মিয়ানমারে প্রেসিডেন্ট থেইন মেইন'র নেতৃত্বাধীন একটি সরকার যখন পশ্চিমা বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং সেখানকার বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সুচিকে দীর্ঘ ২১ বছর পর যখন প্রথমবারের মতো ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হলো, তখন রোহিঙ্গা ইস্যুটি পুনরায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে। রোহিঙ্গারা মূলত ধর্মীয়ভাবে মুসলমান এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের অধিবাসী। মিয়ানমারের ৭টি রাজ্য ও ৭টি ডিভিশনের একটি হচ্ছে এই আরাকান। ইতিহাস বলে আরাকান অঞ্চলটি কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য ছিল। অষ্টাদশ শতকে প্রথমবারের মতো এই অঞ্চলটি তার স্বাধীনতা হারায় এবং বর্মী বাজার অধীনস্থ হয়। তাও মাত্র অর্ধশতাব্দীর জন্য। তার পরই এ এলাকা ব্রিটিশ শাসনে চলে যায়। ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবেই এটি আজ মিয়ানমারের অংশ। মোগল আমলের আগে আরাকান রাজ্যের রাজ্য এক পর্যায় চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার (তখনকার নাম বার্মা) স্বাধীন হলে, একটি বহুজাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রটি গড়ে ওঠে। দেশটির জনসংখ্যার ৪৮ ভাগ বার্মিজ হলেও, জনসংখ্যার ৯ ভাগ শনি, ৭ ভাগ কারেন, ৪ ভাগ রাখাইন। রাখাইনদেরই বাস এই আরাকান রাজ্যে। আমাদের দেশে একসময় এই রাখাইনরা মগ নামে পরিচিত ছিল। ধর্মীয়ভাবেও এদের মাঝে বিভিক্ত আছে। শতকরা ৮৯ ভাগ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ৪ ভাগ মানুষ খ্রিস্টিয় ধর্মাবলম্বী। মুসলমানরা জনসংখ্যার মাত্র ৪ ভাগ। এই মুসলমানরা আরাকান রাজ্যে বসবাস করলেও, চীনা বংশোভূত কিছু মুসলমান চীন-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের এলাকায় বসবাস করে। তবে এদের নিয়ে তেমন সমস্যার কথা শোনা যায় না। শোনা যায় আরাকান রাজ্যে বসবাসকারী মুসলমান তথা রোহিঙ্গাদের নিয়ে। এখানে মূলত মুসলমানদের উচ্ছেদ করে সেখানে বসবাসকারী রাখাইনদের (যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী) একক কর্তৃত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আজকে মিয়ানমারের জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান নব্বইয়ের দশকে বসনিয়া-হারজেগোভিনার জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯২ সালের মার্চে বসনিয়ার জগগোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে গণভোটে রায় দিলে, সেখানে সার্বিয়ার উস্কানিতে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলে। শতকরা ৪৩ ভাগ মুসলমান জগগোষ্ঠী হত্যা, ধর্ষণ ও উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হন। সার্বিয়া এই দেশটিকে সার্বিয়ার একটি আশ্রিত রাজ্য বানাতে চেয়েছিল। জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধে ১৯৯৪ সালের মার্চে ন্যাটোর বিমান বহরকে সার্বীয় অবস্থানের ওপর বিমান হামলা পর্যন্ত চালাতে হয়েছিল। আজ এত বছর পর সেই সার্বিয়া গণহত্যাকারীদের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হচ্ছে। বৃহৎ পরিসরে দেখালে বসনিয়ার সেই পরিস্থিতির সাথে আজকের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির অবশ্য কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মুসলমানরা উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হচ্ছেন এবং রাখাইন রাজ্যটি ধীরে ধীরে একটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে পরিণত হতে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। এমনকি সকল ধরনের সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। এখানে আরো একটি বৈসাদৃশ্য আমাদের চোখে পড়ার কথা। যেখানে বসনিয়ায় ন্যাটোরে এক পর্যায়ে বিমান হামলা চালাতে হয়েছিল, সেখানে আজকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের ব্যাপারে পশ্চিম বিশ্ব নিরব। বরং উল্টো বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেয়ার 'চাকা' পর্যন্ত দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছে। বাংলাদেশ এমনিতেই জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত। বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। সুতরাং বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করতে বাধ্য নয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশন প্রয়োজনে রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যত্র, এমনকি ইউরোপে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইতোমধ্যে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গারা নানা রকম অনৈতিক ও অসামাজিক কর্মকা-ে লিপ্ত। তারা ইতোমধ্যে কক্সবাজার এলাকার ব্যাপক বনাঞ্চল ধ্বংস করেছে। উপরন্তু মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় তাদের ব্যাপক উপস্থিতি একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। বিদেশিদের 'দুরভিসন্ধি' আমাদের নজরে এসেছে। এমনিতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদেশি তৎপরতা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। আমরা নতুন করে আরেকটি 'সমস্যা' দেখতে চাই না, যেখানে বিদেশি দাতাসংস্থা, এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলানোর সুযোগ পাক। এখানেই এসে যায় রিয়েল পলিটিক্সের প্রশ্নটি। বাংলাদেশ রাহিঙ্গাদের প্রত্যাখ্যান