রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রাষ্ট্রের দুই স্তম্ভের মধ্যে বিরোধ কাম্য নয়


রাষ্ট্রের দুই স্তম্ভ, জাতীয় সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব এখন রাজনীতিতে আলোচনার অন্যতম বিষয়। স্পিকারের একটি বক্তব্য নিয়ে এই দ্বন্দ্বের সূচনা। এ ক্ষেত্রে স্পিকারের পক্ষে বলতে গেলে পুরো সংসদ দাঁড়িয়ে গেছে। স্পিকারের বক্তব্যকে তারা সমর্থন করেছেন। অন্য দিকে একজন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে পুরো বিচার বিভাগ দাঁড়িয়ে গেছে, এটা বলা যাবে না। এমনকি আইনজীবীরা সবাই যে বিচারপতি চৌধুরীর পক্ষে আছেন, তাও নয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরা যা বলছেন তার মর্ম দাঁড়ায় এ রকমÑ জাতীয় স্বার্থে সংসদ ও উচ্চ আদালতের সংযত আচরণ করা উচিত। দেশের শীর্ষ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর গুরুত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে সমস্যা সমাধানের প্রত্যাশা করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, কারোরই এমন ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়, যাতে রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ অপর একটি অঙ্গকে আঘাত করে। প্রতিটি অঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে আমাদের। অন্য দিকে বিচারকদের কাছে রাজকীয় আচরণ ও ভাষা প্রত্যাশা করেছেন ব্যারিস্টার এম. আমীর উল ইসলাম। তার মতে, সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সংঘর্ষ হোক, এটা আমরা কখনই চাইবো না। সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সংঘাত শেষ না হলে সামনে খারাপ দিন আসছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রখ্যাত আইনজীবী ড. এম. জহির। তিনি বলেছেন, দু’টি অঙ্গের মধ্যে ঝগড়া অশনিসঙ্কেত। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট জয়নুল আবেদীন বিচারপতিদের কাছ থেকে বিচারিক ভাষা ও সংবিধানিক বক্তব্য আশা করেছেন। ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, আদালত স্পিকারকে নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা যেমন ঠিক হয়নি, তেমনি আদালতকে নিয়ে সংসদে এমপিরা যে মন্তব্য করেছেন, তাও সমুচিত হয়নি। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু। তিনি বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী সংসদে আলোচনার বিষয় নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা বা আদালত কোন কার্যধারা গ্রহণ করতে পারেন না। তেমনি সংসদ সদস্যদের উচিত কার্যপ্রণালী বিধি মেনে কারও বিরুদ্ধে সমালোচনা করা। তিনি বলেন, সংসদ ও বিচার বিভাগ মুখোমুখি হলে দেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার মতে আদালত যেমন  সংসদের আলোচনা নিয়ে মন্তব্য করে সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছেন, তেমনি সংসদেরও উচিত হয়নি আদালতের কোন বিচারপতিকে নিয়ে সংসদে কটূক্তি করা। স্পষ্টই বোঝা যায় বিচার বিভাগের সাথে সংসদের দ্বন্দ্বকে ভালো চোখে দেখেননি এ দেশের সুশীল সমাজ। দুর্ভাগ্য এটাই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের রায় নিয়ে অনাহূত এক বিতর্কে জড়িয়ে গেছেন আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এ ক্ষেত্রে কার ক্ষমতা বেশি, কে কর্তৃত্ব করবে, সংবিধানে কাকে কতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, এ ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই বিরোধকে কেউ কেউ ‘অশনিসঙ্কেত’ হিসেবে মনে করছেন। গণতন্ত্রের জন্য ‘হুমকি’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন কেউ কেউ।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ঢাকায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে থাকা হাইকোর্টের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে যে রায় দিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে জাতীয় সংসদে স্পিকারের দেয়া বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল ও আদালত অবমাননাকর বলে মন্তব্য করেছিলেন। স্পিকার বলেছিলেন, আদালতের রায়ে জনগণ ুব্ধ হলে বিচার বিভাগকেও তারা রুখে দাঁড়াতে পারে’ (সমকাল, ৬ জুন)। স্পিকারের এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই আদালত স্পিকার সম্পর্কে ঐ মন্তব্যটি করেছিলেন। তবে কোন রুল দেননি। রায়ে আদালত স্পষ্ট করেই বলেছিলেন ‘আদালত কখনো সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের বিরুদ্ধে নয়’। কিন্তু আদালতের মন্তব্য নিয়ে সংসদে বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে মন্তব্য করা হয়েছে, তা ছিল অনাকাক্সিত। সংসদে গত ৫ জুনের আলোচনায় বিচারপতি চৌধুরীর অপসারণ চেয়েছেন সংসদ সদস্যরা। বলা হয়েছে, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে। তোফায়েল আহমদের মত একজন সিনিয়র সংসদ সদস্য বিচারপতি চৌধুরীকে আখ্যায়িত করেছেন ‘স্যাডিস্ট’ হিসেবে। একজন বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল সাহেব। তিনি কী করে একজন বিচারপতিকে ‘স্যাডিস্ট’ বলেন? এতে করে তো আদালত অবমাননা হয়ে গেল! তিনি যখন বলেন, ‘বিচারপতিদেরকেও বুঝতে হবে বিচারপতিদের বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’ (সমকাল), তখন কি এই বক্তব্য বিচারপতিদের বিরুদ্ধে এক ধরনের হুমকি হয়ে গেল না? কোন ব্যক্তি কি এ ধরনের কথা বলতে পারে? একজন সংসদ সদস্য নিশ্চয়ই আইনের ঊর্ধ্বে নন। একজন সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বিচারপতি চৌধুরীকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত  বললেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার কথা। কিন্তু সামান্য একটি বিষয় নিয়ে যা ঘটে গেল, তাতে আমরা দুঃখিত ও লজ্জিতও বটে। বিচারপতি চৌধুরী স্পিকারের বক্তব্যকে সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলেননি, বলেছেন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এ ব্যাপারে আদালত কোন রায়ও  দেননি। কিন্তু সংসদ সদস্যদের বক্তব্যে আমি হতাশ। একজন বিচারপতিকে আমরা কিভাবে ‘স্যাডিস্ট’ বা ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ বলি? একজন সাধারণ মানুষের ব্যাপারেও তো আমরা এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে পারি না। আর যেভাবে ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে, তা কি এক ধরনের হুমকি নয়? এরা সবাই সিনিয়র সংসদ সদস্য। এদের কাছ থেকে আমি আরো ‘ম্যাচিওরড’ বক্তব্য আশা করেছিলাম। এরাই তো জাতিকে নেতৃত্ব দেবেন।
বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গকে একটির বিরুদ্ধে অন্যটিকে দাঁড় করানো যায় না। প্রতিটি অঙ্গ স্ব স্ব অবস্থানে থেকে রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করে যায়। আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতীক। জনগণের নিরাপত্তার গ্যারান্টিও দেন উচ্চ আদালত। রাষ্ট্র যখন জনগণের উপর নিপীড়ন চালায়, তখন সাধারণ মানুষের ভরসার স্থল হচ্ছে আদালত। আদালতের সিদ্ধান্তে কোন পক্ষ (এ ক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথ বিভাগ) যদি ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়ে থাকে, তার আপিল বিভাগে যাবার সুযোগ ছিল। আমি অবাক হয়েছি যখন দেখেছি পয়েন্ট অব অর্ডারে সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম আলোচনার সূত্রপাত করলেও স্পিকার নিজেই মন্তব্য করে বসলেন। সংসদ সদস্যরা আলোচনায় অংশও নিলেন না। আরো মজার কথা, আদালতের রায়ের পর সড়ক ও জনপথ বিভাগের দখলে থাকা কয়েকটি ভবন ও কক্ষ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে বুঝিয়েও দেয়া হয়েছে। অথচ ঐ রায়টি নিয়ে এত ‘লঙ্কাকাণ্ড’ ঘটে গেল।
যে ‘ঘটনা’ বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করালো, তা সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য শুভ নয়। হাইকোর্টের একটি রায় নিয়ে কয়েকজন সিনিয়র সংসদ সদস্য যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন, তা দৃষ্টিকটু। তাদের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই বলছি, তারা যদি উত্তেজিত না হয়ে, সংযত হয়ে পুরো বিষয়টি আলোচনা করতেন, তাহলে তা শোভন হতো, ভালো হতো। কিন্তু কেন জানি মনে হয়েছে তারা হুমকির সুরে কথা বলছেন। আদালত একটা কথা বলেছেন, কোন রুল দেননি। পুরো বিষয়টি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। ১০ জুলাই পরবর্তী তারিখও নির্ধারিত রয়েছে। অথচ সংসদে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতির ‘বিচারের’ও দাবি উঠলো। আমরা চাই ৫ জুন সংসদে যে আলোচনার সূত্রপাত, তার সমাপ্তিও হোক সেখানে। গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করতে, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে  সংসদের পাশাপাশি বিচার বিভাগের ভূমিকা অনেক ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ। সংসদে আইন পাস করলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। ঠিক তেমনি হাইকোর্ট একটি রুল ইস্যু করলেই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। রাষ্ট্রের দু’টি স্তম্ভের মধ্যে সম্পর্ক ও আস্থা এ দেশে গণতন্ত্রকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি দিতে পারে। আমরা যদি এ ব্যাপারে আরো সচেতন হই, আমাদের মঙ্গল তাতেই নিহিত।

0 comments:

Post a Comment