রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

কেমন হবে ২০২১ সালের বিশ্ব রাজনীতি

ডিসেম্বরের শেষভাগে এসে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন নিয়ে সারা বিশ্ব যখন উদ্বিগ্ন, তখন সঙ্গত কারণেই একটা প্রশ্ন উঠেছে- কেমন হবে ২০২১ সালের বিশ্ব রাজনীতি? কোভিড-১৯-এর নতুন ধরন, সব মানুষের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, ভ্যাকসিন কূটনীতি যে ২০২১ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে এক নম্বর আলোচিত বিষয় হয়ে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা ২০২১ সালে ১০টি ‘রিস্ক ফ্যাক্টরের’ কথা উল্লেখ করেছেন, যা ২০২১ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। এসব ‘রিস্ক ফ্যাক্টরের’ শীর্ষে রয়েছে কোভিড-১৯-এর নতুন ধরন ও একে মোকাবেলা করা। ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ বলতে বোঝানো হচ্ছে অন্যতম একটি ইস্যু, যা বিশ্বে উত্তেজনা ছড়াবে, সংকট সৃষ্টি করবে এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ ‘সমস্যা’টিকে অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে রাখবেন। অন্য ‘রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো’ হচ্ছে পর্যায়ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের দায়িত্ব গ্রহণ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, কোভিড-১৯জনিত কারণে বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতা, পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের চেষ্টা, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি ও কোরীয় উপদ্বীপে পুনরায় উত্তেজনা, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক ও দু’দেশের মাঝে উত্তেজনা বৃদ্ধি, তাইওয়ান প্রশ্নে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অবনতি, বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট, বিশ্বব্যাপী যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটেছিল তাতে ধস নামা, এবং তুরস্কের নেতৃত্বে ‘নয়া অটোমান সাম্রাজ্যের’ উত্থান। মূলত এ ১০টি প্রধান সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা কিনা ২০২১ সালে নতুন সংকটের জন্ম দেবে এবং বিশ্বে উত্তেজনা বাড়াবে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, যা ২০২১ সালে অন্যতম আলোচিত বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। নিঃসন্দেহে করোনাভাইরাস ও এর নয়া রূপ থাকবে আলোচনার কেন্দ্রে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্ব পাবে তা হচ্ছে, জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ। এ দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্প-পরবর্তী নতুন এক যুগে প্রবেশ করবে। জো বাইডেনের ‘বিশ্ব ব্যবস্থা’ ট্রাম্প থেকে কতটুকু ভিন্ন হবে, তিনি কতটুকু আস্থাশীল একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে পারবেন, প্রশ্ন সেখানেই। সেই সঙ্গে আছে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বিষয়টি, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক অর্থনীতিকে করোনা-পরবর্তী সময়ে সচল করা ইত্যাদি। ২০২০ সাল প্রত্যক্ষ করেছে এক মহামারী, যার নাম কোভিড-১৯। এই মহামারী ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে ছড়িয়ে পড়লেও পুরো ২০২০ সালে বিশ্বকে দাঁপিয়ে বেড়িয়েছে। এর রেশ ২০২১ সালেও থেকে যাবে। বলা হচ্ছে, ভ্যাকসিন হচ্ছে এর প্রতিষেধক। কিন্তু এ ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নতুন এক সংকটের জন্ম দেবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘মাই নেশন্স ফার্স্ট’ ধারণায় উদ্দীপ্ত হয়ে ভ্যাকসিনটি বাজারে আসার আগেই প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে এর কোটি কোটি ডোজের প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছেন। আর এভাবেই জন্ম হয়েছে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’। এর মূল কথা হচ্ছে, অন্য কোনো দেশ ভ্যাকসিন পাক বা না পাক, নিজ দেশে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। ২০২১ সালে এ ভ্যাকসিনের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে জন্ম হবে এক ধরনের বৈষম্যের। বিংশ শতাব্দীতে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মাঝে আর্থিক প্রশ্নে এক ধরনের বৈষম্যের জন্ম হয়েছিল। ধনী দেশ আরও ধনী হয়েছে, আর গরিব দেশ আরও গরিব হয়েছে। কিন্তু একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে ভ্যাকসিন নিয়ে নতুন ধরনের বৈষম্য। অনেক গরিব দেশের পক্ষেই কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন ক্রয় করা (প্রতি ব্যক্তির জন্য দুই ডোজ) সম্ভব হয়ে উঠবে না। একটি পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছি ধনী দেশগুলো কীভাবে ভ্যাকসিন নিয়ে এ বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। কোন দেশ কী পরিমাণ ভ্যাকসিন কিনেছে, তা নিচের পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডোজ (বিশ্বের ভ্যাকসিন ক্রয়ের শতকরা ২১.৮ ভাগ), ভারত ১৫০ কোটি ডোজ (২০.৬৯ ভাগ), যুক্তরাষ্ট্র ১০১ কোটি ডোজ (১৩.৯৩ ভাগ), কোভাস্ক (যারা বিশ্বে বিনামূল্যে সরবরাহ করবে) ৭০ কোটি ডোজ (৯.৬৬ ভাগ), কানাডা ৩৫ কোটি ৮০ লাখ ডোজ (৪.৯৪ ভাগ), যুক্তরাজ্য ৩৫ কোটি ৭০ লাখ ডোজ (৪.৯২ ভাগ)। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইন্দোনেশিয়া ৩৩.৮০ কোটি (৪.৬৬ ভাগ) ও ব্রাজিল ১৯.৫০ কোটি (২.৭০ ভাগ)। বাংলাদেশের পরিমাণ ৩ কোটি ১ লাখ, যা বিশ্বের ০.