রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পাকিস্তান আর থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতার কথা

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তান আর থাইল্যান্ডে গণতন্ত্রের সংকট নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে উৎখাতের জন্য প্রধান বিরোধী দল ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই-ইনসাফ ও ধর্মীয় নেতা তাহিরুল কাদরীর আওয়ামী তেহরিক একত্রিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। গত ২০ আগস্ট তারা হাজার হাজার সমর্থককে নিয়ে ইসলামাবাদের ‘রেড জোন’ এলাকায় প্রবেশ করে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেছে। এই আন্দোলনের পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ও সেনাবাহিনীও জড়িয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরীকে আদালতে উপস্থিত থাকার জন্য সমন জারি করেছে। অন্যদিকে সেনাবাহিনী ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, যাতে সরকার ও বিরোধী দল একটা সমাধানে উপনীত হতে পারে। সর্বশেষ ঘটনায় ইমরান খানের দলের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন। পাকিস্তানের এই সংকট গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। হঠাৎ করেই যেন এই সংকটের সৃষ্টি হলো। গেল বছর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সেখানে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। নির্বাচন নিয়ে তখন কোনো কথা হয়নি। নওয়াজ শরীফ একটি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করে। হঠাৎ করেই ইমরান খান ‘ভোট কারচুপি’সহ ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। এর মাঝে অন্যতম একটি দাবি হচ্ছে নওয়াজ শরীফের পদত্যাগ ও নয়া নির্বাচন। অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরীফের (পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী) পদত্যাগ ও নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার। নওয়াজ শরীফ ইমরানের সঙ্গে আলোচনায় রাজি থাকলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি। পাকিস্তানে এই সরকারবিরোধী আন্দোলনের সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরীফের সম্ভাব্য একটি ভূমিকা আবার সামনে চলে এসেছে। পর্দার অন্তরালে থেকে তিনি ইমরান খানকে দিয়ে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন, এমন কথাও উঠেছে। অথচ নওয়াজ শরীফের আমলেই জেনারেল রাহিল সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। গোষ্ঠীতন্ত্র পাকিস্তানে কত শক্তিশালী এটা আবারো প্রমাণিত হলো। নওয়াজ শরীফ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তারপরও বিরোধী দলের অসাংবিধানিক আন্দোলনের মুখে পড়তে হলো নওয়াজ শরীফকে। পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা মুশকিল। থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতাও খুব ভালো নয়। সেখানেও নির্বাচিত একটি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল বিরোধী দল। এমনকি বিরোধী দল পার্লামেন্ট, সরকারি ভবন দখল করে নিয়েছিল। পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল তখন সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছিল। একই সঙ্গে সংবিধান স্থগিত করা হয়েছিল এবং সেনাপ্রধান জেনারেল প্রাইউথ নিজে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। এর আগে ৬ মাস ধরেই সেখানে সংকট চলে আসছিল। এই সংকট আরো গভীর হয় যখন গত ৭ মে ২০১৪ দেশটির সাংবিধানিক আদালত প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বরখাস্ত করেন। মূলত সংকটের শুরু ২০১৩ সালের অক্টোবরে, যখন ইংলাকের বড় ভাই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার দায়মুক্তির বিল সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ওই বিল নিয়ে দেশে বড় বিতর্কের জন্ম হয়। নভেম্বরে সংসদের নি¤œকক্ষে দায়মুক্তি বিলটি পাস হলেও উচ্চকক্ষে বিলটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। দায়মুক্তি বিলের প্রতিবাদে ব্যাঙ্ককে লক্ষাধিক লোকের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই থেকে থাইল্যান্ডে দিনের পর দিন বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। এমনকি বিক্ষোভকারীরা শহরের রাস্তাঘাট দখল করে অবস্থান করে আসছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই ফেব্রুয়ারিতে (২০১৪) প্রধানমন্ত্রী ইংলাক একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থাইল্যান্ডে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে ক্ষমতাসীন হয়ে থাই পার্টি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় থেকে গিয়েছিল। প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। যারা থাইল্যান্ডের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৈরিতার কারণেই সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। ইতিহাস বলে ১৯৩২ সালে থাইল্যান্ডে প্রথম সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল আর সর্বশেষ (১১তম) সেনা অভ্যুত্থান হয় ২০০৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। তবে ওই সেনা অভ্যুত্থানের একটি ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল। সাবেক ও জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সরকারের বিরুদ্ধে সেনাপ্রধান জেনারেল সোনধি বুজিয়ারাত সিনন এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। অতীতে দেখা গেছে, সেনানায়করা রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করে নিজেরা ক্ষমতায় থাকার জন্য একটি দল গঠন করেন। কিন্তু সোনধি তা করেননি। তিনি একটি নির্বাচনের আয়োজন করেন। কিন্তু নির্বাচন সেখানে কোনো রাজনৈতিক সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং যার তত্ত্বাবধান করেন জেনারেল সোনধি, তাতে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন সামাক সুন্দরাভেজ। কিন্তু তিনি বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হননি। তিনি পদত্যাগ করেন। তার পরিবর্তে পরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন সোমচাই ওয়াংসোয়াত। সুন্দরাভেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি সিনাওয়াত্রার খুব ঘনিষ্ঠ। তিনি দায়িত্ব নিলে প্রায় ৩ মাস বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন দখলসহ সরকার উৎখাতের আন্দোলন করে আসছিল। এর নেতৃত্বে ছিল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেও বিক্ষোভ দমন করতে পারেননি। ওই সময় সেনাপ্রধান বুসরাং নিয়মপ্রাদিতের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের একটা সম্ভাবনার জন্ম হলেও শেষ পর্যন্ত ওই সময় কোনো সেনা অভ্যুত্থান হয়নি। তবে সেনাপ্রধানের চাপে প্রধানমন্ত্রী সোমচাই ওয়াংসোয়াত পদত্যাগ করেছিলেন এবং বিরোধী দল নেতা অভিজিত ভেজাজিভার নেতৃত্বে সেখানে একটি সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি কখনো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ২০০৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সিনাওয়াত্রার থাই রক থাই পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছি। কিন্তু সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা পিপলস পাওয়ার পার্টি (পিপিপি) গঠন করে ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং বিজয়ী হয়েছিল। ওই নির্বাচনে ৪৮০টি আসনের মাঝে পিপিপি ২৩২টি আসন পেয়েছিল। পিপিপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও তারা একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। পিপিপি যেহেতু জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়েছিল ও জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিল, সেহেতু তাদের টার্ম পূরণ করতে দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। নির্বাচনের এক বছর পরপরই শুরু হয়েছিল সরকার উৎখাতের আন্দোলন। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন-আর তা হচ্ছে সাংবিধানিক আদালতের ভূমিকা। সাংবিধানিক আদালত প্রধানমন্ত্রী সুন্দরাভেজকেও অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। ইংলাককেও অযোগ্য ঘোষণা করেছিল এই আদালত। থাইল্যান্ডের রাজনীতি কার্যত দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদিকে ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা, যারা ‘রেড শার্ট’ ধারী হিসেবে পরিচিত। থাকসিন সিনাওয়াত্রার দল থাই রক থাই পার্টি নিষিদ্ধ হলে তারা সমর্থকরা পিপলস পাওয়ার পার্টির ব্যানারে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পরে তারা সিনাওয়াত্রার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রার নেতৃত্বে গঠন করে গয়ে থাই পার্টি। এরা লাল শার্ট পরিধান করে বিধায় তাদের আন্দোলনকে ‘রেড শার্ট’ আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে সিনাওয়াত্রার বিরোাধতা ‘ইয়োলো শার্ট’ এর ব্যানারে সংগঠিত, যে কারণে তারা ‘ইয়েলো শার্ট’ আন্দোলনকারী হিসেবে পরিচিত। এভাবেই থাইল্যান্ডের রাজনীতি ‘লাল শার্ট আর ‘হলুদ শার্ট’ এর মাঝে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ইংলাক এভাবেই ‘রেড শার্ট’ আন্দোলনকারীদের উসকে দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। এটা সত্য, জনগণের ভোটে তিনি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু অভিযোগ ছিল ভাইয়ের (থাকসিন সিনাওয়াত্রা) ছত্রছায়ায় তিনি ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন। থাকসিন সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের শীর্ষ ধনীদের একজন। তবে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তার দেশে আসাও নিষিদ্ধ। ফলে ইংলাক যখন ভাইকে দায়মুক্ত দেয়ার উদ্দেশ্যে সংসদে একটি বিল আনেন, তখন তা বিতর্কের জন্ম দেয়। এটা স্পষ্ট যে অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী এই দায়মুক্তির বিরোধী। থানসিন সিনাওয়াত্রার সঙ্গেও সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ভালো ছিল না কখনো। ২০০৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর একাধিকবার সেনা অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার জন্ম হলেও সেনা অভ্যুত্থান হয়নি এবং সেনাবাহিনী ক্ষমতাও ধরে রাখেনি। সম্ভবত সেনা নেতৃত্ব এটা বোঝেন যে সেনা অভ্যুত্থান আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই প্রচণ্ড ‘চাপ’-এর মুখে থেকেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা ধরে রাখেনি। তারা সরকার পরিবর্তন করিয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু ক্ষমতায় যায়নি। এখন ২০১৪ সালে এসে জেনারেল প্রাইউথ-এর ভূমিকা ও সম্ভাব্য একটি দল গঠন করে ক্ষমতা পরিচালনা করার প্রক্রিয়া শুরু হলো। থাইল্যান্ডের ইতিহাসে সেনা অভ্যুত্থান ও দীর্ঘদিন তাদের ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চম