রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা

সম্প্রতি জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এই নীতিমালা নিয়ে অনেক কথা আছে। ইতোমধ্যে এই সম্প্রচার নীতিমালা বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রাজনীতিগতভাবেও এক ধরনের বিভক্তি আমরা লক্ষ করছি। বিএনপি এর বিরোধিতা করছে। সম্প্রচার নীতিমালা অনুযায়ী ১৩টি বিষয়ে সম্প্রচার করা যাবে না বা সম্প্রচারের সময় কঠোরভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। এসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সব বাহিনী বা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনও বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ, অবমাননা বা বিদ্রƒপ করে কিছু প্রচার করা যাবে না বা তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা যাবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে এমন সামরিক, বেসামরিক কোনও তথ্য প্রচার করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে, এমন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। কোনও বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে যায়, যাতে অন্য কোনও বিদেশি রাষ্ট্র আঘাত পায় কিংবা যাতে শত্রুভাবাপন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে রকম কিছু প্রচারে বিধিনিষেধ রয়েছে। জাতির জন্য ক্ষতিকর কোনও দৃশ্য প্রচার করা যাবে না। টক শোতে কোনও বিভ্রান্তিকর বা অসত্য তথ্য প্রচার পরিহার করতে হবে। ব্যক্তির গোপনীয়তা ক্ষুণœ করে- এমন কিছু আর করা যাবে না। যদিও সম্প্রচার নীতিমালায় একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়েছিল। যে-কোনও বিবেচনায় এ ধরনের নীতিমালা পরোক্ষভাবে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার শামিল। এখন গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল না। এর মধ্য দিয়ে এখন মিডিয়ার ওপর সরকারের কর্তৃত্ব বাড়ল। অভিযোগ উঠেছে, এই নীতিমালা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গত ৪৩ বছরে সংবিধানে মোট ১৫টি সংশোধনী আনা হয়েছে। সংবিধান ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে গেলেও কিছু ধারায় কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। যেমন সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদটি যেভাবে ছিল, তা রয়ে গেছে। সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ এই অনুচ্ছেদের ৩৯ (২) ‘ক’ ও ‘গ’ ধারা দুটো আরও স্পষ্ট। ‘ক’তে বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা এবং ‘গ’তে রয়েছে, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ অর্থাৎ সংবিধানের পুরো ৩৯ নম্বর ধারাটিতে কোনও সংবাদকর্মীকে যেমন অধিকার দিয়েছে তার মত প্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এ ধারাটি একটি রক্ষাকবচ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, মাঝে-মধ্যে ওই ৩৯ নম্বর ধারাটি লঙ্ঘিত হয়। আদালত অবমাননার অভিযোগে ‘আমার দেশ’-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যখন বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেদিন এ দেশের আইনজীবীরা আদালতে ৩৯ নম্বর ধারার কথা বারবার উল্লেখ করেছিলেন। বলার চেষ্টা করেছিলেন, ৩৯ নম্বর ধারাবলেই কোনও সম্পাদক তার মত প্রকাশের অধিকার রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যখন জন্ম হয়, তখন ওই সময়ের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এটি উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে এ দেশটিতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তারা সংবিধানে ৩৯ নম্বর ধারাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। যদিও ৩৯ নম্বর ধারার সঙ্গে সংবিধানের ৩৬ ও ৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদ দুটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং তা ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপূরক। ৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চলাফেরার স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই ধারাবলে বাংলাদেশের যে কোনও নাগরিক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া বা চলাচল করার অধিকার রাখেন। আর ৩৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে সমাবেশের স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদে কোনও নাগরিককে জনসভা তথা শোভাযাত্রা করার অনুমতি দিয়েছে। সংবিধানের এই ৩৬, ৩৭ ও ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ যদি একসঙ্গে পড়ি, তাহলে দেখব- এখানেই নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের স্পিরিট। অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিকাশ ও স্থায়িত্বের বিষয়টি লুকিয়ে আছে এই অনুচ্ছেদগুলোর অন্তরালে। এর একটি যদি লংঘিত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকেন, তাদের অনেক কর্মকা- গণতন্ত্রের এই বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটা স্বীকার করতেই হবে ১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে ৩৯নং অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশিত থাকলেও ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা ৩৯নং অনুচ্ছেদে যে রক্ষাকবচ ছিল, তাতে ছুরি বসিয়েছিলাম। মাত্র ৪টি সংবাদপত্র রেখে বাকি সংবাদপত্রগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এমনকি ৪০নং অনুচ্ছেদে যেখানে ‘পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছিল, তাও লংঘিত হয়েছিল। অনেক সংবাদপত্রকর্মীকে বেঁচে থাকার জন্য ভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়েছিল। যদিও বলা হচ্ছে, ওই সময়ের প্রেক্ষিতে এটি করতে বাধ্য হয়েছিল সরকার।
সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) মাধ্যমে একদলীয় তথা রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে একদলীয় ব্যবস্থা রহিত করা হলেও রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে যায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে রাষ্ট্রপতি সরকারব্যবস্থা বহাল থাকে। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী এনে আমরা পুনরায় সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছি। যদিও বাংলাদেশে সংসদীয় রাজনীতির বিকাশ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেও পরে আমরা তা বাতিল করেছি। এখন অনেকেই স্বীকার করবেন যে, গণতন্ত্রের সুস্থ চর্চার জন্য স্বাধীন একটি মিডিয়া দরকার। স্বাধীন মিডিয়া থাকলে তা সরকারের ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়। সরকারি মিডিয়া যা কখনোই করে না। এখন সরকার একটি সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কার্যকর করল। এর প্রয়োজন ছিল, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু যদি মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যদি টক শোকে একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা হয়, যার আলামত ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে, তা কিন্তু গণতন্ত্র চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করবে। একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে এবং বিশেষজ্ঞদের ওই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে কমিশন কর্তৃক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করলে তা শোভন হত। কিন্তু এখন এই নীতিমালা প্রণয়ন করে মিডিয়াকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী করা হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী অতীতে সংবাদপত্রের তথা মিডিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু এখন তিনি কী বলবেন? যদিও তিনি বলেছেন, ‘সম্প্রচার মাধ্যমকে একটি গতিশীল ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার জন্যই এই নীতিমালা করা হয়েছে।’ কিন্তু গণমাধ্যমের কর্মীরা মন্ত্রীর কথায় আস্থা রাখতে পারছেন না। তাদের অনেকেরই ধারণা এই সম্প্রচার নীতিমালা টিভি ও সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আদৌ কোনও প্রয়োজন ছিল না।বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে সচেষ্ট রয়েছি। কিন্তু গণমাধ্যমের কর্মীরা যখন হত্যা কিংবা গুমের সম্মুখীন হন, তখন তা গণতন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতদিন হয়ে গেল আমরা আজও জানতে পারলাম না কারা এবং কেন সাগর-রুনী সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যা করেছিল। সংবাদপত্রের কর্মীরা এই হত্যার বিচারের জন্য এখনও আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সংবাদপত্র ও সংবাদকর্মীরা যখন অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন, তখন গণতন্ত্রকে আর উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় না। আমরা তা চাই। কিন্তু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে ক্ষমতাসীনরা বরাবরই নির্লিপ্ত। সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণে রেখে একটা ‘ভয়ের আবহ’ তৈরি করে আর যাই হোক, সত্যিকারের গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যাবে না। আমরা চাই সংবাদপত্র লিখুক, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশিত হোক, সরকারের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দিক, সমাজে সব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক, তাহলেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে এবং গণতন্ত্রকে আমরা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে অপব্যবহার হতেও আমরা দেখেছি। যে সংবাদ সমাজে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়, সংঘাত সৃষ্টি করে, তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে ছাপানো উচিত নয়। এখানে সংবাদপত্রের তথা সম্পাদকের দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। তার পরও সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়। সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়ার দাবিও অযৌক্তিক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরও একটা কথা বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। শুধু সংবাদপত্র কিংবা রেডিও, টেলিভিশন নয়, বরং অনলাইন সংবাদপত্রগুলোর জন্যও একটি সমন্বিত নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। ফেসবুক এখন যথেষ্ট জনপ্রিয়। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর জন্যও নীতিমালা করতে হবে, যাতে কেউ কারও নামে এসব যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর, অসংলগ্ন কথা লিখতে না পারেন। ইতোমধ্যে সরকার ২০১৪ নামে যে একটি নীতিমালা অনুমোদন করেছে, এই নীতিমালা শুধু রেডিও, টেলিভিশনের জন্য। ফেসবুকের তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য কোনও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। গণমাধ্যমের জন্য প্রায় ৪৩টি আইনের বিধি রয়েছে, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার পরও আরও একটি সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করা হল। সম্প্রচার কর্মীদের একটা অংশ এর বিরোধিতা করায় শুরুতেই এটি বিতর্কিত হল। সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪ বাতিলের দাবি ইতোমধ্যেই উঠেছে। এটি নিয়ে সংসদে আলোচনারও সুযোগ আছে। আমি মনে করি কিছু ধারায় সংশোধনী আনা যায়। বিশেষ করে ‘টক শোগুলোর ব্যাপারে যেসব কথা বলা হয়েছে, তাতে সংশোধনী আনা যেতে পারে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নীতিমালা মিডিয়ার মঙ্গল ডেকে আনতে পারে। অহেতুক পরোক্ষ বিধিনিষেধ আরোপ করে, ‘টক শো’গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে সরকার সাময়িক সুবিধা পাবে সত্য, কিন্তু গণতন্ত্র চর্চার জন্য তা কখনোই কোনও ভালো খবর নয়। Daily AMADER SOMO 12.08.14

0 comments:

Post a Comment