17:32
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪১ বছরে পা দিয়েছে গেল মার্চ মাসে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে ২০১২ সালের ২৬ মার্চ, এই সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে মূলত তিনটি ধারা আমরা লক্ষ্য করব। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা অব্যাহত থাকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। এই তিনটি ধারাতেই কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, (ক) সংসদীয় গণতন্ত্র (খ) সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতায় দলীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা (গ) সমাজতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো, (ঘ) ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতি। কোনো কোনো বিশ্লেষক এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে, এটা ছিল অনেকটা 'ভারতীয় মডেল'। ওই সময়ে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। যেমন_ (ক) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের 'বিশেষ সম্পর্ক' স্থাপন (খ) ভারতের নির্ধারক ভূমিকা। তবে আদর্শ হিসেবে জোট নিরপেক্ষতা অনুসরণ করা, (গ) অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলোর যে সম্পর্ক উন্নয়ন, (ঘ) চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অনীহা ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন ৪৩ মাস। ওই সময় ব্রেজনেভ (সাবেক সোভিয়েত ইউনিযনের রাষ্ট্রপ্রধান) প্রণীত যৌথ নিরাপত্তা চুক্তির প্রতি সমর্থন, তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারের ৭ দফা দাবির প্রতি সমর্থন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা শীর্ষক সম্মেলনের প্রতি সমর্থন ইত্যাদি কারণে বহিঃবিশ্বে একটা ধারণা জন্ম হয়েছিল যে বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলছে, যা এ অঞ্চলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থকে রক্ষা করবে। বহিঃবিশ্বে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণেই বাংলাদেশ ওই সময় সোভিয়েত শিবিরে অবস্থান করছিল এবং সোভিয়েত-ভারত সম্পর্কের কারণে এটা এক ধরনের বাধ্যবাধকতাও ছিল। অভ্যন্তরীণভাবে একটা 'চাপ'ও ছিল, যারা মনে করতেন সোভিয়েত সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশে 'সমাজতন্ত্র' নির্মাণ করা যাবে না। এই সময় ১৯৭২ সালের মার্চে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ছিল বিতর্কিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিলেও ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। চীনের সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগের একটা উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। ১৯৭৫ সালের আগস্টের নিয়োগান্তুক ঘটনার পর বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়। এর আগে ১৯৭৫ সালে যে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তা বাতিল ঘোষিত হয়। সৌদি আরব ও চীন বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট পরবর্তী ঘটনার মধ্যে দিয়ে শহীদ জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জিয়া মনে করতেন, বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইসলামের ব্রিজ স্বরূপ। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করে। আল কুদস কমিটি ও ১৯৮১ সালে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী কমিটিরও সদস্য ছিল বাংলাদেশ। জিয়ার আমলেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী পরিষদের সদস্যপদের একটিতে নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ সম্পর্কিত ঘচঞ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। জেনারেল জিয়া ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে কঠোর হয়েছিলেন। বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে ও একই বছরে ৪২ জাতি ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ফারাক্কা প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিল। পরে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের প্রশ্নে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রশ্নে তার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি চীনের সঙ্গে শুধু সম্পর্ক বৃদ্ধিই করেননি বরং, বাংলাদেশর বৈদেশিক নীতিতে চীনের উপস্থিতিকে প্রয়োজনীয় করে তুলে ছিলেন। সাবেক সোভিয়েত উন্নয়ন কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের (১৯৭৮) ব্যাপারেও বাংলাদেশ কঠোর হয়েছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বেগম জিয়া কিংবা শেখ হাসিনার (১৯৯৬-২০০১) বৈদেশিক নীতি ছিল জিয়া প্রণীত বৈদেশিক নীতির ধারাবাহিকতা। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ব্যাপারে এরশাদ, বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার সরকারের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়নি। তবে শেখ হাসিনার সময় চীনের ওপর থেকে 'সামরিক নির্ভরতা' কিছুটা হ্রাস করে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। এরশাদের সময় (১৯৮২-১৯৯০) পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালের ১৪ জন সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি সমাদৃত হয়েছিলেন। তার আমলেই ১৯৮৫ সালে সার্ক আত্মপ্রকাশ করে, যদিও এর উদ্যোগটা নিয়েছিলেন শহীদ জিয়া। তবে ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌবাহিনী দক্ষিণ তালপট্টি দখল করে নিলেও, তিনি ভারতের ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে পারেননি। বেগম জিয়ার (১৯৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬) বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, (ক) চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া (খ) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো উন্নতকরণ (গ) আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ককে আরো কার্যকরী করা (ঘ) সৌদি আরব-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া (ঙ) ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা। বেগম জিয়ার সময় নিবারক কূটনীতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেয়। তার আমলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। বেগম জিয়ার দ্বিতীয় টার্মে (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ পূর্বমুখী বৈদেশিক নীতির সূচনা করে, যা ছিল