রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে মিসর

শেষ পর্যন্ত সকল অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে মিসরে মোহাম্মদ মুরসিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হলেও অনেক প্রশ্নের জবাব এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়নি। একটা অনিশ্চয়তা ছিল কাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হবে, তা নিয়ে। কেননা দু’জন প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি এবং মোহাম্মদ শফিক দু’জনই বিজয়ী হয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন। কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রের কিছু অনিয়ম নিয়ে অভিযোগও ছিল। এরপর নির্ধারিত তারিখে যখন ফলাফল ঘোষণা করা হল না, তখন সৃষ্টি হয়েছিল অনিশ্চয়তার। আবারও তেহরির স্কয়ারে (কায়রো) সমবেত হতে শুরু করল বিপ্লবীরা। এমনি এক পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদ মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর পরপরই মুরসিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই ঘোষণা সব প্রশ্নের জবাব দেয় না। মিসরে বিকাশমান গণতন্ত্র নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে এবং আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে সত্যিকার অর্থেই মিসর কোন দিকে যাচ্ছে। যে প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদের সঙ্গে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে। সর্বোচ্চ সেনা পরিষদ কার্যত একটি ‘সুপার কেবিনেট’ হিসেবে কাজ করছে। এই সেনা পরিষদে ৩০ জন সদস্য রয়েছেন, যারা শীর্ষ সেনা কমান্ডার। তারা অলিখিতভাবে অগাধ ক্ষমতা ভোগ করছেন। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তারা যা বলবেন, সেটাই আইন। অনেকেই জানে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদ মিসরের নয়া সংবিধানে সেনাবাহিনীর জন্য একটি ভূমিকা দাবি করে আসছে। এই সেনা জান্তা কিছুদিন আগে কতগুলো ডিক্রি জারি করে। ওইসব ডিক্রিতে প্রেসিডেন্টের ভূমিকা কমানো হয়। ডিক্রিতে বলা হয়েছে-সেনা বাজেট, সেনা নেতৃত্ব কিংবা যুদ্ধ শুরু করার ব্যাপারে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এমনকি খসড়া সংবিধান চূড়ান্ত করার আগে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদের অনুমোদন নিতে হবে এবং তা তিন মাসের মধ্যে গণভোটে পাস করাতে হবে। সেনা পরিষদ নির্বাচিত পার্লামেন্টকেও বাতিল ঘোষণা করেছিল। সর্বোচ্চ সেনা পরিষদের এই ভূমিকা স্পষ্টতই তাদেরকে বিতর্কিত করেছে। তারা একটি সাংবিধানিক অধিকার চাচ্ছেন এবং এটা যদি স্বীকৃত হয়, তাহলে প্রশাসনে ‘দ্বৈত প্রশাসনিক ক্ষমতা’র জন্ম হবে। একদিকে প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে একটি প্রশাসন, যেখানে একজন প্রধানমন্ত্রী ও কেবিনেট প্রেসিডেন্টকে সহযোগিতা করবেন। অন্যদিকে সর্বোচ্চ সেনা পরিষদের নেতৃত্বে একটি অদৃশ্যমান ‘সুপার কেবিনেট’, যারা কোনো কোনো বিষয়ে তাদের ভেটো প্রয়োগ করবে। এই সেনা পরিষদ একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নামও ঘোষণা করেছে। এর আগে নির্বাচিত সংসদ যে কমিটি গঠন করেছিল, তা সেনা পরিষদ বাতিল ঘোষণা করেছিল। এখন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কী করবেন? একদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা। মোহাম্মদ মুরসির জন্য বিষয়টি যে খুব সহজ হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, মোহাম্মদ মুরসি কি ইসলামের শরিয়াভিত্তিক একটি সমাজ বিনির্মাণের উদ্যোগ নেবেন মিসরে? তার দল ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস’ পার্টি। ইসলামিক ব্রাদারহুড একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে। মুরসি কি এদিকে মিসরকে চালিত করবেন? এই মুহূর্তে এটি স্পষ্ট নয়। তবে মুরসি অতটা কট্টরপন্থী নন। তিনি ইসলামপন্থী। তিনি ইসলাম আর গণতন্ত্রকে এক কাতারে দেখতে চান। আর এ কারণে তিনি ‘ইসলামিক গণতন্ত্র’র কথা বলছেন। সম্ভবত মিসর ‘তুরস্ক মডেল’ অনুসরণ করবে। তুরস্কে ইসলামপন্থীরা জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছেন। তুরস্কের সেনাবাহিনী ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের অনুসারী। মিসরের সেনাবাহিনীও অনেকটা তাই। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুরস্কের ক্ষমতাসীন এরদোগান সরকারের দ্বন্দ্বের কথা সবাই জানেন। সেনাবাহিনী এখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। যে কারণে সেখানে সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা কম। মুরসি এমনটি চাইবেন মিসরের জন্য। এ ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সফল হবেন তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। তৃতীয়ত, ইসরায়েলের ব্যাপারে নয়া প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। কেননা ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতির কারণে সমগ্র আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক কখনও ভালো হয়নি। ১৯৭৮ সালে মিসরের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও এ সম্পর্ক কখনই উন্নত হয়নি। এমনকি কট্টরপন্থীদের হাতে মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছিল, যদিও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মুরসিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং নয়া প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন তিনি সকল চুক্তির প্রতি সম্মান জানাবেন। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। কেননা ব্রাদারহুডের নেতৃত্ব এখনও পরিপূর্ণভাবে ‘ইসরায়েল বিরোধিতা’ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। তারা যে প্রেসিডেন্টকে প্রভাব খাটাবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
