গত ১৫ জুন ভারতের লাদাখের সীমান্তবর্তী অঞ্চল গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের পর যে প্রশ্নটি এখন অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে এই সংঘর্ষ দুদেশের সম্পর্ককে কোথায় নিয়ে যাবে? একটি যুদ্ধ? একটি সমঝোতা? নাকি স্ট্যাটাস কো যে যে অবস্থানে আছে, তা মেনে নেওয়া? চীন ও ভারত উভয়েই উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবস্থান (১৪.১৪০ ট্রিলিয়ন ডলার) এখন দ্বিতীয় (ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে প্রথম)। পিপিপিতে জিডিপির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় ২০২২ সালে চীন বিশ্ব জিডিপির ২০.৬১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করবে, ২০২৪ সালে এই হার গিয়ে দাঁড়াবে ২১.৩৯ ভাগে। অর্থাৎ করোনা পরিস্থিতির কারণে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে না। অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবস্থান এখন ৫ম (সাধারণ), আর ক্রয়ক্ষমতা বা পিপিপির ভিত্তিতে অবস্থান তৃতীয়। ২০১৯ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.২ ভাগ, যা ২০২১ সালে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭.৪ ভাগ। করোনাভাইরাসের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা হেরফের হতে পারে। ৩.২০২০ ট্রিলিয়ন ডলারের (সাধারণ হিসেবে, পিপিপিতে ১১.৩২১ ট্রিলিয়ন ডলার) ভারতের অর্থনীতির সঙ্গে চীনের অর্থনীতির হয়তো তুলনা হবে না। কিন্তু ভারত ও চীন উভয়েই জানে একটি ‘যুদ্ধ’ পরিপূর্ণভাবে বদলে দেবে এই অর্থনৈতিক শক্তিকে। কোনো কোনো বহিঃশক্তি এটাই চাইছে। এজন্যই আমার বিবেচনায় কোনো যুদ্ধ হবে না। তবে বেশ কিছুদিন এক ধরনের ‘স্নায়বিক যুদ্ধ’ বিশ^ প্রত্যক্ষ করবে হিমালয় অঞ্চলে।
এ অঞ্চলের একটি স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে। এই স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কারণে একদিকে ভারত এ অঞ্চলের ব্যাপারে আগ্রহান্বিত হয়েছে এবং লাদাখের রাজধানী লেহ থেকে চীনের সীমান্তঘেঁষা দৌলতবেগ আলভি বিমানঘাঁটি পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ শেষ করেছে। চীনের আগ্রহের কারণ একটাই তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। লাদাখের পূর্বে রয়েছে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে চীনের ঝিন ঝিয়াং প্রদেশ। তিব্বত চীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর (১৯৫০-৫১) তিব্বতে চীনবিরোধী অসন্তোষ বাড়ছে। লাদাখের দক্ষিণে রয়েছে ভারতের হিমাচল রাজ্য। আর এই রাজ্যের ওপর চীন তার অধিকার এখনো দাবি করে আসছে। একই সঙ্গে হিমাচল রাজ্যের ধরমশালায় তিব্বতি নির্বাসিত সরকারের অস্তিত্ব রয়েছে। চীন ঝিন ঝিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে সংকটে আছে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। তাই চীন কখনোই চাইবে না ঝিন ঝিয়াং এবং তিব্বত আবারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠুক।
পশ্চিমা ইন্ধন এখানে রয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে উইঘুর মুসলমান ও তিব্বত নিয়ে একটি আইন পাসও হয়েছে। ফলে এই সীমান্ত যাতে নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে চীন। ব্রিটিশরা এ অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার সময় চীনের সঙ্গে ভারতের সীমানা চিহ্নিত করে যায়নি। এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় ছিল এই এলাকায়। এই গালওয়ানভ্যালির একদিকে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর, অন্যদিকে চীন-নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীন, যা কি না ভারত তার নিজের এলাকা বলে দাবি করে। এর উত্তরে রয়েছে সিয়াচিন হিমবাহ, যেখানে ১৯৮৪ সালে পাকিস্তান ও ভারতযুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। এই সিয়াচিন হিমবাহ ভূমি থেকে ৫৪০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত, যার স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক। সিয়াচিন হিমবাহের ৭০ কিলোমিটার এলাকা ভারতের নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বালতিস্তানের সীমান্তঘেঁষে রয়েছে সিয়াচিন। সিয়াচিন হিমবাহের পাশে অবস্থিত একটি এলাকা Shaksgam Valley পাকিস্তান চুক্তি করে চীনকে দিয়ে দিয়েছিল।
১৫ জুন গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষ হলেও ওই অঞ্চলের (পশ্চিম অংশ), অর্থাৎ লাদাখ ও আকসাই চীনের কর্তৃত্ব নিয়ে ১৯৬২ সালে ভারত ও চীন বহুল আলোচিত যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৭ সালেও সংঘর্ষ হয়েছে সিকিমের নাথু লা ও চো লা গিরিপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ১৯৯৯ সালে কারগিল (লাদাখ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত) যুদ্ধের খবর আমরা জানি। আর ২০১৭ সালে দোকলামে ভারত-চীন একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা জন্ম দিলেও, শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে, হিমালয় অঞ্চলে যুদ্ধ আর সংঘর্ষের ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে যে বিষয়টি নতুন, তা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত তথা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার শক্তি বৃদ্ধি করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও সম্প্রতি ব্রাসেলসে একটি অনুষ্ঠানে ভারত, ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, এই দেশগুলো চীনের সম্প্রসারণবাদী নীতির টার্গেট। এই দেশগুলোকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব (Live Mint, 26 June)|।