অং
সান সূ চি যেদিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন, সেদিন পুরো বিশ্ব অবাক হয়ে
তাকিয়েছিল মিয়ানমারের দিকে। যাক বাবা, দীর্ঘ দিনের সামরিক শাসনের লৌহ কপাট
ভেঙ্গে তাহলে দেশটি সংস্কার আর বিনিয়োগের পথ ধরেই আগাবে। ২৪ বছর পর
পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে সূ চি দেশের বাইরে সফরে গিয়ে সেই আমন্ত্রণ জানালেন। আর
সে নিমন্ত্রণ রক্ষায় যখন অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনি ফের অঘটন।
আরাকানে মুসলিম নিধন। মিয়ানমারের এ প্রদেশটির নামও পাল্টে ফেলা হয়েছে রাখাইন নামে। দেশটিতে মুসলিম নিধন অনেক পুরোনো কাহিনী। রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী দাবি করে নাগরিকের মর্যাদা দিতে নারাজ মিয়ানমার।
এমনি এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হামলার শিকার রোহিঙ্গা মুলমানদের সীমান্তে ফিরিয়ে না দিয়ে আশ্রয় দেবার আবেদন জানিয়েছে।
সরকারি হিসেবে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয়ের হিসেব থাকলেও এ সংখ্যা বেসরকারি হিসেবে ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে অনেক সামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ তাই আরো শরণার্থী নিতে রাজি নয়।
তাহলে যতই সংস্কারের কথা বলা হোক মিয়ানমারের শাসকদের মনোভাব এখনো পরিবর্তন হয়নি। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এ সহিংস হামলার আড়ালে বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তনের অন্য কোনো আলামত টের পাওয়া যাচ্ছে কি? যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার আগে মধ্য এশিয়ার অনেক দেশেই মুসলমানদের ওপর হামলা কিংবা স্বায়ত্তশাসনের দাবি তীব্র হয়ে উঠেছিল।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান আভাস দিয়েছেন চীনকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গী পেয়েছে ভারতকে। রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন উপলক্ষ মাত্র। সংস্কার, বিনিয়োগের পথ ধরে পুঁজিবাদের প্রবক্তারা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীনকে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে আগাচ্ছে।
রিয়েল-টাইম নিউজ ডটকম- এর সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক মনে করছেন আপাতত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হাতে মুসলিম নিধনের মত ঘটনা ঘটলেও এর একটা বিহিত মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সন্ধান করতেই হবে।
প্রশ্ন: কিছু দিন আগেই সমুদ্র সীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের ফয়সালা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মেনে নিয়েছে। সংস্কার ও বিনিয়োগের জন্যে অনেক দেশ এখন মিয়ানমারের দিকে তাকাচ্ছে। আবার ভূকৌশলগত অবস্থান বিবেচনায় মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়ন প্যানেট্টা এ অঞ্চলে দেশটির নৌবাহিনীর তদারকি বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনি এক সময়ে মিয়ানমারে নতুন করে সহিংস ঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: এ ঘটনার অনেকগুলো প্রেক্ষাপট আছে। অনেকগুলো দিক আছে। প্রথম দিকটি হল আমি ২১ শতকে একটা নতুন করে স্নায়ু যুদ্ধের আশঙ্কা করছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্নায়ু যুদ্ধের বিষয়টা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। এখন চীন অন্যতম সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি রুপে আবির্ভূত হয়েছে। এখন চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে স্নায়ু যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর অন্যতম ক্ষেত্র। যাকে কেন্দ্র করে এই স্নায়ু যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে যে তাদের সামরিক প্রভাব বলয় বিস্তার করতে চাচ্ছে তার উদ্দেশ্য মূলত একটাই তা হচ্ছে চীনকে ধরে রাখা অর্থাৎ সেই মার্কিন কূটনীতিক জর্জ এফ কেনানের ‘কনটেইনমেন্ট’ থিউরি বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছে ফের যুক্তরাষ্ট্র। ওই কনটেইনমেন্ট থিউরির একটা এশীয় সংস্করণ আমরা দেখতে পাব। চীনকে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক নীতি থেকে বের করে আনতে তাকে ঘিরে ফেলা এবং খুব সম্ভবত চীনকে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে যুক্তরাষ্ট্র একটা সুদূরপ্রসারী একটা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
