রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

উন্নয়নশীল বিশ্বের 'পপুলিজম' আর মোদির বিজয়

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি ২৬ মে শপথ নেবেন। নরেন্দ্র মোদির এই বিজয়কে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? শুধু 'হিন্দুত্ববাদ' কার্ডকে ব্যবহার করে কি তিনি বিজয়ী হয়েছেন? আমরা যদি খুব সরলরেখায় তার এই বিজয়কে চিহ্নিত করি, তাহলে ভুল করব। আসলে নরেন্দ্র মোদি ভারতে এক ধরনের 'পপুলিজম'-এর জন্ম দিয়েছেন। এই 'পপুলিজম' বা সাধারণ মানুষনির্ভর ও সাধারণ মানুষের জন্য যে রাজনীতি, এই রাজনীতি উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা জামাল আবদুল নাসের। গান্ধী কোনোদিন ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি। নিজে উচ্চশিক্ষিত হয়েও সাধারণ মানুষের মতো থেকে গেছেন। তাদের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদিকে মেলানো বোধহয় ঠিক হবে না। কিন্তু মোদির সাফল্য এক জায়গায়_ রাজনীতিতে সোনার চামচ মুখে নিয়ে তিনি আসেননি। অতি সাধারণ ঘরের মানুষ তিনি। বাবার সঙ্গে রেলস্টেশনে কিশোর বয়সে চা বিক্রি করা মোদি পরবর্তীকালে নিজের অধ্যবসায় আর দৃঢ়তার গুণে মাস্টার্স করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। এক সময় তার মা, যিনি এখনও জীবিত আছেন, পাশের বাড়ির বাসন-কোসন পরিষ্কার করে সংসারে সাহায্য করেছেন। এসব তথ্য তিনি লুকিয়ে রাখেননি। সাধারণ মানুষ হয়ে বড় হওয়া একজন নরেন্দ্র মোদি জানেন ভারতের মানুষের সমস্যা কোথায়। এমনকি তার আগে যারা বিজেপির নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, বিশেষ করে বাজপেয়ি কিংবা আদভানি, কেউই নরেন্দ্র মোদির মতো দারিদ্র্যকে ধারণ করে বেড়ে ওঠেননি। মোদি তাদের থেকে ব্যতিক্রম। নিঃসন্দেহে তিনি বিতর্কিত, অভিযুক্ত এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। কিন্তু ভারতের মানুষ এসব বিবেচনায় নেয়নি। বিবেচনায় নিয়েছে তার দৃঢ়তা, নেতৃত্বের ধরন, উন্নয়নের ধারণা এবং নতুন এক ভারতবর্ষ উপহার দেওয়ার তার চিন্তা-চেতনা। নির্বাচনী প্রচারণায় ৩ লাখ কিলোমিটার ভ্রমণ করে তিনি যে রেকর্ড করলেন, তা সমসাময়িক ভারতের ইতিহাসে বিরল। গান্ধী পরিবারকে চ্যালেঞ্জ করা অত সহজ ছিল না। যদিও করপোরেট হাউসগুলোর প্রচারণায় মোদি যেখানে ছিলেন উজ্জ্বল, সেখানে রাহুল গান্ধী ছিলেন ম্লান। কিন্তু মোদির 'পপুলিজম'-এর কাছে হেরে গেলেন রাহুল গান্ধী। এই ব্যর্থতা তার সব সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিল। দাদির মতো (ইন্দিরা গান্ধী) ১৯৭৭ সালে ক্ষমতা হারিয়ে ১৯৮০ সালে ফিরে আসা_ বিষয়টি তার জন্য খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না এখন। বাংলাদেশের জন্য একটা বড় শঙ্কার কারণ হচ্ছে তার বক্তব্য। ভারতে বাংলা ভাষাভাষীদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বাংলাদেশে 'পুশব্যাক' করা খোদ পশ্চিম বাংলাতেই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যেখানে আস্থাহীনতা রয়েছে সেখানে কুলদীপ নায়ারের মতো ব্যক্তিত্ব ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়ায় 'অভিন্ন বাজার' চালুর কথা বলেছেন। কিন্তু 'সাফটা' কার্যকর হয়নি। সার্কের অনুন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা, তা বাংলাদেশ ভারতে পায় না। ট্যারিফ আর প্যারা ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। অথচ চাহিদা আছে প্রচুর। এখন 'অভিন্ন বাজার' বা দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন হলে বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় পণ্যের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রতিযোগিতায় আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দাঁড়াতে পারব না। ঢাকার কোনো কোনো বিশ্লেষক দু'দেশের সম্পর্ককে 'শর্ট টার্ম', 'লং টার্ম' ও 'মিডিয়াম টার্ম'-এ ভাগ করার কথা বলেছেন! অথচ তারা ভুলে গেছেন সম্পর্কের ক্ষেত্রে 'সীমিত' বা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছু নেই। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমাদের অবস্থান স্থায়ী। এখানে মধ্যবর্তী কোনো সমাধান নেই। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রসঙ্গটি এনেছে। অথচ ভারতীয় গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ (জনান্তিকে ১০ লাখ) ভারতীয় অবৈধভাবে কাজ করেন (গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, আইটি সেক্টরে)। তারা বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা পাঠান, তাও অবৈধভাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা (১১১টি ভারতীয় যা বাংলাদেশে, ৫১টি বাংলাদেশি যা ভারতে) যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং ভারতীয় ক্যাবিনেটে হস্তান্তর প্রক্রিয়া অনুমোদিত হলেও শুধু বিজেপির বিরোধিতার কারণে তা ভারতীয় সংবিধানের অংশ হতে পারেনি। এই 'মানবাধিকার লঙ্ঘনে'র বিষয়টিও নির্বাচনী প্রচারণায় উচ্চারিত হয়নি। উল্লেখ্য, ভারত বর্তমানে জাপানকে হটিয়ে দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি (২০১১)। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ভারত দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। তখন মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলার (বর্তমানে ৯৪০ ডলার)। বিশ্ব অর্থনীতিতে তখন ভারত অবদান রাখবে শতকরা ১৭ ভাগ। এ থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। এ কথাটাও আমরা যেন ভুলে না যাই। ভারতে দারিদ্র্য একটা প্রধান সমস্যা। ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৭.০৫ ভাগ অথচ ২০০৪ সালে ছিল ২৭.৫০ ভাগ। অর্থাৎ দারিদ্র্য বেড়েছে। সুতরাং বাংলাদেশিদের ওই দেশে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না কাজের জন্য।

তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি বহুল আলোচিত। ফারাক্কা নিয়েও পুনঃআলোচনার সময় এসেছে। মোদি ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে তার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। টিপাইমুখ ও ফুলেরতল ব্যারাজ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কোনো একটি ক্ষেত্রেও আমরা পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারিনি। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। সেই আশ্বাস আশ্বাসই থেকে গেছে। বাস্তবতায় আমরা দেখেছি ভিন্ন জিনিস। সুতরাং দিলি্লতে একটি বিজেপি সরকার এই নীতিতে পরিবর্তন আনবে, এটা মনে হয় না।
নিঃসন্দেহে নির্বাচন-পরবর্তী ভারতীয় সরকারের দিকে দৃষ্টি থাকবে আমাদের। মোদি সরকার গঠন করবেন। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী হবে? মোদি কি তাদের আস্থায় নিতে পারবেন? ভোল পাল্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ প্যাকেজের প্রস্তাব দিয়েছেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং) কিংবা জয়ললিতা যে মোদিকে সমর্থন করবেন না_ এটাও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তাই দু'দেশের বিশ্লেষকরা যখন বলেন, 'পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক জোরদার করা যেতে পারে', 'তিস্তা সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত', 'রাজনৈতিক অবিশ্বাস রয়েছে', 'নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে ভারতকে', তখন এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়, এসব বক্তব্য কাগজ-কলমেই থেকে যাবে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা আমাদের সব সময় আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই। মনমোহন সিংয়ের মতো একজন প্রধানমন্ত্রী যখন কথা দিয়ে যান 'কোনো সীমান্ত হত্যা হবে না', সে কথার প্রতিও সম্মান দেখায়নি ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা চাইলেও(?) ভারতীয় আমলারা বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেন না। তারা বাংলাদেশ থেকে কীভাবে সুবিধা আদায় করে নেওয়া যায়, সেদিকেই দৃষ্টি দেন বেশি। অথচ ভারতীয় উন্নয়ন থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। আমরাও হতে পারি ভারতের উন্নয়নের অংশীদার। কিন্তু ভারতের নীতিতে, মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে দু'দেশের মাঝে সম্পর্কের যে তিক্ততা তা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। এটা সত্য, ভারতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দের অনেকের ব্যক্তিগত সখ্য রয়েছে। এই সখ্য সম্পর্ক উন্নয়নে অতীতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে মোদির সঙ্গে বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দের পরিচয় তেমন একটা নেই। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির নেতৃবৃন্দ অতীতে বিজেপির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটা 'চ্যানেল ওপেন' করেছেন, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে নিঃসন্দেহে বীণা সিক্রি, যিনি কিছুদিন আগ পর্যন্ত ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন, তিনি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। বীণা সিক্রি মোদির পররাষ্ট্র উপদেষ্টাদের একজন। মোদির অগ্রাধিকারের তালিকায় বাংলাদেশ না থাকারই কথা। তিনি এখন গুরুত্ব দেবেন চীন ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্ককে। কেননা উন্নয়নের যে টার্গেট তিনি নির্ধারণ করেছেন, সেখানে তার বিনিয়োগ দরকার। আর চীন ও জাপান থেকেই তার এই বিনিয়োগ আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি গুরুত্ব দেবেন কম। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি এখন ৩১ বিলিয়ন ডলার। এটা কমানোর উদ্যোগ নেবেন তিনি। এটা করতে গিয়ে নয়া অর্থনৈতিক জোট বিসিআইএমকে (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) গুরুত্ব দেবেন তিনি, যা কি-না ভারতকে আশিয়ানের সদস্যপদ পেতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে 'ব্রিকস'কে (ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা) শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেবে ভারত। তাই মোদির পররাষ্ট্র নীতিতে আপাতত বাংলাদেশ খুব একটা গুরুত্ব পাবে বলে মনে হয় না। মোদি অর্থনীতিকে গুরুত্ব দেবেন। উন্নয়নের ব্যাপারে ব্যাপক কর্মসূচি নেবেন। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিরাজমান সমস্যাগুলো 'ডিপ ফ্রিজে' চলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
Daily SAMOKAL
25.05.14

0 comments:

Post a Comment