আগে উপেক্ষিত। বেগম জিয়ার সময় চীন 'কুনমিং উদ্যোগ' এর কথা বলে (চীনের ইউনান প্রদেশ, মিয়ানমার, ভারতের উত্তর পূবাঞ্চলের রাজ্যগুলো ও থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। কিন্তু ভারতের আগ্রহ ছিল 'গঙ্গা-মেকং সহযোগিতার' ওপর, যে কারণে 'কুনমিং উদ্যোগ' এর আর জট খোলেনি। ভারত এখন আসিয়ান-এর সদস্য হতে চায়। যে কারণ কুনমিং উদ্যোগ-এ যেখানে চীনের জড়িত হওয়ার কথা রয়েছে, সে ব্যাপারে তার আগ্রহ কম। বেগম জিয়ার সময়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য সঙ্কটে মিয়ানমার আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে পারে। শেখ হাসিনা দুই টার্মের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি হয়েছিল। যদিও তার আমলে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তার আমলে সার্ক-এর ভেতর একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত (ঝঅএছ) গৃহীত হয়েছিল। যদিও তা কার্যকরী হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য আমদানি বাড়ে ৩ গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পর পর কয়েকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা প্রশংসিত হয়। তার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশে সফরে আসেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিঝিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে 'হানা' চুক্তিও (হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিসটেন্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্র ঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর থেকে পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার) চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজী হলেও বাংলাদেশ ওই বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ দুটি আঞ্চলিক জোট ডি-৮, বিমসটেক-এ যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে (ইসলামাবাদ মার্চ, ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি একটি মহাজোট সরকার গঠন করেছেন। মহাজোট সরকারের সময় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এবং ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরীও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ফি এখনো নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে ট্রানজিটের বিষয়টি আপেক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনো ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু ইতোমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে_ এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের 'সাতবোন' রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি যেভাবে বাড়ছে তাতে করে আগামী দিনগুলো বাংলাদেশি পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খাবে। এ ক্ষেত্রে 'সাতবোন' রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামোখাতে যে ঋণ দিয়েছে, তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এই ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিং এর ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে 'ভাষা' ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেয়া-নেয়ার ব্যাপারে ভারতের পাল্লাটি ভারী, বাংলাদেশের প্রাপ্তি তুলনামূলক বিচারে কম। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তিস্তা চুক্তি হয়নি। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি সিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি সিটমহলের ব্যাপারেও কোনো সমাধান হয়নি। ভারত আমাদের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। এতে ১৩টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। এই বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমাদানির একটি চুক্তি হলেও, তাতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশে সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে ওই সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাংলাদেশের প্রাপ্তিও এখানে কম। যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান ও জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধরোধ ও নিরাপত্তা সংহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। তবে ধারণ করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখনিতে এটা বেরিয়ে এসেছে যে, এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গড়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান মার্কিনী প্রভাব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে ওঠার আলোকেই হিলারি সফরকে বিশ্লেষণ করতে হবে। হিলারির ওই সফরেও বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ তার পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবশোধিকারের প্রতিশ্রুতি পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র 'টিফা'র বদলে এখন 'টিআইসিএফ' (ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম) চুক্তি করতে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসি) থেকে ভবিষ্যতে সাহায্য পাবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও আমরা পাইনি। তবে হিলারি ক্লিনটনের একটি বক্তব্যে আমি আশাবাদী তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় তিনি বাংলাদেশকে একটি ঝড়ভঃ চড়বিৎ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। যে কোনো বিবেচনায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কিংবা আরএমজি সেক্টরে বিশ্ব আসরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে একটি 'শক্তি' হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। হিলারি ক্লিনটন সেটাই স্বীকার করে গেলেন। যারা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত, তাদের উচিত হবে বাংলাদেশের এই 'অর্জন'কে ধরে রাখা। সমুদ্রসীমায় আমাদের অধিকার নিশ্চিত হওয়ায়, ওই সম্ভাবনা এখন আরো বাড়ল। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থটাই হলো মূল কথা। পররাষ্ট্রনীতি এমনভাবে পরিচালিত করা উচতি, যাতে সর্বদা জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়। এই স্বার্থ সব সময় রক্ষিত হয়েছে, এটা বলা যাবে না। আমাদের সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনাগুলোকে আমরা যদি কাজে লাগাতে পারি, আমাদের সাফল্য সেখানেই নিহিত/.... Daily JAI JAI DIN6.6.12
0 comments:
Post a Comment