খবরটি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে গত ১৭ জুন। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত, যারা গবেষণা করেন তারা এ সংবাদটি পাঠ করে উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারবেন না। সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন প্রভাষক তার পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রায় ১২ লাখ ৭৫ হাজার ৪৭ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। ২০০৮ সালে পিএইচডির কাজ শুরু করে ২০১১ সালের মে মাসে তিনি থিসিস জমা দেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ওই গবেষক ২২ জন অধ্যাপকের নাম উল্লেখ করেছেনÑ যারা তার সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। তার এ গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. শওকত আরা হোসেন। বহিঃস্থ দু’জন পরীক্ষক হলেন অধ্যাপক আবদুল মান্নান (জাহাঙ্গীরনগর) ও অধ্যাপক মকসুদুর রহমান (রাজশাহী)। অধ্যাপক মান্নানের নিজের কোন পিএইচডি ডিগ্রি নেই।
সংবাদটি পাঠ করে আমার মনে নানা প্রশ্নের জš§ হয়েছে। আমার ধারণা, আরও অনেক শিক্ষকের মনে দেখা দিয়েছে একই প্রশ্ন। প্রথমত, প্রায় ১৩ লাখ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব কি-না? আর যদি সম্ভব হয়েও থাকে, তবে তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তিনি কিভাবে ‘এনালাইসিস’ করলেন? এটা সম্ভব কি-না? যারা রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন তারা জানেন এটি আদৌ সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ এভাবে কাজ করেন না। আমি জানি না তত্ত্বাবধায়ক অথবা বহিঃস্থ পরীক্ষকরা এটি আদৌ যাচাই করে দেখেছেন কি-না। আমার ধারণা, এটি করা হয়নি। তারা তা না করে একটা ‘ইনটেলেকচুয়াল’ অপরাধ করেছেন। এ অপরাধে ওই তত্ত্বাবধায়ক তথা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়। দ্বিতীয়ত, গবেষণার বিষয়টি ছিল মার্কসবাদ এবং বর্তমান বিশ্বে এর প্রভাব নিয়ে। স্পষ্টতই এটা একটা বিশাল ক্ষেত্র। গবেষণার ক্ষেত্রে ‘কেস স্টাডি’ হিসেবে একটা দেশকে বেছে নেয়া হয়। গবেষক তা করেননি। বিশাল একটা ক্ষেত্র তিনি বেছে নিয়েছিলেন। এটি নিয়ে প্রবন্ধ লেখা যায়, কোন পিএইচডি গবেষণা হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের উচ্চতর শিক্ষা কমিটি কীভাবে এ প্রস্তাব অনুমোদন করল আমি তা ভেবে পাই না। উপরন্তু আমার কাছে আরও অবাক লেগেছে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অধ্যাপক শওকত আরা হোসেনের নাম দেখে। অধ্যাপক শওকত আরা আদৌ মার্কসবাদ নিয়ে কোন প্রবন্ধ লেখেননি, গ্রন্থ তো দূরের কথা। তিনি কী করে তত্ত্বাবধায়ক হলেন? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। চীনে মার্কসবাদ নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছেÑ সেখানে পূর্ব এশিয়ার ঘবড় অঁঃযড়ৎরঃধৎরধহরংস, লাতিন আমেরিকার ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃরংস এবং পশ্চিম ইউরোপের ঝড়পরধষ উবসড়পৎধপু’র এক সংমিশ্রণ ঘটেছে। এসব বিষয় সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক আদৌ ধারণা রাখেন কি-না, আমার সন্দেহ রয়েছে। উপরন্তু দু’জন বহিঃস্থ পরীক্ষক অধ্যাপক মান্নান ও মকসুদুর রহমান কেউই এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। স্পষ্টতই পরীক্ষা কমিটি গঠনের ব্যাপারে অসততার আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। কেননা পিএইচডি গবেষণা কোন ‘ছেলেখেলার’ বিষয় নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে যদি এ ধরনের থিসিস ‘তৈরি’ হয় (কোন রকম তত্ত্বাবধান ছাড়াই!), তাহলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আমরা কোথায় নিয়ে গেলাম। আমি জানি, বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ ক’জন প্রবীণ ও সিনিয়র অধ্যাপক রয়েছেন, যারা এ গবেষণাটি তত্ত্বাবধান তথা পরীক্ষা করতে পারতেন। এ গবেষণায় তাদের কেন অন্তর্ভুক্ত করা হল না, এ প্রশ্ন