গাজায়
ইসরাইলি সামরিক আগ্রাসনের এক মাস পূর্ণ হল। ৮ জুলাই শুরু হওয়া এ সামরিক
আগ্রাসন তথা ‘অসম যুদ্ধে’ ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ১৯০০ ফিলিস্তিনি
নাগরিক, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ও শিশু রয়েছে। এ হামলায় এ
পর্যন্ত ৪০০ কোটি ডলার বা ৩০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ‘যুদ্ধ’
বেশকিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎকে একটা
প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছে। প্রথমত, এ যুদ্ধ প্রমাণ করেছে ইসরাইলি নেতারা
পশ্চিমতীর নিয়ন্ত্রণকারী আল ফাতাহ গ্র“পের সঙ্গে এক ধরনের সহাবস্থানে যেতে
রাজি থাকলেও গাজা নিয়ন্ত্রণকারী হামাসকে ইসরাইলের জন্য এক ধরনের ‘হুমকি’
বলে মনে করে। পশ্চিমতীর আর গাজা নিয়েই একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে
উঠেছে। কিন্তু এর কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। ২০১২ সালে পিএলওকে
জাতিসংঘের ‘নন মেম্বার অবজার্ভার স্ট্যাটাস’ দেয়া হয়েছে। ইসরাইল এ
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে না।দ্বিতীয়ত, গাজায়
ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুরা ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হলেও পশ্চিমা
বিশ্ব ও জাতিসংঘ এক্ষেত্রে পালন করেছে আশ্চর্য রকমের নীরবতা। জুলাইয়ের শেষ
সপ্তাহে লন্ডনে আন্তর্জাতিক ‘গার্ল সামিট’ অনুষ্ঠিত হলেও একটিবারের জন্যও
ওই সম্মেলনে ফিলিস্তিনি শিশু তথা কন্যাদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আলোচিত
হয়নি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেনে একটি মালয়েশিয়ান যাত্রীবাহী
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে কড়া হুশিয়ারি তথা অর্থনৈতিক
অবরোধের কথা বলা হলেও একটিও পশ্চিমা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে
অবরোধের কথা বলা হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
অবশ্য ন্যামের একটি কোর কমিটির বৈঠকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের
কথা বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের
সমর্থনের যে ধারা, তা বাংলাদেশ অব্যাহত রাখল।তৃতীয়ত, সনাতন
রাজতন্ত্রশাসিত মুসলিম বিশ্বে এ অসম যুদ্ধের ও গণহত্যার যে প্রতিক্রিয়া
হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার দাবিদার
সৌদি আরব, জর্ডান ও আরব আমিরাত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসরাইলি এ আগ্রাসনকে
সমর্থন করেছে। হামাসকে তারা তাদের নিজেদের ক্ষমতার প্রতি অন্যতম হুমকি বলে
মনে করে। যদি হামাস এ যুদ্ধে ‘জয়ী’ হতে পারে, তাহলে হামাসের জনপ্রিয়তা এসব
রাজতন্ত্রশাসিত দেশে বেড়ে যাবে। ফলে তা প্রকারান্তরে রাজতন্ত্রের জন্য
হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। আরব বিশ্বের শুধু কাতারকে এবং এর বাইরে তুরস্ককে
হামাসকে সমর্থন করতে দেখা গেছে। যদিও তুরস্ক কোনো আরব রাষ্ট্র নয়। এ
ক্ষেত্রে এরদোগানের ব্যক্তিগত স্বার্থ (তুরস্কের তিন টার্ম প্রধানমন্ত্রী ও
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী) কিংবা কাতারের মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব
দেয়ার অভিপ্রায় কাজ করেছে বলে স্ট্র্যাটেজিস্টদের ধারণা। বলা ভালো, হামাসের
শীর্ষস্থানীয় নেতারা (খালেদ মিসেলসহ) অনেকেই এখন কাতারে বসবাস করেন। আরও
একটা মজার কাহিনী এখানে উল্লেখ করার মতো। ইরাক ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে হঠাৎ
করে আবির্ভূত হওয়া ‘ইসলামিক স্টেট’-এর সুন্নি জঙ্গিদের হামাসবিরোধী
অবস্থান। যেখানে তাদের জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামাসের সংগ্রামকে
সমর্থন করার কথা, সেখানে তারা হামাসের বিরোধিতা করছে। এমনকি তারা
ফিলিস্তিনি পতাকাও পুড়িয়েছে। এরা মনে করে, এ মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের
প্রধান কর্তব্য হচ্ছে গত জুনে বুগদাদী যে ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা
করেছেন, তার পেছনে সব মুসলমানের দাঁড়ানো। মুসলমানদের এটাই প্রধান কাজ এখন,
অন্য কিছু নয়!চতুর্থত, এই ‘যুদ্ধের’ মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে ইরানি প্রভাব
বাড়বে। ইরান হামাসকে শুধু সমর্থনই করেনি বরং হামাসের অস্ত্রশস্ত্রের অন্যতম
জোগানদাতা হচ্ছে ইরান।পঞ্চমত, আগামীতে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে কোনো
শান্তি আলোচনা শুরু হলেও (?) আদৌ এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা মনে
করার কোনো কারণ নেই। কেননা ১৯৭৩ সাল থেকেই এ শান্তি আলোচনা চলে আসছে।
কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে
ইসরাইল। ইসরাইলের ওই আগ্রাসী নীতির কাছে ফিলিস্তিনি স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে
না। বলা ভালো, পিএলও ১৯৮৮ সালে আলজিয়ার্স সম্মেলনে সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ
করা সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। পরে ১৯৯৩ সালে ইসরাইল ও পিএলও
পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়ে বৃহত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বড় ধরনের
অগ্রযাত্রা শুরু করলেও শুধু ইসরাইলি আগ্রাসী নীতির কারণে এ শান্তি
প্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।ষষ্ঠত, একটি ‘টু-নেশন’ থিওরির কথা
দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে ইসরাইল, অন্যদিকে ফিলিস্তিন
রাষ্ট্র। এটা একটা সমাধানের পথ হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসময় এই
‘টু-নেশন’ থিওরির পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করলেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে,
ইসরাইল এখন চাচ্ছে ‘থ্রি-নেশন’ থিওরি। অর্থাৎ ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা।
একদিকে পশ্চিমতীরে প্রতিষ্ঠিত হবে আল ফাতাহর নেতৃত্বে একটি প্রশাসন,
অন্যদিকে গাজায় প্রতিষ্ঠিত হবে আরেকটি প্রশাসন। তারা হামাসকে উৎখাত করে
গাজায় একটি দুর্বল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যাদের নিয়ন্ত্রণ করা
ইসরাইলের পক্ষে সহজ হবে। এতে করে ইসরাইলের লাভ অনেক। তারা ফিলিস্তিনি
নেতৃত্বকে বিভক্ত করে সুবিধা নিতে চাইবে বেশি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে,
এপ্রিল মাসে (২০১৪) হামাস ও আল ফাতাহ ঐক্যবদ্ধভাবে একটি সরকার গঠন করার
উদ্যোগ নিলে ইসরাইল পরিকল্পিতভাবে গাজায় আগ্রাসন চালায়।সপ্তমত, গাজায়
যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এটি স্বীকার করেছেন নাভি পিল্লাই স্বয়ং, যিনি
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান। এখন এ যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত
ইসরাইলি নেতাদের যদি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করা না যায়, তাহলে
আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ইতিমধ্যে বিচার হওয়া সব বিচার
কর্মকাণ্ড প্রশ্নের মুখে পড়বে।অষ্টমত, হামাস প্রস্তাবিত ১০ দফাকে সামনে
রেখে একটি শান্তি আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। গাজায় ইসরাইলি অবরোধ
প্রত্যাহার, বিমান ও সমুদ্রবন্দর খুলে দেয়া এবং গাজায় জাতিসংঘের
শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন এ অঞ্চলে এক ধরনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে
পারে। তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন যুদ্ধবিরতি। ইসরাইলের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়
করাও জরুরি।
যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। একটি বৃহত্তর ইসরাইলি রাষ্ট্র গঠন
কিংবা ফিলিস্তিনিদের এক ধরনের বস্তি জীবনযাপনে বাধ্য করা দীর্ঘস্থায়ী
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মঙ্গলজনক নয়। একসময় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলকে ধ্বংস
করার অঙ্গীকার করেছিল পিএলও। সেই অবস্থানে তারা এখন আর নেই। হামাসও একই
অবস্থানে যাবে- এ জন্য দরকার আস্থা। ইসরাইলি নেতারা যদি হামাসের সঙ্গে এ
আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন, তাহলেই দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা
সম্ভব। ফিলিস্তিনিদের উৎখাত, শিশু ও নারীদের হত্যার মধ্য দিয়ে কোনো সমাধান
আসবে না। এতে করে বরং বহির্বিশ্বে হামাসের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আরও
বাড়বে। এ ‘যুদ্ধ’ গাজাকে একটি ধ্বংসের নগরীতে পরিণত করেছে, এটা সত্য।
কিন্তু হামাস অনেক অংশেই লাভবান হয়েছে।
Daily JUGANTOR
07.08.4
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment