স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের জন্য আমার দুঃখ হয়। সংসদের বাজেট অধিবেশনের শেষদিনে সরকার সমর্থক জাতীয় পার্টির এক এমপি প্রকাশ্যে তার পদত্যাগ চাইলেন। শুধু তিনি কেন? এর আগেও সরকারি দলের দু-একজন এমপির মুখেও আমি তার পদত্যাগের দাবি শুনেছি। দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি যখন খুব একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যাচ্ছে না, তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটায় দুর্নীতির খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে।
এর মধ্যে তিনটি সংবাদ ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রথম সংবাদটি ঢাকা মেডিকেল কলেজে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ানদের জন্য দু’মাসে ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি টাকা! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের একটি সংবাদ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, এখানে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দ্বিতীয় সংবাদে (যমুনা টিভি) বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এডিবি ও সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় যে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে; তাতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এ প্রকল্পের সঙ্গে যিনি জড়িত ছিলেন, তিনি ৩০টি অডিও ভিডিও তৈরিতে খরচ দেখিয়েছেন ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা! তৃতীয় সংবাদটি আগের দুটির চেয়ে আরও ভয়াবহ। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য ২০ হাজার ৬০০ পিস মাস্ক এন-৯৫ হিসেবে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) সরবরাহ করেছিল জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাচারিং লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি। পরে জানা গেল, ওই মাস্ক এন-৯৫ ধরনের মাস্ক ছিল না; অথচ বিশ্বব্যাপী এন-৯৫ মাস্ক স্বীকৃত ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হলে জেএমআই সরবরাহকৃত মাস্কগুলো ফেরত নিয়ে এ থেকে দায়মুক্তি পেতে চেয়েছিল। তারা এটাকে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ বলে দাবি করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিয়েছিল। দুদক এটা নিয়ে এখন তদন্ত করছে।
স্বাস্থ্য সেক্টরে এই যে দুর্নীতি, এই দুর্নীতির খবর শুধু আজকেরই নয়। ৩৭ হাজার টাকায় পর্দা কেনা কিংবা ৫ হাজার টাকায় একটি করে বালিশ কেনার কাহিনী তো অনেক পুরনো। কোটি কোটি টাকায় কেনা মেডিকেল সরঞ্জামাদি বছরের পর বছর বাক্সবন্দি থেকে নষ্ট হয়ে গেছে- এ ধরনের একাধিক ঘটনার সংবাদ আমরা সংবাদপত্র থেকেই পাঠ করেছি। কিন্তু ‘পর্দা ও বালিশ’ কাহিনীর সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের ক’জনকে আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পেরেছি? দুদক চেয়ারম্যান মাঝে মাঝে বেশ স্পষ্ট কথা বলেন। স্বাস্থ্য সেক্টর নিয়েও তিনি মন্তব্য করেছেন। কিন্তু আমরা জানি না স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্নীতিবাজদের আমরা শাস্তি দিতে পেরেছি কিনা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সাধারণ কর্মচারীর ঢাকায় একাধিক বাড়িসহ কানাডায় বাড়ি থাকার খবর ছবিসহ তো সংবাদপত্রেই ছাপা হয়েছিল। মন্ত্রণালয় তাকে চাকরিচ্যুত করেছিল। কিন্তু শুধু চাকরি থেকে অপসারণ করাই কি এর সমাধান?
২.
ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ২০ কোটি টাকা খরচের ব্যাপারটি এখন বহুল আলোচিত। ইতোমধ্যে ডিএমসি পরিচালকের একটি ব্যাখ্যাও আমরা পেয়েছি। তিনি জানিয়েছেন, এ টাকা শুধু খাওয়ার বিল নয়; এর সঙ্গে হোটেল ভাড়া ও যাতায়াতের খরচও রয়েছে এবং এটা ২ মাসের বাজেট। মোট ২ হাজার ২৭৬ জন কর্মীর (ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান ও নিরাপত্তাকর্মী) জন্য এ টাকা খরচ হয়েছে। একজন ডাক্তারের জন্য প্রতিদিনের খাবার খরচ মাত্র ৫০০ টাকা! কিন্তু ২৯ জুন প্রধানমন্ত্রী যখন এ টাকা খরচের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সংসদে বক্তব্য দেন, তখন এটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এখানে অনেক প্রশ্ন, যে প্রশ্নটি তুলেছেন বিএমএ’র মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল চৌধুরী। কারা হোটেল ঠিক করল, কোন বিবেচনায় ওইসব হোটেল ঠিক করা হল, ১২ কোটি টাকার ‘হোটেল বিল’ কতটুকু যৌক্তিক- এ প্রশ্নই যমুনা টিভিকে করেছেন বিএমএ’র মহাসচিব। আমাদের এটা ভুললে চলবে না, আমাদের দেশের ডাক্তার আর নার্সরা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সম্মুখ সমরে আছেন। তাদের মনোবলকে আমরা ভেঙে ফেলতে পারি না। পরিবার থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু তাদের সামনে রেখে কিছু অসৎ লোক অবৈধ পন্থায় সরকারি অর্থের ‘ছয়-নয়’ করবেন, তা হতে পারে না। মুগদা হাসপাতালের ডাক্তারদের হোটেল বিল নিয়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে ব্যবহার করে কিছু অসৎ লোক তাদের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। এদের সামাজিকভাবে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।
যারা এসব তদন্ত করেন, তারা একবারও ভেবে দেখেছেন কি ৩০টি ভিডিও বানাতে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ হয় কিনা? অভিযুক্ত ওই প্রকল্প পরিচালককে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটাই কি সমাধান? যিনি অসৎ পথে টাকা উপার্জন করেন, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন; দুর্নীতি করবেন। এ সংক্রান্ত আইনও দুর্বল। দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যায় না। আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে এরা বের হয়ে যান। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে স্বাস্থ্য সেক্টরের দুর্নীতি উৎখাত করা যাবে না।
একটি ‘কালো দৈত্য’ স্বাস্থ্য সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করছে। যুগে যুগে এ ‘কালো দৈত্যরা’ মন্ত্রণালয়কে নিয়ন্ত্রণ করছে। গত ২০ জুন একটি সংবাদপত্রে (বাংলাদেশ প্রতিদিন) একটি মাফিয়া ডনের ছবিসহ সংবাদ ছাপা হয়েছে। এ মাফিয়া ডন স্বাস্থ্য খাতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ওই মাফিয়া ডন একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে পুরো স্বাস্থ্য সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এ মাফিয়া ডন এত শক্তিশালী যে, তার ব্যাপারে আপত্তি করায় কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পর্যন্ত সেখান থেকে চলে যেতে হয়েছে। এ সিন্ডিকেট নিয়ে কথা বলেছেন এমপি একরামুল করিম চৌধুরীও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আছে সে খবর।
৩.
