রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ডিজির পদত্যাগে সমস্যার সমাধান হবে কি?


 

বিজ্ঞাপন

তিনি ছিলেন বহুল আলোচিত ও সমালোচিত একজন ডিজি বা মহাপরিচালক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। তিনি পদত্যাগ করলেন গত ২১ জুলাই মঙ্গলবার। বলা যেতে পারে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তার এই পদত্যাগ স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় তথা স্বাস্থ্য অধিদফতরে ব্যাপক সংস্কার আসতে আদৌ কোন সাহায্য করবে কিনা? প্রশ্নটা এখন 'ওয়ান মিলিয়ন' ডলারের।

বাংলাদেশ করোনা সংকট মোকাবিলায় যখন হিমশিম খাচ্ছে, যখন জুলাই তথা শেষ দিকে এসেও করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা 'শুন্যের' কোটায় কমিয়ে আনা যাচ্ছে না, তখন স্বাস্থ্য সেক্টরের দূর্নীতিকে কেন্দ্র করেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক। মাস্ক ও পিপিই কেলেংকারী, রিজেন্ট, সাহাবুদ্দিন হাসপাতাল আর জেকেজির ভূয়া করোনা সনদের সংবাদ যখন দেশী ও বিদেশী মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে থাকলো, তখন সবার দৃষ্টি ছিলো তার দিকে। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল-জানিয়ে দিয়েছিলেন কেউ তাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারবে না। তিনি বললেন, রিজেন্টের সাথে যে যুক্তি হয়েছে, তাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের 'উর্ধতন কর্তৃপক্ষের' সম্মতি আছে। মৌচাকে তিনি ঢিল ছুড়লেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় তাকে শো-কজ করলো। তিনি এর জবাব একটি দিয়েছিলেন বটে। কিন্তু তাতে করে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় যে সুখী হয়েছিল, তা বলা যাবে না। তারপর বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়িয়ে গেল। তিনি পদত্যাগ করলেন। কিন্তু তার কি? আরেকজন মহাপরিচালক নিযুক্ত হবেন। কিন্তু স্বাস্থ্য সেক্টরকে ঘিরে হাজার হাজার কোটি টাকার যে দূর্নীতি, তার কি হবে? স্বাস্থ্য অধিদফতরের 'কালো বিড়াল'দের সবাইকে কি আমরা খুঁজে বের করতে পারবো?

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় নানা কৌশল অবলম্বন করছে। কিন্তু স্বাস্থ্য সেক্টরের ব্যাপক দূর্নীতি ও অনিয়মের খবর একের পর এক মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। এই দূর্নীতি বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। ভূয়া করোনাভাইরাস নেগেটিভ রিপোর্ট, লাইসেন্স ছাড়াই হাসপাতালে করোনাভাইরাস চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া ও সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করা, যাদের কোন অনুমতিই নেই তাদেরকে দিয়ে করোনা টেষ্টের নামে বুথ তৈরি করে নমুনা সংগ্রহ করা- সব কিছু স্বাস্থ্য সেক্টরের নানা অনিয়ম, অদক্ষতা আর দূর্নীতির চিত্রকে সামনে নিয়ে এসেছে। কিছুতেই যেন স্বাস্থ্য সেক্টরের অনিয়ম আর দূর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

রিজেন্ট হাসপাতাল আর জেকেজি নামক প্রতিষ্ঠানের ভূয়া সনদ কাহিনী নিয়ে মিডিয়া এখন সোচ্চার, সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ- স্বাস্থ্যখাতে পাঁচ বছরে সরকারের গচ্চা ২ হাজার কোটি টাকা। মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার নামে এই অর্থ আত্মসাত করা হয়েছে। ১০টি ঠিকাদারের কাছে জিম্মি গোটা স্বাস্থ্যখাত।

মিঠু, সাহেদ, সাবরিনা-আরিফ 'কাহিনী' সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে কথিত 'গডফাদার' এতোই শক্তিশালী যে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেও মিঠুরা স্বাস্থ্য সেক্টরের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করছে, কিংবা কেউ কেউ গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়িয়ে নির্বিঘ্নে থাকছেন। এরা সবাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

সাবরিনা আর আরিফ গ্রেফতার হয়েছেন। দুদক সক্রিয় হয়েছে। কিন্তু যাদের সক্রিয় হওয়ার কথা, তাদের নিষ্ক্রিয়তা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যেই স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এখন বিদায় নিলেন। কিন্তু রেখে গেলেন নানা প্রশ্ন। দুদক এখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। কিন্তু দেশের যে ক্ষতি হলো, তার কি হবে?

স্বাস্থ্য সেক্টরের এই যে দূর্নীতি, এই দূর্নীতির খবর শুধুমাত্র আজকেরই না। ৩৭ হাজার টাকায় পর্দা কেনা, ৫ হাজার টাকায় একটি করে বালিশ কেনার কাহিনী তো অনেক পুরনো। কোটি কোটি টাকায় কেনা মেডিকেল সরঞ্জামাদি বছরের পর বছর বাক্সবন্দী থেকে নষ্ট হয়ে গেছে- এ ধরনের একাধিক ঘটনার সংবাদ আমরা সংবাদপত্র থেকেই পাঠ করেছি। কিন্তু 'পর্দা ও বালিশ' কাহিনীর সাথে যারা যারা জড়িত ছিলেন, তাদের ক'জনকে আমরা দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দিতে পেরেছি?

