জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন তার দায়িত্ব
গ্রহণের একমাস পার করলেন আজ। শিক্ষক ও ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সাবেক
উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং গত ২০
মে অধ্যাপক হোসেন জাবির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন। গত এক মাসে অধ্যাপক
হোসেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেননি বটে; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আবার
অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এতদিন আন্দোলনে ছিলেন শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
এবারে আন্দোলনে নেমেছে কর্মচারীরা। পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে সদ্য নিয়োগ পাওয়া
একজন শিক্ষক ও কয়েকজন শিক্ষার্থী জনৈক ঊর্ধ্বতন সহকারীকে লাঞ্ছিত করায়
তারা আন্দোলনে নেমেছেন। তারা এই শিক্ষকের বিচারও দাবি করেছেন। এ নিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয় এখন উত্তপ্ত। এ ঘটনায় উপাচার্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।
এদিকে সাবেক উপাচার্যের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরা 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা'
নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসেনের বিচার দাবি করে
আসছেন। আর 'শিক্ষক সমাজ' নতুন করে আন্দোলনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছে।
তাই সঙ্গত কারণেই নয়া উপাচার্যের জন্য দিনগুলো মোটেই ভালো নয়। একটি দাবি
উঠেছিল, নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ব্যাপারে একটি 'রিভিউ কমিটি' গঠন করার।
'শিক্ষক সমাজ' এর দাবি ছিল এটি। জাবির নয়া প্রশাসন এখন একটি 'রিভিউ কমিট'
গঠন করতে পারেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষককে দিয়ে এই কমিটি
গঠন করলে, তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মুঞ্জরি কমিশনের
একজন সদস্যকে দিয়ে এই 'রিভিট কমিটি' গঠন করা উত্তম। না হলে আন্দোলনকারীদের
আস্থায় নেয়া যাবে না এবং নয়া প্রশাসন তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারবে
না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার স্বার্থেই এই কাজটি করা
জরুরি। একই সঙ্গে দুর্নীতির বড় অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয়
শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে
যে, শিক্ষক নিয়োগসহ কর্মচারী নিয়োগে লাখ লাখ টাকা হাতবদল হয়েছে। অভিযোগ
উঠেছে, কর্মচারী নিয়োগে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা
বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। তাদের অনেকেই সাবেক ভিসির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। গত ৪ মে
দৈনিক যুগান্তরের শেষের পাতায় প্রকাশিত হয়েছে, জাবিতে চাকরি দেয়ার নাম করে
৪০ লাখ টাকাসহ জনৈক জসিমুদ্দিনকে আশুলিয়া পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা
হয়েছে। ওই ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তা জড়িত
রয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার
স্বার্থেই দুদককে দিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত করা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়,
'শিক্ষক সমাজ' ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটা দাবি ছিল, যেসব ছাত্র সাংস্কৃতিক
কর্মী বিগত প্রশাসন দায়িত্ব নেয়ার পর ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল,
তাদেরকে ক্যাম্পাসে, তাদের নিজস্ব হলগুলোতে তুলে দিয়ে তাদের নিরাপত্তা
নিশ্চিত করা। ছাত্রলীগের মূল ধারাটি ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত। এদেরকে
ক্যাম্পাসে ফিরে আসার স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য ছাত্র
সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে ক্যাম্পাসে অবস্থান করা ও তাদের মাঝে সহাবস্থান
নিশ্চিত করা এই মুর্হূতে জরুরি। নয়া প্রশাসন এই কাজটি করলে, তিনি তার
গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারবেন। জাহাঙ্গীরনগরের লেকগুলো ছিল অতিথি পাখীদের
একটি বড় আশ্রয়স্থল। লেক সংস্কারের নামে এই আশ্রয়স্থল ধ্বংস করা হয়েছে।
গেলবার এখানে এই লেকে পাখি আসেনি। পাখিরা যাতে শীতে আসতে পারে, সে জন্য
লেকগুলোতে পাখিদের আশ্রয়স্থল তৈরি করতে হবে। প্রশাসন অনেক গাছ কেটে
বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। জাবি প্রশাসনের উচিত হবে ক্যাম্পাসে ব্যাপক বনায়নের
উদ্যোগ নেয়া। প্রশাসন প্রয়োজনে এ ব্যাপারে বন অধিদফতরের সহযোগিতা নিতে
পারে। অভিযোগ আছে, একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী জন্ম হয়েছে জাহাঙ্গীরনগরে, যারা
স্থানীয় অধিবাসীর নাম করে, ক্ষমতাসীন দলের নাম করে, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির
সঙ্গে সম্পর্ক রেখে শিক্ষক তথা কর্মচারী নিয়োগে প্রভাব খাটাচ্ছে। অনেকে
অভিযোগ করেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে
পরিণত হয়েছে। শিক্ষকের ছেলে বা মেয়ে বা মেয়ের স্বামী এখানে ভর্তি হচ্ছেন,
পরে শিক্ষক হচ্ছেন। এখানে মেধার চেয়ে ব্যক্তি সম্পর্ক কাজ করছে বেশি। এই
