রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায় বারবার

আস্থার জায়গাটা বারবার নষ্ট হয়ে যায়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দেশে ও বিদেশে হাজারটা প্রশ্ন থাকলেও এক সময় মনে করা হতো সরকার যেহেতু 'নিয়ম রক্ষার্থে' এ নির্বাচন আয়োজন করেছিল সেহেতু সরকার অতিদ্রুত একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেবে। কিন্তু ছ'মাস পার হয়ে যাওয়ার পর সরকারপ্রধান এবং অন্য নীতি-নির্ধারকদের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে সরকার ২০১৯ সালের আগে আর মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবছে না। শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো দায়িত্ব নেয়ার পর ইতোমধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ সফর করেছেন। জাপান, চীন ও ব্রিটেন। ধারণা করছি আগামী জানুয়ারিতে তিনি ভারত সফরে যাবেন। বলার অপেক্ষা রাখে না এই চারটি দেশই আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরের মধ্য দিয়ে সরকারপ্রধান চেষ্টা করছেন এক ধরনের 'লেজিটেম্যাসি' তৈরি করতে। তিনি পুরোপুরিভাবে এ ক্ষেত্রে সফল তা বলা যাবে না। সর্বশেষ ব্রিটেন সফর নিয়েও একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রিটেন সফরের পর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, 'ব্রিটেন মনে করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এখন অতীত'। কিন্তু পরে জানা গেল দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ব্রিটেন এ ধরনের কোনো মনোভাব দেখায়নি। বরং বলা হয়েছে, 'যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচন নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন।' যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নতুন করে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলেননি বটে, কিন্তু একটি 'মুক্ত সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার' পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজেও ২৬ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'যুক্তরাজ্য ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেনি' (যায়যায়দিন)। তিনি বিএনপির আন্দোলনকে মাঠেই প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে সঙ্কট নিরসনে আলোচনার আহ্বানে সাড়া না দিলে সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধের হুশিয়ারি দিয়েছেন দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। ফলে একটি সমঝোতার যে সম্ভাবনা ছিল তা দৃশ্যত এখন আর নেই। গণতন্ত্রে একটি নির্বাচিত সরকার যেমনি থাকে ঠিক তেমনি থাকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলও। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা অন্যতম একটি শর্ত। বাংলাদেশে এটি নেই। এই আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যায় না। বাংলাদেশে আমরা গণতন্ত্র চেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আর গড়ে না ওঠায় আমরা সবাই মিলে 'সকল দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ'-এর একটি আবহ তৈরি করতে পারলাম না। এখন দশম সংসদ নির্বাচন অতীত বটে, কিন্তু আমরা কীভাবে নির্বাচনকে মূল্যায়ন করব? ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এর মধ্যে ১২৭ জন আওয়ামী লীগের, ওয়ার্কার্স পার্টির ২ জন, জাসদের ৩ জন, জাতীয় পার্টির ২০ জন, জেপির ১ জন। ১৪৭ আসনে যেখানে তথাকথিত নির্বাচন হয়েছে, সেখানে আরেক জায়গায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন 'বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের' প্রার্থীরাই। ওইসব আসনে ভোটার ছিল ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। প্রার্থী ছিলেন ৩৯০ জন। মোট ১৮ হাজার ২০৮টি, ভোট কেন্দ্রের সবকটিতে সুষ্ঠু ভোটও হয়নি। ভোটারের উপস্থিতির হার সম্পর্কে ইসির ব্যাখ্যা ৪০ ভাগ। তবে অনেকেই তা মানতে নারাজ। আওয়ামী লীগ এখন নতুন করে 'দ্বিতীয় আরেকটি মহাজোট সরকার' গঠন করেছে এবং প্রয়োজনে ২৩৩টি আসন নিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিশ্চিত করে সংবিধানে আরো ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। নবম সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল আওয়ামী লীগ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আবারো সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে ইঙ্গিত দিয়েছেন। সংসদীয় রাজনীতির একটা বড় সৌন্দর্য হচ্ছে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা। কিন্তু দশম সংসদ নিয়ে ইতোমধ্যে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এই সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির এই সিদ্ধান্ত দলকে বিতর্কিত করেছে। কেননা জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশীদার। এর আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন একাধিক। ওই নির্বাচনে ২৭টি আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী ছিল না। ফলে জাতীয় পার্টিকে কেন্দ্র করে গুজবের ডালপালা বাড়বেই। তবে জাতীয় পার্টি ও এর নেতা এইচএম এরশাদ ইতোমধ্যে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। 