তারেক শামসুর রেহমান ২৬ জুলাই ২০২০, ১২:০০ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. আবুল কালাম আজাদ শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেছেন। এটা ছাড়া তার কোনো গত্যন্তর ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে তার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। তিনি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন, আর তা চাপিয়ে দিতেন অন্যদের ঘাড়ে। তিনি উৎসাহী হয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন হাসপাতালটির লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও এবং কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত না হওয়ার পরও।
জেকেজি নামে একটি প্রতিষ্ঠানেরও অনুমোদন ছিল না সনদ দেয়ার। রিজেন্ট যেমন টাকার বিনিময়ে করোনা ‘নিগেটিভ’ সনদ দিয়েছে, একই ধরনের সনদ দিয়েছে জেকেজিও। প্রতিটি ক্ষেত্রে ডা. আজাদের ব্যক্তিগত ভূমিকা আজ বিতর্কিত। শুধু তা-ই নয়, স্বাস্থ্য সেক্টরের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির সঙ্গে তার নাম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। এক মাস ধরে স্বাস্থ্য অধিদফতর নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি, প্রশাসনিক অদক্ষতা, মন্ত্রণালয় তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের একাধিক সংবাদ ছাপা হয়েছে। তিনি চাপের মুখে ছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিবের বক্তব্যও তার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করলেন, যদিও এর আগে তিনি বলেছিলেন তাকে চাকরিচ্যুত করার অধিকার কারোরই নেই। তার সেই দম্ভোক্তি এখন আর থাকল না। তার পদত্যাগের পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন ডিজি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদফতর নিয়ে যে নানা ‘বিতর্ক’, ডিজির পদত্যাগ এবং ব্যক্তির পরিবর্তন তার অবসান ঘটাবে কি?
দুঃখজনক হচ্ছে, দুর্নীতি থামানো যাচ্ছে না। একটি সংবাদ- বেশি দামে কিট কিনছে সরকার। করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য এ কিট সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। এখানেও কেনাকাটায় রয়েছে একটি বড় সিন্ডিকেট। ৭০০ টাকার কিট ২ হাজার ৩০০ টাকায়, ১ হাজার টাকার কিট ২ হাজার ৭০০ টাকায় কেনা হয়েছে। প্রথম দফা কেনায় ১১৯ কোটি টাকা ও দ্বিতীয় দফায় ৫৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা বেশি দেয়া হয়েছে। সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষধাগারই এসব কিট কিনেছে ১০টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে (দেশ রূপান্তর, ১৯ জুলাই)। কেন অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে এসব কিট কেনা হল, তার কোনো সুস্পষ্ট জবাব কারও কাছেই নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কিংবা কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালকও এর জবাব এড়িয়ে গেছেন। সরকারি টাকার এই যে ‘নয়ছয়’- এর শেষ কোথায়? দুর্নীতির রেশ কেন টানা যাচ্ছে না? তাহলে কি এভাবেই মাসের পর মাস, বছরের পর বছর স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্নীতি চলতে থাকবে?
আমাদের আতঙ্কের জায়গাটা হচ্ছে, ‘অতি ক্ষমতাবানদের’ কারণে স্বাস্থ্য সেক্টরের এ দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫২ হাজার কোটি টাকা এখন যাচ্ছে করোনা মোকাবেলায়। এখানে যে দুর্নীতি হবে না, তার গ্যারান্টি আমাদের কে দেবে? এদিকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা করোনা টেস্টের সনদ জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে (কালের কণ্ঠ)। তিনি যে জেকেজির কাছ থেকে প্রতি মাসে মাসোহারা নিতেন, তার প্রমাণও পেয়েছে পুলিশ। এখানে তিনি দুটো অপরাধ করেছেন। প্রথমত, তিনি ভুয়া করোনা সনদ দিয়ে অন্যায় করেছেন এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের জন্য দায়ী। দ্বিতীয়ত, তিনি সরকারি চাকরি করে জেকেজি থেকেও টাকা নিতেন। এটা সরকারি চাকরি বিধির পরিপন্থী। তাকে তার কর্মস্থল থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। এবার অন্তত একটা সুযোগ এসেছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ‘কালো বেড়াল’রা দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয়। এদের বিরুদ্ধে কখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। রিজেন্ট হাসপাতালের সনদ কেলেঙ্কারি নিয়েও অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার বিতর্কেরও অবসান হয়নি। একজন আরেকজনের ওপর দোষ চাপিয়েছিলেন। মন্ত্রী বাহাদুরও এ কেলেঙ্কারিতে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু তার নেতৃত্বেই তো মন্ত্রণালয় পরিচালিত হয়। তিনি দায় এড়াতে পারেন না।
