করোনাভাইরাস কভিড-১৯-এর খবর প্রথমবারের মতো জানাজানি হওয়ার পর সাত মাস পার হতে চলেছে, কিন্তু ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুহার কমেছে, কিন্তু নতুন করে সেখানে আবারও ভাইরাসটির বিস্তার ঘটেছে। Worldomete আমাদের জানাচ্ছে গত ২ আগস্ট পর্যন্ত সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৯২১ জনে, আর আক্রান্তের সংখ্যা ৪৭ লাখ ৬৫ হাজার ৩৪২ জন, যা বিশে^র সর্বোচ্চ। বিশে^র ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে মোট মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছে ৬ লাখ ৮৯ হাজার ৫৯০ জনে, আর আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৩ জনে। এদিকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে মোট মৃত্যুর সংখ্যা জানানো হয়েছে ৩ হাজার ৩৯৯ জন। আর আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৬০০ জন। যদিও অনেকেই বিশ^াস করেন মৃত্যুর যে সংখ্যা বলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। এর চাইতে অনেক বেশি মানুষ মারা গেছেন বলে অনেকে বিশ^াস করেন। মৃত্যুর সংখ্যা যাই হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে ৮ মার্চ প্রথম যখন বাংলাদেশে কভিড-১৯ এর মৃত্যুর খবর জানা যায়, তারপর গত ৫ মাসে করোনাভাইরাসটি আমাদের দেশে নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এটাই বাস্তবতা।
করোনাভাইরাসটি যখন নিয়ন্ত্রণে আসছে না, তখন সংগত কারণেই অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত, ৮ মাসেও বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এর অর্থ হচ্ছে সম্ভবত করোনাভাইরাসের সঙ্গেই মানব জনগোষ্ঠীকে বসবাস করতে হবে। এক সময় টিকা বা ইনজেকশনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলে হয়তো এই ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে এই ভাইরাসটি নিয়েই মানুষকে বসবাস করতে হবে। অনেকটা স্মল পক্সের মতো। Variola ভাইরাসের কারণে স্মল পক্সের ( (Smallpox)) সৃষ্টি হয়েছিল, যা ১৯৮০ সালে নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। বহুল আলোচিত স্প্যানিশ ফ্লুর কথাও আমরা বলতে পারি। ১৯১৮-১৯২০ সময়সীমায় এই স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী আকারে সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়েছিল, যাতে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫ কোটি মানুষ। এটা ছিল এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জাজনিত ভাইরাস, যা পরে নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। কভিড-১৯ এই গোত্রীয় একটি ভাইরাস। এ যাবৎকালের যতগুলো মহামারীর কথা জানা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক সময় তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সুতরাং করোনাভাইরাস কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেই আমার ধারণা। তবে এই ভাইরাসটি আর কত দিন দাপিয়ে বেড়াবে, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন।
দ্বিতীয়ত, এই করোনাভাইরাস ও এর প্রতিষেধক ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পার্টনার Astra-Zeneca plc এবং ফাইজার BioN Tech SE সম্মিলিতভাবে করোনা প্রতিরোধে একটি টিকা আবিষ্কারের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তবে এখনো যেতে হবে অনেক দূর এখনো ট্রায়াল সম্পন্ন হয়নি। ব্লুমবার্গ গবেষকদের তথ্য মতে ২০২২ সালের প্রথম কোয়ার্টারের আগে কোনো মতেই এক বিলিয়ন ডোজ-এর এই টিকা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না (আগস্ট ২, ২০২০)। টিকা আবিষ্কারের আগেই যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইইউ ও জাপান ১ বিলিয়ন ডোজ টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গেল জুন মাসেই ১৮ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছিল পরীক্ষামূলক টিকার জন্য। ২০২১ সালের জন্য তাদের বরাদ্দ ২০ মিলিয়ন ডলার। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলো কী পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে এই টিকা পাবে? এই টিকা সররবাহের ব্যাপারে গঠিত হয়েছে COVAX Initiative। ৭৫টি দেশ ইতিমধ্যে ইচ্ছা পোষণ করেছে এই উদ্যোগে যোগ দিতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ এই উদ্যোগের সঙ্গে নেই। এরা টিকা বিপণনে অর্থায়ন করবে। তবে GAVI -The Global Alliance for Vaccines and Immunization আরো একটি উদ্যোগ নিয়েছে, যারা গরিব দেশগুলোকে বিনামূল্যে টিকা সরবরাহ করবে। GAVI এর অনেক উদ্যোগ অতীতে প্রশংসিত হয়েছিল। GAVI বিশ্বের ৭৬০ মিলিয়ন শিশুকে টিকা দিয়ে তাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। বাংলাদেশ GAVI প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এখন দেখার পালা বাংলাদেশ কোন প্রক্রিয়ায় এই টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকার ট্রায়াল নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল একটি চীনা কোম্পানি Sinovac -কে সরকার বাংলাদেশে তাদের উৎপাদিত ওষুধের ট্রায়াল করার অনুমতি দেবে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল এই অনুমোদনটি দিয়েছিল (স্টার, ৩১ জুলাই)। সংবাদে এটাও জানানো হয়েছিল যে ট্রায়ালের জন্য ৪,২০০ স্বাস্থ্যকর্মীকেও নির্বাচিত করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে পরে জানানো হয় এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এর কারণ কী হতে পারে? একজন বিশেষজ্ঞ, যিনি তার নাম প্রকাশ করতে চাননি, সংবাদকর্মীদের কাছে জানিয়েছেন সিদ্ধান্তটা সঙ্গে একটা ‘রাজনীতি’ জড়িত (ওই)! আমরা আসলেই জানি না কেন চীনের কোম্পানি (বেসরকারি) Sinovac -এর ট্রায়ালের সঙ্গে ‘কোন রাজনীতি’টা জড়িত? তবে সংবাদপত্রের মাধ্যমেই আমরা জেনেছি চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান Sinopharma আরব আমিরাতে ১,৫০০ ব্যক্তির ওপর তাদের ট্রায়াল প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আবার Sinovac ব্রাজিলেও তাদের ট্রায়াল শুরু করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ব্রাজিল করোনাভাইরাসে এ যাবৎ মৃত্যুর সংখ্যা ৯৪,১৩০ জন। আর আক্রান্তের সংখ্যা ২৭,৩৩,৬৭৭ জন। সে তুলনায় আমাদের অবস্থান অনেক ভালো। চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যদি-Sinovac এর ট্রায়াল বাংলাদেশে সফল হয়, তাহলে বাংলাদেশ বিনামূল্যে এই ওষুধটি পাবে। এমনকি স্থানীয়ভাবে Sinovac বাংলাদেশেও এটি করবে ও বাজারজাত করবে এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছিল। Sinovac তাদের উৎপাদিত ওষুধের তৃতীয় স্টেজের ট্রায়াল ইতিমধ্যে জীবজন্তুর ওপর এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর প্রয়োগ করে সফলতা পেয়েছে। আমরা এখনো জানি না চূড়ান্ত পর্যায়ে Sinovac তাদের তৃতীয় স্টেজের ট্রায়াল বাংলাদেশে সম্পন্ন করবে কি না। আর শেষ পর্যন্ত যদি ট্রায়াল না-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশ একটা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন।
