একটা প্রশ্ন এখন অনেকের মনে- কী হতে যাচ্ছে ১০ জুনের পর? বিরোধী দল একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ১০ জুন হচ্ছে ওই সময়সীমা। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে বিরোধী দলের দাবি সরকারকে মেনে নিতে হবে। আর যদি সরকার না মানে, তাহলে ঢাকায় আহূত জনসভায় বেগম জিয়া নতুন কর্মসূচি দেবেন। প্রশ্নটা সেখানে, নতুন কর্মসূচি কী? হরতাল, লাগাতার হরতাল? অবরোধ? নাকি অন্য কিছু? বিরোধী দল বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আর সরকার বলছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এখানেই জট লেগে আছে। খুলছে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও বিরোধী দল রাজি হতে পারে। কিন্তু এর কাঠামো কী? সংবিধান যদি অনুসরণ করি, তাহলে ব্যাপারটা এ রকম যে সরকার তার মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন করবে এবং ওই সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে চিহ্নিত হবে। সরকার কি তাহলে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথাই বলতে চাইছে? যদিও সৈয়দ আশরাফ বিষয়টি খোলাসা করেননি। তবে মন্ত্রীদের কথাবার্তায় তো সে কথাই মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও অনেকটা এভাবেই বলছেন। এতে করে জট খুলবে না। কোনো সংলাপও হবে না। বলতে গেলে এ দেশের সুশীল সমাজের প্রায় সবাই বলছেন একটি সংলাপ হোক, একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো দাঁড় করানো হোক, যারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। হিলারি ক্লিনটন বলে গেলেন সে কথা। তাঁর কথার প্রতিধ্বনি করলেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত। আর সর্বশেষ গত ৩০ মে এদের সুরে সুর মেলালেন অ্যালিস্টার বার্ট, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মন্ত্রী। বললেন, 'বাংলাদেশে অবাধ, সুষুম ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করে যুক্তরাজ্য। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বললেন না বটে, কিন্তু সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেন।' একটি সংলাপ হবে, এমনটাও আশা করলেন তিনি। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নই তো ফিরে আসছে- সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা নিশ্চিত করব কিভাবে?
সরকার হার্ডলাইনে গেছে, এ কথাটা সরাসরিই বলেন মন্ত্রীরা। এর প্রমাণ তো আমরা পাচ্ছিই। পাঁচজন এমপিসহ বিরোধী দলের ৩৩ জন নেতা-কর্মীকে জেলে পাঠানো হয়েছিল যে 'অভিযোগের' পরিপ্রেক্ষিতে, সেই অভিযোগটি নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। অভিযোগটি গুরুতর- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মুখে বাসে অগি্নসংযোগ। পাঁচজন এমপি ছাড়া পেয়েছেন। বাকিরা পাননি, যাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবও। তাঁর বিরুদ্ধে সচিবালয়ে বোমা নিক্ষেপের ঘটনায় অভিযোগ এনে চার্জশিটও দাখিল করা হয়েছে। ফলে ঝুলে গেছে সংলাপ-প্রক্রিয়া। এসব সংলাপ হবে, ওই বিশ্বাসটা রাখতে পারছি না। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে। পুলিশ এখন নিয়ন্ত্রণহীন। কেউ তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সাংবাদিক পেটানো থেকে শুরু করে আদালতপাড়ায় তরুণীর শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে পুলিশ। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ ঘটনায় পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছেন। অতীতেও একাধিকবার আদালত পুলিশ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতির নির্দেশ দিয়েছেন। ভর্ৎসনা করেছেন, তাতে কিছু একটা হয়েছে বলে মনে হয় না। যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে 'সার্টিফিকেট' দেন, যেখানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের পুলিশের কাছ থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন, যেখানে অত্যন্ত ক্ষমতাবান আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব 'ষড়যন্ত্র' আবিষ্কার করেন, সেখানে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠবে- এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা কি ভুলে গেছি বহির্বিশ্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকলাপ মনিটর করা হচ্ছে। অ্যালিস্টার বার্ট বলে গেলেন, তাঁরা র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় র্যাবকে প্রশিক্ষণ দেওয়া বন্ধ করেছেন। লন্ডনের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকারবিষয়ক রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। আর সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের যে রিপোর্ট, তা তো আমাদের জন্য কোনো আসার কথা বলে না। রাজনীতির বাইরেও অর্থনীতির যে সূচক, তাতেও তো কোনো ভালো খবর নেই। গড়ভিত্তিক মূল্যস্ফীতি এখন ১০.৮৬ শতাংশ। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ৪১.৪৭ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে মাত্র ৮.৪১ শতাংশ। অথচ আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১.২২ শতাংশ। টাকার মান কমেছে। বাজেট এলেই ভয় হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন কোন জিনিসের দাম আবার বেড়ে যাচ্ছে! কুইক রেন্টাল নিয়ে 'নানা' কাহিনী। এ কাহিনী সাধারণ মানুষ জানে না। বোঝে না। কিন্তু বোঝে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ মাঝেমধ্যে আসে মাত্র। এখন শোনা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম আবার বাড়বে! আগামী দেড় বছর সরকারের জন্য অনেক কঠিন সময়। একটা সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে পরিস্থিতি যে অসহনীয় হয়ে উঠবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। একটি সমঝোতা এখন কিভাবে সম্ভব? প্রধানমন্ত্রী তথা বর্তমান মন্ত্রিপরিষদকে ক্ষমতায় রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেই সরকার বিরোধী দল কেন, কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে যদি ষষ্ঠ সংসদের মতো একটি ঝুঁকি নেয়, তাহলে ভুল করবে। আমরা আর ইয়াজউদ্দিন মার্কা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাব না- এটা ঠিক আছে। কিন্তু সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক না হোক, অন্য কোনো নামে একটি নির্দলীয় সরকার গঠন করতে হবে। বিএনপি যদি নিজেরাই একটা 'ফর্মুলা' দেয়, তাতেও আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। আর সেটা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোনো মানে নেই। বিএনপি ১১ জুনের মহাসমাবেশে এই 'ফর্মুলা' উপস্থাপন করতে পারে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এ দেশের দুটি অবিসংবাদিত শক্তি। দুটি শক্তিই প্রায় সমানসংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল এ কথাই প্রমাণ করে। এ ক্ষেত্রে কখনো আওয়ামী লীগ জনসমর্থনে এগিয়ে থাকে, কখনো থাকে বিএনপি। সুতরাং এটা উপলব্ধি করেই একটা সমঝোতা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ যদি ভালো কাজ করে থাকে, তাহলে জনগণ আবার দলটিকে ক্ষমতায় পাঠাবে। আর জনসমর্থন নিশ্চিত করা না গেলে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। গণতন্ত্র এ কথাটাই শেখায়। সংবিধানের যুক্তি তুলে ধরা হয় বটে, কিন্তু বিশ্ব ইতিহাস বলে সংবিধানের বাইরে গিয়েও সমঝোতা হয়েছে। যেমন- কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে ২০০৮ সালে। সরকার ও বিরোধী দল মিলেই সেখানে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করে আসছে। আসলে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে আন্তরিকতা। বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ যদি আন্তরিক হয়, তাহলে সমাধান সম্ভব। হার্ডলাইন কখনো মঙ্গল ডেকে আনে না।Daily KALERKONTHO6.6.12
0 comments:
Post a Comment