এতসব হতাশার মাঝেও একটি আশার খবর- রিজেন্ট কেলেঙ্কারির রেশ ধরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজিসহ এক ডজন কর্মকর্তাকে ডাকবে দুদকে। সারা জাতি তাকিয়ে আছে দুদকের দিকে। শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করেই যদি দুদকের কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করেন, তাহলে আমাদের হতাশার জায়গাটা আরও বেড়ে যাবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ঘিরে যে দুর্নীতি, তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা সংবাদ কর্মীদের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। করোনা মোকাবেলায় সরকারের সব উদ্যোগ ভেস্তে যাবে, যদি না আমরা ওইসব দুষ্কৃতকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারি। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যেন শাস্তির ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কথাটাই আমাদের বলেছেন। আমরা এর বাস্তবায়ন দেখতে চাই। মহাপরিচালক পদত্যাগ করেছেন। হাসপাতালের যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তাকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এতে করে কি তাদের ‘পাপের’ মুক্তি হল? সাহেদ অপরাধ করেছেন। তাই তিনি আজ জেলে। সাবরিনাও চিকিৎসা শাস্ত্রে তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে কুড়াল মেরে আজ জেলে আছেন। তাহলে সেই একই ধরনের ‘অপরাধ’ করে আজাদরা জেলের বাইরে থাকেন কী করে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ প্রশ্নটাই করেছেন অনেকে। আমার কাছে এর কোনো জবাব নেই। তবে আমি বুঝি রাষ্ট্র নাগরিকদের মাঝে কোনো পার্থক্য করতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান- এ ক্ষেত্রে সাহেদ, সম্রাট, শামীমের সঙ্গে আজাদদের কোনো পার্থক্য নেই। হাজার হাজার কোটি টাকার ‘নয়ছয়’-এর কাহিনী এখন সংবাদপত্রে। ডা. আবুল কালাম আজাদ ১০ বছরের ওপরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। দুদক তাদের সবাইকে ডেকেছে। দুদক নিশ্চয়ই তার এবং তার সহকর্মীদের সবার সম্পত্তির হিসাব চাইবে। দুদকের ওপর আমি আস্থাটা রাখতে চাই। দুদক এবার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার জানতে ইচ্ছা করে গত ১০ বছরে আজাদ-আমিনুলদের সম্পত্তি বেড়েছে, না কমেছে? তিনি ট্যাক্স ফাইল করেন। নিশ্চয়ই তার ফাইলে সম্পত্তির সব হিসাব দেয়া হয়েছে। একজন সিনিয়র নাগরিক হিসেবে নিশ্চয়ই তিনি কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না- এটা আমি প্রত্যাশা করতেই পারি। তিনি একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, একজন ‘অধ্যাপক’। একজন ‘অধ্যাপকের’ কাছে আমার এ প্রত্যাশা তো থাকবেই। আরও একটি কথা, একসময় আমাদের ধারণা ছিল, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর শুধু ডাক্তারদের দ্বারাই পরিচালিত হবে। এখন দেখলাম ডাক্তাররা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন না। তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং আমলারাই চালান মন্ত্রণালয়। সেটাই বরং ভালো। ডাক্তারদের ওপর আস্থাটা আর রাখতে পারছি না।
আরও একটা কথা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের (স্বাচিপ) কিছু নেতার চাপে তারা জেকেজিকে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিলেন (প্রথম আলো)। অথচ এর কোনো ফাইল পাওয়া যায়নি। এটা একটা বড় অপরাধ। এর জন্য স্বাচিপের কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা অধিদফতরে নিষিদ্ধ করা হোক এবং সেই সঙ্গে নাসিমা সুলতানাকেও পদত্যাগ করতে বলা হোক। স্বাস্থ্য সেক্টরের সর্বত্র ‘কালো বেড়াল’রা লুকিয়ে আছে। ডিবির দায়িত্ব হচ্ছে এদের খুঁজে বের করা। শুধু একজন আবুল কালাম আজাদ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তা আমার মনে হয় না। আমার ধারণা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিচ থেকে উপরে প্রতিটি পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তাদের অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত। অনেকেই জানতেন রিজেন্টের লাইসেন্স নেই। জেকেজির অনুমতি নেই। তারা তথ্য গোপন করেছেন। এ কারণে তারা অপরাধী। একজন মিঠু কিংবা একজন বেঙ্গল জাহের একা হাজার কোটি টকার দুর্নীতি করতে পারেন না, যদি না তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ‘সহযোগিতা’ পেয়ে থাকেন। এই ‘সহযোগীদের’ এখন খুঁজে বের করা দরকার। করোনা মোকাবেলায় নিজেদের জীবন বাজি রেখে স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন কাজ করছেন, তখন এন-৯৫ মাস্কের নামে ভুয়া মাস্ক সরবরাহ করা, ভুয়া সনদ দিতে ‘উৎসাহিত’ করা- এসব অপরাধের সাধারণ আইনে বিচার না করে বিশেষ আইন এবং বিশেষ আদালতের মাধ্যমে বিচার করা উচিত। সাহেদ, সাবরিনা, আরিফরা গ্রেফতার হয়েছেন। এতে করে তাদের ‘অপরাধ’ ক্ষমা করা যায় না। সময় এসেছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে ‘জিরো টলারোন্সে’র কথা বলা হয়, তা প্রমাণ করার। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিশাল অর্থ ব্যয় করা হয় স্বাস্থ্য সেক্টরে। এ অর্থ ‘উইপোকারা’ খেয়ে ফেলবে, তা তো হতে পারে না! দুর্নীতি এ সরকারের সব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে যে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। না হলে সাময়িক বিরতি দিয়ে দুর্বৃত্তরা আবারও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সক্রিয় হবে।
স্বাস্থ্য সেক্টরকে যদি ঢালাওভাবে সাজানো না যায়, তাহলে একজন মহাপরিচালকের পরিবর্তন আদৌ কোনো ‘পরিবর্তন’ সাধন করতে পারবে না। ‘কালো বিড়াল’রা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। এদের সবাইকে উৎখাত, নিষিদ্ধ ও আইনের আশ্রয়ে নেয়া জরুরি। এরা অতি ক্ষমতাবান। ধরাছোঁয়ার বাইরে। সুতরাং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদত্যাগ আমাদের জন্য কোনো ‘মেসেজ’ কি না, সেটাই দেখার বিষয়। এখন একটি ‘সুযোগ’ এসেছে, এই ‘সুযোগ’কে কাজে লাগানো প্রয়োজন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা এ মুহূর্তে জরুরি
Jugantor
26.7.2020
0 comments:
Post a Comment