এক্ষেত্রে খুব আশ্চর্যজনকভাবে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। অতীতে ভারত কখনই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বা সামরিক বন্ধু ছিল না। কিন্তু একুশ শতকে এসে আমরা দেখলাম, সেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে সমর্থন জানাচ্ছে এবং এ অঞ্চল ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একটা বলয় তৈরি করছে যে বলয়টা চীনের বিরুদ্ধে কাজ করবে।
এখানে খুব সঙ্গত কারণেই মিয়ানমার একটা ফ্যাক্টর। দেশটির এক পাশে চীন ও অন্য পাশে বাংলাদেশ। এই মিয়ানমারকে যদি এখন নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তাহলে খুব সঙ্গত কারণেই চীনের ওপর চাপটা বাড়বে। এজন্যেই নতুন নতুন পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে, মিয়ানমারে সংস্কার বা উদার নীতি, অং সান সূ চির সাথে মার্কিন সখ্যতার মত বিষয়গুলো যদি আমরা এক নজরে আনতে চাই তাহলে দেখতে পাব মিয়ানমারে একটি তথাকথিত সংস্কারবাদী সরকার চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যে সরকার তার স্বার্থ রক্ষা করবে এবং বাহ্যত সে সরকার চীনের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান গ্রহণ করবে। এখন রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন একই সূত্রে গাঁথা।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে তারা মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে, এটাই কি যথেষ্ট নাকি কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে? বিশেষ করে ভূ-কৌশলগত অবস্থান দিক থেকে?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এককেন্দ্রীকমুখী পররাষ্ট্রনীতি। এটা করা হয়েছে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার জন্যে। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। সেই বৃটিশ যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষ মিয়ানমারে যেয়ে কাজ করতে। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের কদর সবার জানা। ভারতের শেষ স্বাধীন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের মাজার এখনো রেঙ্গুনে। বার্মার কালাপানিতে নির্বাসনের কাহিনী আজো গ্রামে গ্রামে মায়েরা শিশুদের গল্প বলে শোনায়। কিন্তু পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির কথা বলছি বটে, কিন্তু এজন্যে মিয়ানমার যে একটা ফ্যাক্টর, সেই দেশটির সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখা যায়নি। অস্বীকার করেছি। অবজ্ঞা করেছি। আর বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্কে একটা বড় বাধা রোহিঙ্গা সমস্যাতো আছেই।
প্রশ্ন: কিন্তু মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে ধরে নিয়ে তাদেরকে নাগরিকের মর্যাদা দিতে নারাজ। উল্টো দাবি করে আসছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে রাখাইন রাজ্যে ঢুকে আবাস গড়ে তুলেছে।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে এসে অবৈধভাবে বসবাস করছে। দ্রুত আমাদের জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যাচ্ছে। সামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট করে অন্য দেশে গিয়ে অপরাধ করলে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশের উচিত স্টাটাসকু বজায় রেখে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নত করা। কারণ আমাদের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে মিয়ানমার অন্যতম একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। গার্মেন্টস খাতের জন্যে মিয়ানমার থেকে তুল আমদানি করতে পারি। বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারি মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে। সীমান্তে বাঁধ নির্মাণ করে সেখানে বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। মিয়ামারের আমাদের কৃষক যেয়ে কনট্রাক্ট ফার্ম করে বাড়তি ফসল বাংলাদেশে আনতে পারে। এধরনের অনেক বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যদি মিয়ানমারের সাথে সাংঘর্ষিক সম্পর্কের দিকে আগাই তা কখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্যে মঙ্গল ডেকে আনবে না।
