ব্রিকস ব্যাংক কি বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হতে পারবে?
17:48
No comments
যারা
আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা সাম্প্রতিক দুটি
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ব্যাপারে গভীরভাবে দৃষ্টি রেখেছেন। এর একটি হচ্ছে
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আর্জেন্টিনার দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয়টি গত ১৫-১৭
জুলাই ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে ব্রিকস উন্নয়ন ব্যাংক
প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত। এই দুটি ঘটনার সঙ্গে একটা মিল আছে- আন্তর্জাতিক অর্থ
ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থ
রক্ষা করতে পারছে না। এ ধরনের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন ফোরামে আলোচিত
হয়ে আসছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের পাল্টা আরেকটি বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার কথা
কখনও জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়নি। এবারই প্রথম ব্রিকসের নেতারা ব্যাংক
প্রতিষ্ঠার কথা বললেন। অনেকের মনে থাকার কথা, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির
অভিযোগ ও অর্থ সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়ার পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে
বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তবে এটাও সত্য, অন্যান্য প্রকল্প
থেকে বিশ্বব্যাংক অর্থ সহায়তা প্রত্যাহার করে নেয়নি। এখন ব্রিকস ব্যাংক
প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে
অর্থমন্ত্রী ব্রিকসের সদস্য ৫টি দেশের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও
দক্ষিণ আফ্রিকা) রাষ্ট্রদূতদের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে ব্রিকস ব্যাংকের
সদস্যপদ পেতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথাও জানিয়েছেন। বাংলাদেশ একই সঙ্গে চীনের
প্রস্তাবিত এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি)
ব্যাপারেও আগ্রহ দেখিয়েছে। ব্রিকস ব্যাংক কিংবা এআইআইবির ব্যাপারে এখনও
বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে এআইআইবি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আগামী অক্টোবরে
আসতে পারে, এমন একটি কথা শোনা যাচ্ছে।ব্রিকস উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যাপারে
সিদ্ধান্ত হয়েছে, এটি আপাতত ৫ হাজার কোটি ডলারের মূলধন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত
হবে। ভারত এর প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করবে। ব্রিকস উন্নয়ন ব্যাংকের
প্রধান কার্যালয় হবে চীনের সাংহাইয়ে। ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত
যে কিছুটা হলেও বিশ্বব্যাংককে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, তা গেল সপ্তাহে
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের ভারত সফরের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত
হয়। মি. কিম ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। কিমের
সঙ্গে আলোচনার পর অরুণ জেটলি বলেছিলেন, ভারত মনে করে বিশ্বব্যাংকের
কার্যক্রম পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক
ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন আসছে। ভুলে গেলে চলবে না, চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বড়
অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের পরই তার স্থান। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল
কম্পারিজন প্রোগ্রামের (আইসিপি) মতে ভারত জাপানকে হটিয়ে দিয়ে ২০১১ সালে
বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। অথচ ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম
অর্থনীতির দেশ ছিল।আইসিপি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাজ করে। তাদের রিপোর্ট
থেকেই জানা যায়, ২০১১ সালে বিশ্ব ৯০ ট্রিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের পণ্য ও
সেবা উৎপাদন করে। তবে এর মোট উৎপাদনের অর্ধেকই নিু ও মধ্য আয়ের অর্থনীতির
দেশগুলো থেকে আসে। আইসিপির প্রধান পর্যবেক্ষণ হল, বিশ্বের ১২টি বৃহত্তম