করেছে বটে। কিন্তু কেন প্রত্যাখ্যান করল, তা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে তুলে ধরতে হবে। জাতিসংঘে বিষয়টি প্রয়োজনে তুলতে হবে জোরালোভাবে। কিছু মুসলমান দেশ রয়েছে, যারা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। তাদের বোঝাতে হবে এখানে 'মানবতা' কোনো বিষয় নয়, বিষয় 'রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা'। সেই সঙ্গে দ্রুত মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে 'সংলাপ' শুরু করা উচিত। আমাদের স্বার্থেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে নয়। একাধিক কারণ এই নিরাপত্তা আজ ঝুঁকির মুখে প্রথমত, রোহিঙ্গা ইস্যুটি অবশ্যই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারে জাতিসংঘকেই উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিসংঘ তথা পশ্চিমা বিশ্বকে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়। প্রয়োজনে সেখানে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিকে পাঠাতে হবে এবং তাকে পরিস্থিতি মনিটর করার সুযোগ দিতে হবে। দ্বিতীয়, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বয়কট তথা অর্থনৈতিক অবরোধের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। তৃতীয়ত, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শিবিরে সরকারি তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা (রোহিঙ্গা) ১০ হাজার ৪০০ জন। অন্যদিকে টেকনাফের নয়াপাড়া শিবিরে তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা ১৪ হাজার। এর বাইরে আরো প্রায় দুই লাখ আন-রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। রেজিস্টার্ড শরণার্থীরা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন থেকে সাহায্য সহযোগিতা পায়। আন-রেজিস্টার্ডরা কোনো সাহায্য পায় না। ফলে তারা আসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে এ অঞ্চলের নিরাপত্তাকে একটি হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর নতুন করে কোনো ঝুঁকি গ্রহণ করতে পারে না। চতুর্থ, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশি এলাকায় এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি একসময় রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। মিয়ানমারে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের লড়াই অনেক পুরনো। কোচিন, মান জাতিগোষ্ঠী স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। একসময় রোহিঙ্গারাও বাধ্য হবে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে। বাংলাদেশ এর দায় দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন। মিয়ানমার আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। আমাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টারও। আমাদের জ্বালানি ও খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারে মিয়ানমার। সুতরাং আমাদের স্বার্থেই আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি ঘটাতে পারি না। পঞ্চমত, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোনো কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অতি উৎসাহ আমাদের চিন্তিত করে। হঠাৎ করেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার প্রবণতা বাড়েনি। বরং বাইরের কোনো কোনো মহল থেকে এদেরকে বাংলাদেশে আসতে উৎসাহ জোগানো হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রাখাইন (বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী) কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত উৎপীড়ন চলছে, এটা সত্য। তবে দীর্ঘদিন সেখানে এ ব্যাপারে 'স্ট্যাটাস কো' বজায় ছিল। হঠাৎ করেই আবার জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়। এ ব্যাপারে পশ্চিমা শক্তির ইন্ধন রয়েছে। তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করতে চায়। বিশেষ করে এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে মার্কিনি নয়া স্ট্র্যাটেজি স্মরণ করা যেতে পারে। 'চীনকে ঘিরে ফেলার' একটি চক্রান্ত চলছে। মার্কিন নীতি নির্ধারকরা এ লক্ষ্যে এখন কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের দিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিতে চায়। সুতরাং বাংলাদেশ এই মার্কিন স্ট্র্যাটেজির অংশ হতে পারে না। বাংলাদেশ স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ কোনো রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে পারে না। শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি। সুতরাং রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে বাংলাদেশ বাধ্য নয়। বাংলাদেশের এই ভূমিকা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশ মার্কিনি চাপের কাছে মাথা নত করেনি। তবে রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তুলতে পারে। আগামী ১৭ জুলাই মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ওই সময় বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি তুলতে পারে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি হোক, আমরা তা চাই না। আমাদের জাতীয় স্বার্থে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা আমাদের প্রয়োজন রয়েছে।Daily JAI JAI DIN25.6.12
কেন বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে পারে না