'অসুস্থ' হয়ে গলফ খেলে তিনি 'চিকিৎসা নিয়েছিলেন' সিএমএইচএ। আর এই গলফ খেলাটা ছিল নাকি তার চিকিৎসার অংশ। আমাদের দুর্ভাগ্য ওবায়দুল কাদেরের মতো লোকের কাছ থেকেও আমাদের এ ধরনের কথা শুনতে হয়েছিল। ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য যখন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। বলতে দ্বিধা নেই অতীতে ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্য ও নেতৃত্বের গুণে নিজেকে একজন যোগ্য ও খাঁটি নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। যে কারণে দীর্ঘদিন তিনি মন্ত্রিসভায় না থাকলেও মহাজোট সরকারের শেষের দিকে তিনি মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। তিনি এখনো মন্ত্রী। যারা সংবাদপত্র নিয়মিত পাঠ করেন তারা দেখেছেন এই নির্বাচনকে ঘিরে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বাজে ধারণার জন্ম হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি রাশিয়া কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছিল, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রভাবশালী কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজার বলেছিল 'খুব দ্রুত একাদশ নির্বাচনের প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন 'ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের তালিকায় বাংলাদেশ'-এর নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিল। যে ১০টি দেশকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও আছে। কী দুর্ভাগ্য যেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষী পাঠাতে অনুরোধ করেন, সেই বাংলাদেশই কিনা এখন ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিণত হলো। যে যুক্তি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের গবেষকরা উল্লেখ করেছেন তা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। অনেকেই জানেন প্রভাবশালী এ সাময়িকীটি মার্কিন নীতি-নির্ধারণে প্রভাব খাটায়। নির্বাচন হয়ে গেল। কিন্তু 'সকল দলের অংশগ্রহণ' তাতে থাকল না। আমাদের দুঃখ এখানেই, আমাদের রাজনীতিবিদরা দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেননি। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। আস্থার সম্পর্কটা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। পশ্চিমা বিশ্বের যে উৎকণ্ঠা, সেই উৎকণ্ঠা ও উদ্যোগ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। কেননা বিএনপি বড় দল। দলটিকে আস্থায় না নিলে তা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে না। নির্বাচনে বিরোধী দল আসেনি। এর জন্য কে দায়ী, কে দায়ী নয়, সেই হিসাব নিয়ে আমরা যদি 'ব্যস্ত' থাকি তাহলে আমাদের এতদিনের অর্জন আরো বাধাগ্রস্ত হবে। ইতোমধ্যেই আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ আরো 'ক্ষতি' সহ্য করতে পারবে না। মনে রাখতে হবে অর্থনীতির চাকা যদি না চলে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতা না হলে এই অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা থেকেই যাবে। আর তা অর্থনীতিকে আঘাত করবে। যা আমাদের কারো জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। গত ২৪ জুলাই জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ২০১৪ সালের মানবোন্নয়ন সূচক প্রকাশ করেছে। বেশকিছু বছর ধরে ইউএনডিপি এ সূচক প্রকাশ করে আসছে। এতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সেক্টরে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়। এবার মোট ১৮৭ দেশের অগ্রগতি আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২ নাম্বারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। জাতিসংঘ 'দ্রুত পর্যায়ে চলা' যে ১৮ দেশের কথা উল্লেখ করেছিল বাংলাদেশ এর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ তার অবস্থান ধরে রেখেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ তার অবস্থানকে আরো উন্নত করেছে। গেলবার (২০১৩) বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৩। এবার একধাপ উন্নতি হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে তার মধ্যে রয়েছে গড় আয়ু বৃদ্ধি, সাক্ষরতা, শিক্ষা ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি। ইউএনডিপি নিজস্ব গবেষকদের দ্বারাই এই সূচক প্রণয়ন করে। এখানে বাংলাদেশ সরকারের কোনো ভূমিকা থাকে না। অর্থাৎ সূচক প্রণয়নে বাংলাদেশ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। Daily JAI JAI DIN 04.08.14

0 comments:

Post a Comment