অর্থনীতির দেশের ৬টিই মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশের অন্তর্গত। ১২টি বৃহত্তম
অর্থনীতির দেশ সম্মিলিতভাবে উৎপাদন করে বিশ্ব অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ। আর
বিশ্বের ৫৯ শতাংশ লোক এই ১২টি দেশে বসবাস করে বলে আইসিপি তাদের রিপোর্টে
উল্লেখ করেছে। ক্রয়ক্ষমতার অসমতা (পার্চেজিং পাওয়ার প্যারিটি- পিপিপি)
অনুযায়ী বিশ্ব জিডিপি ৯০ হাজার ৬৪৭ বিলিয়ন ডলার। সে তুলনায় বিনিময় হার
অনুযায়ী বিশ্ব জিডিপি ৭০ হাজার ২৯৪ বিলিয়ন ডলার। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন
থাকবে, মাত্র ৫টি দেশ নিয়ে গঠিত ব্রিকস কতদূর যেতে পারবে? ইন্দোনেশিয়া,
দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা আর্জেন্টিনার মতো দেশ অদূর ভবিষ্যতে ব্রিকসে যোগ দেবে
কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন।বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক
আছে উন্নয়নশীল বিশ্বে। বিশ্বব্যাংক সমাজসেবা করে না। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর
বিভিন্ন দেশে তারা যে সাহায্য দেয়, এটা তাদের বিনিয়োগ। সুদসহ তারা আসল বুঝে
নেয়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের ঋণ পলিসি নিয়ে নানা কথা আছে। যারা পল ব্যারেন,
রাউল প্রোবিস, গ্রাহাম হেনকক, পল সুইজি, এজি ফ্রাংক কিংবা সামির আমিনের
লেখার সঙ্গে পরিচিত, তারা জানেন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ঋণ কেন দেয়, তাদের
স্বার্থ কী এবং ঋণের বিনিময়ে তাদের প্রাপ্তি কী। তাই শুধু ভারত নয়, বরং
উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্বব্যাংকের সংস্কার দাবি
করে আসছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের
৬৭তম অধিবেশনে (২০১৩) প্রদত্ত ভাষণে বিশ্বব্যাংকের সংস্কারের দাবি
তুলেছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও সিদ্ধান্ত
প্রক্রিয়া ৬০ বছরের পুরনো ক্ষমতার সমীকরণের প্রতিফলন। প্রধানমন্ত্রী যা
বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে, বেটন উডস (১৯৪৪) সম্মেলনের পর অনেক দিন পার হয়ে
গেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির
কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ানো উচিত। আজকে
প্রধানমন্ত্রীর এই কথারই প্রতিধ্বনি করলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। বিশ্বব্যাংক
উন্নয়নশীল বিশ্বকে আর্থিক সহায়তা দেয়, এটা সত্য। কিন্তু শর্ত থাকে শুধু
তাই নয়, তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশেও
বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা একেবারে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন
নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ
তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে
নিয়েছিল। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসবে বলা হলেও
বিশ্বব্যাংক আর ফিরে আসেনি। বাংলাদেশ এখন স্বউদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণ
করছে।বিশ্বব্যাংকের ঋণের সঙ্গে কাঠামোগত সামঞ্জস্যের একটি কথা শোনা
যায়। বাংলাদেশে এটি ব্যাপকভাবে পরিচিত। এটা হচ্ছে এক ধরনের সুপারিশমালা।
বিশ্বব্যাংক ঋণের শর্ত হিসেবে এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের কথা বলে থাকে।
কাঠামোগত সামঞ্জস্যের নামে বিশ্বব্যাংক যেসব শর্ত আরোপ করে থাকে তা অনেকটা এ
রকম : ১. গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ২. সরকারি ব্যয় হ্রাস, ৩.
শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস, ৪.
প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, ৫. দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, ৬.
জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারিকরণ, ৭. কর ও সুদের
হার বাড়ানো, ৮. আমদানি অবাধ করা, ৯. মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।বাংলাদেশসহ
সব উন্নয়নশীল দেশ এবং সমাজতন্ত্রের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এখন
কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় ঋণ পেয়ে থাকে। কিন্তু তাতে করে কি ঋণ গ্রহীতা
দেশের অর্থনীতিতে তেমন পরিবর্তন এসেছে? কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে এর জবাব দেয়া