প্রশ্ন: তাহলে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ত্রুটি কোথায়?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: আমি মনে করি পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজানো উচিত। মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেই পূর্বমূখী কূটনীতিতে এগিয়ে যেতে হবে। এটা আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, বহির্বিশ্বে আমাদের সম্মান উজ্জ্বল করা ছাড়াও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পূর্বমুখী কূটনীতি অনেক অবদান রাখবে।
প্রশ্ন: তো জাতিসংঘ বলছে মিয়ানমার থেকে শরণার্থী বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে দিক। এমনিতে সরকারি হিসেব ২৮ হাজার রোহিঙ্গা মুসলামান যা বেসরকারি হিসেবে প্রায় ৫ লাখ শরণার্থী বাংলাদেশে বাস করছে। এরপরও কি বাংলাদেশের পক্ষে আরো শরণার্থীর চাপ সহ্য করা সম্ভব।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: বাংলাদেশ কোনো অবস্থাতেই রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ এমনিতেই একটা জনসংখ্যা বহুল দেশ। উপরন্তু রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের বাস করতে যেয়ে বনাঞ্চলের বড় ক্ষতি করেছে। এখন জাতিসংঘ কোন প্রেক্ষাপটে আরো শরণার্থী নিতে বলছে এটা বিবেচনায় আনতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টি এখন মিয়ানমারের দিকে। দেশটিতে তেল গ্যাসসহ প্রচুর খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। তারা পেয়েছেও। এখন মিয়ানমারকে যদি একটু হাতে রাখা যায়, তাহলে অনেক স্বার্থ আদায় করা সম্ভব। এখানে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ একটা বড় ঝুঁকির মুখে থাকলেও কূটনৈতিক উদ্যোগটা কিভাবে গ্রহণ করবে, কিভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করবে এটাই হচ্ছে বড় কথা। জাতিসংঘ একটা কথা বললেই যে বাংলাদেশ মানবে তা নয়, এ ক্ষেত্রেও মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক রেখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের সব সরকারই পূর্বমুখী কূটনীতির কথা বলে। তা যদি সম্ভব হত, রেল ও সড়ক পথে যোগাযোগ হলে দুদেশের মানুষের চলাচল ও পণ্যের আদান প্রদান হত। চীন, ভিয়েতনাম, লাওস বা আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মানুষের সাথে আরো যোগাযোগ বৃদ্ধি পেত, ওসব দেশ থেকে প্রযুক্তি আনা যেত যা বাংলাদেশের উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগানো যেত, কিন্তু তা হচ্ছে না কেনো?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: মূল কারণ একটাই। কূটনৈতিক ব্যর্থতা। আমরা আমাদের বন্ধু চিনতে ভুল করেছি। একমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে ভারতকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। সেখানে মিয়ানমারকে আমরা অবজ্ঞা করেছি। মিয়ানমার বাংলাদেশের স্বার্থে অনেক বড় অবদান রাখতে পারে। শুধু স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে নয়, খাদ্য ও জ্বালানির মত বিভিন্ন সংকটগুলো নিরসনে মিয়ানমারের কাছ থেকে একটা বড় সহায়তা পেতে পারি। এজন্যে সফল কূটনীতি প্রয়োগ করতে পারিনি। মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বাড়লে চীনের সাথে সম্পর্ক আরো বাড়বে।
আর যেটা বলা হচ্ছে যে, চীনের কুম্বিং থেকে কক্সবাজার রাস্তাটা চলে আসার কথা, সেজন্যে সম্পর্ক উন্নয়ন হলেই তা সম্ভব হবে। চীনের সাথে সড়ক যোগাযোগ হলে বাংলাদেশের জন্যে একটা বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আসিয়ানের বড় একটা বাজার রয়েছে। সেখানে ভারত তার পণ্য নিয়ে যেতে শুরু করেছে, আমরা পারছি না। কারণ চীন ও মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি না করে তা সম্ভব নয়। আর এগুলো আটকে আছে একমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্যে, একই কারণে আমরা মিয়ানমারকে উপেক্ষা করছি।
প্রশ্ন: কিন্তু মহাজোট সরকারতো সবসময় কানেকটিভিটির কথা বলে, এখন ভারত মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করছে, আমরা বসে আছি কেন? নাকি বসিয়ে রাখা হয়েছে? আমরাতো জানি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর প্রযুক্তি ও পণ্য উন্নত ও অপেক্ষাকৃত সস্তা তাইনা?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: খেয়াল করবেন, বাংলাদেশ ভারতের একটা বিশাল বাজার। আমাদের প্রয়োজন এমন প্রতিটি পণ্য ভারত উৎপাদন করে। যে পণ্যগুলো অনেক সহজ শর্তে আমরা চীন থেকে পেতে পারি। ভারত তা কখনই করতে দেবে না। কারণ বাংলাদেশে ভারত একটা বিশাল বাজার তৈরি করেছে। আর আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে পূর্বমুখী কূটনীতির পথ ধরে এগিয়ে যাই, বা ওসব দেশে পণ্য রফতানি করি তা ভারতের বণিকরা কখনই চাইবে না। এজন্যেই পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়েছে।
মুখে পূর্বমুখী কূটনীতির কথা বলছি বটে কিন্তু বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি না। সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন চীনে গিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু কুম্বিং গিয়েছিলেন, সেখান থেকে কক্সবাজারের সাথে সংযোগ সড়কের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ঐ বক্তব্য কিন্তু ওখানেই থেকে গেছে। উনি এ প্রকল্প নিয়ে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
প্রশ্ন: তাহলে প্রযুক্তির অভাব থেকেই যাচ্ছে, উৎপাদনশীল খাত বা উদ্যোক্তার বিকাশ অবহেলিত থাকবে কেবল? আমরা বিদেশি পণ্যের ভোক্তা হয়েই থাকব?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: দেখুন সারা বিশ্বে কানেকটিভিটির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা যদি একমাত্র ভারতের সাথেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে তা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে না। শুধু ভারতের স্বার্থে কানেকটিভিটি নয়, সবার সাথেই তা উম্মুক্ত করতে হবে। চীন কিন্তু শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে। বাংলাদেশেও গভীর সমুদ্র বন্দ্রর তৈরিতে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। কিন্তু সেই উদ্যোগ না নিয়ে শুধু আমরা মুখে মুখে বলছি।
প্রশ্ন: তাহলে নতুন করে মিয়ানমারে মুসলিম নিধন বা এধরনের আরো অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবে বলে আপনি আশঙ্কা করছেন?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: না বিষয়টিকে আমি এভাবে দেখি যে, রোহিঙ্গা সমস্যা একেবারেই মিয়ানমারের বিষয়। এ সমস্যা আজকের নয়, অনেক আগে থেকে। তবে মিয়ানমারে খুব সূক্ষ্মভাবে বুড্ডিষ্ট ডমিনেট তৈরি করা হচ্ছে। অর্থাৎ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটা কর্তৃত্ব মিয়ানমারের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। যে কারণে বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে অন্য ধর্ম বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উচ্ছেদ করার একটা প্রক্রিয়া কিন্তু আজকে থেকে নয় অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে।
যার ফলশ্রুতিতেই বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছে। আমাদের পরিবেশ নষ্ট করছে। তাই সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া এ সংকট মোকাবেলা করা যাবে না। ভারত এখন এগিয়ে আসছে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে। ভারত গণতন্ত্রের প্রবক্তা কিন্তু ভারত কখনো অং সান সূ চির মুক্তির ব্যাপারে বড় ধরনের কোনো ভুমিকা পালন করেনি। ভারতের প্রয়োজন ছিল জাতীয় স্বার্থ, সে কারণে মিয়ানমার সরকারের সাথে ভারত সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। অং সান সূ চির মুক্তি দাবি নয়, ভারত মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস উত্তোলনে বিনিয়োগ করেছে, আরো অনেক প্রকল্প নিয়ে এগিয়েছে। বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমার সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করে এগিয়ে যাওয়া।