বিশ্বজুড়েই করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তা বলা যাবে না। একটি আতঙ্কের খবর সম্প্রচারিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস নিউজে ৪ মে। তাতে বলা হয়েছে, আগামী দু’বছর এ ভাইরাসটি থাকবে। ৭০ ভাগ জনগোষ্ঠী পরিপূর্ণভাবে রোগমুক্ত না হলে এ মহামারীর প্রকোপ থেকেই যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা থেকেই সিবিএস এ উদ্ধৃতিটি দেয়। একই কথা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। তারা বলেছে, ভাইরাসটির সংক্রমণের ভয়াবহ ধাপটি সামনে অপেক্ষা করছে (বাংলাদেশ প্রতিদিন)। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশে এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে আমরা এক ধরনের আতঙ্কে থাকব। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভূমিকা তাই বারবার আলোচিত হতে থাকবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও আলোচনা-সমালোচনার মুখে থাকবেন। এটা তো এখন সবাই বলছেন- যদি আরও বেশি মানুষের ‘টেস্ট’ করানো যেত তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়ত। টেস্ট করানোর জন্য দরকার কিট। সেই কিট নিয়েও দুর্নীতির খবর আছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটি অসহায় পরিস্থিতির মাঝে আছেন। কিন্তু তিনি যখন সংসদে বলেন, তিনি কোটি কোটি লোককে টেস্ট করাতে পারবেন না, তখন করোনাভাইরাসকে তিনি হালকাভাবে নিয়েছেন বলেই মনে হয়। উহানে (চীন) যখন দ্বিতীয়বার কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সংবাদ প্রকাশিত হল, তখন উহানের সব নাগরিককে টেস্টের আওতায় এনেছিল চীন। বাংলাদেশে মানুষের মাঝে সচেতনতার বড় অভাব। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় কথাটা অন্যভাবে বললেও পারতেন। তার আরেকটি বক্তব্যেও ডাক্তাররা অখুশি হতে পারেন। তিনি সংসদে বলেছেন, পিপিই কীভাবে পরতে হয় এবং খুলতে হয়- এ বিষয়টি জানা না থাকায় ডাক্তাররা আক্রান্ত হয়েছেন (সূত্র বাংলা ট্রিবিউন)। ডাক্তারদের এভাবে হেয় করে বক্তব্য না দিলেও পারতেন মন্ত্রী মহোদয়। এটা ঠিক, দেশে টেস্টিং ক্যাপাসিটি বেড়েছে। ৬৮টি ল্যাব হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসার অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। অক্সিজেন সরবরাহ নেই, আইসিইউ বেড নেই, কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত নন, এমন রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না- এ ধরনের কত সংবাদ পত্রিকায় প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। সুতরাং দায়-দায়িত্ব মন্ত্রীর ঘাড়ে গিয়েই বর্তায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তিনি যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক।
কোভিড-১৯কে কেন্দ্র করে একটি অসাধু চক্র অতি মুনাফার আশায় নানা ফন্দি-ফিকিরে লিপ্ত হয়েছেন। কোভিড-১৯ মানেই যেন ব্যবসা! মানুষের মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা। যারা ভুয়া মাস্ক সরবরাহ করে, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে শুধু সফটওয়্যার তৈরি করে- এরা দেশ ও জাতির শত্রু। এরা কোনোমতেই পার পেতে পারেন না। এর রেশ ধরেই স্বাস্থ্যকর্মীদের (ডিএমসি) দু’মাসের হোটেলে থাকা ও খাওয়া নিয়ে ২০ কোটি টাকার খবর যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়, তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল পরের দিনই একটা ব্যাখ্যা দেয়া। এমন কী প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঠিক তথ্যটি পর্যন্ত ছিল না। মাত্র ৫০০ টাকা (প্রতিদিন) একজন ডাক্তারের জন্য ব্যয় হয়েছে খাওয়া খরচ বাবদ। এ হিসাবে মাসের মোট খরচ খুব বেশি নয়। কিন্তু ১২ কোটি টাকার ওপরে শুধু হোটেল ভাড়াই যদি হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। মন্ত্রী মহোদয় সঠিকভাবে তার মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতে পারছেন না বলেই অনেকের ধারণা। এ সেক্টর যতদিন পর্যন্ত না দুর্নীতিমুক্ত রাখা যায়, ততদিন মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাবে না। করোনা পরিস্থিতির সময় দুর্নীতিবাজরা যেন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এ সেক্টর সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত রাখা প্রয়োজন- এটাই হোক করোনাকালের শিক্ষা।
Jugantor
5.7.2020
0 comments:
Post a Comment