যেতে পারে। ১৯৭৭-৮৫ সময়ে পেরুতে বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলা অনুযায়ী কাঠামোগত
সামঞ্জস্যের শর্তাবলী গ্রহণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, এর ফলে মাথাপিছু আয়
শতকরা ২০ ভাগ কমেছে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০ ভাগে, সেই সঙ্গে
বেড়েছে বেকারত্ব। আরও একটি কথা। ঋণ দেয়া হয় সাধারণত ধনতন্ত্র কায়েম করতে
এবং সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি রোধ করতে। অনেক জাতীয়তাবাদী সরকারের পতন ঘটানো
হয়েছে শুধু তাদের কথামতো না চলার জন্য (ইরানেয় মোসাদ্দেক ১৯৫৩ সালে,
গুয়াতেমালায় আরবেনজ ১৯৫৪ সালে, ব্রাজিলে গাউলাট ১৯৬৪ সালে, ইন্দোনেশিয়ায়
সুকর্ন ১৯৬৫ সালে, ঘানায় নক্রুমা ১৯৬৬ সালে, মালিতে কাইটা ১৯৬৮ সালে,
চিলিতে আলেন্দে ১৯৭৩ সালে)। ১৯৭২-৭৬ সময়ে আর্জেন্টিনায় পেরনিস্টরা কিংবা
ব্রাজিলে গাউলাট বিশ্বব্যাংকের কোনো ঋণ পাননি। কেননা তাদের রাজনীতিতে
পুঁজিবাদী বিশ্ব সন্তুষ্ট ছিল না। অথচ তারা যখন উৎখাত হন, তখন থেকেই এই
দুদেশে বিশ্বব্যাংকের সাহায্য বেড়ে যায়। শুধু ১৯৭৬ সালে এককভাবে
আর্জেন্টিনা বিশ্বব্যাংক থেকে যত ঋণ পেয়েছে, এর আগের ২০ বছরেও দেশটি
বিশ্বব্যাংক থেকে এত ঋণ পায়নি।বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের জুলাই থেকে
সম্প্রসারিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির আওতায় কাজ করে যাচ্ছে। এতে করে
সরকারের ৯টি ক্ষেত্রে (কৃষি, শিক্ষা, বাণিজ্য, সরকারি সম্পদের ব্যবহার,
সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ, সরকারি ব্যয়নীতি, বহিঃখাত, অর্থখাত সংশোধন, মানব
সম্পদ এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ ও পরিবেশ নীতি) করণীয় কাজ নির্দিষ্ট করে দেয়া
হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সেচ উপকরণ আমদানি ও বিতরণ ব্যবস্থা সহজীকরণ, আমদানির
ওপর আরোপিত শর্তাবলী তুলে দেয়া ও রফতানি ভর্তুকি ব্যবস্থা বাতিল করা,
ভ্যাট প্রথা প্রবর্তন, পাট, বস্ত্র, রসায়ন, ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থাকে
বেসরকারিকরণ, রেলওয়ের ঘাটতি দূরীকরণ, প্রশাসনিক খাতে ব্যয় হ্রাস, রফতানি
বহুমুখিকরণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি। এছাড়া
পরিবার পরিকল্পনা, শিল্পায়ন ইত্যাদি বিষয়েও দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর বিভিন্ন
সুপারিশমালা রয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ এ থেকে কতটুকু উপকৃত
হয়েছে? দারিদ্র্র্য কিংবা চরম দারিদ্র্যসীমায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা
কমেনি। দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে ১৭ হাজার টাকা ঋণের
বোঝা মাথায় নিয়ে (২০০৮)। রাষ্ট্রকে এই ঋণ পরিশোধ করতে হয় আর চক্রবৃদ্ধি
হারে সেই ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে, ঋণ আর শোধ হয় না। ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে এক
ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৮৮ টাকা, আজ সেখানে
টাকার বিনিময় হার ৭৯ টাকা। ঋণের শর্ত হিসেবে আমরা টাকার মান নির্ধারণ করতে
বাধ্য হয়েছি। কিন্তু দারিদ্র্য কমেনি। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে বটে, কিন্তু
এতে করে উপকৃত হয়েছে কিছু ব্যক্তি ও রাজনীতিক। তথাকথিত কনসালটেন্সির নামে
কিছু বুদ্ধিজীবী তথা শিক্ষকের পকেট ভারী হয়েছে মাত্র!মনে রাখতে হবে,
বিশ্বব্যাংক থেকে একবার ঋণ নিলে সেখান থেকে আর বের হয়ে আসা যায় না। ব্রাজিল
একবার ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ডিফল্টার হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক দেশটিকে
আবারও ঋণ দিয়েছিল, যাতে ব্রাজিল ঋণের সুদ পরিশোধ করতে পারে। না হলে
আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিত। এজন্যই ঋণের পরিমাণ বাড়লেও
বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়া অব্যাহত রাখে।আজ তাই বিশ্বব্যাংকের যে সংস্কারের
কথা উঠেছে, তাতে অযৌক্তিক কিছু নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাংক আদৌ সংস্কারের কোনো
উদ্যোগ নেবে, এটা মনে হয় না। তাই সঙ্গত কারণেই ব্রিকস ব্যাংকের দিকে
তাকিয়ে থাকবে সবাই। কিন্তু কাজটি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। এর ভবিষ্যৎ
অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। দুই বড় অর্থনৈতিক শক্তি চীন ও ভারতের মাঝে
সম্পর্ক আগামী দিনে কোন পর্যায়ে দাঁড়ায়, চীনের ভূমিকা ব্যাংক পরিচালনায় কী
হবে, কিংবা ঋণের ধরন কী হবে- এসবের ওপর ব্রিকস ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নির্ভর
করছে। বলা ভালো, মোট ১০ হাজার কোটি ডলার মূলধন নিয়ে ব্যাংকটি যাত্রা শুরু
করছে। এক্ষেত্রে চীন একাই দেবে ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার। রাশিয়া, ভারত ও
ব্রাজিল দেবে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার করে। আর দক্ষিণ আফ্রিকা দেবে ৫০০ কোটি
ডলার। ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্বের ৪০ শতাংশ জনগণ ও ২৫ শতাংশ এলাকা এ
দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত এবং তারা বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশের অধিকারী।
ব্রিকস দেশগুলো বর্তমানে বৈশ্বিক মুদ্রা রিজার্ভের ৪৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
সুতরাং ব্রিকস ব্যাংকের ব্যাপারে আমাদের একটা আগ্রহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
আর্জেন্টিনার ঋণের পরিমাণ এখন ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। নিউইয়র্কে অবস্থিত
বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা কিরসনার সরকারের
দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ৩০ জুনের মধ্যে আর্জেন্টিনার ৫৩৯ মিলিয়ন (সুদ ও আসল)
পরিশোধ করার কথা থাকলেও আর্জেন্টিনা তাতে ব্যর্থ হয়। আর্জেন্টিনার
অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। গত বছর ডলারের সঙ্গে পেসোর (আর্জেন্টিনার
মুদ্রা) অবমূল্যায়ন হয়েছে শতকরা ৩৫ ভাগ। বিশ্বব্যাংকের নীতি অনুসরণ করতে
গিয়েই আর্জেন্টিনার এই দুরবস্থা।আর্জেন্টিনার এই ঘটনাটি সারা ল্যাটিন
আমেরিকায় আলোড়ন তুলেছে। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন,
প্রস্তাবিত ব্রিকস ব্যাংক নতুন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য
করবে এবং লুটপাটের হাত থেকে আমাদের অর্থনীতিকে রক্ষা করবে। আর বলিভিয়ার
প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের মন্তব্য : নয়া উপনিবেশবাদের ছায়া থেকে রক্ষা
করবে এই ব্যাংক। শুধু ভেনিজুয়েলা বা বলিভিয়াই নয়- চিলি, কলম্বিয়া,
ইকুয়েডরসহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিটি দেশ প্রস্তাবিত ব্রিকস ব্যাংক গঠনের
উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা ব্রিকসের নেতাদের সঙ্গে দেখাও করেছেন।
এমনকি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, তারা আর্জেন্টিনাকে
দেউলিয়াত্বের হাত থেকে রক্ষা করবেন।তবে ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কাজটি
খুব যে সহজ হবে, তা বলা যাবে না। পাঁচ উদ্যোক্তা দেশের সংসদে ব্রিকস
ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, চীন-ভারত সম্পর্ক,
তাদের ভেতরকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক ব্রিকস ব্যাংক গঠনে প্রভাব ফেলবে। যেখানে
চীনের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৭ ভাগ (২০১৩), সেখানে ভারতে মাত্র ৫ ভাগ
(২০১৩)। চীনে মাথাপিছু আয় বছরে ১১ হাজার ৮৫০ ডলার, আর ভারতে ৫ হাজার ৩৫০
ডলার। চীনে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা কমছে, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যা
অর্থনীতিকে চাপের মুখে রাখবে। ভারতে বাড়বে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা। বিশ্ব
অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় যেখানে চীনের অবস্থান ২৯তম, সেখানে ভারতের অবস্থান
৬০তম। জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্বে ভারতের অবস্থান ১০২তম। চীনের
অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভারতের চেয়ে অনেক ভালো। ফলে এই দুটি বড় দেশের
অর্থনৈতিক অবস্থা, পার্থক্য ব্রিকস ব্যাংক গঠনে প্রভাব ফেলতে পারে। চীনের
ভূমিকা নিয়েও থাকবে প্রশ্ন। সুতরাং ব্রিকস ব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বে বড়
ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারলেও সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে, সেটাই
দেখার বিষয়।
Daily JUGANTOR
25.08.14
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment