হিলারি কিনটনের বাংলাদেশ সফরের রেশ শেষ হতে না হতেই শোনা গেল ‘আকসা’র খবর। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ‘আকসা’ বা ‘অ্যাকুইজেশন ও ক্রস সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট’ নিয়ে ঢাকা ও ওয়াশিংটন আলোচনা শুরু করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে কার স্বার্থে আমরা ‘আকসা’ চুক্তি করতে যাচ্ছি? আদৌ এ ব্যাপারটি পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে কি না? কিংবা আমরা কি এটা নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, এতে করে আমাদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে? বিষয়টি সম্পর্কে দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, বিশেষ করে যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তারা কতটুকু ধারণা রাখেন, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। হিলারি কিনটনের সফরের পর পরই যখন ‘আকসা’ নিয়ে বাংলাদেশ আলোচনার উদ্যোগ নেয়, তখন এ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
পাঠক, স্মরণ করার চেষ্টা করুন হিলারি
কিনটনের ঢাকা সফরের দু’ সপ্তাহ আগে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে
প্রথমবারের মতো একটি সামরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই ‘সংলাপ’-এ
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও রাজনীতি বিষয়ক
সহকারী মন্ত্রী অ্যান্ড্রু শ্যাপিরো। সংলাপের বিষয় তথা কোন কোন বিষয় নিয়ে
আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, তার কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। কোন প্রেস
ব্রিফিংও হয়নি। বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিল। এরপরই আমরা দেখলাম
হিলারি কিনটনের সফরের সময় যৌথ অংশিদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই
চুক্তিরও বিস্তারিত আমরা জানি না। শুধু বলা হয়েছে, এই সংলাপের আওতায় বছরে
একবার বাংলাদেশ ও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা মিলিত
হবেন। তখন আমরা শুনলাম ‘আকসা’র কথা। এখানেও একটা অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে
যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে নানা কারণে। প্রথমত, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে
চীনের নৌ বাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে
পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি
এ্যালায়েন্স গড়ে তোলা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সকল
মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে, সেখানে যে ‘শূন্যতার’ সৃষ্টি হবে সেই
‘শূন্যতা’ পূরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘শান্তিরক্ষী’
বাহিনী গঠন করা, যারা ২০১৪ সালে মার্কিন সৈন্যদের পরিবর্তে আফগানিস্তানে
শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইসলামিক
কট্টরপন্থীরা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন করে একটি ঘাঁটি গড়তে
পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাস বিরোধী মোর্চা
গঠন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বিপুল জ্বালানি
সম্পদ রয়েছে (গভীর সমুদ্রে)। মার্কিনী আইওসির এ ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে
যথেষ্ট। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের
জন্য এ কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অবস্থান করে খুব সহজেই
মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করা যায় এবং বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী চীনের
রাজনৈতিক উত্থান পতনের প্রভাব খাটানো সম্ভব। হিলারি কিনটনের বাংলাদেশ সফরের
পর পরই বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি রচিত
হয়েছ্ ে‘আকসা’ চুক্তি এ লক্ষ্যেই স্বাক্ষরিত হয়েছে।
হিলারির সফরের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল একটি
যৌথ অংশিদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর। এই সংলাপের আওতায় বছরে একবার
বাংলাদেশ ও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিবপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা মিলিত হবেন।
চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা, মাদক ও অস্ত্র
চোরাচালান ও জলদস্যুতার মত আন্তঃদেশীয় অপরাধ রোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা
বলা হয়েছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা নানাভাবে বিশ্লেষণ হতে পারে। ‘সন্ত্রাসবাদ
রোধে সহযোগিতার আলোকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত
হয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন। আরো একটা কথা তরুণদের এক সমাবেশে হিলারি কিনটন
যখন বাংলাদেশের স্ট্রাটেজিক গুরুত্বের কথা বলেন, তখন আমাদের প্রখ্যাত
মার্কিন স্ট্রাটেজিক রবার্ট কাপলানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাপলান লিখেছেন,
দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির উদ্দেশ্য একটাইÑ আর তা
হচ্ছে চীনের প্রভাবকে সংকুচিত করা। বাংলাদেশের অবস্থান তাই খুব
স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন নীতিনির্ধারকদের আকৃষ্ট করবে। মার্কিন স্ট্রাটেজিতে
ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে
উঠতে না পারে, সে জন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। চীন ইতোমধ্যে
