রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যৎ কোন পথে

 

 

রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যৎ এখন কোন পথে? সারা বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস নিয়ে উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার জীবন একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ২০১৭ সালে যে ‘রোহিঙ্গা ঢল’ এ অঞ্চলের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল, গত ২৫ আগস্ট ছিল তার তৃতীয় বার্ষিকী। অর্থাৎ বর্তমান সংকট তিন বছর পার করে চার বছরে ‘পা’ দিল। কিন্তু বিশ্ব এই তিন বছরে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেনি। 

এটা ঠিক, রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালে যে গণহত্যা ও নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সে ব্যাপারে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’ বা ‘আইসিজে’ একটি রায় দিয়েছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু ওই রায় সংকট সমাধানে কোনো বড় ভূমিকা পালন করতে পারেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি চুক্তিও হয়েছিল মিয়ানমারের সঙ্গে। কিন্তু এ ব্যাপারেও কোনো অগ্রগতি নেই। বরং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গেল জুন মাসেও রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবর দিয়েছে আল-জাজিরা। এক প্রতিবেদনে তারা আমাদের জানিয়েছে, রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০০ রোহিঙ্গা বসতি পুড়িয়ে দিয়েছে। ফলে তারা বাধ্য হয়েছে রাখাইন ত্যাগ করতে। আরেকটি খবরে দেখা গেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তিনজন সেনা সদস্যকে রাখাইনে ঘটনাবলির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কোর্ট মার্শাল করে শাস্তি দিয়েছে। 
যদিও এদের নামপরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি যখন আরও অবনতি ঘটেছে, তখন গত ২৯ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন। ওই ফোনালাপে তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রকাশিত এই ঘটনা কতগুলো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। 

এক. গেল ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত এক সিদ্ধান্তে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের নিন্দা জানানো হয়েছিল (নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৮ ডিসেম্বর) কিন্তু নতুন করে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে মিয়ানমার সাধারণ পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তকে আদৌ কোনো গুরুত্ব দেয়নি। 

দুই. রোহিঙ্গা সংকট একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। আর তা হচ্ছে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার বারবার বলে আসছে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন। সর্বশেষ আসিয়ান নেতাদের টেলি সম্মেলনেও মিয়ানমারের প্রতিনিধি একই কথা বলেছেন। এর অর্থ সারা বিশ্বের মতামতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। 

তিন. মিয়ানমারের কৌশল হচ্ছে রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করা। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের জমি এখন চীন ও জাপানি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে। রাখাইনে চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে (Kyaukphyu), যেখান থেকে দেশটি বঙ্গোপসাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ওপর নজর রাখতে পারে। এখানে চীনের স্বার্থ অনেক বেশি। সুতরাং চীন কখনোই মিয়ানমারের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেবে না। রোহিঙ্গামুক্ত রাখাইনে চীন তার স্বার্থকে বড় করে দেখছে। 

চার. গেল ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’ বা ‘আইসিজে’ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছিল। তাতে রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধ, কোনো সামরিক ব্যবস্থা না দেওয়া, আলামত নষ্ট না করা, আদালতে চার মাস অন্তর রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। আদালতের আদেশ মিয়ানমার মানছে না। তিনজন সেনা সদস্যের বিচার লোক দেখানো। আইসিজের আদেশ মিয়ানমারকে বাধ্য করেনি রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে এবং তারা নেবেও না। 

পাঁচ. আসিয়ান শীর্ষ টেলি কনফারেন্সে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেড়ে যাবে এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠী এদের সন্ত্রাসী কর্মকন্ডের জন্য রিক্রুট করবে। এ ধরনের আশঙ্কাকে ফেলে দেওয়া যায় না। এতে করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। 

ছয়. রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ছে এবং মৃত্যুর খবরও রিপোর্ট হয়েছে। এই ঘটনা বাংলাদেশের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এই সুযোগটি নিয়েছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি এখন ‘ডিপ ফ্রিজে’ চলে গেছে। 

মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। এ বিষয়টি আমরা বারবার বলে এলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এমনকি বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে চীন ও ভারত। চীন ও ভারতের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা এর কোনো ফল পাইনি। 

চীনের পাশাপাশি ভারতেরও বিনিয়োগ রয়েছে মিয়ানমারে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরের সময়ও মিডিয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের সাহায্যের প্রশ্নটি উঠেছিল। কিন্তু আশ্বাসসের মধ্যেই তা থেকে গেছে। ভারতের বড় স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইন স্টেটে যেখানে রোহিঙ্গা সংকটের জন্ম, সেখানে ভারতের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। ভারতের ‘কালাদান মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের’ কথা অনেকেই স্মরণ করতে পারেন। এই প্রজেক্টের আওতায় ভারত রাখাইন স্টেটের সিটওয়েতে (Sittw) একটি গভীর সমুদ্রবন্দর ও অভ্যন্তরীণ নৌ-টার্মিনাল নির্মাণ করছে। ভারতের এখানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৮৪ মিলিয়ন ডলার। এই প্রজেক্টের কাজ শেষ হলে সমুদ্রপথে কলকাতার সঙ্গে রাখাইনের সিটওয়ের (একসময়ের আকিয়াব) সংযুক্ত হবে। ভারত অনেক আগেই এই প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে এই সমুদ্রবন্দর (সিটওয়ে) ভারতের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতা থেকে পণ্য পরিবহনে (সাত বোন রাজ্যে) এই রুটটি ব্যবহৃত হবে। কালাদান নদীর মোহনায় এটি অবস্থিত বিধায় এটা ‘কালাদান প্রজেক্ট’ হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। এটা সম্পন্ন হলে নদীপথে সিটওয়ের সঙ্গে মিয়ানমারের চিন স্টেটের পালেটওয়া (Paletw) বন্দরকে সংযুক্ত করবে। এরপর সড়ক পথে পালেটওয়া সংযুক্ত হবে মিজোরামের জরিনপুই (Zorinpui) এর সঙ্গে। এই প্রজেক্টটি সম্পন্ন হলে একদিকে মিয়ানমার-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে সাত বোন রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। সুতরাং ভারতের বড় স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। 

ভারতের ‘Act East Policy’র গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে মিয়ানমার। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। চলতি বছরই ভারতের অর্থনীতি পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হবে ও ২০২৫ সালের মধ্যে বিশে^র তৃতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ভারতের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করছে। মিয়ানমারে ভারতের বিনিয়োগ দেশটিকে ১১তম বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে পরিণত করেছে। ভারতের ৩০টি কোম্পানির সেখানে বিনিয়োগর পরিমাণ ৭৬৩ মিলিয়ন ডলার (চীনের বিনিয়োগ ২০ বিলিয়ন ডলার)। মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেও, মিয়ানমারের বিশাল তেল ও গ্যাস রিজার্ভ দেশটিকে পশ্চিমা বিশে^র কাছে একটি আকর্ষণীয় দেশে পরিণত করেছে। ভারতও এই প্রতিযোগিতায় আছে। সুতরাং রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের সিদ্ধান্ত মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যাবে বলে মনে হয় না। কূটনৈতিকভাবে ভারত রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে আছে। কিন্তু বড় কোনো ভূমিকা পালন করছে না। 

এ অবস্থায় আগামীতে সব রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে যাবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। হয়তো কিছু রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নেবে। কিন্তু বড় অংশই রয়ে যাবে। আর এ কারণেই বাটিল লিন্টনার  Asia Times-এ লিখেছেন, ‘Rohingya refugees becoming Palestinians of Asia’ ফিলিস্তিনিদের মতো ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা! এই আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। মিয়ানমারের অসহযোগিতা, আন্তর্জাতিক মতামতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ও রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন এই সংকটকে আরও জটিল করেছে। এ থেকে বের হওয়ার পথ মিয়ানমারকেই বের করতে হবে।

Desh Rupantor

1.9.2020

0 comments:

Post a Comment