আরাকানে মুসলিম নিধন। মিয়ানমারের এ প্রদেশটির নামও পাল্টে ফেলা হয়েছে রাখাইন নামে। দেশটিতে মুসলিম নিধন অনেক পুরোনো কাহিনী। রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী দাবি করে নাগরিকের মর্যাদা দিতে নারাজ মিয়ানমার।
এমনি এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হামলার শিকার রোহিঙ্গা মুলমানদের সীমান্তে ফিরিয়ে না দিয়ে আশ্রয় দেবার আবেদন জানিয়েছে।
সরকারি হিসেবে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয়ের হিসেব থাকলেও এ সংখ্যা বেসরকারি হিসেবে ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে অনেক সামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ তাই আরো শরণার্থী নিতে রাজি নয়।
তাহলে যতই সংস্কারের কথা বলা হোক মিয়ানমারের শাসকদের মনোভাব এখনো পরিবর্তন হয়নি। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এ সহিংস হামলার আড়ালে বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তনের অন্য কোনো আলামত টের পাওয়া যাচ্ছে কি? যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার আগে মধ্য এশিয়ার অনেক দেশেই মুসলমানদের ওপর হামলা কিংবা স্বায়ত্তশাসনের দাবি তীব্র হয়ে উঠেছিল।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান আভাস দিয়েছেন চীনকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গী পেয়েছে ভারতকে। রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন উপলক্ষ মাত্র। সংস্কার, বিনিয়োগের পথ ধরে পুঁজিবাদের প্রবক্তারা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীনকে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে আগাচ্ছে।
রিয়েল-টাইম নিউজ ডটকম- এর সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক মনে করছেন আপাতত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হাতে মুসলিম নিধনের মত ঘটনা ঘটলেও এর একটা বিহিত মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সন্ধান করতেই হবে।
প্রশ্ন: কিছু দিন আগেই সমুদ্র সীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের ফয়সালা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মেনে নিয়েছে। সংস্কার ও বিনিয়োগের জন্যে অনেক দেশ এখন মিয়ানমারের দিকে তাকাচ্ছে। আবার ভূকৌশলগত অবস্থান বিবেচনায় মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়ন প্যানেট্টা এ অঞ্চলে দেশটির নৌবাহিনীর তদারকি বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনি এক সময়ে মিয়ানমারে নতুন করে সহিংস ঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: এ ঘটনার অনেকগুলো প্রেক্ষাপট আছে। অনেকগুলো দিক আছে। প্রথম দিকটি হল আমি ২১ শতকে একটা নতুন করে স্নায়ু যুদ্ধের আশঙ্কা করছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্নায়ু যুদ্ধের বিষয়টা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। এখন চীন অন্যতম সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি রুপে আবির্ভূত হয়েছে। এখন চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে স্নায়ু যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর অন্যতম ক্ষেত্র। যাকে কেন্দ্র করে এই স্নায়ু যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে যে তাদের সামরিক প্রভাব বলয় বিস্তার করতে চাচ্ছে তার উদ্দেশ্য মূলত একটাই তা হচ্ছে চীনকে ধরে রাখা অর্থাৎ সেই মার্কিন কূটনীতিক জর্জ এফ কেনানের ‘কনটেইনমেন্ট’ থিউরি বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছে ফের যুক্তরাষ্ট্র। ওই কনটেইনমেন্ট থিউরির একটা এশীয় সংস্করণ আমরা দেখতে পাব। চীনকে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক নীতি থেকে বের করে আনতে তাকে ঘিরে ফেলা এবং খুব সম্ভবত চীনকে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে যুক্তরাষ্ট্র একটা সুদূরপ্রসারী একটা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
