লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশির মৃত্যুর করুণ কাহিনি গত ৩০ মে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোয় ছাপা হয়েছে। লিবিয়ার মিজদা শহরে এ ঘটনাটি ঘটে। হতভাগ্য ব্যক্তিরা সবাই লিবিয়া থেকে ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। মানবপাচারকারীরা তাদের বিভিন্ন রুট দিয়ে ইউরোপে পৌঁছে দেবে বলে লিবিয়ায় নিয়ে যায়।
বেশ কিছুদিন ধরেই মানবপাচারকারীদের কাছে লিবিয়া হচ্ছে একটি ট্রানজিট পয়েন্ট, যেখান থেকে ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালিতে পাচার করানো সহজ। ভূমধ্যসাগরের একপাড়ে লিবিয়া, অপরপাড়ে ইতালি। পাচারকারীরা এ সুযোগটিই গ্রহণ করে। তারা মধ্য-ভূমধ্যসাগরীয় রুট ব্যবহার করে সাধারণ নৌকায় বিভিন্ন দেশ থেকে আনা লোকদের তুলে দেয়। সাগর পাড়ি দিয়ে নৌকা এক সময় ওপারে যায়। সমুদ্র পথে দূরত্ব মাত্র ৫৮১ নটিক্যাল মাইল। অনেক সময় ইতালির কোস্টগার্ডদের হাতে কেউ কেউ ধরা পড়ে। একবার ইতালির সীমানায় পৌঁছালেই হলো। তারা তখন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হয়ে যায়। এর পরের খরচ সব ইতালি সরকারের।
পাচারকারীরা তাদের স্বপ্ন দেখায় ইতালি মানেই ইউরোপ আর স্বপ্নের বসবাস। পাচারকারীরা কখনই এ দুর্গম পথে সাগর পার হওয়ার কাহিনি শোনায় না। সাগর অনেক সময় বিক্ষুব্ধ থাকে। সমুদ্রঝড়ের মধ্যেও পড়তে হয়। নৌকা মাঝসাগরে নষ্ট হয়ে যায়। তার পর ভাসতে থাকে সাগরে দিনের পর দিন।
এ ধরনের শত শত ঘটনার কোনো কোনো ঘটনা সংবাদপত্রে ছাপা হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছাপা হয় না। গত বছরে এই সমুদ্র রুট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ ইউরোপ গেছে। এ পথে ইতালি, গ্রিস ও স্পেনও যাওয়া যায়। ইতালি সবচেয়ে কাছের। তাই পাচারকারীরা ইতালিকেই প্রথম পছন্দ করে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মতে, ইউরোপের পাচার হওয়া মানবসন্তানদের শতকরা ৮২ ভাগ এই লিবিয়া রুট ব্যবহার করেছিল। পাচারকারীরা বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তানসহ আফ্রিকা থেকে শত শত মানবসন্তানদের প্রধানত তুরস্ক নিয়ে আসে। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। তার পর ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তুলে দেওয়া হয় ভূমধ্যসাগরে। ২০১৭ সালে আইওএমএর (ওঙগ) তথ্য মতে, ৩ হাজর ১০৮ জনের সাগরে মৃত্যু ঘটেছিল।
পাঠক, নিশ্চয় স্মরণ করতে পারেন ২০১৫-১৬ সালে লাখ লাখ সিরিয়ার নাগরিকদের ইউরোপে আশ্রয় নেওয়ার কাহিনি। ইউরোপের পথেঘাটে, জঙ্গলে শত শত সিরীয় নাগরিকের উপস্থিতি ওই সময় আন্তর্জাতিক সংবাদে পরিণত হয়েছিল। তাদের প্রায় সবাই এই সমুদ্র রুট ব্যবহার করেছিল। পরবর্তী ক্ষেত্রে এই রুটে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও মানবপাচার থামেনি। তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০০৮ সালে লিবিয়ার ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর পরই লিবিয়া মানবপাচারকারীদের জন্য আকর্ষণীয় স্পট পরিণত হয়।
তবে সম্প্রতি লিবিয়ার পরিস্থিতি ভালো নয়। সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের কাছে তা গুরুত্ব পায়নি। কেননা তারা ইতোমধ্যেই লিবিয়ার স্থানীয় ওয়ার লর্ডদের সঙ্গে একটা সখ্য গড়ে তুলেছে। অতি সম্প্রতি লিবিয়ার পাশাপাশি সুদানও পাচারকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশিরা এই সুদান রুটটি ব্যবহার করছে। একটা অবৈধ ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়ে বাংলাদেশিদের সুদানে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর তাদের সুদান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ার বেনগাজি। সুদান থেকে তাদের ট্রাকে করে সীমান্ত পার করে লিবিয়ায় ঢোকানো হয়। বাংলাদেশিরা এ পথেই লিবিয়ায় ঢুকছেন। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এই তথ্যগুলো জানি না। লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশির মৃত্যুর পর আমরা এখন জানলাম।
অনেক ক্ষেত্রই পাচারকারীরা লিবিয়ায় নিয়ে আসা যাত্রীদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে। নিহত হতভাগ্য যাত্রীদের ক্ষেত্রে এবার এমনটি হয়েছে। নিহত বাংলাদেশিরা প্রায় তিন মাস আগে লিবিয়ায় পৌঁছেছিলেন। তারা জেলেও ছিলেন। জেল থেকে ওই পাচারকারীরা তাদের ছাড়িয়ে আনে। টাকার জন্য তাদের জিম্মি করে। একপর্যায়ে ওই আফ্রিকান পাচারকারীকে জিম্মিরা হত্যা করে। আর এর প্রতিশোধ হিসেবেই বাংলাদেশি তথা আফ্রিকার কয়েক নাগরিককে হত্যা করা হয়। এই মৃত্যুর ঘটনা কয়েকটি প্রশ্নকে এখন সামনে নিয়ে এলো।
