রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মন্ত্রীর কথায় কতটুকু আস্থা রাখা যায়

হাসানুল হক ইনু জাসদের সভাপতি এবং বর্তমান সরকারের তথ্যমন্ত্রী। তার আমলেই প্রণীত হলো জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪। এই নীতিমালা শুধু সংবাদপত্র কর্মীরাই সমালোচনা করেননি, সুধী সমাজের একটা বড় অংশের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। বিএনপি এই নীতিমালার সমালোচনা করেছে। এর মধ্যে রাজনীতি আছে ধরে নিলেও সুধী সমাজের সমালোচনাকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? নীতিমালা বিতর্কিত হওয়ায় খুব সঙ্গত কারণেই আলোচনা এখন তথ্যমন্ত্রীকে ঘিরে। এই নীতিমালা প্রণয়নে তার ভূমিকা কি ছিল কিংবা তিনি কতটুকু প্রভাব খাঁটিয়েছিলেন, এর ব্যাখ্যা হয়তো আমরা কোনোদিনই পাব না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই নীতিমালার ভালো, মন্দ সবকিছুর জন্য তথ্যমন্ত্রী তার দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সম্প্রতি তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি।’ শুধু তাই নয় তিনি এমন কথাও বলেছেন যে, ‘সম্প্রচার মাধ্যমকে একটি গতিশীল ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য এই নীতিমালা করা হয়েছে। এটা গণমাধ্যম জগতে নতুন দিন উšে§াচনকারী পদক্ষেপ। বিকাশমান সম্প্রচার জগত গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হবে। বহুবাদ ও বৈচিত্র্য বজায় থাকবে।’ তথ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য সংবাদকর্মীদের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা সংবাদকর্মীদের বক্তব্যের মধ্যে থেকেই প্রমাণিত হয়েছে। সংবাদকর্মীদের একটা বড় অংশই মনে করেন সংবাদপত্র ও মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্যই এই নীতিমালা। মন্ত্রী সাহেব যুক্তি দেখিয়েছেন এটা কোনো আইন নয়। এই নীতিমালার ভিত্তিতেই আইন প্রণয়ন করা হবে। কিন্তু নীতিমালাটি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট একটা নির্দেশনা অর্থাৎ বলে দেয়া হচ্ছে মিডিয়ায় কোনটা যাওয়া উচিত, আর কোনটা যাওয়া উচিত নয়। নীতিমালার প্রতিটি লাইনে, অনুচ্ছেদে এক ধরনের নির্দেশনা আছে। মুক্ত তথ্য প্রবাহের যুগে রাষ্ট্র এই কাজটি করতে পারে না। এই নীতিমালা শুধু সংবিধানের সঙ্গেই সাংঘার্ষিক নয় বরং একই সঙ্গে তথ্য অধিকার আইনেরও বরখেলাপ। সাধারণত অতীতে আমরা দেখেছি দেশে যখন সামরিক আইন জারি হয়, তখন তথ্য মন্ত্রণালয় এ ধরনের নির্দেশনা দিয়ে থাকে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সরকার কেন এই ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন করবে? এটা তো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিপন্থী। কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে মানুষ এমনটা প্রত্যাশা করে না। ইতোমধ্যে নীতিমালা নিয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তা খুব আশার কথা নয়। যাদের জন্য এই নীতিমালা করা, তারাই যদি এই নীতিমালা প্রত্যাখান করেন, তাহলে এই নীতিমালার গ্রহণযোগ্যতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? সরকারের নীতি-নির্ধারকরা নিশ্চয়ই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন এবং নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে দ্বিতীয়তবার চিন্তা করবেন। নীতিমালা গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা কার্যকরী হয়েছে। ইতোমধ্যে এর প্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে। টক শোগুলো ‘নিয়ন্ত্রিত’ হয়ে গেছে এক রকম। সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত বেশ ক’জন শিক্ষক তথা বুদ্ধিজীবীকে ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়েছে বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। বেশ ক’জন অধ্যাপক রয়েছেন, যারা টিভি টক শোতে বেশ জনপ্রিয়, তাদের এখন আর টক শোতে দেখা যায় না। তারা নিজেরাই অভিযোগ করেছেন, তারা টিভিতে ‘নিষিদ্ধ’! যদিও আমি নিজে দু’একজন সঞ্চালককে ফোন করে জানতে চেয়েছি মূল বিষয়টি আসলে কী? তারা আমাকে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে এটা তো ঠিক টক শোগুলোতে সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতি এখন বেশি। এটা অনেকটা পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছে। একটা সিন্ডিকেট এই টক শোগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে যদি চলে, তাহলে টক শোগুলো অচিরেই তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে! আমি বেশ কিছু লেখাতে বলার চেষ্টা করেছি টক শোগুলো হচ্ছে গণতন্ত্র চর্চার বিকল্প মাধ্যম। যেহেতু সংসদ সঠিকভাবে কাজ করছে না। বিগত সংবাদগুলোতে বিরোধী সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণ এক রকম ছিলই না। বর্তমান সংসদ (দশম) যারা বিরোধী দলে আছেন, তাদের ভূমিকা নিয়ে স্বয়ং দলীয় প্রধানই যুক্তি তুলে ধরেছেন। সংসদে বর্তমানে কোনো জাতীয় ইস্যু আমি আলোচিত হতে দেখিনি। কোনো জাতীয় ইস্যু যদি আলোচনা না হয়, তাহলে জাতি দিকনির্দেশনা পাবে কীভাবে? তাই টক শোগুলো জনপ্রিয়। ওখানে বিশেষজ্ঞরাই আলোচনায় অংশ নেন। বিভিন্ন ইস্যুতে মতামত দেন। সরকারের নীতির সমালোচনা করার অর্থ সরকারের ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়া, যাতে সরকার সংশোধিত হতে পারে। এটা সরকারের জন্যই মঙ্গল। টক শোতে দেখেছি কিছু মানুষ রয়েছেন, যারা সরকারের সব সিদ্ধান্তেই হ্যাঁ বলেন। এমন কি কেউ কেউ সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছিল ওই কমিটিতেও ছিলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য তারা প্রেসক্লাবের গোলটেবিল আলোচনায় সোচ্চার থাকেন। অথচ কমিটিতে বসেই তারা মিডিয়ার স্বাধীনতাকে কণ্ঠরোধ করার সব ব্যবস্থা পাকা করলেন। এমনকি তিনজন ব্যক্তি ছিলেন, যারা বেসরকারি টিভি চালান। তারা কমিটিতে থেকে কী করলেন! একজন সম্পাদকও ছিলেন। ওই কমিটিতে থাকার সময় তার ভূমিকা কি ছিল? কেন তারা সবাই নীতিমালা প্রণয়নের সময় তাদের আপত্তির কথা জানালেন না? নিদেনপক্ষে তারা ‘জোট অব ডিসেন্ট’ দিতে পারতেন। তাহলে আজ তাদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু কমিটিতে থেকে সবাই নীতিমালা প্রণয়ন করলেন, কোনো আপত্তি জানালেন না। অথচ আজ মিডিয়াতে তারা উল্টো সুরে কথা বলছেন। তাই আজ যখন মন্ত্রী মহোদয় নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি মিথ্যা বলেন না। আমি এটা বিশ্বাস করি কমিটির সদস্যরা যদি ন্যূনতম ভূমিকা পালন করতেন, তাহলে নীতিমালাটি এভাবে প্রণীত হতো না। তবে এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে সশস্ত্রবাহিনীকে মিডিয়ায় ‘ভূমিদস্যু’ বলা শুধু অপরাধই নয় বরং তা রাষ্ট্রদ্রোহেও শামিল। আমাদের মাঝে অনেক অবিবেচক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা এ ধরনের কথাবার্তা বলে কোনো কোনো মহলের বাহবা পেতে চান। তাদের জন্যই এই নীতিমালা। এটা সমর্থনযোগ্য। তবে নীতিমালায় এ সংক্রান্ত অপরাধে কি শাস্তি হবে, তা বলা হয়নি, তা বলা হবে আইনে। আমার ধারণা সরকার সব মতামতকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়েই একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করবে, যারা আইনের খসড়াটি তৈরি করবেন। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা কখনো কোনো ভালো কাজ হতে পারে না। সংবিধান সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গ্যারান্টার। ইতোমধ্যে সংবিধানে ১৫টি সংশোধনী আনা হয়েছে এবং আরো একটি সংশোধনী আনার প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু সংবিধানের ৩৯টি অনুচ্ছেদটি যেভাবে ছিল, সেভাবেই রয়ে গেছে। ৩৯নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ এই অনুচ্ছেদের ৩৯(২) ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা দুটি আরো স্পষ্ট। ‘ক’তে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের অধিকারের কথা এবং ‘খ’তে রয়েছে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ অর্থাৎ সংবিধানের পুরো ৩৯নং ধারাটিতে