থেকে আশির দশকে পৃথিবীর একাধিক দেশে (আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য) সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এবং কোথাও কোথাও সেনা শাসকরা যথেষ্ট জনপ্রিয়ও হয়েছিলেন (মুস্তাফা কামাল তুরস্কে, নাসের মিসরে, পেরেন আর্জেন্টিনায় কিংবা শ্যাভেজ, ভেনিজুয়েলা)। নব্বই দশকের পর থেকেই এই প্রবণতা কমতে থাকে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে এর কোনো সমর্থনও নেই। থাইল্যান্ডের ইতিহাসে ৪টি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের খবর পাওয়া যায়, যা সেনাবাহিনীর উদ্যোগে ও সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে থাইল্যান্ডে সেনাবাহিনী প্রথম ক্ষমতা দখল করে ১৯৩২ সালে। সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল ফি বুন ১৯৩২ সালে ক্ষমতা দখল করে গঠন করেছিল ‘সেরি মানাংখাছিলা’ পার্টি। ১৯৫৭ সালে জেনারেল ফি বুনের পতন ঘটলে তার দলেরও বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৫৭ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন জেনারেল সারিত, গঠন করেছিলেন ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি।’ ১৯৬৩ সালের নির্বাচনে নতুন একটি দল ‘ইউনাইটেড থাই পিপলস পার্টি’ গঠিত হয়েছিল। আর্মি কমান্ডাররা এ দলের সদস্য ছিলেন। তবে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে গঠিত কোনো রাজনৈতিক দল পরিপূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে কিনা সে ব্যাপারে সমাজ বিজ্ঞানীদের মাঝে দ্বিমত আছে। মূলত এক ধরনের ‘প্রেট্রোনাইজেশন’ ও ক্ষমতায় সরাসরি অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা ধরে রাখে। যেমন ইন্দোনেশিয়ায় জেনারেল সুহার্তো গোসফার পার্টি গঠন করে দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন (১৯৬৫-১৯৮১)। সেনাবাহিনীর সেখানে সরাসরি সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকত। এখন অবিশ্যি গোলকাপের কাঠামোয় বড় পরিবর্তন এসেছে। মিসরেও বারেবারে সেনা নেতৃত্ব দল গঠন করেছেন, যার সঙ্গে সনাতন রাজনৈতিক দলের কোনো মিল ছিল না। নাসের, সাদাত কিংবা মোবারক সবাই এক একটি দলের ছত্রছায়ায় তাদের ক্ষমতা ধরে রাখাকে নিয়মসিদ্ধ করে নিয়েছিলে। ২০১১ সালে আরব বসন্ত সেখানে একটি পরিবর্তন ডেকে আনলেও মিসর আবারো পুরনো দিনে ফিরে গেছে। জেনারেল সিসি শুধু নাসের সাদাত কিংবা হোসনি মোবারকের পদঙ্ক অনুসরণ করছেন। একটা দলও তিনি করবেন! থাইল্যান্ডে সেনাবাহিনী মূলত একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসেবে গড়ে উঠেছে। ব্যবসা, আমদানি-রফতানির একটা সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা (মিসরে এটা নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানগতভাবে)। আর সম্ভবত সিনাওয়াত্রার সঙ্গে দ্বন্দ্বটা এখান থেকেই শুরু। কেননা টেলি কমিউনেশন খাতসহ বেশ কিছু খাতের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে সিনাওয়াত্রা পরিবার। ফলে সিনাওয়াত্রা ও তার বোন ইংলাক কখনই সেনাবাহিনীর কাছে গ্রহণযোগ্য হননি। এখানে সিনাওয়াত্রার একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল তিনি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন। তার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে ছিলেন জনপ্রিয়। তিনি সাধারণ মানুষের উন্নয়ন, ব্যাপক কর্মসংস্থান, সাধারণ মানুষের মানোন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছিলেন। ফলে তিনি নিষিদ্ধ হলেও তার সমর্থকদের (লাল শার্ট আন্দোলন) সাধারণ মানুষ বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল। অন্যদিকে ‘হলুদ শার্ট’ আন্দোলনকারীরা, যারা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ব্যানারে সংগঠিত এবং যাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সখ্য রয়েছে বলে ধরা হয়, তারা মূলত অভিজাততন্ত্র, ধনী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে স্পষ্টতই থাই রাজনীতি দু’ধারায় বিভক্ত হয়ে আছে। এখন জেনারেল প্রাইউথ তথাকথিত একটি পার্লামেন্টের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। কিন্তু পাকিস্তানে কী হবে? সেনাবাহিনী নওয়াজ শরীফকে কী উৎখাত করবে? ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে তারা পাকিস্তানে কোনো অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করবে না। এতে একটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে যুক্তরাষ্ট্র নওয়াজ শরীফের পেছনে আছে। পাকিস্তান আর থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে মিলটা এখানেই। সেনাবাহিনী উভয় দেশেই শক্তিশালী। উভয় দেশেই সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সমঝোতার অভাবে গণতান্ত্রিক ধারা সেখানে ব্যাহত হচ্ছে। পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এখন দেখতে হবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে কিনা। থাকসিন সিনাওয়াত্রা যেমনি সেনাবাহিনীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, ঠিক তেমনি নওয়াজ শরীফও সেনাবাহিনীর পছন্দের পাত্র নয়। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ নওয়াজ শরীফকেই ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছিল। তারপর দীর্ঘদিন জেনারেল মোশাররফ পাকিস্তানি শাসন করেছে। আজ পাকিস্তান তেমনি এক পরিস্থিতির মুখোমুখি। Daily Manobkontho 26.08.14

0 comments:

Post a Comment