রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র কি আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে?

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি সামরিক অভিযান এবং গণহত্যা ঠেকাতে জাতিসংঘ তথা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার পর যে প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে তা হচ্ছে, আদৌ কি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে কিংবা ইসরাইল কি তার সীমান্তে এ রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব মেনে নেবে? যারা এ অঞ্চলের রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সঙ্গত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি মূলত আজকের নয়। এমনকি পশ্চিমা বিশ্ব নীতিগতভাবে এ দাবিটি মেনে নিলেও আজও এ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অনেকে স্মরণ করতে পারেন, একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অতীতে আল ফাতাহ এক ধরনের গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ৭০ দশকের প্রথম দিকে বিমান ছিনতাই করে তা উড়িয়ে দিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল আল ফাতাহ। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধা লায়লা খালেদের কথা, যিনি বিমান ছিনতাই করে শুধু ইতিহাসই রচনা করেননি, বরং আজও ফিলিস্তিনি তরুণদের কাছে তিনি এক সংগ্রামের আদর্শ। তারপরও অনেক সময় পার হয়ে গেছে। সেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধু শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পিএলও ১৯৮৮ সালে আলজিয়ার্স সম্মেলনে সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ করার কথা ঘোষণা করেছিল। এরপর থেকে পিএলও আর বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব পিএলওর এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে নেয়নি। শুধু তথাকথিত একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে ফিলিস্তিনি জনগণকে সান্ত্বনা দিয়ে আসছে। সুতরাং আজ যখন ইসরাইলি গোলায় শত শত শিশু ও নারী মারা যাচ্ছে, তখন প্রশ্নটা উঠবেই যে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র কি আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে? ফিলিস্তিন নিয়ে সমস্যা মূলত একটিই আর তা হচ্ছে, একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। পশ্চিমা বিশ্ব বার বার এ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক শান্তি আলোচনা সেই ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু হলেও আজও এ শান্তি আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৩ সালে ওয়াশিংটনে ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালে ওয়াশিংটনের অদূরে 'উই রিভার' চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইসরাইলের ব্যাপারে পিএলও ও আরব রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন সময় কিছু কিছু নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করলেও ইসরাইল কখনোই তার একগুঁয়ে ও আগ্রাসী মনোভাব পরিত্যাগ করেনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ ও ৩০৮ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী ইসরাইলের অধিকৃত আরব এলাকা ফিরিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু ইসরাইল নিরাপত্তা পরিষদের সেই সিদ্ধান্ত কখনোই কার্যকর করেনি। বরং একের পর এক বসতি স্থাপন করে উত্তেজনা জিইয়ে রেখেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, নিরাপত্তা পরিষদও সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে কখনও উদ্যোগী হয়নি। অথচ ১৯৯১ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগ বহুজাতিক সেনাবাহিনী গঠন করে সেখানে সেনা পাঠানো হয়েছিল ও ইরাককে বাধ্য করা হয়েছিল সেই সিদ্ধান্ত মানতে। সুতরাং আজ যখন গাজায় নিরীহ শিশুদের ইসরাইল হত্যা করছে, তখন এ কর্মকান্ড বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি জাতিসংঘ। তখনই এসে যায় মূল প্রশ্নটি- তা হচ্ছে, জাতিসংঘ মূলত পশ্চিমাদের স্বার্থেই পরিচালিত হয়! যুদ্ধ, মানবতা তাদের কাছে বড় কথা নয়। যখন গাজা একটি বিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে, যখন ১০০-এর অধিক শিশুকে হত্যা করা হয়েছে গাজায়- এ বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি জাতিসংঘের কাছে। বরং নিরাপত্তা পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইউক্রেনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায়। শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান নাভিপিল্লাই ইসরাইলের এ হামলাকে যুদ্ধাপরাধ পর্যায়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন বটে; কিন্তু তা কোনো পরিবর্তনের কথা বলে না। যারা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন 'জিওনবাদের' বা ইহুদিবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা থিওডর হারজেল(Theodor Herzl) ১৯০৪ সালে একটি বৃহত্তর ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই রাষ্ট্রটির সীমানা হবে একদিকে নীলনদ, অন্যদিকে ফোরাত নদী। এ লক্ষ্যেই ১৯৮২ সালে ইনন পরিকল্পনা (Oded Yinon)প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ পরিকল্পনায় গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে ধর্মীয় ও এথনিকভাবে ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হবে। ফলে আরব রাষ্ট্রগুলো দুর্বল হবে এবং তা ইসরাইলি রাষ্ট্রকে কোনো নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করবে না। আজকে ইরাকের দিকে তাকালে কিন্তু সেই 'ইনন ফর্মুলা'র বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। ইরাক আজ বাহ্যত তিন ভাগে বিভক্তির পথে-কুর্দি অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কুর্দিস্তান, শিয়া ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে একটি শিয়া রাষ্ট্র এবং সুন্নিরা আলাদা হয়ে একটি আলাদা রাষ্ট্র। এ পরিকল্পনা এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কুর্দিরা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য একটি গণভোটের কথা বলছে। অনেকে স্মরণ করতে পারেন, জো বাইডেন (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট) ২০০৬ সালের ১ মে পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতে (তখন তিনি একজন সিনেটর) এক ভাষণে ইরাককে ভেঙে তিনটি রাষ্ট্র করার প্রস্তাব করেছিলেন। ২০০৭ সালে সিনেটে গৃহীত এক প্রস্তাবে (৭৫-২৩ ভোটে) সেই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল। কুর্দিরা সেই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিল। আজ যখন জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যান, তখন সঙ্গত কারণেই তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। বলা ভালো, জো বাইডেন নিজে একজন ইহুদি। ওবামার ইহুদিপ্রীতির খবরও ইতিহাসে আছে। তরুণ সিনেটর হিসেবে প্রয়াত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামায়ারের সঙ্গে দেখা, তার প্রশংসা করা ও চলতি জানুয়ারিতে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শেরনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান এবং নেতানিয়াহুর সঙ্গে দুই ঘণ্টা বৈঠক-এসবই ছিল ইসরাইলের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ। এখানে আরও একটি কথা বলা দরকার, ১৯৬০ সাল থেকেই কুর্দি নেতারা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে এবং সেখান থেকে সামরিক সাহায্য পেয়ে আসছে। চলতি জুন মাসে নেতানিয়াহু তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভাষণে স্বাধীন কুর্দিস্তানের পক্ষে কথা বলেছেন। ইতিহাসের কী অনিবার্য পরিণতি! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হিটলারের দক্ষিণহস্ত বলে পরিচিত আইকম্যানের ফর্মুলা অনুযায়ী হিটলার ইহুদিদের বন্দি শিবিরে একত্রিত রাখা ও তাদের উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছিলেন। গ্যাস চেম্বারে ইহুদিদের হত্যা করা হয়েছিল। আজ এত বছর পর সেই ইহুদি নেতৃত্ব একই পন্থা অবলম্বন করে ফিলিস্তিনিদের এক ধরনের বস্তি জীবনযাপনে বাধ্য করছে। ইতিহাস থেকে ইহুদি নেতৃত্ব কোনো শিক্ষাই নেয়নি। এখানে ইনন ফর্মুলা নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। ওডেড ইনন (Oded Yinon)  মূলত একজন কট্টর ইহুদি স্ট্র্যাটেজিস্ট। তিনি মূলত একজন গবেষক ও শিক্ষক। বলা যেতে পারে, থিওডর হারজেল যে স্বপ্ন এক সময় দেখতেন, তার বাস্তব রূপ দিতেই ইনন সদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন। আর তা বাস্তবে রূপ দিতে যাচ্ছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। ইনন হিব্রু ভাষায় একটি প্রবন্ধ লেখেন Kivunim নামে একটি কট্টরপন্থী ম্যাগাজিনে। আশির দশকের মাঝামাঝি ওই প্রবন্ধটি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে এভাবে- 'A Strategy for Israel in the Nineteen Eightees'। লেবাননকে ভেঙে পাঁচটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করা কিংবা সিরিয়াকে ভেঙে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করা- এসবই ছিল 'ইনন ফর্মুলা'র অন্তর্গত। ইসরাইলের কট্টরপন্থী নেতারা এ ফর্মুলা এখন ধারণ করেন। আজকে যদি আমরা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে, এ 'ইনন ফর্মুলা'ই এখন কার্যকর হচ্ছে। ইসরাইল মূলত ফাতাহ ও হামাসের ভেতরকার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাচ্ছে। মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট হলেও পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে হামাস। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের কাছে হামাস গ্রহণযোগ্য হয়নি। এমনকি খোদ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছেও হামাসের এ বিজয় নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধীন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে ওয়াশিংটন চুক্তি (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩) ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ওই শান্তি চুক্তির ফলে ইসরাইল অধিকৃত গাজা ও পশ্চিম তীরের জেরিকো শহরে সীমিত স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি অপর একটি চুক্তির বিনিময়ে হেবরন শহরে ফিলিস্তিনি শাসন সম্প্রসারিত হয়। ওয়াশিংটন চুক্তির পরপরই যে ফিলিস্তিনি স্বশাসিত এলাকার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়নি। তবে ১৯৯৬ সালে ফিলিস্তিনি স্বশাসিত এলাকার প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং আরাফাত প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৪ সালে আরাফাতের মৃত্যু ফিলিস্তিনি আন্দোলনের জন্য ছিল এক ছুরিকাঘাতের শামিল। জীবদ্দশায় আরাফাত 'একজন প্রেসিডেন্টের' সম্মান পেয়ে গেছেন; কিন্তু স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তিনি দেখে যেতে পারেননি। অভিযোগ আছে, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা 'মোসাদ' বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করেছিল। এরপর ২০০৫ সালে মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন। কিন্তু হামাসের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোনো পর্যায়েই ভালো ছিল না এবং দেখা গেল, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মাঝে দুই কর্তৃপক্ষের জন্ম হয়েছে- একদিকে ফাতাহর নেতৃত্বে পশ্চিম তীরে একটি প্রশাসন, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাহমুদ আব্বাস, অন্যদিকে গাজায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হামাসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। এতে করে পুরো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দুর্বল হয়েছে। ইসরাইলের সুবিধা এখানেই। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে যদি বিভক্ত রাখা যায়, তাহলে এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তারের সুবিধা অনেক। তবে অতীতের সব হামলার চেয়ে এবারের ইসরাইলের আগ্রাসনের বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। খুব সহসাই ইসরাইলি এ আগ্রাসন বন্ধ হবে বলে মনে হয় না। ইসরাইলের স্ট্র্যাটেজি এখন স্পষ্ট-তারা হামাসের নেতৃত্বকে পুরোপুরিভাবে গাজা থেকে উচ্ছেদ করতে চায়। প্রয়োজনে তারা সেখানে বিকল্প একটি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বও প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগ নেবে। কিন্তু এতে করে কি গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে? ইসরাইলি নেতৃত্বকে হামাসের সঙ্গেই সমঝোতায় যেতে হবে। কেননা হামাসকে জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। জনগণ হামাসকেই চায়। সুতরাং ইসরাইলি নেতৃত্ব যদি হামাসকে উৎখাত করার উদ্যোগ নেয় এবং পশ্চিমা বিশ্ব যদি তাতে সায় দেয়, তাহলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা থেকে যাবে। কোনো দিনই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতি বলে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর আল ফাতাহর প্রভাব কমেছে। হামাসের প্রভাব বেড়েছে। ফলে হামাসকে সঙ্গে নিয়েই শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে ওই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। হামাস যে ১০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে, তাকে ভিত্তি করে আলোচনা শুরু হতে পারে। এ ১০ দফা মেনে নেয়া কঠিন কিছু নয়। একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা, ইসরাইলি কারাগারে আটক ফিলিস্তিনিদের মুক্তি, গাজার সমুদ্র ও বিমানবন্দর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে খুলে দেয়া ইত্যাদি প্রস্তাব খুব সহজেই মেনে নেয়া যায়; কিন্তু ইসরাইল এ কাজটি করবে না। জাতিসংঘ যেখানে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধে ব্যর্থ, সেখানে নাভিপিল্লাইয়ের বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়ে ইসরাইলি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা সবাই জানি, হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে লাইবেরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট চার্লস টেলারের বিচার হয়েছে। বসনিয়ার কসাই হিসেবে পরিচিত মিলোসেভিচেরও বিচার হয়েছে। এমনকি কেনিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টেরও বিচার শুরু হতে যাচ্ছে। কেনিয়ায় ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সংঘটিত গণহত্যার জন্য তারা অভিযুক্ত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি ওইসব গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার করতে পারে, তাহলে আজ 'ইসরাইলি কসাই' হিসেবে পরিচিত নেতানিয়াহুরও বিচার হওয়া প্রয়োজন। না হলে দ্বৈত ভূমিকার জন্য জাতিসংঘ তথা পশ্চিমা বিশ্ব বার বার অভিযুক্ত হবে। পশ্চিমা বিশ্ব এ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন 'দানব' ইসরাইলকে সৃষ্টি করেছিল। ভুলে গেলে চলবে না, এ 'দানব' এক সময় পশ্চিমা স্বার্থের উপরও আঘাত করতে পারে। সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বন্ধ চায়। এ যুদ্ধ অনেকটাই একতরফা হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ যুদ্ধে শত শত মানুষ মারা গেছে। শিশু হত্যার যে মহোৎসব আমরা দেখছি, দুঃখজনক হলেও সত্য, সদ্য শেষ হওয়া 'লন্ডন গার্ল সামিটে' বিশ্বের কন্যাসন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হলেও গাজার কন্যাসন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা কথাও বলা হলো না! এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি- পশ্চিমা বিশ্ব আসলে কী চায়? নাভিপিল্লাইয়ের বক্তব্য, কিংবা বান কি মুনের উদ্বেগ, এসব আসলে লোক দেখানো! ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্ব আদৌ আন্তরিক নয়। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। নেই কোনো সমাধান। জোর করে একটি জাতিকে বছরের পর বছর এক ধরনের বস্তি জীবনে বসবাস করতে বাধ্য করা, এ ২১ শতকে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আজ তাই সময় এসেছে বিশ্বের শুভবুদ্ধির মানুষদের জেগে ওঠার। সময় এসেছে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার। আল ফাতাহ মূল ধারার রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। আমার ধারণা, হামাসও আসবে। শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতার ও হামাসকে আস্থায় নেয়ার। এটা না নেয়া হলে উত্তেজনা থাকবেই। আর তাতে করে ইসরাইলের খুশি হওয়ারও কোনো কারণ থাকবে না। সুতরাং ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধ হওয়া, হামাসের ১০ দফা প্রস্তাবকে সামনে রেখে তাদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা এবং 'দুই রাষ্ট্র' (ফিলিস্তিন ও ইসরাইল) ফর্মুলাকে সামনে রেখে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ইসরাইলি নেতারা যত তাড়াতাড়ি এটি উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল। Daily ALOKITO BANGLADESH 05.08.14

0 comments:

Post a Comment