এক্ষেত্রে খুব আশ্চর্যজনকভাবে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। অতীতে ভারত কখনই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বা সামরিক বন্ধু ছিল না। কিন্তু একুশ শতকে এসে আমরা দেখলাম, সেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে সমর্থন জানাচ্ছে এবং এ অঞ্চল ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একটা বলয় তৈরি করছে যে বলয়টা চীনের বিরুদ্ধে কাজ করবে।
এখানে খুব সঙ্গত কারণেই মিয়ানমার একটা ফ্যাক্টর। দেশটির এক পাশে চীন ও অন্য পাশে বাংলাদেশ। এই মিয়ানমারকে যদি এখন নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তাহলে খুব সঙ্গত কারণেই চীনের ওপর চাপটা বাড়বে। এজন্যেই নতুন নতুন পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে, মিয়ানমারে সংস্কার বা উদার নীতি, অং সান সূ চির সাথে মার্কিন সখ্যতার মত বিষয়গুলো যদি আমরা এক নজরে আনতে চাই তাহলে দেখতে পাব মিয়ানমারে একটি তথাকথিত সংস্কারবাদী সরকার চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যে সরকার তার স্বার্থ রক্ষা করবে এবং বাহ্যত সে সরকার চীনের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান গ্রহণ করবে। এখন রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন একই সূত্রে গাঁথা।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে তারা মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে, এটাই কি যথেষ্ট নাকি কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে? বিশেষ করে ভূ-কৌশলগত অবস্থান দিক থেকে?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এককেন্দ্রীকমুখী পররাষ্ট্রনীতি। এটা করা হয়েছে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার জন্যে। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। সেই বৃটিশ যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষ মিয়ানমারে যেয়ে কাজ করতে। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের কদর সবার জানা। ভারতের শেষ স্বাধীন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের মাজার এখনো রেঙ্গুনে। বার্মার কালাপানিতে নির্বাসনের কাহিনী আজো গ্রামে গ্রামে মায়েরা শিশুদের গল্প বলে শোনায়। কিন্তু পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির কথা বলছি বটে, কিন্তু এজন্যে মিয়ানমার যে একটা ফ্যাক্টর, সেই দেশটির সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখা যায়নি। অস্বীকার করেছি। অবজ্ঞা করেছি। আর বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্কে একটা বড় বাধা রোহিঙ্গা সমস্যাতো আছেই।
প্রশ্ন: কিন্তু মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে ধরে নিয়ে তাদেরকে নাগরিকের মর্যাদা দিতে নারাজ। উল্টো দাবি করে আসছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে রাখাইন রাজ্যে ঢুকে আবাস গড়ে তুলেছে।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে এসে অবৈধভাবে বসবাস করছে। দ্রুত আমাদের জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যাচ্ছে। সামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট করে অন্য দেশে গিয়ে অপরাধ করলে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশের উচিত স্টাটাসকু বজায় রেখে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নত করা। কারণ আমাদের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে মিয়ানমার অন্যতম একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। গার্মেন্টস খাতের জন্যে মিয়ানমার থেকে তুল আমদানি করতে পারি। বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারি মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে। সীমান্তে বাঁধ নির্মাণ করে সেখানে বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। মিয়ামারের আমাদের কৃষক যেয়ে কনট্রাক্ট ফার্ম করে বাড়তি ফসল বাংলাদেশে আনতে পারে। এধরনের অনেক বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যদি মিয়ানমারের সাথে সাংঘর্ষিক সম্পর্কের দিকে আগাই তা কখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্যে মঙ্গল ডেকে আনবে না।