একজন সংবাদকর্মীকে যেমনি অধিকার দিয়েছে তার মতপ্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এই ধারাটি একটি রক্ষা কবচ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝে মধ্যে আমরা এই ৩৯নং ধারাটি লঙ্ঘিত হতে দেখি। আদালত অবমাননার অভিযোগে আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যখন বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেদিন এ দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীরা আদালতে ৩৯নং ধারার কথা বারবার উল্লেখ করেছিলেন। তারা বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, ৩৯নং ধারাবলেই একজন সম্পাদক তার মতপ্রকাশের অধিকার রাখেন। তখন সম্প্রচার নীতিমালার কোনো কোনো ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই এবং উচ্চ আদালত এর ফয়সালা করে দিতে পারেন। নতুবা বারবার এ প্রশ্ন উঠতেই থাকবে। যে জন্য সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, তার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। সাধারণত সেনাবাহিনী কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে নেতিবাচক কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয় না। বরং প্রশংসার সংবাদই থাকে বেশি। সেনাবাহিনী বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে, এ কথা হরহামেশাই আমরা টক শোতে বলি। তবে হ্যাঁ, প্রতিরক্ষা বা পুলিশ বাহিনীর দু’একজন সদস্যের অপকর্ম যখন সংবাদ হয় এবং এতে যখন স্থানীয় অসন্তোষ বেড়ে যায় (নারায়ণগঞ্জের ঘটনা), তখন তা আলোচনারই দাবি রাখে। মিডিয়া তখন সে কাজটিই করে। অতীতে করেছেও। মিডিয়া সমাজের প্রতি, জাতির প্রতি তার দায়বদ্ধতা এড়াতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আইন করে মিডিয়ায় এসব সংবাদ প্রকাশ ও সম্প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, তাহলে তা প্রকারান্তরে সমাজে কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। তবে খুব সঙ্গতকারণেই মিডিয়ায় বিশেষ করে টক শোতে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া কাম্য নয়। বেসরকারি টিভির কর্মকর্তারা জানেন, কারা অহেতুক সরকারের গুণগান গেয়ে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেন। এদের ‘বয়কট’ করাই মঙ্গল। না হলে সরকার সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারবে না। টক শোগুলোতে শুধু সরকারের প্রশংসা বা সমালোচনাই হবে এটা কাম্য হতে পারে না। টক শো হচ্ছে একটা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ভালো কাজ, তথা জনমুখী নীতি গ্রহণ করার জন্য সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা হবে। শুধু সমালোচনাই যেমন কাম্য নয়, ঠিক তেমনি শুধু প্রশংসাও কাম্য নয়। একটা সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আইন প্রণয়ন করার আগে সরকার এটি কার্যকর করবে না, এমনটাই সবাই প্রত্যাশা করে। এখন সব সমালোচনাকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে সরকার একটি আইন করুক। অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করুক। একটি ‘স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন’ গঠন করুক। তবে এটা বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন যে, শুধু মুখ চেনা কিছু লোককে নিয়ে যদি এই কমিশনটি গঠিত হয়, তাহলে এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। মন্ত্রী বাহাদুর বলছেন, ‘মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে না।’ বরং মিডিয়াকে নাকি তার ভাষায় ‘তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রভাবের’ বাইরে রাখা হবে। মন্ত্রীর কথা সত্য হোক। যদি তার কথার সত্যতা তিনি প্রমাণ করতে পারেন তাহলে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞ হাসানুল হক ইনু দেশের একজন যোগ্য রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন। আমরা সেই দিনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। Daily MANOBKONTHO 19.08.14

0 comments:

Post a Comment