18:54
No comments
মিয়ানমারে প্রেসিডেন্ট থেইন মেইন'র নেতৃত্বাধীন একটি সরকার যখন পশ্চিমা বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং সেখানকার বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সুচিকে দীর্ঘ ২১ বছর পর যখন প্রথমবারের মতো ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হলো, তখন রোহিঙ্গা ইস্যুটি পুনরায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে। রোহিঙ্গারা মূলত ধর্মীয়ভাবে মুসলমান এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের অধিবাসী। মিয়ানমারের ৭টি রাজ্য ও ৭টি ডিভিশনের একটি হচ্ছে এই আরাকান। ইতিহাস বলে আরাকান অঞ্চলটি কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য ছিল। অষ্টাদশ শতকে প্রথমবারের মতো এই অঞ্চলটি তার স্বাধীনতা হারায় এবং বর্মী বাজার অধীনস্থ হয়। তাও মাত্র অর্ধশতাব্দীর জন্য। তার পরই এ এলাকা ব্রিটিশ শাসনে চলে যায়। ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবেই এটি আজ মিয়ানমারের অংশ। মোগল আমলের আগে আরাকান রাজ্যের রাজ্য এক পর্যায় চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার (তখনকার নাম বার্মা) স্বাধীন হলে, একটি বহুজাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রটি গড়ে ওঠে। দেশটির জনসংখ্যার ৪৮ ভাগ বার্মিজ হলেও, জনসংখ্যার ৯ ভাগ শনি, ৭ ভাগ কারেন, ৪ ভাগ রাখাইন। রাখাইনদেরই বাস এই আরাকান রাজ্যে। আমাদের দেশে একসময় এই রাখাইনরা মগ নামে পরিচিত ছিল। ধর্মীয়ভাবেও এদের মাঝে বিভিক্ত আছে। শতকরা ৮৯ ভাগ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ৪ ভাগ মানুষ খ্রিস্টিয় ধর্মাবলম্বী। মুসলমানরা জনসংখ্যার মাত্র ৪ ভাগ। এই মুসলমানরা আরাকান রাজ্যে বসবাস করলেও, চীনা বংশোভূত কিছু মুসলমান চীন-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের এলাকায় বসবাস করে। তবে এদের নিয়ে তেমন সমস্যার কথা শোনা যায় না। শোনা যায় আরাকান রাজ্যে বসবাসকারী মুসলমান তথা রোহিঙ্গাদের নিয়ে। এখানে মূলত মুসলমানদের উচ্ছেদ করে সেখানে বসবাসকারী রাখাইনদের (যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী) একক কর্তৃত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আজকে মিয়ানমারের জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান নব্বইয়ের দশকে বসনিয়া-হারজেগোভিনার জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯২ সালের মার্চে বসনিয়ার জগগোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে গণভোটে রায় দিলে, সেখানে সার্বিয়ার উস্কানিতে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলে। শতকরা ৪৩ ভাগ মুসলমান জগগোষ্ঠী হত্যা, ধর্ষণ ও উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হন। সার্বিয়া এই দেশটিকে সার্বিয়ার একটি আশ্রিত রাজ্য বানাতে চেয়েছিল। জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধে ১৯৯৪ সালের মার্চে ন্যাটোর বিমান বহরকে সার্বীয় অবস্থানের ওপর বিমান হামলা পর্যন্ত চালাতে হয়েছিল। আজ এত বছর পর সেই সার্বিয়া গণহত্যাকারীদের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হচ্ছে। বৃহৎ পরিসরে দেখালে বসনিয়ার সেই পরিস্থিতির সাথে আজকের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির অবশ্য কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মুসলমানরা উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হচ্ছেন এবং রাখাইন রাজ্যটি ধীরে ধীরে একটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে পরিণত হতে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। এমনকি সকল ধরনের সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। এখানে আরো একটি বৈসাদৃশ্য আমাদের চোখে পড়ার কথা। যেখানে বসনিয়ায় ন্যাটোরে এক পর্যায়ে বিমান হামলা চালাতে হয়েছিল, সেখানে আজকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের ব্যাপারে পশ্চিম বিশ্ব নিরব। বরং উল্টো বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দেয়ার 'চাকা' পর্যন্ত দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছে। বাংলাদেশ এমনিতেই জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত। বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। সুতরাং বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করতে বাধ্য নয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশন প্রয়োজনে রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যত্র, এমনকি ইউরোপে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইতোমধ্যে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গারা নানা রকম অনৈতিক ও অসামাজিক কর্মকা-ে লিপ্ত। তারা ইতোমধ্যে কক্সবাজার এলাকার ব্যাপক বনাঞ্চল ধ্বংস করেছে। উপরন্তু মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় তাদের ব্যাপক উপস্থিতি একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। বিদেশিদের 'দুরভিসন্ধি' আমাদের নজরে এসেছে। এমনিতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদেশি তৎপরতা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। আমরা নতুন করে আরেকটি 'সমস্যা' দেখতে চাই না, যেখানে বিদেশি দাতাসংস্থা, এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলানোর সুযোগ পাক। এখানেই এসে যায় রিয়েল পলিটিক্সের প্রশ্নটি। বাংলাদেশ রাহিঙ্গাদের প্রত্যাখ্যান করেছে বটে। কিন্তু কেন প্রত্যাখ্যান করল, তা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে তুলে ধরতে হবে। জাতিসংঘে বিষয়টি প্রয়োজনে তুলতে হবে জোরালোভাবে। কিছু মুসলমান দেশ রয়েছে, যারা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। তাদের বোঝাতে হবে এখানে 'মানবতা' কোনো বিষয় নয়, বিষয় 'রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা'। সেই সঙ্গে দ্রুত মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে 'সংলাপ' শুরু করা উচিত। আমাদের স্বার্থেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে নয়। একাধিক কারণ এই নিরাপত্তা আজ ঝুঁকির মুখে প্রথমত, রোহিঙ্গা ইস্যুটি অবশ্যই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারে জাতিসংঘকেই উদ্যোগ নিতে হবে। জাতিসংঘ তথা পশ্চিমা বিশ্বকে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়। প্রয়োজনে সেখানে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিকে পাঠাতে হবে এবং তাকে পরিস্থিতি মনিটর করার সুযোগ দিতে হবে। দ্বিতীয়, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বয়কট তথা অর্থনৈতিক অবরোধের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। তৃতীয়ত, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শিবিরে সরকারি তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা (রোহিঙ্গা) ১০ হাজার ৪০০ জন। অন্যদিকে টেকনাফের নয়াপাড়া শিবিরে তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা ১৪ হাজার। এর বাইরে আরো প্রায় দুই লাখ আন-রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। রেজিস্টার্ড শরণার্থীরা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন থেকে সাহায্য সহযোগিতা পায়। আন-রেজিস্টার্ডরা কোনো সাহায্য পায় না। ফলে তারা আসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে এ অঞ্চলের নিরাপত্তাকে একটি হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর নতুন করে কোনো ঝুঁকি গ্রহণ করতে পারে না। চতুর্থ, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশি এলাকায় এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি একসময় রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। মিয়ানমারে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের লড়াই অনেক পুরনো। কোচিন, মান জাতিগোষ্ঠী স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। একসময় রোহিঙ্গারাও বাধ্য হবে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে। বাংলাদেশ এর দায় দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন। মিয়ানমার আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। আমাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টারও। আমাদের জ্বালানি ও খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারে মিয়ানমার। সুতরাং আমাদের স্বার্থেই আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি ঘটাতে পারি না। পঞ্চমত, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোনো কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অতি উৎসাহ আমাদের চিন্তিত করে। হঠাৎ করেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার প্রবণতা বাড়েনি। বরং বাইরের কোনো কোনো মহল থেকে এদেরকে বাংলাদেশে আসতে উৎসাহ জোগানো হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রাখাইন (বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী) কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত উৎপীড়ন চলছে, এটা সত্য। তবে দীর্ঘদিন সেখানে এ ব্যাপারে 'স্ট্যাটাস কো' বজায় ছিল। হঠাৎ করেই আবার জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়। এ ব্যাপারে পশ্চিমা শক্তির ইন্ধন রয়েছে। তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করতে চায়। বিশেষ করে এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে মার্কিনি নয়া স্ট্র্যাটেজি স্মরণ করা যেতে পারে। 'চীনকে ঘিরে ফেলার' একটি চক্রান্ত চলছে। মার্কিন নীতি নির্ধারকরা এ লক্ষ্যে এখন কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের দিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিতে চায়। সুতরাং বাংলাদেশ এই মার্কিন স্ট্র্যাটেজির অংশ হতে পারে না। বাংলাদেশ স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ কোনো রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে পারে না। শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি। সুতরাং রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে বাংলাদেশ বাধ্য নয়। বাংলাদেশের এই ভূমিকা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশ মার্কিনি চাপের কাছে মাথা নত করেনি। তবে রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তুলতে পারে। আগামী ১৭ জুলাই মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ওই সময় বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি তুলতে পারে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি হোক, আমরা তা চাই না। আমাদের জাতীয় স্বার্থে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা আমাদের প্রয়োজন রয়েছে।Daily JAI JAI DIN25.6.12
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment