এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা শুধু একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে এই জোট গঠনের কথা বলছেন। নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখনো আলোচিত হয়নি। বলা হচ্ছে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠনের কথা। তবে এই আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যদি ভেঙে যায়, আমি অবাক হব না! কেননা বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী প্রকাশ্যেই বলেছেন, তাঁরা ১৫০ আসন চাচ্ছেন ঐক্যপ্রক্রিয়ার নেতাদের কাছে, পরোক্ষভাবে বিএনপির কাছে। অন্যদিকে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না চাচ্ছেন দুই বছরের জন্য তাঁদের ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে! শুধু নেতারা একটি ঐক্যে মিলিত হয়েছেন। এরই মধ্যে ১৫০ আসন চাওয়া কিংবা দুই বছরের জন্য ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব চাওয়া—বিষয়গুলো উত্থাপিত হওয়ায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা খুব ভালো চোখে দেখবেন বলে আমার মনে হয় না। এটা ঠিক, বিএনপি একটি বড় ‘সংকটে’ আছে। খালেদা জিয়ার জেল থেকে ‘মুক্ত’ না হওয়া ও তাঁর অসুস্থতা, তারেক রহমানের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সম্ভাব্য শাস্তি, শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নামে শত শত মামলা দলটিকে বড় সংকটে ফেলে দিয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে তাঁরা নির্বাচনে যাচ্ছেন। তবে চূড়ান্ত কথা বলার সময় বোধ হয় এখনো আসেনি।
এর আগে বিএনপির মহাসচিব জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। দেখা করেছেন একজন সহকারী মহাসচিবের সঙ্গে। গত কয়েক দিন রাজনৈতিক ময়দান এটা নিয়ে ছিল উত্তপ্ত। মির্জা ফখরুল এটা নিয়ে কথা বলেছেন। সিনিয়র মন্ত্রীরা বলেছেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করেছে। এখানে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। কথা উঠেছে বিএনপির মহাসচিব এই সফরে কী পেলেন? বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বিএনপি মহাসচিবের বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলা ঠিক হয়েছে কি না—এটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন যে চলমান রাজনৈতিক সংকটের বিষয়টি তিনি জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, জাতিসংঘ সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। তিনি আরো জানিয়েছেন, তাঁকে বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল এবং যেহেতু অতীতেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটে সহকারী মহাসচিবকে (জাতিসংঘের) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেহেতু এবার তিনি তাঁর সঙ্গেই দেখা করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে তিনি দেখা করেননি। মির্জা ফখরুল জানিয়েছেন, খুব শিগগির তাঁর দল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের রূপরেখা প্রকাশ করবে। তিনি মনে করেন, বর্তমান সমস্যার একটি বড় সমাধান হলো বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা। তা বৃহত্তর জোটের মাধ্যমে এখন সম্পন্ন হয়েছে। তবে বিএনপি যুগপৎ কর্মসূচির কথাও বলেছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বিএনপি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘে নালিশ দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা আরেক দফায় নিজেদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ দিয়েছে। তাঁর মতে, মির্জা ফখরুল জাতিসংঘে একজন ডেস্ক কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন (সমকাল, ১৮ সেপ্টেম্বর)। তোফায়েল আহমেদ এটা জানিয়ে দিতে ভোলেননি যে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই এবং সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এই দুজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অস্থিরতা, আস্থাহীনতা, পরস্পরকে অবিশ্বাস করার যে ‘রাজনীতি’, তা এখনো রয়ে গেছে। অথচ জাতীয় নির্বাচনের বাকি আছে তিন মাসেরও কম সময়। এ মাসেই শিডিউল ঘোষণা করা হবে। অথচ দুটি বড় দলের ‘অবস্থান’ পরস্পরবিরোধী।
মির্জা ফখরুল জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। এটা কোনো ধরনের ‘নালিশ’ জানাতে নয়, বরং তাঁর মতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অবহিত করতেই তিনি জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিরোস্লাভ জেনকারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে জাতিসংঘ আদৌ স্ব-উদ্যোগে কোনো দেশে নির্বাচন আয়োজন করতে পারে না। এটা সত্য, জাতিসংঘের অধীনে ‘ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স ডিভিশন’ নামে একটি শাখা আছে। এটি ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই শাখা পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে নির্বাচন আয়োজন করে আসছে। এরা বিভিন্ন দেশে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে ‘টেকনিক্যাল সহযোগিতা’ দেয়, সেখানে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে, নির্বাচন যে ‘সুষ্ঠু’ হয়েছে, তা ‘সার্টিফাই’ করে ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এককভাবে স্ব-উদ্যোগে ‘ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স ডিভিশন’ কোনো দেশে নির্বাচনের আয়োজন, পর্যবেক্ষণ বা নির্বাচন মনিটর করতে পারে না। শুধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুমোদনই নয়, বরং ওই দেশের এবং বিবদমান গোষ্ঠীরও অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। নেপালের দৃষ্টান্ত আমরা দিতে পারি। ২০০৬ সালের নভেম্বরে নেপাল সরকার ও মাওবাদীদের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই সময় সরকার ও মাওবাদীরা জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানায় সেখানে সংবিধান প্রণয়নের জন্য যে সাংবিধানিক পরিষদ (সংসদ) গঠিত হবে, তা আয়োজন করে দেওয়ার জন্য। জাতিসংঘ মিশন সেই কাজটি শুরু করে ২০০৭ সালে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে সেখানে সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের ‘ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স ডিভিশন’ তাদের লোকবল দিয়ে, পর্যবেক্ষক দিয়ে এই নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করে। কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধের পর জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল ১৯৯২-৯৩ সালে। সেখানে ওই সময় প্রায় ৪৬ দেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল (বাংলাদেশসহ)। এই কর্তৃপক্ষ সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে নির্বাচনে সহযোগিতা করেছিল জাতিসংঘ। গৃহযুদ্ধের পর নামিবিয়ায় (১৯৮৯-১৯৯০) জাতিসংঘ একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন পরিচালনা করেছিল এবং সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশে জাতিসংঘের ‘ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স ডিভিশন (ইএডি)’ নির্বাচন পরিচালনা করেছে (UNOWAS News, 14 December 2017)। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে ওই সব দেশের পরিস্থিতিকে মেলানো যাবে না। ওই সব দেশে গৃহযুদ্ধ চলছিল, তারপর বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সমঝোতা হয়, শান্তিচুক্তি হয় এবং জাতিসংঘ সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে এটা তো সত্য, অতীতে জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে কথাও বলেছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখন মির্জা ফখরুল নিজে গেলেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তাঁদের অবহিত করলেন। জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিরা কি এসব বিষয়ে অবগত নন? নিশ্চয়ই তাঁরা জানেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে তাঁদের করার কিছু নেই। এটা ঠিক একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা শুধু বিএনপিই বলছে না, বলতে গেলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বাদে প্রতিটি দলই একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট কিংবা ঐক্যপ্রক্রিয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর তিন মাস ছুটি’ শীর্ষক একটি ফর্মুলার কথা মাঝেমধ্যে বলা হয়। কিন্তু এটাও অসম্পূর্ণ। তাহলে ওই সময় সরকার পরিচালনা করবে কে? উপরন্তু সরকার একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান তাদের পক্ষে। সংবিধান তো প্রধানমন্ত্রীর ‘তিন মাস ছুটি’ অনুমোদন করে না! সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে। কিন্তু সরকার এই শেষ সময়ে সংবিধান সংশোধন করবে, এটা মনে হয় না। তাহলে ‘সমঝোতাটা’ হবে কিভাবে?
এখন বিএনপির জন্য ‘কাজটি’ সহজ হয়ে গেল। বিএনপির ‘নেতৃত্ব’ এখন চলে গেল ড. কামাল হোসেনের কাছে! বিএনপি যখন নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছিল তখন ড. কামাল হোসেন আর বি চৌধুরীর সঙ্গে ‘ঐক্য’ করে বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার এবং না যাওয়ার বিভ্রান্তি দূর করল। বিএনপি এখন নির্বাচনে যাবে। সরকারের জন্যও এটা বড় ‘পাওয়া’, অন্তত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো ‘পরিস্থিতি’ হয়তো এড়ানো সম্ভব হবে! জাতীয় ঐক্যজোট এবং প্রকারান্তরে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে একটি ‘বৈধতা’ দেবে। তবে সব কথা বলার সময় এখনো আসেনি। বিএনপির শীর্ষ পদগুলোতে কট্টরপন্থীরা এখনো আছেন। তথাকথিত ‘মালয়েশিয়ান ফর্মুলা’ কাজ না-ও করতে পারে। উপরন্তু ২০ দলীয় জোটে স্পষ্টতই অসন্তোষ আছে এবং তা জোটের ভাঙনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। জাতীয় ঐক্যজোট হয়েছে। এতে বিএনপি কতটুকু লাভবান হলো, সে প্রশ্ন থাকলই।
Daily Kaler Kontho
01.10.2018