চতুর্থত, করোনা টিকা উদ্ভাবক, বিপণন কিংবা ব্যবহারের সঙ্গে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থের প্রশ্ন জড়িত। বিশ্বেবড় বড় ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ব্যবসায়িক স্বার্থে’ এ ধরনের ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত হয়। তাদের স্বার্থ থাকে টাকা কামানো। করোনাভাইরাসের টিকার সঙ্গে এ রকমটি হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুঁজিবাদের প্রসারের প্রশ্নটিও ফার্মাকোলজির অধ্যাপক Romeo F. Quijanoর একটি প্রবন্ধের ওপর চোখ বোলাতে পারেন। ( (Vaccination: Most deceptive tool of imperialism) । অধ্যাপক Quijanoর প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছে একটি অনলাইন পোর্টাল Bulatlat.com.পড়স-এ ১২ অক্টোবর ২০১৯ সালে। অধ্যাপক Quijano দেখিয়েছেন কীভাবে মার্কিন বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী রকফেলার ভাইরোলজিস্ট টম রিভার (Tom River)-কে ব্যবহার করে স্মলপক্সের টিকা আবিষ্কার করে ধনী হয়েছেন। উপনিবেশবাদী আমলে কীভাবে কলোনিগুলোতে পরীক্ষার নামে টিকা প্রয়োগ করে ‘বিগ ফার্মা’ বা তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছিল, সে তথ্যও আছে। অন্যদিকে, GAVI’র কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। সঙ্গে জড়িত বিল গেটস ও ম্যালিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন (BMGF) | BMGF GAVII-তে অর্থায়ন করে, যারা উন্নয়নশীল বিশে^ (ভারত) টিকা সরবরাহ করে শিশুদের জন্য। যাতে করে প্রাণঘাতী কয়েকটি রোগ থেকে শিশুরা রক্ষা পায়। এঅঠও-তে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানি না BMGF মার্কিন ওষুধ তৈরি কোম্পানি Merck & Co.-এ ২০৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল। একই সঙ্গে ফাইজার ও জনসন অ্যান্ড জনসন এও তাদের বিনিয়োগে আছে, যারা টিকার গবেষণায় নিয়োজিত। অর্থাৎ এখানে এসে যায় লাভের প্রশ্নটি। এইসব বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ওষুধ আবিষ্কার ও ব্যবহারের নামে আপনাদের মতো দেশে এক ধরনের ‘শোষণ’ চালায়। কলোনিয়াল যুগেও এ-রকমটি ছিল।
এ জন্যই বলা হয়, ‘Vaccine Imperialism’ এর কথা। আজ যখন কভিড-১৯ নিয়ে ১৬০টি ভিন্ন ধরনের ওষুধ নিয়ে বিভিন্ন স্তরে গবেষণা চলছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে, তখন তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ কেউ যে প্রশ্ন তুলবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে এখন অবধি কোনো কোম্পানির টিকাই কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত নয় (ব্লুমবার্গ, ২ আগস্ট)। সুতরাং যে কোনো ধরনের ট্রায়ালের নামে আমাদের ‘গিনিপিগ’ বানানো হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নও কেউ কেউ তুলছেন।
পঞ্চমত, কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারটির সঙ্গে একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রশ্নটি সরাসরি জড়িত। এ প্রসঙ্গে জনস্্ হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়ের GHS Index-এর কথা উল্লেখ করতে পারি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে ২০১৯ অক্টোবরে এই সূচক প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে ১৯৫টি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে (৬টি ক্ষেত্রে)। এক্ষেত্রে দেখা যায় Prevention বা রোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশের স্কোর ২৭.৩ (অবস্থান ১১৬), দ্রুত রোগ চিহ্নিতকরণে ৫০.৯ (৫৯), রোগ বিস্তার রোধে দ্রুত ব্যবস্থাপনা ও প্রশমনে ২৩.১ (১৬৫), স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তায় ১৪.৭ (১৩২), স্বাস্থ্যসেবা উন্নতকরণে আগ্রহ ও অর্থায়নে ৫২.৫ (৭৪), পরিবেশগত ঝুঁকি ও জৈব নিরাপত্তায় ৪৪.০ (১৪২)। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের স্কোর ৪৪.০ (অবস্থান ১৪২)। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের অবস্থা যে ভালো, এই গবেষণা তা প্রমাণ করে না। সুতরাং করোনাভাইরাস মোকাাবিলায় এই বিষয়গুলো আমাদের বিচেনায় রাখতে হবে।
Desh Rupantor
10.8.2020
0 comments:
Post a Comment