পাকিস্তান সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা। মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান, উভয়দলীয় নেতারা মন্তব্য করেছিলেন যে, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘ব্ল্যাক হোলে’র মতো। অর্থাত্ তারা যা বলতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে পাকিস্তান যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কেউ-ই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। এটা সেই ‘ব্ল্যাক হোল’ এর মতো, যার কোনো শেষ নেই।
মার্কিন কংগ্রেসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটদলীয় গ্রে অ্যাকারম্যান কিংবা রিপাবলিকানদলীয় ড্যানা রোহরাব্যাচারের মতো ব্যক্তিত্ব যখন পাকিস্তান সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ নিয়ে উত্কণ্ঠিত না হয়ে পারা যায় না। মার্কিন আইন প্রণেতারা এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন গত মে মাসে কংগ্রেসের মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক একটি প্যানেলে আমন্ত্রিত হয়ে। মার্কিন আইনপ্রণেতাদের এই মন্তব্য যখন ওয়াশিংটনে নীতিনির্ধারকদের চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে, ঠিক তখনই আরও একটি ‘বোমা ফাটালেন’ পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পূর্ণ বেঞ্চ। গত ১৯ জুন এক রায়ে তারা প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এমনকি সংসদ সদস্যপদেও তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। আদালত অবমাননার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় আদালত এই রায় দেন। পাকিস্তানের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন অবৈধ। প্রধান বিচারপতি চৌধুরী তার রায়ে উল্লেখ করেন, বিচারকদের সাত সদস্যের বেঞ্চ ২৬ এপ্রিল গিলানিকে সংবিধানের ২০৪(২) ধারা অনুযায়ী আদালত অবমাননার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। প্রতীকী সাজা দিয়েছিলেন বিচারকরা। ৩০ সেকেন্ড কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন গিলানি। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো আপিল নথিভুক্ত না হওয়ায় তিনি সংসদ সদস্যপদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, অন্যদিকে খোদ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ‘তালেবানি’ তত্পরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাকিস্তানের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। আগের চেয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা পাকিস্তানের ব্যাপারে সোচ্চার। প্রকাশ্যেই তারা বলছেন গত দশক ধরে দেশটিকে দেওয়া ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অর্থ সহায়তা কোনো কাজেই লাগেনি। মার্কিন কংগ্রেসে এমন কথাও উঠেছে যে, পাকিস্তানে সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেয়া উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান সম্পর্কে যখন এ ধরনের একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে, ঠিক তখনই গিলানিকে অযোগ্য ঘোষণা করলেন উচ্চ আদালত। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান স্পষ্টতই একটি গভীর সঙ্কটে পতিত হল।
কী হতে যাচ্ছে এখন পাকিস্তানে? সেখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পিপলস পার্টির নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সিনিয়র নেতা মখদুম শাহাবুদ্দিনকে নয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছে। তিনি মজলিসে শূরার (সংসদ) সমর্থন পাওয়ার আগেই তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ফলে তার দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। যদিও কোয়ালিশন সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তবে শেষ রক্ষা হবে কি না বলা মুশকিল। শাহাবুদ্দিন কিংবা অন্য যে কারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি সব প্রশ্নের জবাব দেয় না। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, যে কারণে গিলানি অভিযুক্ত হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে নয়া প্রধানমন্ত্রী আদৌ কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না? পাকিস্তানের বর্তমান যে সঙ্কট, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন জারদারি অবৈধভাবে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার ঘুষ নিয়েছিলেন এবং ওই টাকা সুইজারল্যান্ডে পাচার করেছিলেন। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে সুইজারল্যান্ডে তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু স্ত্রী বেনজির ভুট্টোর বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু (২০০৭) জারদারিকে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে। তিনি ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুইজারল্যান্ডের ওই মামলার তদন্ত কাজ স্থগিত করতে প্রভাব খাটান। কিন্তু পাকিস্তানের উচ্চ আদালত আবার মামলা শুরু করার ব্যাপারে সুইজারল্যান্ডকে অনুরোধ করতে গিলানির প্রতি নির্দেশ দেন। গিলানি উচ্চ আদালতের এই নির্দেশ অমান্য করেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট দায়মুক্তি পেয়েছেন। তাই তার পক্ষে সুইজারল্যান্ড কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখা সম্ভব নয়। এই যুক্তি উচ্চ আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখন নয়া প্রধানমন্ত্রী মখদুম শাহাবুদ্দিন কী করবেন? তিনি কি চিঠি লিখবেন সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে, নাকি গিলানির পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন? নয়া প্রধানমন্ত্রী যদি গিলানিকে অনুসরণ করেন তা হলে তিনিও যে আদালত অবমাননার শিকার হবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন, জারদারির ভূমিকা এখন কী হবে? তিনি কি রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? গিলানি অযোগ্য হলেন বটে, কিন্তু এর জন্য তিনি এতটুকুও দায়ী নন। ইফতেখার-জারদারির দ্বন্দ্বে বলি হলেন গিলানি। জারদারির একটা বড় ব্যর্থতা তিনি এই সঙ্কেটে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা নওয়াজ শরিফের সমর্থন পাননি। মূলত আদালত অবমাননার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন নওয়াজ শরিফ স্বয়ং। তৃতীয় প্রশ্ন, বিচার বিভাগের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে লাভবান হবে কোন শক্তি? অত্যধিক ক্ষমতাবান সেনাবাহিনী তথা সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানির ভূমিকাও বা কী এই সঙ্কটে? কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এই সঙ্কট থেকে কোনো সুবিধা নেবে কি না? চতুর্থ প্রশ্ন, সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসতে পাকিস্তান কি সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আগামি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। পাকিস্তানের ইতিহাস বলে, অতীতে কখনই কোনো সরকার তার টার্ম (পাঁচ বছর) শেষ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে পিপিপির নেতৃত্বাধীন সরকার যদি এই টার্ম শেষ করে, তা হলে এটা হবে একটা রেকর্ড। পঞ্চম প্রশ্ন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের উত্থানের মধ্য দিয়ে যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে উচ্চ আদালতের এই রায়ের মধ্য দিয়ে আগামীতে ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির পথ কি উন্মুক্ত হল? ইমরান খান রাজনীতিতে এসেছেন কিছুদিন হল। তিনি একটি দলও করেছেন-‘তেহরিক-ই ইনসাফ’। তার মূল স্লোগান হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান। উচ্চ আদালত গিলানির বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছেন, তার পেছনেও কাজ করছে এই দুর্নীতির প্রশ্নটি। একসময় জারদারি পরিচিত ছিল ‘মি. টেন পারসেন্ট’ হিসেবে। স্ত্রী বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বড় বড় কনট্যাক্ট তিনি পাইয়ে দিতেন অর্থের বিনিময়ে। ওই টাকায় তিনি দুবাইয়ে বিশাল বাড়ি কিনেছেন। সুইজারল্যান্ড তথা লন্ডনেও রয়েছে তার সম্পদ। তবে তার প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফও ‘ধোয়া তুলসী পাতা’ নন। তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আগামীতে উচ্চ আদালত যদি নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধেও কোনো রুল ইস্যু করে আমি অবাক হব না। এর মধ্য দিয়ে তৃতীয় শক্তি হিসেবে ইমরান খান সামনে চলে আসছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইমরান খানের মাঝে বিকল্প শক্তি দেখতে চাইবে। পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের সঙ্গেও ইমরান খানের যোগাযোগ রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ইসরায়েল অনেকদিন ধরেই চাইছে পাকিস্তান তাদের স্বীকৃতি দিক। এখন ইমরান খানকে যদি ক্ষমতায় আনা যায়, তা হলে ইসরায়েলের স্ট্র্যাটেজি তাতে সার্থক হবে। উচ্চ আদালতের রায় ইমরান খানের ইসলামাবাদে যাওয়ার যাত্রাপথকে আরও প্রশস্ত করছে কি না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। ষষ্ঠ প্রশ্ন, এই রায় ইসলামী কট্টরপন্থীদের স্ট্র্যাটেজিতে আদৌ কি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে? আমার তা মনে হয় না। পাকিস্তান বাহ্যত ধীরে ধীরে আরেকটি ‘তালেবানি রাষ্ট্র’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী পাখতুন খোয়া প্রদেশে সনাতন রাজনীতির কোনো প্রভাব নেই। এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানপন্থী তালেবানরা। উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানসহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ এখন ইসলামিক কট্টরপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে। এদের সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবানদের রয়েছে যোগাযোগ। পাকিস্তান অধ্যুষিত এই অঞ্চলে একটি ইসলামপন্থী দল স্থানীয় ক্ষমতা পরিচালনা করে বটে, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে কট্টরপন্থীরা। তাই এখানে দীর্ঘদিন যাবত্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানববিহীন ড্রোন বিমান হামলা পরিচালনা করে আসছে। কট্টরপন্থীদের প্রভাব দিন দিন বাড়ছেই। পাঁচ-ছয় বছর আগে পাকিস্তান সফরে গিয়ে কট্টরপন্থীদের যে ‘শক্তি’ আমি দেখেছিলাম, আজ সেই ‘শক্তি’ কমেনি, বরং বেড়েছে। ইসলামাবাদে গিলানি সরকারের পতন ঘটলেও পাকিস্তানি তালেবানদের তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছেই।
পাকিস্তানে একটি পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান একজন নয়া প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। মনে রাখতে হবে, আগামী ২০১৩-১৪ সাল পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে সকল সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। এর ফলে কারজাই সরকার আদৌ কাবুলে থাকতে পারবে কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মডারেট তালেবানদের সঙ্গে (যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে) কারজাই সরকারের যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল, তা খুব বেশি দূর যেতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে এ অঞ্চলে তার স্বার্থ পরিত্যাগ করবে, আমার তা মনে হয় না। ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে নতুন করে এক স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’র এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে। ভারত হচ্ছে তার সঙ্গী। এ ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক্যালি পাকিস্তানের গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রথমত, আফগানিস্তানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর জন্য রসদ সরবরাহের পথ পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে। পাকিস্তান এই পথ (খাইবার উপতক্যা) বন্ধ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার অন্যতম কারণ। ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য বেলুচিস্তানের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অতি জরুরি। পাকিস্তানের প্রদেশ বেলুচিস্তান থেকে ইরান সীমান্ত মাত্র ৭২ কিমি দূরে। তৃতীয়ত, গাওদারের গভীর সমুদ্রে রয়েছে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি। ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে বেলুচিস্তানের গাওদার ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন রয়েছে। সব মিলিয়ে তাই দরকার ইসলামাবাদে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার। গিলানি সরকার মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে পারছিল না। তাই তাকে চলে যেতে হল। আগামীতে যিনিই আসবেন তাকে মার্কিনি স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। তবে মার্কিন আইনপ্রণেতারা পাকিস্তান সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। পাকিস্তানের পরিস্থিতি ‘ব্লাক হোল’-এর মতো-কোন দিকে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। আর এর শেষ কোথায়, তাও কেউ বলতে পারছে না।
Daily SAKALER KHOBOR
22.6.12
মার্কিন কংগ্রেসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটদলীয় গ্রে অ্যাকারম্যান কিংবা রিপাবলিকানদলীয় ড্যানা রোহরাব্যাচারের মতো ব্যক্তিত্ব যখন পাকিস্তান সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ নিয়ে উত্কণ্ঠিত না হয়ে পারা যায় না। মার্কিন আইন প্রণেতারা এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন গত মে মাসে কংগ্রেসের মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক একটি প্যানেলে আমন্ত্রিত হয়ে। মার্কিন আইনপ্রণেতাদের এই মন্তব্য যখন ওয়াশিংটনে নীতিনির্ধারকদের চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে, ঠিক তখনই আরও একটি ‘বোমা ফাটালেন’ পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পূর্ণ বেঞ্চ। গত ১৯ জুন এক রায়ে তারা প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এমনকি সংসদ সদস্যপদেও তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। আদালত অবমাননার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় আদালত এই রায় দেন। পাকিস্তানের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন অবৈধ। প্রধান বিচারপতি চৌধুরী তার রায়ে উল্লেখ করেন, বিচারকদের সাত সদস্যের বেঞ্চ ২৬ এপ্রিল গিলানিকে সংবিধানের ২০৪(২) ধারা অনুযায়ী আদালত অবমাননার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। প্রতীকী সাজা দিয়েছিলেন বিচারকরা। ৩০ সেকেন্ড কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন গিলানি। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো আপিল নথিভুক্ত না হওয়ায় তিনি সংসদ সদস্যপদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, অন্যদিকে খোদ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ‘তালেবানি’ তত্পরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাকিস্তানের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। আগের চেয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা পাকিস্তানের ব্যাপারে সোচ্চার। প্রকাশ্যেই তারা বলছেন গত দশক ধরে দেশটিকে দেওয়া ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অর্থ সহায়তা কোনো কাজেই লাগেনি। মার্কিন কংগ্রেসে এমন কথাও উঠেছে যে, পাকিস্তানে সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেয়া উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান সম্পর্কে যখন এ ধরনের একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে, ঠিক তখনই গিলানিকে অযোগ্য ঘোষণা করলেন উচ্চ আদালত। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান স্পষ্টতই একটি গভীর সঙ্কটে পতিত হল।
কী হতে যাচ্ছে এখন পাকিস্তানে? সেখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পিপলস পার্টির নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সিনিয়র নেতা মখদুম শাহাবুদ্দিনকে নয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছে। তিনি মজলিসে শূরার (সংসদ) সমর্থন পাওয়ার আগেই তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ফলে তার দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। যদিও কোয়ালিশন সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তবে শেষ রক্ষা হবে কি না বলা মুশকিল। শাহাবুদ্দিন কিংবা অন্য যে কারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি সব প্রশ্নের জবাব দেয় না। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, যে কারণে গিলানি অভিযুক্ত হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে নয়া প্রধানমন্ত্রী আদৌ কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না? পাকিস্তানের বর্তমান যে সঙ্কট, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন জারদারি অবৈধভাবে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার ঘুষ নিয়েছিলেন এবং ওই টাকা সুইজারল্যান্ডে পাচার করেছিলেন। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে সুইজারল্যান্ডে তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু স্ত্রী বেনজির ভুট্টোর বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু (২০০৭) জারদারিকে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে। তিনি ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুইজারল্যান্ডের ওই মামলার তদন্ত কাজ স্থগিত করতে প্রভাব খাটান। কিন্তু পাকিস্তানের উচ্চ আদালত আবার মামলা শুরু করার ব্যাপারে সুইজারল্যান্ডকে অনুরোধ করতে গিলানির প্রতি নির্দেশ দেন। গিলানি উচ্চ আদালতের এই নির্দেশ অমান্য করেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট দায়মুক্তি পেয়েছেন। তাই তার পক্ষে সুইজারল্যান্ড কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখা সম্ভব নয়। এই যুক্তি উচ্চ আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখন নয়া প্রধানমন্ত্রী মখদুম শাহাবুদ্দিন কী করবেন? তিনি কি চিঠি লিখবেন সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে, নাকি গিলানির পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন? নয়া প্রধানমন্ত্রী যদি গিলানিকে অনুসরণ করেন তা হলে তিনিও যে আদালত অবমাননার শিকার হবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন, জারদারির ভূমিকা এখন কী হবে? তিনি কি রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? গিলানি অযোগ্য হলেন বটে, কিন্তু এর জন্য তিনি এতটুকুও দায়ী নন। ইফতেখার-জারদারির দ্বন্দ্বে বলি হলেন গিলানি। জারদারির একটা বড় ব্যর্থতা তিনি এই সঙ্কেটে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা নওয়াজ শরিফের সমর্থন পাননি। মূলত আদালত অবমাননার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন নওয়াজ শরিফ স্বয়ং। তৃতীয় প্রশ্ন, বিচার বিভাগের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে লাভবান হবে কোন শক্তি? অত্যধিক ক্ষমতাবান সেনাবাহিনী তথা সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানির ভূমিকাও বা কী এই সঙ্কটে? কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এই সঙ্কট থেকে কোনো সুবিধা নেবে কি না? চতুর্থ প্রশ্ন, সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসতে পাকিস্তান কি সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আগামি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। পাকিস্তানের ইতিহাস বলে, অতীতে কখনই কোনো সরকার তার টার্ম (পাঁচ বছর) শেষ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে পিপিপির নেতৃত্বাধীন সরকার যদি এই টার্ম শেষ করে, তা হলে এটা হবে একটা রেকর্ড। পঞ্চম প্রশ্ন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের উত্থানের মধ্য দিয়ে যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে উচ্চ আদালতের এই রায়ের মধ্য দিয়ে আগামীতে ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির পথ কি উন্মুক্ত হল? ইমরান খান রাজনীতিতে এসেছেন কিছুদিন হল। তিনি একটি দলও করেছেন-‘তেহরিক-ই ইনসাফ’। তার মূল স্লোগান হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান। উচ্চ আদালত গিলানির বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছেন, তার পেছনেও কাজ করছে এই দুর্নীতির প্রশ্নটি। একসময় জারদারি পরিচিত ছিল ‘মি. টেন পারসেন্ট’ হিসেবে। স্ত্রী বেনজির ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বড় বড় কনট্যাক্ট তিনি পাইয়ে দিতেন অর্থের বিনিময়ে। ওই টাকায় তিনি দুবাইয়ে বিশাল বাড়ি কিনেছেন। সুইজারল্যান্ড তথা লন্ডনেও রয়েছে তার সম্পদ। তবে তার প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফও ‘ধোয়া তুলসী পাতা’ নন। তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আগামীতে উচ্চ আদালত যদি নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধেও কোনো রুল ইস্যু করে আমি অবাক হব না। এর মধ্য দিয়ে তৃতীয় শক্তি হিসেবে ইমরান খান সামনে চলে আসছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইমরান খানের মাঝে বিকল্প শক্তি দেখতে চাইবে। পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের সঙ্গেও ইমরান খানের যোগাযোগ রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ইসরায়েল অনেকদিন ধরেই চাইছে পাকিস্তান তাদের স্বীকৃতি দিক। এখন ইমরান খানকে যদি ক্ষমতায় আনা যায়, তা হলে ইসরায়েলের স্ট্র্যাটেজি তাতে সার্থক হবে। উচ্চ আদালতের রায় ইমরান খানের ইসলামাবাদে যাওয়ার যাত্রাপথকে আরও প্রশস্ত করছে কি না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। ষষ্ঠ প্রশ্ন, এই রায় ইসলামী কট্টরপন্থীদের স্ট্র্যাটেজিতে আদৌ কি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে? আমার তা মনে হয় না। পাকিস্তান বাহ্যত ধীরে ধীরে আরেকটি ‘তালেবানি রাষ্ট্র’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী পাখতুন খোয়া প্রদেশে সনাতন রাজনীতির কোনো প্রভাব নেই। এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানপন্থী তালেবানরা। উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানসহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ এখন ইসলামিক কট্টরপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে। এদের সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবানদের রয়েছে যোগাযোগ। পাকিস্তান অধ্যুষিত এই অঞ্চলে একটি ইসলামপন্থী দল স্থানীয় ক্ষমতা পরিচালনা করে বটে, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে কট্টরপন্থীরা। তাই এখানে দীর্ঘদিন যাবত্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানববিহীন ড্রোন বিমান হামলা পরিচালনা করে আসছে। কট্টরপন্থীদের প্রভাব দিন দিন বাড়ছেই। পাঁচ-ছয় বছর আগে পাকিস্তান সফরে গিয়ে কট্টরপন্থীদের যে ‘শক্তি’ আমি দেখেছিলাম, আজ সেই ‘শক্তি’ কমেনি, বরং বেড়েছে। ইসলামাবাদে গিলানি সরকারের পতন ঘটলেও পাকিস্তানি তালেবানদের তাতে কিছু যায় আসে না। তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছেই।
পাকিস্তানে একটি পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান একজন নয়া প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। মনে রাখতে হবে, আগামী ২০১৩-১৪ সাল পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে সকল সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। এর ফলে কারজাই সরকার আদৌ কাবুলে থাকতে পারবে কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মডারেট তালেবানদের সঙ্গে (যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে) কারজাই সরকারের যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল, তা খুব বেশি দূর যেতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে এ অঞ্চলে তার স্বার্থ পরিত্যাগ করবে, আমার তা মনে হয় না। ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে নতুন করে এক স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’র এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে। ভারত হচ্ছে তার সঙ্গী। এ ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক্যালি পাকিস্তানের গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রথমত, আফগানিস্তানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর জন্য রসদ সরবরাহের পথ পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে। পাকিস্তান এই পথ (খাইবার উপতক্যা) বন্ধ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার অন্যতম কারণ। ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য বেলুচিস্তানের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অতি জরুরি। পাকিস্তানের প্রদেশ বেলুচিস্তান থেকে ইরান সীমান্ত মাত্র ৭২ কিমি দূরে। তৃতীয়ত, গাওদারের গভীর সমুদ্রে রয়েছে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি। ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হলে বেলুচিস্তানের গাওদার ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রয়োজন রয়েছে। সব মিলিয়ে তাই দরকার ইসলামাবাদে একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার। গিলানি সরকার মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে পারছিল না। তাই তাকে চলে যেতে হল। আগামীতে যিনিই আসবেন তাকে মার্কিনি স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। তবে মার্কিন আইনপ্রণেতারা পাকিস্তান সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। পাকিস্তানের পরিস্থিতি ‘ব্লাক হোল’-এর মতো-কোন দিকে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। আর এর শেষ কোথায়, তাও কেউ বলতে পারছে না।
Daily SAKALER KHOBOR
22.6.12
0 comments:
Post a Comment