থেকেই গেল। তৃতীয়ত, আমি থিসিসটি দেখিনি, কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে ধারণা করছি প্রচণ্ড রকম ‘মেথোডোলজিক্যাল’ সমস্যা রয়েছে এতে। কিভাবে এটি উচ্চতর কমিটি তথা ডিন কমিটি পার হল, বুঝতে কষ্ট হয়। চতুর্থত, আকার-ইঙ্গিতে অভিযোগ করা হয়েছে, থিসিসটির সঙ্গে একটি ‘রাজনীতি’ আছে। এতদিন শুনে এসেছি, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এখন শুনলাম পিএইচডি ডিগ্রিও দেয়া হচ্ছে! অধ্যাপক শওকত আরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। তিনি খুব উঁচুমানের পণ্ডিত, তা বলা যাবে না। তবে ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে রয়েছেন। আর ওই গবেষক নিজেও একই রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার অনুসারী। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘পেট্রোনাইজেশন’ হয়েছে বলে আমার ধারণা। বহিঃস্থ দু’জন পরীক্ষকের সঙ্গে অধ্যাপক শওকত আরার ব্যাপক যোগসাজশ রয়েছে। অধ্যাপক মান্নানের স্ত্রীর পিএইচডি থিসিসেরও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক শওকত আরা। মিসেস মান্নান এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পঞ্চমত, অধ্যাপক শওকত আরা প্রতিবেদকের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, ওই গবেষক প্রায় ১৩ লাখ লোকের (৮০টি দেশের) সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন তার কাছে এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট চাইতে পারে। তিনি যদি দেখাতে ব্যর্থ হন, তাহলে ভবিষ্যতে তাকে সব ধরনের গবেষণা থেকে নিবৃত রাখা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উত্তম কাজ। ষষ্ঠত, ওই গবেষক ২২ জন অধ্যাপককে তার সহকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কী ঔদ্ধত্য! প্রভাষক হয়ে একজন অধ্যাপককে দেখান ‘গবেষণা সহকারী’! বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই ২২ জন অধ্যাপকের কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাইতে পারে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আমাদের জন্য অনেক চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। এভাবে আমরা তথাকথিত পিএইচডি ডিগ্রি দেব কি-না? এ ধরনের প্রবণতা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে সারাদেশ লাখ লাখ পিএইচডিতে ভরে যাবে। এমনিতেই পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে আমরা বিপদে আছি। শত শত ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিতে দেশ ভরে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অনেক শিক্ষকের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে কথা উঠেছে। কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে (তাদের চাকরি থাকে কীভাবে?)। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’একজন শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনলাইনে করা পিএইচডি ডিগ্রির এখন রমরমা বাজার বাংলাদেশ। একজন সাবেক সচিব (তিনি আবার কলাম লেখকও বটে) অনলাইনে ডিগ্রি নিয়ে নির্দ্বিধায় তা ব্যবহার করছেন। অথচ একজন সাবেক সচিবের জানার কথা, অনলাইনে নেয়া পিএইচডি ডিগ্রি নামের আগে ব্যবহার করা যায় না। আরও একজন এনজিও ব্যক্তিত্ব ‘অধ্যাপক’ ও ‘পিএইচডি’ ডিগ্রি দুটোই ব্যবহার করে চলেছেন কোনরকম লজ্জা-শরম ছাড়াই। একটি টিভি চ্যানেলের মালিক, তিনিও পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। অথচ তারা জানেন না পিএইচডি একটি গবেষণা। বছরের পর বছর লাইব্রেরি ঘেঁটে, ফিল্ড ওয়ার্ক করে গবেষণা কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। তা না করে কোন একটি সংস্থা কাউকে ‘সম্মানজনক’ পিএইচডি ডিগ্রি দিল, আর তিনি তা ব্যবহার করতে শুরু করলেন! জানা যায়, ঢাকার বনশ্রীতে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈঁষঃঁৎব টহরাবৎংরঃু নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছেÑ তারাও টাকার বিনিময়ে পিএইচডি দিচ্ছে!
