রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধান ও বিবিধ প্রসঙ্গ

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪ কার্যকর হওয়ার পর অনেক প্রশ্ন এখন নানা মহলে আলোচিত হচ্ছে। এক. এই নীতিমালা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক! দুই. এর মধ্য দিয়ে সরকার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়! তিন. এই নীতিমালার কী আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? চার. জনপ্রিয় টক শোগুলো বন্ধ হয়ে যাবে কি না? বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের অনেক প্রশ্ন এখন উঠেছে। তবে স্পষ্টতই জাতীয় রাজনীতির মতোই এ নীতিমালার প্রশ্নেও বিএনপি ও সরকার পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। সাংবাদিক সমাজে যে দ্বিধাবিভক্তি, সম্প্রচার নীতিমালার প্রশ্নেও এই বিভক্তি স্পষ্ট। অর্থাৎ সরকার সমর্থক সাংবাদিক সমাজ ও তাদের ইউনিয়ন এই সম্প্রচার নীতিমালাকে সমর্থন করেছে। আবার বিএনপি সমর্থিত সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতারা এর বিরোধিতা করেছেন। তবে সুধীসমাজের একটা বড় অংশ এই সম্প্রচার নীতিমালাকে সমর্থন করেনি। অনেক কারণের জন্য এই নীতিমালাকে সমর্থন করা যায় না। এবং আমি মনে করি সরকার একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিল। বিরোধী দলের জন্য এটা একটা সুযোগ তৈরি হলো। যাঁরা ওই নীতিমালাটা তৈরি করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই আমলা এবং একজন আমলার নেতৃত্বেই এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এটা কেন হবে? আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটি দল, তাদের রাজনীতির সমর্থক বুদ্ধিজীবী বা সিনিয়র সম্পাদকের তো কোনো অভাব নেই। তাদের নেতৃত্বে একটি কমিটি হলো না কেন? কিংবা একজন সিনিয়র দলীয় নেতা অথবা একজন সম্পাদক এই কমিটির সভাপতি হতে পারতেন। একজন মাত্র সম্পাদককে দেখলাম কমিটির সদস্য। তিনি একা কেন থাকবেন? বেসরকারি টিভির ছিলেন তিনজন প্রতিনিধি। কেন? মাত্র দুজন শিক্ষককে দেখলাম কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। এর মধ্যে একজন আবার মাত্র সহকারী অধ্যাপক। এত বড় একটি কাজ। সেখানে আরো বেশি সংখ্যায় বিশেষজ্ঞ রাখলে ভালো হতো এবং সেটিই যৌক্তিক ছিল। আমরা ভুলে যাই আমলারা সরকারের আদেশ পালন করবেন বিশ্বস্ত কর্মচারীদের মতো। তাঁরা কখনোই জাতীয় স্বার্থ দেখেন না। তাঁরা দেখেন নিজ স্বার্থ। তাঁরা মূলত 'হুকুমের দাস'। তাঁদের 'মেন্টাল মেক-আপ' এভাবেই তৈরি। ফলে একটি নীতিমালা তাঁরা তৈরি করে দিয়েছেন, কিন্তু এটা যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তা তাঁরা বিবেচনায় নেননি। বেসরকারি চ্যানেলের তিনজন প্রতিনিধি ছিলেন, যাঁরা সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত, তাঁদের করার কিছু ছিল বলেও মনে হয় না। একটি 'স্বাধীন কমিশন' গঠনের প্রস্তাব তাঁরা করেছেন বটে, তবে ওই কমিশনের মাধ্যমে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার প্রস্তাব করলে সেটা বরং ভালো হতো। তাঁরা প্রস্তাবিত নীতিমালার একটি কাঠামো বা ধারণাপত্র উপস্থাপন করতে পারতেন। তখন তাহলে ওই 'স্বাধীন কমিশনের' কাজটি কী হবে? কমিশনে কিছু লোকের চাকরি হবে। তাঁরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেবেন। এ ধরনের লোক পেতে সরকারের এই মুহূর্তে কোনো সমস্যা হবে না। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি থেকে শুরু করে সাবেক আমলা, সাবেক ভিসি কিংবা সিনিয়র অধ্যাপকদের অভাব এ দেশে নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের কেউ কেউ অবসরের পর যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'লাখ টাকার' চাকরি করেন, তখন তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন সরকারের আরো একটা 'ডাকের' জন্য! একটা অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর পেছনে সত্যতা আছে। সংবিধানের বেশ কয়েকটি ধারার সঙ্গে সম্প্রচার নীতিমালার কোনো কোনো ধারা অথবা মূল স্পিরিটের পরিপন্থী। আমাদের ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান মোট ১৫ বার সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু মূল সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদটি যেভাবে ছিল, তা রয়ে গেছে। সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে 'চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।' এই অনুচ্ছেদের ৩৯(২) 'ক' ও 'খ' ধারা দুটি আরো স্পষ্ট। 