দূদক চেয়ারম্যান মাঝে মাঝে বেশ স্পষ্ট কথা বলেন। স্বাস্থ্য সেক্টর নিয়েও তিনি মন্তব্য করেছেন। কিন্তু আমরা জানিনা স্বাস্থ্য সেক্টরের সব দূর্নীতিবাজদের আমরা শাস্তি দিতে পারবো কিনা?

সাহেদ-সাবরিনা কাহিনী নিয়ে সারা দেশে যখন তোলপাড় চলছে তখন তথাকথিত কোন জাহেরের পারিবারিক সিন্ডিকেটের খবর ছাপা হয়েছে একটি সংবাদপত্রে (দেশ রুপান্তর, ১৮ জুলাই)।

মিঠুর পাশাপাশি এই জাহেরও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঠিকাদারী নিয়ন্ত্রণ করেন। রংপুর মেডিকেল কলেজে কোনও যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই এরা হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। এটা কীভাবে সম্ভব, ভাবতেই অবাক লাগে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ২০ কোটি টাকা খরচের ব্যাপারটিও বহুল আলোচিত। ইতোমধ্যে ডিএমসির পরিচালকের একটি ব্যাখ্যাও আমরা জেনেছি। তিনি জানিয়েছেন, এই টাকা শুধুমাত্র খাওয়ার বিলই নয়, এর সাথে হোটেল ভাড়া ও যাতায়াতের খরচও জড়িত। এবং এটা ছিল ২ মাসের বাজেট।

মোট ২২৭৬ জন কর্মীর (ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান, নিরাপত্তা কর্মী) জন্য এই টাকা খরচ হয়েছে। একজন ডাক্তারের জন্য প্রতিদিনের খাবার খরচ মাত্র ৫০০ টাকা। কিন্তু ২৯ জুন প্রধানমন্ত্রী যখন এই টাকা খরচের ব্যাপারে বিষ্ময় প্রকাশ করেন এবং ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সংসদে বক্তব্য দেন, তখন এটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন, যে প্রশ্নটি তুলেছেন বিএমএ'র মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল চৌধুরী। কারা হোটেল ঠিক করলো, কোন বিবেচনায় এইসব হোটেল ঠিক করা হলো, ১২ কোটি টাকার 'হোটেল বিল' কতটুকু যোক্তিক, এ প্রশ্নই যমুনা টিভিকে করেছেন বিএমএ'র মহাসচিব।

আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের দেশের ডাক্তার আর নার্সরা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সম্মুখ যুদ্ধে আছেন। তাদের মনোবলকে আমরা ভেঙ্গে ফেলতে পারি না। পরিবার থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু তাদেরকে সামনে রেখে কিছু অসৎ লোক অবৈধ পন্থায় সরকারি অর্থের 'ছয়-নয়" করবেন, তা হতে পারে না।

মুগদা হাসপাতালের ডাক্তারদের হোটেল বিল নিয়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে ব্যবহার করে কিছু অসৎ লোক তাদের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। এদের সামজিকভাবে চিহ্নিত করে তাদের শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। কিন্তু সেই কাজটি আমরা করতে পারিনি।

করোনাভাইরাসকে সামনে রেখে প্রচারনা ভিডিও তৈরী করার জন্য এডিবি ও সরকার একটি প্রকল্প তৈরী করেছিল। সেই ভিডিও তৈরীতে ব্যয় দেখানো হয়েছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। শুধুমাত্র ভিডিও তৈরীতেই এতো টাকা! এখানেও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কি অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়া গেছে?

আরো একটি সংবাদ- বেশি দামে কিট কিনছে সরকার। করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য এই কিট ব্যবহৃত হয়। এখানেও কেনাকাটায় রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। ৭০০ টাকার কিট ২৩০০ টাকায়, এক হাজার টাকার কিট ২৭০০ টাকায় কেনা হয়েছে। প্রথম দফায় ১১৯ কোটি ও দ্বিতীয় দফায় ৫৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা বেশি দেওয়া হয়েছে। সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষধাগারই এসব কিট কিনেছে ১০টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে (দেশ রুপান্তর, ১৯ জুলাই)। কেন অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে এসব 'কিট' কেনা হলো, তার কোন উত্তর আমাদের জানা নেই।

স্বাস্থ্য সেক্টরকে যদি ঢালাওভাবে সাজানো না যায়, তাহলে একজন মহাপরিচালকের পরিবর্তন আদৌ কোন 'পরিবর্তন' সাধন করতে পারবে না। ' কালো বিড়াল'রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। তাদের সবাইকে উৎখাত, নিষিদ্ধ ও আইনের আওতায় নেওয়া জরুরী। এরা অতি ক্ষমতাবান। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সুতরাং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদত্যাগে আমাদের জন্য কোন 'মেসেজ' কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।

Sara Bangla

25.7.2020


0 comments:

Post a Comment