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌ শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে,
যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। চীন এ অঞ্চলে String of Pearls
বা ‘মুক্তার মালার’ মত বিভিন্ন সামুদ্রিক বন্দরে তার অবস্থান শক্তিশালী করে
নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। চীনের String of Pearls-এর যে নেটওয়ার্ক, তাতে
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত গাওদার সমুদ্র বন্দর একটি বড়
ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত
মহাসাগর পার হয়ে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্র পথ এ পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে
চায় চীন। চীন যে তেল আমদানি করে তার ৮০ ভাগ এই মালাক্কা প্রণালি হয়ে চীনে
যায়। তাই সঙ্গত কারণেই চীনের জন্য তার ভারত মহাসাগর উপস্থিতি অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। গাওদারে চীনা নৌ বাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিটও থাকবে, যা কি না
ভারত মহাসাগরের সকল নৌ মুভমেন্ট মনিটর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের
সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব আরো বেড়েছে।
স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে গাওদার এর দূরত্ব মাত্র ১৮০ ন্যাটিকাল মাইল। আর
ইরান সীমান্ত রয়েছে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। চীন এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়
করেছে গাওদার সমুদ্র বন্দর উন্নয়নে। চীন তার দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে
মধ্য এশিয়ার গ্যাস এই গাওদার বন্দর দিয়েই পাইপ লাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে
চায়। চীন শ্রীলংকার হামবানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। তামিল
টাইগারদের সাথে যুদ্ধে চীন শ্রীলংকা সরকারকে সমর্থন করেছিল। মিয়ানমারে
রয়েছে চীনের নৌ বাহিনীর একটি রাডার স্টেশন। সিটওয়েসহ আরো বেশ ক’টি বন্দরে
রয়েছে চীনের উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা
গড়ে তুলছে,তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চীনের এই
জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করা ও চীনের নৌ বাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য
নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাথে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে,
যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম একটি পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্রাটেজি সেই স্ট্রাটেজিকে সামনে
রেখেই এখন যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ চুক্তি করতে আগ্রহী হয়েছে। ‘আকসা’ চুক্তি
সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। যতদূর জানা গেছে, এ ধরনের চুক্তি অত্যন্ত
স্পর্শকাতর। প্রস্তাবিত ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে
‘গাইডেড মিসাইল’সহ বেশ কয়েক ধরনের আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করবে। এসব অস্ত্র
ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য
সহযোগিতা দেয়ার কথাও রয়েছে। এ ছাড়া থাকবে যৌথ মহড়া ও সংলাপের ব্যবস্থা।
প্রস্তাবিত ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী জ্বালানি
সংগ্রহ, যাত্রা বিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার জন্য
বাংলাদেশ ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর
বাংলাদেশ উপস্থিতিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। তথ্য ঘেটে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত এই
চুক্তিটির এক সময় নাম ছিল ‘ন্যাটো মিউচ্যুয়াল সাপোর্ট অ্যাক্ট’।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও সরবরাহ বিনিময় সহজ করার
জন্য এটি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ওই অ্যাক্টে পরিবর্তন আনা হয়, যাতে করে
ন্যাটোর সদস্য নয় এমন দেশগুলোর সাথে এ ধরনের একটি চুক্তি করা যায়।
চুক্তিটির নামেও পরিবর্তন আনা হয়। চুক্তিটি এখন ‘আকসা’ চুক্তি নামে পরিচিত।
‘আকসা’ চুক্তি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ
রক্ষা করবে না। বরং বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির যে
পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, বাংলাদেশ সেই পরিকল্পনার যদি অংশ হয়, তাহলে
বাংলাদেশ বহিঃবিশ্বে ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে। একই সাথে চীনের সাথে সম্পর্কের
অবনতি হতেও বাধ্য। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজির অংশ
হতে পারি না। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্তিও খুব কম। শুধু যুক্তরাষ্ট্র সফর ও
তথাকথিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারবো
না। তাই প্রস্তাবিত চুক্তিটি স্বাক্ষরের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের
পরামর্শ, বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া জরুরি। চুক্তিটি নিয়ে সংসদে আলোচনা করারও
প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের একটি চুক্তি বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের উসকে দিতে
পারে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও বেড়ে যেতে পারে, যা কোনমতেই কাম্য নয়। সংসদকে
অবহিত না করে এ ধরনের একটি চুক্তি যদি করা হয়, তাহলে সেই চুক্তি নিয়ে
প্রশ্ন থাকবেই।
0 comments:
Post a Comment