এখানেই এসে যায় ‘রিয়েল পলিটিক্স’-এর বিষয়টি। মুরসি এই রিয়েল পলিট্রিক্স’ কতটুকু অনুসরণ করেন, সেটাই দেখার বিষয়। তবে আমি মোহাম্মদ মুরসির সাম্প্রতিক দেওয়া বক্তব্যে আশাবাদী। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি একটি জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি এই মুহূর্তে খুবই জরুরি। কেননা মিসর এখন একটি ‘বিভক্ত’ সমাজ। একদিকে রয়েছে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা, অন্যদিকে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মোবারক সমর্থকরা। ২০১১ সালে তেহরির স্কয়ারের ১৭ দিনের ‘বিপ্লব’ নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল মিসরে। দীর্ঘ ১৭ দিন দখলে রেখেছিল ‘বিপ্লবীরা’। মূলত তরুণরাই এই বিপ্লবের নায়ক। এরা সবাই যে ইসলামিক আদর্শকে পছন্দ করেন, তা নয়। তারা   মোবারকের অপশাসন (১৯৮১ সাল থেকে ক্ষমতায় ছিলেন) থেকে মিসরকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ওই তরুণরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে বিপ্লবকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ মুরসিকে সমর্থন করেছেন, এটা সত্যি। কিন্তু মিসর ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র হোক, এটি তারা চাইবে না। মিসর বিপ্লবে নারীরা একটা বড় ভূমিকা রেখেছেন। সেনাবাহিনীর হাতে অনেক তরুণী নিগৃহীতও হয়েছিলেন। এরা নিশ্চয়ই চাইবেন না মিসরে নারীদের অধিকার সঙ্কুুচিত হোক, বাধ্যতামূলক পর্দাপ্রথা আরোপ করা হোক। মিসরের নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন। তারা আধুনিকমনস্ক। পূর্ণ পর্দাপ্রথা তারা অনুসরণ না করলেও শালীনতা তারা বজায় রেখে চলেন। নয়া নেতৃত্ব নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করেন। মিসরের সংখ্যালঘু ‘কপটিক খ্রিস্টান’রা কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত। আশঙ্কা করছেন তারা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। সম্ভবত এটা উপলব্ধি করেই নয়া প্রেসিডেন্ট অঙ্গীকার করেছেন নতুন সরকারে ‘কপটিক খ্রিস্টান’দের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং নয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। মুরসি বাস্তববাদী। তিনি সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছেন। তিনি আধুনিকমনস্ক একজন মানুষ। প্রকৌশল বিদ্যায় আমেরিকা থেকে ডক্টরেট ডিগ্রিও নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। তার রাজনৈতিক জীবন মাত্র ১২ বছরের। দীর্ঘ ৮৪ বছরের একটি সংগঠনের (ইসলামিক ব্রাদারহুড) প্রতিনিধি তিনি। দলে কট্টরপন্থী, উগ্র ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাসী এবং শরিয়া আইনভিত্তিক একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লোক অনেক রয়েছে। এদের ‘চাপ’ও থাকবে তার ওপর। এই ‘চাপ’ উপেক্ষা করে ইসলামিক আদর্শ ও গণতন্ত্রকে একত্রিত করে ‘নতুন এক মিসর’ কীভাবে তিনি জন্ম দেন, সেটাই দেখার বিষয়।
আরব বিশ্বে যে বসন্তের ঢেউ বইছিল, তা এখন দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করছে। তিউনিসিয়ার পর মিসরে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের উচ্ছেদের পর জনগণের ভোটে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাসীন হয়েছেন। এটা বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তর। তৃতীয় স্তরে হয় কট্টরপন্থীরা ক্ষমতা নেবেন, নতুবা আধুনিকমনস্ক ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবেন। এই মুহূর্তে মিসরে মুরসির জন্য সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ পাঁচটি। এক. সেনাবাহিনীর পূর্ণ আস্থা অর্জন করা। সর্ব্বোচ্চ সেনা পরিষদের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে যাওয়া। দুই. সেনাবাহিনীকে একধরনের সাংবিধানিক অধিকার দেওয়া। সংবিধানে এই অধিকার না দেওয়া হলেও পরোক্ষভাবে এই অধিকার তিনি দিতে পারেন। তিন. একটি সাংবিধানিক পরিষদ গঠন ও একটি নয়া সংবিধান প্রণয়ন করা। চার. সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। পাঁচ. ইসরায়েলসহ দাতা দেশগুলোর আস্থা অর্জন করা। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি ঘোষণা করেছেন ‘ঞযব ত্বাড়ষঁঃরড়হ পড়হঃরহঁবং ঁহঃরষ বি ধপযরবাব ধষষ ড়ঁত্ ধরসং’. অর্থাত্ বিপ্লব চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করি। যদিও মুরসি ‘লক্ষ্য’গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়। নিঃসন্দেহে মুরসির বিজয়ের মধ্য দিয়ে নতুন এক ইতিহাস রচিত হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়।
Daily SAKALER KHOBOR
26.6.12

0 comments:

Post a Comment