উচ্চশিক্ষা আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, এসব ঘটনা তার বড় প্রমাণ। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এভাবে ডিগ্রি কেনা যায় কি-না, ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করা যায় কি-না, আমার জানা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা বড় ব্যর্থতাÑ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী থাকলেও তারা এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ থাকলে, ওই ‘ভূত’ আমরা তাড়াব কীভাবে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এতদিন শুধু সার্টিফিকেট বিক্রি করত। এখন সেখানে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির ছড়াছড়ি। সেদিন পত্রিকায় এক অধ্যাপিকার ছবি দেখলাম, যিনি এখন স্বামীর মালিনাকাধীন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ভিসি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন! বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাচ্ছেন, তিনি পিএইচডি করে ফেলেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কবে করলেন তিনি গবেষণা? কবে গেলেন ওখানে? দিনের পর দিন ঢাকায় থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে কি গবেষণা করা যায়! হায়রে পিএইচডি! এ দেশে বুঝি সবই সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তরুণ প্রভাষক ও তার তত্ত্বাবধায়কের কর্মকাণ্ড দেখে আমি উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। জানি না আর কতদিন শিক্ষকতায় থাকতে পারব! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পণ্ডিত শিক্ষক আছেন, যারা আমার নমস্য। তারা কি বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন? তারা যদি সোচ্চার না হন, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ধরে রাখা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও একটি ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের হাত থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচানোর দায়িত্ব তাদের। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় বিষয়টি এড়িয়ে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ’ শিক্ষকের মান-সম্মানের প্রশ্নও জড়িত। আমি এক সময় এ বিভাগের ছাত্র ছিলাম। আজ আমি নিজেও বিব্রতবোধ করছি। যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তিনি আবার ইতিমধ্যে বিভাগের অপর পাঁচজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাদের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অথচ এ পাঁচ শিক্ষকের সবাই ৫ থেকে ৭ বছর আগে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং তাদের ডিগ্রি নিয়ে কখনও প্রশ্ন তোলা হয়নি। ভিসি ইতিমধ্যে অভিযুক্ত শিক্ষকের পিএইচডি থিসিস পরীক্ষার জন্য প্রো-ভিসিকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। আমরা চাই, তদন্ত রিপোর্টটি দ্রুত প্রকাশিত হোক। আর ইউজিসির চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া পিএইচডি শনাক্ত করতে সব শিক্ষকের ‘ডাটাবেজ’ তৈরি করার জন্য। আমরা উচ্চশিক্ষার অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। আর ক্ষতি করতে চাই না।
Daily JUGANTOR
23.6.12
সংবাদটি পাঠ করে আমার মনে নানা প্রশ্নের জš§ হয়েছে। আমার ধারণা, আরও অনেক শিক্ষকের মনে দেখা দিয়েছে একই প্রশ্ন। প্রথমত, প্রায় ১৩ লাখ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব কি-না? আর যদি সম্ভব হয়েও থাকে, তবে তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তিনি কিভাবে ‘এনালাইসিস’ করলেন? এটা সম্ভব কি-না? যারা রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন তারা জানেন এটি আদৌ সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ এভাবে কাজ করেন না। আমি জানি না তত্ত্বাবধায়ক অথবা বহিঃস্থ পরীক্ষকরা এটি আদৌ যাচাই করে দেখেছেন কি-না। আমার ধারণা, এটি করা হয়নি। তারা তা না করে একটা ‘ইনটেলেকচুয়াল’ অপরাধ করেছেন। এ অপরাধে ওই তত্ত্বাবধায়ক তথা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়। দ্বিতীয়ত, গবেষণার বিষয়টি ছিল মার্কসবাদ এবং বর্তমান বিশ্বে এর প্রভাব নিয়ে। স্পষ্টতই এটা একটা বিশাল ক্ষেত্র। গবেষণার ক্ষেত্রে ‘কেস স্টাডি’ হিসেবে একটা দেশকে বেছে নেয়া হয়। গবেষক তা করেননি। বিশাল একটা ক্ষেত্র তিনি বেছে নিয়েছিলেন। এটি নিয়ে প্রবন্ধ লেখা যায়, কোন পিএইচডি গবেষণা হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের উচ্চতর শিক্ষা কমিটি কীভাবে এ প্রস্তাব অনুমোদন করল আমি তা ভেবে পাই না। উপরন্তু আমার কাছে আরও অবাক লেগেছে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অধ্যাপক শওকত আরা হোসেনের নাম দেখে। অধ্যাপক শওকত আরা আদৌ মার্কসবাদ নিয়ে কোন প্রবন্ধ লেখেননি, গ্রন্থ তো দূরের কথা। তিনি কী করে তত্ত্বাবধায়ক হলেন? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। চীনে মার্কসবাদ নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছেÑ সেখানে পূর্ব এশিয়ার ঘবড় অঁঃযড়ৎরঃধৎরধহরংস, লাতিন আমেরিকার ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃরংস এবং পশ্চিম ইউরোপের ঝড়পরধষ উবসড়পৎধপু’র এক সংমিশ্রণ ঘটেছে। এসব বিষয় সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক আদৌ ধারণা রাখেন কি-না, আমার সন্দেহ রয়েছে। উপরন্তু দু’জন বহিঃস্থ পরীক্ষক অধ্যাপক মান্নান ও মকসুদুর রহমান কেউই এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। স্পষ্টতই পরীক্ষা কমিটি গঠনের ব্যাপারে অসততার আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। কেননা পিএইচডি গবেষণা কোন ‘ছেলেখেলার’ বিষয় নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে যদি এ ধরনের থিসিস ‘তৈরি’ হয় (কোন রকম তত্ত্বাবধান ছাড়াই!), তাহলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আমরা কোথায় নিয়ে গেলাম। আমি জানি, বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ ক’জন প্রবীণ ও সিনিয়র অধ্যাপক রয়েছেন, যারা এ গবেষণাটি তত্ত্বাবধান তথা পরীক্ষা করতে পারতেন। এ গবেষণায় তাদের কেন অন্তর্ভুক্ত করা হল না, এ প্রশ্ন থেকেই গেল। তৃতীয়ত, আমি থিসিসটি দেখিনি, কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে ধারণা করছি প্রচণ্ড রকম ‘মেথোডোলজিক্যাল’ সমস্যা রয়েছে এতে। কিভাবে এটি উচ্চতর কমিটি তথা ডিন কমিটি পার হল, বুঝতে কষ্ট হয়। চতুর্থত, আকার-ইঙ্গিতে অভিযোগ করা হয়েছে, থিসিসটির সঙ্গে একটি ‘রাজনীতি’ আছে। এতদিন শুনে এসেছি, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এখন শুনলাম পিএইচডি ডিগ্রিও দেয়া হচ্ছে! অধ্যাপক শওকত আরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। তিনি খুব উঁচুমানের পণ্ডিত, তা বলা যাবে না। তবে ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে রয়েছেন। আর ওই গবেষক নিজেও একই রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার অনুসারী। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘পেট্রোনাইজেশন’ হয়েছে বলে আমার ধারণা। বহিঃস্থ দু’জন পরীক্ষকের সঙ্গে অধ্যাপক শওকত আরার ব্যাপক যোগসাজশ রয়েছে। অধ্যাপক মান্নানের স্ত্রীর পিএইচডি থিসিসেরও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক শওকত আরা। মিসেস মান্নান এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পঞ্চমত, অধ্যাপক শওকত আরা প্রতিবেদকের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, ওই গবেষক প্রায় ১৩ লাখ লোকের (৮০টি দেশের) সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন তার কাছে এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট চাইতে পারে। তিনি যদি দেখাতে ব্যর্থ হন, তাহলে ভবিষ্যতে তাকে সব ধরনের গবেষণা থেকে নিবৃত রাখা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উত্তম কাজ। ষষ্ঠত, ওই গবেষক ২২ জন অধ্যাপককে তার সহকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কী ঔদ্ধত্য! প্রভাষক হয়ে একজন অধ্যাপককে দেখান ‘গবেষণা সহকারী’! বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই ২২ জন অধ্যাপকের কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাইতে পারে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আমাদের জন্য অনেক চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। এভাবে আমরা তথাকথিত পিএইচডি ডিগ্রি দেব কি-না? এ ধরনের প্রবণতা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে সারাদেশ লাখ লাখ পিএইচডিতে ভরে যাবে। এমনিতেই পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে আমরা বিপদে আছি। শত শত ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিতে দেশ ভরে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অনেক শিক্ষকের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে কথা উঠেছে। কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে (তাদের চাকরি থাকে কীভাবে?)। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’একজন শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনলাইনে করা পিএইচডি ডিগ্রির এখন রমরমা বাজার বাংলাদেশ। একজন সাবেক সচিব (তিনি আবার কলাম লেখকও বটে) অনলাইনে ডিগ্রি নিয়ে নির্দ্বিধায় তা ব্যবহার করছেন। অথচ একজন সাবেক সচিবের জানার কথা, অনলাইনে নেয়া পিএইচডি ডিগ্রি নামের আগে ব্যবহার করা যায় না। আরও একজন এনজিও ব্যক্তিত্ব ‘অধ্যাপক’ ও ‘পিএইচডি’ ডিগ্রি দুটোই ব্যবহার করে চলেছেন কোনরকম লজ্জা-শরম ছাড়াই। একটি টিভি চ্যানেলের মালিক, তিনিও পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করছেন। অথচ তারা জানেন না পিএইচডি একটি গবেষণা। বছরের পর বছর লাইব্রেরি ঘেঁটে, ফিল্ড ওয়ার্ক করে গবেষণা কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। তা না করে কোন একটি সংস্থা কাউকে ‘সম্মানজনক’ পিএইচডি ডিগ্রি দিল, আর তিনি তা ব্যবহার করতে শুরু করলেন! জানা যায়, ঢাকার বনশ্রীতে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈঁষঃঁৎব টহরাবৎংরঃু নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছেÑ তারাও টাকার বিনিময়ে পিএইচডি দিচ্ছে!
উচ্চশিক্ষা আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, এসব ঘটনা তার বড় প্রমাণ। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এভাবে ডিগ্রি কেনা যায় কি-না, ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করা যায় কি-না, আমার জানা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা বড় ব্যর্থতাÑ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী থাকলেও তারা এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ থাকলে, ওই ‘ভূত’ আমরা তাড়াব কীভাবে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এতদিন শুধু সার্টিফিকেট বিক্রি করত। এখন সেখানে ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রির ছড়াছড়ি। সেদিন পত্রিকায় এক অধ্যাপিকার ছবি দেখলাম, যিনি এখন স্বামীর মালিনাকাধীন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ভিসি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন! বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাচ্ছেন, তিনি পিএইচডি করে ফেলেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কবে করলেন তিনি গবেষণা? কবে গেলেন ওখানে? দিনের পর দিন ঢাকায় থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে কি গবেষণা করা যায়! হায়রে পিএইচডি! এ দেশে বুঝি সবই সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তরুণ প্রভাষক ও তার তত্ত্বাবধায়কের কর্মকাণ্ড দেখে আমি উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। জানি না আর কতদিন শিক্ষকতায় থাকতে পারব! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পণ্ডিত শিক্ষক আছেন, যারা আমার নমস্য। তারা কি বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন? তারা যদি সোচ্চার না হন, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ধরে রাখা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও একটি ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের হাত থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচানোর দায়িত্ব তাদের। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় বিষয়টি এড়িয়ে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ’ শিক্ষকের মান-সম্মানের প্রশ্নও জড়িত। আমি এক সময় এ বিভাগের ছাত্র ছিলাম। আজ আমি নিজেও বিব্রতবোধ করছি। যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তিনি আবার ইতিমধ্যে বিভাগের অপর পাঁচজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাদের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অথচ এ পাঁচ শিক্ষকের সবাই ৫ থেকে ৭ বছর আগে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং তাদের ডিগ্রি নিয়ে কখনও প্রশ্ন তোলা হয়নি। ভিসি ইতিমধ্যে অভিযুক্ত শিক্ষকের পিএইচডি থিসিস পরীক্ষার জন্য প্রো-ভিসিকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। আমরা চাই, তদন্ত রিপোর্টটি দ্রুত প্রকাশিত হোক। আর ইউজিসির চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া পিএইচডি শনাক্ত করতে সব শিক্ষকের ‘ডাটাবেজ’ তৈরি করার জন্য। আমরা উচ্চশিক্ষার অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। আর ক্ষতি করতে চাই না।
Daily JUGANTOR
23.6.12
0 comments:
Post a Comment