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগন কংগ্রেসের কাছে ২০.১ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত বাজেট চেয়েছে চীনকে এশিয়ায় ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার জন্য। একাধিক লেখক এটা বলেছেন যে, হিমালয় অঞ্চলে উত্তেজনা থাকবে, তাতে লাভ হবে যুক্তরাষ্ট্রের। গবেষকরা দেখেছেন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে এক ধরনের ‘কনটেনমেন্ট পলিসি’ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ চীনকে ঘিরে ফেলা! এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে চীনকে ভেঙে ফেলা। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এই নীতি অবলম্বন করেছিল এবং ১৯৯১ সালে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর থেকে বিশ^ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে কর্তৃত্ব করছে। কিন্তু সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনের উত্থান মার্কিন একক কর্তৃত্বের প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। তাই চীনকে চাপে রাখা, চীনকে ঘিরে ফেলার একটি স্ট্র্যাটেজি যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। অনেকেই QUAD (Quadrilateral Security Dialogue)--এর কথা স্মরণ করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতকে নিয়ে QUAD গঠিত। গত বেশ কবছর ধরে QUAD ভারত মহাসাগরে নৌ-সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়ে আসছে। এই জোট চীনের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে একটি পক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারে।
এ ক্ষেত্রে আরও দুটি সামরিক কার্যক্রমের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। ভারত অতি-সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি করেছে। এই চুক্তি বলে প্রয়োজনে অস্ট্রেলিয়ার বিমানবাহিনী ভারতীয় বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ভারতের এমন ধরনের চুক্তি রয়েছে। এ ধরনের চুক্তি নিঃসন্দেহে হুমকি হিসেবে চীন দেখছে। চীন যখন গালওয়ান উপত্যকা নিয়ে ভারতের সঙ্গে এক ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে, তখন গত ২১ জুন চীনের সরকারি মুখপাত্র স্পেশাল টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি সংঘর্ষের ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের আওতায় রয়েছে ৩৭৫০০০ সদস্যের বিশাল বহর এবং আরও ৮৫০০০ সদস্য রয়েছে, যাদের প্রয়োজনে নিয়োজিত করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ৬০ ভাগ যুদ্ধজাহাজ এ অঞ্চলে টহলকাজে নিয়োজিত। মোট মেরিন সদস্যদের মধ্যে তিন ভাগের দুভাগ এ অঞ্চলে কর্মরত। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এই এলাকার স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব থাকায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের কর্তৃত্ব মানছে না। হংকং পরিস্থিতি, তাইওয়ানে মার্কিনি অস্ত্র বিক্রি, কভিড-১৯, বাণিজ্যযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে গালওয়ান উপত্যকায় চীন-ভারত সংঘর্ষের পেছনে ভারতকে উসকে দেওয়ার ব্যাপারে পরোক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা ইন্ধন থাকতে পারে।
সরাসরিভাবে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ইন্ধন নেই এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি মধ্যস্থতার সংবাদও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারত ও চীন উভয়ই উঠতি শক্তি। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুটি দেশই ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেট’ চাইবে না চীন ও ভারত একত্র হয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠুক। এদের মধ্যে যদি বিরোধ থাকে, তাহলে লাভবান হবে যুক্তরাষ্ট্রই। অনেক দিন ধরেই চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। চীন-ভারত উত্তেজনা ও সংঘর্ষকে যুক্তরাষ্ট্র কাজে লাগাতে চায়। তাই এশিয়ায় সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করছে ট্রাম্প প্রশাসন। ২৯ জুন ভারত ও জাপান একসঙ্গে ভারত মহাসাগরে নৌ-সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সঙ্গে তিনটি সামরিক মহড়া সম্পন্ন করেছে। এসব সামরিক মহড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনকে চাপে রাখা। ফলে স্পষ্টতই চীন-ভারত উত্তেজনার একটি আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটেছে। দক্ষিণ চীন সাগর মার্কিন নৌ-তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের এলাকার দাবি অব্যাহত রেখেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বিতর্কিত গালওয়ান উপত্যকা সফর করেছেন। সেখানে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রয়েছে। তবে উত্তেজনা আছে। একদিকে চীন, অন্যদিকে ভারত এবং পরে পাকিস্তান লাদাখ সীমান্তবর্তী পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত গিলগিট-বালতিস্তানে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে। এই সেনা সমাবেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতের ওপর ‘মনস্তাত্ত্বিক চাপ’ সৃষ্টি করা। সব মিলিয়ে গালওয়ান অঞ্চলে উত্তেজনা আছে। এই উত্তেজনা পরিস্থিতিকে কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই দেখার বিষয়।
Desh Rupantor
9.7.2020
0 comments:
Post a Comment