প্রশ্ন: তাহলে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ত্রুটি কোথায়?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: আমি মনে করি পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজানো উচিত। মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করেই পূর্বমূখী কূটনীতিতে এগিয়ে যেতে হবে। এটা আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, বহির্বিশ্বে আমাদের সম্মান উজ্জ্বল করা ছাড়াও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পূর্বমুখী কূটনীতি অনেক অবদান রাখবে।
প্রশ্ন: তো জাতিসংঘ বলছে মিয়ানমার থেকে শরণার্থী বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে দিক। এমনিতে সরকারি হিসেব ২৮ হাজার রোহিঙ্গা মুসলামান যা বেসরকারি হিসেবে প্রায় ৫ লাখ শরণার্থী বাংলাদেশে বাস করছে। এরপরও কি বাংলাদেশের পক্ষে আরো শরণার্থীর চাপ সহ্য করা সম্ভব।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: বাংলাদেশ কোনো অবস্থাতেই রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ এমনিতেই একটা জনসংখ্যা বহুল দেশ। উপরন্তু রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের বাস করতে যেয়ে বনাঞ্চলের বড় ক্ষতি করেছে। এখন জাতিসংঘ কোন প্রেক্ষাপটে আরো শরণার্থী নিতে বলছে এটা বিবেচনায় আনতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টি এখন মিয়ানমারের দিকে। দেশটিতে তেল গ্যাসসহ প্রচুর খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। তারা পেয়েছেও। এখন মিয়ানমারকে যদি একটু হাতে রাখা যায়, তাহলে অনেক স্বার্থ আদায় করা সম্ভব। এখানে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ একটা বড় ঝুঁকির মুখে থাকলেও কূটনৈতিক উদ্যোগটা কিভাবে গ্রহণ করবে, কিভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করবে এটাই হচ্ছে বড় কথা। জাতিসংঘ একটা কথা বললেই যে বাংলাদেশ মানবে তা নয়, এ ক্ষেত্রেও মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক রেখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের সব সরকারই পূর্বমুখী কূটনীতির কথা বলে। তা যদি সম্ভব হত, রেল ও সড়ক পথে যোগাযোগ হলে দুদেশের মানুষের চলাচল ও পণ্যের আদান প্রদান হত। চীন, ভিয়েতনাম, লাওস বা আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মানুষের সাথে আরো যোগাযোগ বৃদ্ধি পেত, ওসব দেশ থেকে প্রযুক্তি আনা যেত যা বাংলাদেশের উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগানো যেত, কিন্তু তা হচ্ছে না কেনো?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: মূল কারণ একটাই। কূটনৈতিক ব্যর্থতা। আমরা আমাদের বন্ধু চিনতে ভুল করেছি। একমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে ভারতকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। সেখানে মিয়ানমারকে আমরা অবজ্ঞা করেছি। মিয়ানমার বাংলাদেশের স্বার্থে অনেক বড় অবদান রাখতে পারে। শুধু স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে নয়, খাদ্য ও জ্বালানির মত বিভিন্ন সংকটগুলো নিরসনে মিয়ানমারের কাছ থেকে একটা বড় সহায়তা পেতে পারি। এজন্যে সফল কূটনীতি প্রয়োগ করতে পারিনি। মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বাড়লে চীনের সাথে সম্পর্ক আরো বাড়বে।
আর যেটা বলা হচ্ছে যে, চীনের কুম্বিং থেকে কক্সবাজার রাস্তাটা চলে আসার কথা, সেজন্যে সম্পর্ক উন্নয়ন হলেই তা সম্ভব হবে। চীনের সাথে সড়ক যোগাযোগ হলে বাংলাদেশের জন্যে একটা বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আসিয়ানের বড় একটা বাজার রয়েছে। সেখানে ভারত তার পণ্য নিয়ে যেতে শুরু করেছে, আমরা পারছি না। কারণ চীন ও মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি না করে তা সম্ভব নয়। আর এগুলো আটকে আছে একমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্যে, একই কারণে আমরা মিয়ানমারকে উপেক্ষা করছি।