এক. এই পাচার প্রক্রিয়া আজ নতুন নয়। বহুদিন ধরে এভাবে পাচারচক্র বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে মানুষ পাচার করছে। যাদের পাচার করা হয়, তাদের ইউরোপের স্বপ্ন দেখানো হয়। বলা হয় স্পেন ও ইতালিতে কৃষিকাজে লোক লাগবে। ওখানে পৌঁছাতে পারলেই এক সময় অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়া হবে। এ ফাঁদে পড়েই হতভাগ্যরা লিবিয়া গিয়েছিলেন। এখন আমাদের জানা দরকার কারা তাদের বাংলাদেশ থেকে রিক্রুট করেছিল? কোন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে তারা সেখানে গিয়েছিল? তাদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হয়, তা হলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে। সুতরাং এই মুহূর্তে যা দরকার, তা হচ্ছে নিহত পরিবারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাচারকারীদের এ জোটগুলোর খুঁজে বের করা ও তাদের আইনের আওতায় আনা। ইতোমধ্যে হাজী কামাল নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর সঙ্গে আরও লোকজন জড়িত আছে তাদেরকেও গ্রেপ্তার করতে হবে।
দুই. এসব হতভাগ্য বাংলাদেশিরা ভুয়া ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেখিয়ে সুদান গিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগের কর্মকর্তাদের দৃষ্টি এড়ালেন কীভাবে? তারা তো জানতেন, সুদানে কাজের কোনো সুবিধা নেই। সেখানেও গৃহযুদ্ধ চলছে। এত লোক ভুয়া ডকুমেন্ট দেখিয়ে বিমানবন্দর পার হলো, কেউ এটা বুঝতে পারল নাÑ এটা হতে পারে না। এর অর্থ হচ্ছে, ওই পাচারকারীদের সঙ্গে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন অফিসারদের সখ্য আছে। তারাই বিমানরবন্দরে উপস্থিত থেকে হতভাগ্য যাত্রীদের বিমানবন্দর পার করে দেন। সুতরাং ওইদিন কোন কোন কর্মকর্তা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
তিন. বাংলাদেশে কিছু অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে এই তথ্য থাকার কথা। তা হলে প্রশ্ন ওঠে ওইসব অসাধু এজেন্সির বিরুদ্ধে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিলাম না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা দরকার।
চার. পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, তারা এই হত্যকা-ের জন্য লিবিয়া সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ ও দোষী ব্যক্তিদের বিচার চাইবেন। বিষয়টি অনেকটাই হাস্যকর। কেননা এই মুহূর্তে লিবিয়ায় কার্যত কোনো সরকার নেই। ত্রিপোলিতে যে সরকার আছে এবং যা জাতিসংঘ স্বীকৃত, ওই সরকারের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। জেনারেল হাফতারের বাহিনী যে কোনো সময় ত্রিপোলি দখল করতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশ কার কাছে ক্ষতিপূরণ চাইবে? কে ক্ষতিপূরণ দেবে? এই বক্তব্য লোক দেখানো। বরং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের জনগণকে সতর্ক করা তারা যেন লিবিয়ায় না যান। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ কাজটি করা যেত। তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেনি। ত্রিপোলিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশি নাগরিকদের রক্ষায় তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এসব অদক্ষ লোকদের দিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা যাবে না।
পাঁচ. হতভাগ্য নাগরিকদের একটি তালিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি এসব পরিবারকে কিছুটা ক্ষতিপূরণ দেয়, তা হলে নিঃসন্দেহে ওইসব পরিবারে কিছুটা হলেও সান্ত¦না পাবে।
ছয়. আহত ১১ বাংলাদেশি এখন লিবিয়ায় চিকিৎসাধীন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা।
হতভাগ্য বাংলাদেশি নাগরিকরা একটি স্বপ্নের আশায় লিবিয়া গিয়েছিলেন। পাচারকারীরা তাদের ইউরোপের চাকচিক্যময় জীবনের গল্প শুনিয়েছিল। যুগ যুগ ধরে মানুষ অভিবাসী হয়েছে। কিন্তু এবারের গল্পটা ভিন্ন। সুতরাং ইউরোপের চাকচিক্যময় জীবন যে তাদের শেষযাত্রা হতে পারে, ২৬ বাংলাদেশির মৃত্যু তা প্রমাণ করল। এ পথে বিভ্রান্ত হয়ে বাংলাদেশিরা আর যাতে ওই পথে পা না বাড়ান, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া আজ সবার প্রয়োজন। সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি। আর এ কাজটি করতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কেই।
Amader Somoy
2.6.2020
0 comments:
Post a Comment