'ক'তে বলা হয়েছে, 'প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের' কথা এবং 'খ'তে রয়েছে 'সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হইল।' অর্থাৎ সংবিধানের পুরো ৩৯ নম্বর ধারাটিতে একজন সংবাদকর্মীকে যেমনি অধিকার দিয়েছে তার মত প্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এই ধারাটি একটি রক্ষাকবচ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝেমধ্যে এই ৩৯ নম্বর ধারাটি লঙ্ঘিত হয়। আদালত অবমাননার অভিযোগে আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যখন বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেদিন এ দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীরা আদালতে ৩৯ নম্বর ধারার কথা বারবার উল্লেখ করেছিলেন। বলার চেষ্টা করেছিলেন ৩৯ নম্বর ধারা বলেই একজন সম্পাদক তাঁর মত প্রকাশের অধিকার রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যখন জন্ম হয়, তখন এই সময়ের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এটা উপলব্ধি করেছিলেন বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে এই দেশটিতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা সংবিধানে ৩৯ নম্বর ধারাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। যদিও ৩৯ নম্বর ধারাটি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা কায়েমের মধ্য দিয়ে লঙ্ঘিত হয়েছিল। সেদিন দেশে চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ওই সিদ্ধান্তের জন্য বারবার সমালোচিত হয়েছে। আজ এত বছর পরও আওয়ামী লীগকে কথা শুনতে হয়। ২০১৪ সালে এসে আওয়ামী লীগ আরেকটি ভুল করল। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় যে ধরনের বাক্য, শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা আওয়ামী লীগকে আরো একবার বিতর্কিত করল। বিশেষ করে টক শোর ব্যাপারটি বেশ স্পর্শকাতর। এটা ঠিক টক শোতে অনেকে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। কেউ কেউ নিজেকে সবজান্তা হিসেবে উপস্থাপন করেন। বিষয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান না থাকলেও নিজেকে 'বিশেষজ্ঞ' হিসেবে পরিচয় দেন। উপস্থাপকদের কেউ কেউ (কোনো একটি বিশেষ চ্যানেলে) 'রাজনৈতিক এক্টিভিস্টের' ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কেউ কেউ আবার প্রতিপক্ষকে মারতে পর্যন্ত উদ্যত হন। এ ক্ষেত্রে একটি 'গাইড লাইন' পরোক্ষভাবে থাকতে পারে। গণমাধ্যমের জন্য প্রায় ৪৩টি আইনের বিধি রয়েছে। মিথ্যা, অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশনের অভিযোগে এসব আইনে পরিবর্তন কিংবা সংশোধনী এনে অভিযোগের বিচার করা সম্ভব। প্রেস কাউন্সিল বাহ্যত একটি কাগুজে সংগঠন। প্রেস কাউন্সিলকে আরো শক্তিশালী করে এর বিচারিক ক্ষমতা আরো বাড়ানো যায়। তা না করে টক শো বন্ধ অথবা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, দুজন জনপ্রিয় 'টকার'কে টক শোতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একজন নিজে অভিযোগ করেছেন। আমি নিজে টক শোতে নিয়মিত যাই। আমার ক্ষেত্রে এক ধরনের বিধিনিষেধের আশঙ্কা আমিও লক্ষ করছি। আমার এই আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হোক, এটিই প্রত্যাশা করব। দেশে প্রায় ২৬টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল রয়েছে, যার মালিকানার পুরোটাই সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে। ফলে সরকারের চ্যানেল নিয়ে 'ভয় পাওয়া' অমূলক; বরং তিন-তিনটি চ্যানেল বন্ধ করে সরকার অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে করে সরকার বিতর্কিত হয়েছে সন্দেহ নেই। কোনো সম্প্রচার নীতিমালার প্রয়োজন তখন কিন্তু হয়নি এগুলো বন্ধ করার জন্য। ফলে সরকারের কাছে 'অস্ত্র' তো ছিলই! শুধু শুধু সম্প্রচার নীতিমালা করে অনাহূত 'বিতর্ক' টেনে আনা হলো কেন? এখন প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ায় এই আইন কার্যকর হয়েছে। টক শোগুলোতে নিষেধাজ্ঞা যে জারি হয়েছে, তা তাদের অনুষ্ঠানমালা ও আমন্ত্রিত অতিথিদের দেখেই বোঝা যায়। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই চ্যানেলগুলো 'একেকটি বিটিভি'তে পরিণত হবে। আমলারা হয়তো সেটাই চান। খুশি রাখতে চান সরকারের নীতিনির্ধারকদের। কিন্তু একটি বড় রাজনৈতিক দল, তারা কেন আমলাদের কথায় চলবে? বস্তাপচা নাটক আর মারদাঙ্গা বাংলা সিনেমা মানুষ কী দেখে? গভীর রাত জেগে মানুষ টক শো কেন শোনে, এটা যদি একটি রাজনৈতিক দল না বোঝে, তার চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। তাই প্রজ্ঞাপন জারি হলেও সব কিছু শেষ হয়ে গেছে- এটা আমি মনে করি না। সরকার আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করা অবদি (অবশ্যই যোগ্য ও মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়ে) এই নীতিমালা কার্যকর করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে পারে। এতে সবারই মঙ্গল নিহিত Daily KALER KONTHO 17.08.14

0 comments:

Post a Comment