প্রশ্ন: কিন্তু মহাজোট সরকারতো সবসময় কানেকটিভিটির কথা বলে, এখন ভারত মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করছে, আমরা বসে আছি কেন? নাকি বসিয়ে রাখা হয়েছে? আমরাতো জানি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর প্রযুক্তি ও পণ্য উন্নত ও অপেক্ষাকৃত সস্তা তাইনা?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: খেয়াল করবেন, বাংলাদেশ ভারতের একটা বিশাল বাজার। আমাদের প্রয়োজন এমন প্রতিটি পণ্য ভারত উৎপাদন করে। যে পণ্যগুলো অনেক সহজ শর্তে আমরা চীন থেকে পেতে পারি। ভারত তা কখনই করতে দেবে না। কারণ বাংলাদেশে ভারত একটা বিশাল বাজার তৈরি করেছে। আর আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে পূর্বমুখী কূটনীতির পথ ধরে এগিয়ে যাই, বা ওসব দেশে পণ্য রফতানি করি তা ভারতের বণিকরা কখনই চাইবে না। এজন্যেই পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়েছে।
মুখে পূর্বমুখী কূটনীতির কথা বলছি বটে কিন্তু বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি না। সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন চীনে গিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু কুম্বিং গিয়েছিলেন, সেখান থেকে কক্সবাজারের সাথে সংযোগ সড়কের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ঐ বক্তব্য কিন্তু ওখানেই থেকে গেছে। উনি এ প্রকল্প নিয়ে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
প্রশ্ন: তাহলে প্রযুক্তির অভাব থেকেই যাচ্ছে, উৎপাদনশীল খাত বা উদ্যোক্তার বিকাশ অবহেলিত থাকবে কেবল? আমরা বিদেশি পণ্যের ভোক্তা হয়েই থাকব?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: দেখুন সারা বিশ্বে কানেকটিভিটির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা যদি একমাত্র ভারতের সাথেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে তা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে না। শুধু ভারতের স্বার্থে কানেকটিভিটি নয়, সবার সাথেই তা উম্মুক্ত করতে হবে। চীন কিন্তু শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে। বাংলাদেশেও গভীর সমুদ্র বন্দ্রর তৈরিতে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। কিন্তু সেই উদ্যোগ না নিয়ে শুধু আমরা মুখে মুখে বলছি।
প্রশ্ন: তাহলে নতুন করে মিয়ানমারে মুসলিম নিধন বা এধরনের আরো অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবে বলে আপনি আশঙ্কা করছেন?
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান: না বিষয়টিকে আমি এভাবে দেখি যে, রোহিঙ্গা সমস্যা একেবারেই মিয়ানমারের বিষয়। এ সমস্যা আজকের নয়, অনেক আগে থেকে। তবে মিয়ানমারে খুব সূক্ষ্মভাবে বুড্ডিষ্ট ডমিনেট তৈরি করা হচ্ছে। অর্থাৎ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটা কর্তৃত্ব মিয়ানমারের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। যে কারণে বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে অন্য ধর্ম বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উচ্ছেদ করার একটা প্রক্রিয়া কিন্তু আজকে থেকে নয় অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে।
যার ফলশ্রুতিতেই বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছে। আমাদের পরিবেশ নষ্ট করছে। তাই সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া এ সংকট মোকাবেলা করা যাবে না। ভারত এখন এগিয়ে আসছে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে। ভারত গণতন্ত্রের প্রবক্তা কিন্তু ভারত কখনো অং সান সূ চির মুক্তির ব্যাপারে বড় ধরনের কোনো ভুমিকা পালন করেনি। ভারতের প্রয়োজন ছিল জাতীয় স্বার্থ, সে কারণে মিয়ানমার সরকারের সাথে ভারত সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। অং সান সূ চির মুক্তি দাবি নয়, ভারত মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস উত্তোলনে বিনিয়োগ করেছে, আরো অনেক প্রকল্প নিয়ে এগিয়েছে। বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমার সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করে এগিয়ে যাওয়া।
0 comments:
Post a Comment