন ওই সংবাদ সম্মেলনে। অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য, কিংবা সিনেটর মেনেন্দেজের "হুমকি'র আগেও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি" নিয়ে মূল্যায়নপত্র, যেখানে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। তাই বিষয়টি উদ্বেগের। যদি আগামীতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়, তা আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে। কেননা, বৈদেশিক বাণিজ্যের একটা বড় অংশ আসে এ তৈরি পোশাক থেকে। সুতরাং সরকার বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেবে_ এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। Daily ALOKITO BANGLADESH 04.05.14

0 comments:

Post a Comment