সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব খবরাখবর ছাপা হয়েছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। একের পর এক যেসব খবরাখবর পত্রিকায় আসছে, তাতে করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা হতে বাধ্য। গত ২৫ মে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করা হয়েছে। বিরোধী দলের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথকে সঙ্কুুচিত করা হয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার সীমিত করা হয়েছে। সরকারি পর্যায় দুর্নীতি আজ মারাত্মক এক সমস্যা। লন্ডনের অ্যামনেস্টির রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে একই দিন। তাতে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই ধরনের প্রতিবেদন সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না। এমনকি লন্ডনের ইকোনমিস্ট পত্রিকায় যে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছিল, তা ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এক ধরনের হস্তক্ষেপের শামিল। ইকোনমিস্ট কখনো কোনো পাকপরবর্তী দেশকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার উপদেশ দিতে পারে না। মোট কথা এ ধরনের সংবাদ আমাদের হতাশার মাঝে ঠেলে দেয়। ঢাকায় সৌদি নাগরিক খালাফ আল আলীকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করেছিল। আজো আমরা তার কূলকিনারা করতে পারলাম না। গেল মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন উপসহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস শিয়ার বলে গিয়েছিলেন, অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয় বাংলাদেশ (আমার দেশ, ৭ মার্চ)। সব সংবাদকে একত্রিত করলে কেন জানি মনে হয় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি ইমেজ সঙ্কটের মুখে পড়েছে। প্রতিটি প্রকাশিত সংবাদে সরকার তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। প্রতিবাদ করেছে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যা প্রয়োজন তা হচ্ছে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উদ্ধারে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিশেষ করে সৌদি আরবের জন্য ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি নাগরিক খালাফ আল আলী হত্যাকা-ে সে দেশের সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ছিলেন, তা ছিল আমাদের জন্য একটি 'ম্যাসেজ'। সৌদি মিডিয়া, ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত খুনিদের গ্রেপ্তার ও সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছিলেন। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছিলেন। এই 'দাবি' একটি ম্যাসেজ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি যে কীভাবে নিয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হয় কিংবা প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা সম্ভব না হয়, তাহলে তা মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বিবেচনায় নিলে ভালো করবেন। এমনিতেই পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকা- নিয়ে আমি রীতিমত হতাশ। রুনি-সাগরের হত্যাকা- নিয়ে আজো কূলকিনারা হলো না। আমরা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছি এই হত্যাকা-ের খবর। মিডিয়ায় লেখালেখির কারণে সম্ভবত এখানে একটি 'জজ মিয়া নাটক' মঞ্চস্থ হয়নি। কিন্তু মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন 'প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং রুনি-সাগরের হত্যাকা- মনিটর করছে, তখন আমি একটা দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। যদি সত্যি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী মনিটর করে থাকেন যে, তাহলে এতদিন কেন লাগবে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্মকর্তাদের ভূমিকা ও দক্ষতা তাই সঙ্গত কারণেই উঠবে। পুলিশ যদি মূল কাজ ফেলে অন্য কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে হত্যাকারীরা তো এ সুযোগ নেবেই। পুলিশের উচিত মূল কাজে মনোনিবেশ করা ও তাদের দক্ষতা বাড়ানো। পুলিশ বাহিনীতে একজন থ্রি স্টার জেনারেলের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর জন্য ৫ জন সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করে সরকার পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বাড়াতে চেয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকদের পিটিয়ে পুলিশ যা করল, তাতে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়নি। প্রধানমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয়ের দিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবেন। মার্কিন কর্মকর্তা জেমস শিয়ার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যখন বলেন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকিমুক্ত নয়, তখন সরকারের পক্ষ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা দাবি করা উচিত ছিল। কেননা প্রধানমন্ত্রী তো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে বলেছিলেন বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা- নেই। এটাই হচ্ছে বাস্তব কথা। বর্তমান সরকারের শাসনামলে গেল সাড়ে তিন বছরে আমরা কোনো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- লক্ষ্য করিনি। সন্ত্রাসীরা তেমনভাবে সংগঠিত হতে পারছে না। বিচ্ছিন্ন দু'একটি সংবাদ ছাপা হলেও তাদের তৎপরতা সমাবেশ, লিফলেট বিতরণ কিংবা জমায়েতের মাধ্যমেই তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ অবশ্য তৎপর হয়েছে। কিন্তু ওইসব নিষিদ্ধ ঘোষিত গ্রুপ কর্তৃক কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালিত হতে আমরা দেখিনি। তাই অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ একটি ঝুঁকিমুক্ত দেশ, তা নিঃসন্দেহে বলা যাবে না। বাইরের সন্ত্রাসী হামলা? এটাও তো আমাদের চোখে ধরা পড়েনি। কিছু ভারতীয় সন্ত্রাসী বাংলাদেশে পালিয়ে ছিল। কিন্তু তাদের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা- ছিল না এ দেশে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের হস্তান্তরের ফলে ওই অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটেছে। এর বাইরে 'আল-কায়দা' কিংবা লস্করে তৈয়েবা'র মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে কাজ করছে বলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের কখনো অবহিত করেনি। ফলে মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্য প্রশ্ন থেকেই গেল। তার ওই বক্তব্যের উদ্দেশ্য কী-এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর করতে ভালোবাসেন। তিনি জানিয়ে ছিলেন, খালাফ আল আলীর মৃত্যুর ঘটনার প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এতদিন পার হওয়ার পরও সত্য বেরিয়ে আসেনি। তাতে করে কী আমাদের ভাবমূর্তি আদৌ উজ্জ্বল হয়েছে? বাংলাদেশি প্রায় ২০ লাখ (প্রকান্তরে ৩০ লাখ) নাগরিক এখন সৌদিতে কর্মরত। তাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। গত ৭ মার্চ রাতে একটি চ্যানেলে অংশ নিতে গিয়ে সৌদি আরব থেকে প্রবাসীরা ফোন করে আমাদের তাদের আতঙ্কের কথা জানিয়েছিলেন। এই আতঙ্কের খবরটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। এমনিতেই বাংলাদশে-সৌদি আরব সম্পর্ক খুব উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে এটা বলা যাবে না। গত ২০০৮ সাল থেকেই সৌদিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়োগ পরিপূণভাবে বন্ধ করেছে। এটা আমাদের একটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই বিষয়টির ওপর গরুত্ব দেয়নি কখনো। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি বাজার যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদন, আমাদের নীতি নির্ধারকরা তা আদৌ বিবেচনায় নেয়নি। আমাদের অদক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদেশ সচিব পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটি বারবার এড়িয়ে গেছেন। অথচ সৌদি আরব বাংলাদেশকে বাইরে রেখে নেপালের মতো হিন্দু প্রধান দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করে আসছিল। শুধু তাই নয়, সংবিধান ২৫(২) ধারাটি সংযোজন করে আমরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গরুত্ব দিয়েছিলাম। এটি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল নির্দেশনা। কিন্তু সংবিধান সশোধনের ফলে সংবিধানের এই ধারাটি এখন আর নেই। এতে করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে 'বিশেষ সম্পর্ক' এ যে প্রভাব ফেলছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। সৌদি আররেব সঙ্গে সম্পর্ককে এ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যেতে পারে। মোট দাগে যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থেই উচিত এই হত্যাকা-ের 'মোটিভ' খুঁজে বের করা এবং হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা। প্রয়োজনে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মতো বিশ্বসেরা আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতাও নেয়া যেতে পার। দেশে এ মুহূর্তে যুদ্ধপরাধীদের বিচার চলছে। বিরোধী দল একের পর এক কর্মসূচি পালন করে সরকার পতনের আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে অতি দ্রুত হত্যাকা-ের মোটিভটি সুস্পষ্ট করা। এটি একটি স্পর্শকাতর হত্যাকা-। এর সঙ্গে আমাদের অনেক স্বার্থ জড়িত। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে একটি সংবাদও কোনো কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। এরই প্রতিধ্বনী আমরা দেখতে পাই এষড়নধষ ঞযৎবধঃ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে গত ৯ মার্চ। সেখানেও মধ্যপ্রাচ্যের ওই রাষ্ট্রটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটা চিন্তার কারণ। খুব দ্রুত আমরা যদি এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে তা শুধু সৌদি আরবের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতেও এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাতে করে জনশক্তি রপ্তানিতে আরো ধস নামবে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমবে। আর মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি কর্মী থাকবেন এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায়। আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই তা কোনো ভালো সংবাদ নয়। একই সঙ্গে মানবাধিকার পরিস্থিতি যদি আরো একটু উন্নত করা যায়, তাতে ক্ষতির কিছু নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীকে একটা দায়বদ্ধতার মাঝে আনা উচিত। এমনিতেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে, তা নিয়ে বড় বিতর্ক রয়ে গেছে। এমনি এক সময় বিদেশের পত্রি-পত্রিকায় এ ধরনের সংবাদ ছাপা হলে, তা কখনোই আমাদের জন্য কোনো শুভ সংবাদ হতে পারে না। তাই আমি বিশ্বাস করি সরকার বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উদ্ধারে উদ্যোগ নেবে।
Daily JAI JAI DIN
09.06.12
0 comments:
Post a Comment