প্রবণতা যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে আগামী দিনে মেধাবীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে
শিক্ষকতার কোনো সুযোগই পাবে না। শিক্ষকের সন্তান শিক্ষক হতেই পারে এবং
সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সন্তানের সেই 'মেধা' তারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে
শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করাতে পারেন। বিগত
প্রশাসনের আমলে যত বেশি শিক্ষকের সন্তান বা তাদের আত্মীয়-স্বজন শিক্ষক
হয়েছেন, অতীতে কখনো এমনটি হয়নি। এটা এলার্মিং চিন্তা করার যথেষ্ট সুযোগ
রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যতের জন্য এটা মঙ্গল। জাবির সাবেক উপাচার্য
দাবি করেছেন তার আমলে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এটা সত্য, অবকাঠামো খাতে যথেষ্ট
উন্নতি হয়েছে। বেশ কিছু ভবন তৈরি হয়েছে। কিন্তু একাডেমিক ভবন কী তৈরি
হয়েছে? নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। কিন্তু ক্লাসরুম নেই। পর্যাপ্ত ল্যাব
নেই। শুধু প্রভাষকদের দিয়ে নতুন নতুন বিভাগে শিক্ষাদান করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বয়স ১২ বছরের ওপরে হলেও, ৯ জন প্রভাষককে দিয়ে
বিভাগ চলছে। প্রফেসর মাত্র একজন। শতকোটি টাকার 'উন্নয়ন' এর কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু একাডেমিক উন্নতি কতটুকু হয়েছে? অনেক বিভাগেই (পুরনো বিভাগগুলো ছাড়া)
সিনিয়ির শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সিনিয়র শিক্ষকদের ছাড়া যে একাডেমিক উন্নয়ন
সম্ভব নয়, নয়া প্রশাসন এটা উপলব্ধি করলে ভালো করবেন। প্রভাষক নয়, বরং
সিনিয়র শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত। অনেক বিভাগেই সিনিয়র-জুনিয়র শিক্ষক সম্পর্কে
অবনতি ঘটেছে। এটা উচ্চশিক্ষার পথে বড় বাধা। এ ক্ষেত্রে সাবেক উপাচার্যের
নেতৃত্বের ব্যর্থতা অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। নৃ-বিজ্ঞান,
উদ্ভিদ বিদ্যা কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ঘটনাবলির ব্যাপারে
উপাচার্য মহোদয় তথা প্রশাসন যদি 'শক্ত' অবস্থান নিতেন, তাহলে পুলিশ দিয়ে
শিক্ষক গ্রেফতারের ঘটনা ঘটত না। উপাচার্য মহোদয় এসব ঘটনা ঘটতে দিয়ে নিজে
'সুবিধা' নিয়েছেন_ এই অভিযোগ তিনি কাটাতে পারবেন না। জাবির পরিবহন
প্রশাসনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সাবেক উপাচার্য
একাধিক গাড়ি ব্যবহার করতেন (একটি অ্যাম্বুলেন্সসহ)। সরকারি খরচে তার
ব্যক্তিগত কাজে এসব গাড়ি ব্যবহার করা হতো। সাবেক একজন উপ-উপাচার্য তার
দীর্ঘ ৪ বছরের আমলে প্রতিদিন তিনি ঢাকা থেকে যাওয়া-আসা করে বিপুল জ্বালানি
খরচ করেছেন। উপ-উপাচার্যের পদটি সার্বক্ষণিক, তার ক্যাম্পাসেই থাকার কথা।
তিনি তা করেননি। বর্তমান উপ-উপাচার্যের জ্বালানি বিলের ব্যাপারেও কথা
উঠেছে। এ ব্যাপারে বস্নগে ও সংবাদপত্রে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। সবচেয়ে
অবাক করার বিষয়, পরিবহন প্রশাসক নিজে সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন।
এটি তিনি কোনো আইন বলেই পারেন না। পরিবহনের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ
করা উচিত। নয়া প্রশাসনকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। জাবির প্রক্টরের
কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সংকটের সময় তিনি বিদেশে
ছিলেন। তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন, এটা জেনে-শুনেই তাকে প্রক্টর হিসেবে
নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এখন প্রক্টরিয়াল বডিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
বিগত তিন বছরে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হয়েছেন। এদের ব্যাপারটি নয়া
প্রশাসন বিবেচনায় নিতে পারেন। দলীয় প্রশাসন নয়, বরং সবার মতামতের ও
সহযোগিতার ভিত্তিতেই একটি প্রশাসন গড়ে তোলা উচিত। সিন্ডিকেট বা সিনেটের
বাইরে নয়া প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে একটি উপদেষ্টা পরিবষদ
গঠন করতে পারেন, যাদের উপদেশ নিয়ে তিনি প্রশাসন পরিচালনা করবেন। যদিও এর
কোনো আইনগত বৈধতা তিনি দিতে পারবেন না। কিন্তু 'শিক্ষক সমাজ' এর আন্দোলন
প্রমাণ করেছে, নয়া প্রশাসনের জন্য এ ধরনের একটি উপদেষ্টাম-লী তার প্রয়োজন।
ভিসি প্যানেল নির্বাচনের দাবি অনেক আগেই উঠেছে। এ ব্যাপারে তিনি উদ্যোগ
নিতে পারেন। আগামী ২৯ জুন তিনি সিনিটের বিশেষ অধিবেশন ডেকেছেন। এখান থেকে ৩
জন সিন্ডিকেট প্রতিনিধি তিনি নির্বাচন করবেন। এখানেও অনেকের আপত্তি রয়েছে।
নতুন সিনেট নির্বাচন করে এ কাজটি করলে তিনি ভালো করতেন। সামনে তার অনেক
কাজ বাকি। ডিন নির্বাচনসহ সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন তাকে সম্পন্ন
করতে হবে। তিনি ধীরে আগাচ্ছেন। এমনি সময় এলো কর্মচারীদের আন্দোলনের খবর। এ
খবরগুলো ভালো নয়। নয়া ভিসিকে একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেবে। তাঁকে
কাজ করতে দেয়া উচিত। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হোক।
নিয়মিত ক্লাস হোক। পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন হোক। কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।
Daily DESTINY
20.6.12
0 comments:
Post a Comment