৪২ ভাগ (Visual Capitalist, ১৮ ডিসেম্বর)। প্রাপ্ত তথ্যমতে ৭.২৫ বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিনের প্রি-অর্ডার হয়ে গেছে। কী পরিমাণ অর্থ দেশগুলো ব্যয় করছে, তারও একটা হিসাব আমরা দিতে পারব। অর্থের পরিমাণটা অনেকটা এরকম : ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১.৬ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১ বিলিয়ন ডলার, কানাডা ৩৫৮ মিলিয়ন, জাপান ২৯০ মিলিয়ন, যুক্তরাজ্য ৩৫৭ মিলিয়ন, ইন্দোনেশিয়া ৩৩৮ মিলিয়ন, ব্রাজিল ১৯৬ মিলিয়ন। ভারতের জনসংখ্যা বেশি, তারা ব্যয় করেছে ১.৫ বিলিয়ন, আর কোভাস্ক ব্যয় করেছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার। ভ্যাকসিন এখনও সরবরাহ হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২১ সালের মাঝামাঝি তা পাওয়া যাবে। এখন সীমিত পরিসরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এ ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হচ্ছে। সুতরাং ভ্যাকসিনের প্রাপ্তি ও সরবরাহ যে অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে উঠবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে ভ্যাকসিন নিয়েও কথা আছে। চারটি ভ্যাকসিন চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে বা পাওয়ার পথে। এর মাঝে ফাইজার/বায়োএনটেক উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা রয়েছে। ভ্যাকসিনটি মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফ্রিজে রাখতে হবে। ফলে অনেক গরিব দেশ এ ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করতে পারবে না। পরিবহন করাও একটা ঝামেলা। মডার্নার তৈরি ভ্যাকসিন রাখতে হবে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। বাকি দুটো- অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়/অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও গামালিয়ার (স্পুটনিক-ভি) তৈরি ভ্যাকসিন- সাধারণ তাপমাত্রায় রাখা যাবে। ভ্যাকসিনের এ প্রতিযোগিতায় চীনা ভ্যাকসিন হারিয়ে গেছে। যদিও এটা ঠিক, বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ চীনে বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন দরকার। এক সময় বলা হয়েছিল, চীন বিনামূল্যে উন্নয়নশীল বিশ্বে ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে। কিন্তু এখন এ ব্যাপারে তেমন কিছু শোনা যায় না। তবে নিঃসন্দেহে ২০২১ সালে বিষয়গুলো আলোচিত হবে বারবার। ২০২১ সালে সারা বিশ্বের দৃষ্টি থাকবে জো বাইডেনের দিকে। ট্রাম্পের একগুঁয়েমি ও স্বৈরাচারী মনোভাব, তার বিচ্ছিন্নতাবাদ, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অস্বীকার করা (হু, ইউনেস্কো, প্যারিস চুক্তি) যুক্তরাষ্ট্রকে একঘরে করে ফেলেছিল। সেখান থেকে জো বাইডেন কীভাবে বেরিয়ে আসবেন, তা একটা প্রশ্ন। চীনের সঙ্গে কোন পর্যায়ে ও কতটুকু সম্পর্ক উন্নত হবে, সেটা একটা ‘ওয়ান মিলিয়ন ডলারের’ প্রশ্ন। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ চলছে। কোভিড-১৯ মোকাবেলা এবং বিশ্বে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতা ও ঐক্য প্রয়োজন। ট্রাম্পের আমলে এ সমঝোতা ভেঙে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, এশিয়ায় মার্কিন সেনা উপস্থিতি বাড়ানো, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনবিরোধী অবস্থান শক্তিশালী করা, ভারতের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা- ট্রাম্প প্রশাসনের এসব সিদ্ধান্ত চীনবিরোধী এক ধরনের ‘কনটেনমেন্ট পলিসির’ জন্ম দিয়েছিল। বাইডেন প্রশাসন কি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে? পেন্টাগন কি চাইবে চীনবিরোধী এই ‘অবস্থান’ থেকে একটি ‘প্রো-চীন’ নীতি গ্রহণ করতে? জো বাইডেন প্রশাসনের দিকে তাই তাকিয়ে থাকবে সারা বিশ্ব। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে মধ্যপ্রাচ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে- ইসরাইলের সঙ্গে কয়েকটি আরব দেশের (বাহরাইন, আরব আমিরাত, সুদান, মরক্কো) কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গেও পরোক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করেছে ইসরাইল। সৌদি নিরাপত্তার এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল। এ ব্যাপারে বড় উদ্যোগ ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর হয়েছে ট্রাম্পের শাসনামলেই। কিন্তু এতে করে ফিলিস্তিন সমস্যা চাপা পড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানে যে মধ্যস্থতা করে আসছিল, ট্রাম্পের শাসনামলে তা অনেকটাই পরিত্যক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রো-ইসরাইলি অবস্থান থেকে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে কতটুকু বের করে আনতে পারবেন, আদৌ পারবেন কিনা, সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ‘সম্পর্ক’ ছিল বহুল আলোচিত। ট্রাম্প-কিম জং উন শীর্ষ বৈঠক (তিন তিনবার) নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় বইলেও প্রত্যাশিত পারমাণবিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়নি। উপরন্তু নতুন করে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ প্রমাণ করেছে দেশটি কোনো পারমাণবিক আলোচনায় উৎসাহী নয়। ফলে জো বাইডেনের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হবে তিনি কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে মোকাবেলা করবেন। জো বাইডেন ঘোষণা করেছেন, তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে যাবেন, প্যারিস জলবায়ু আলোচনায় আবার যোগ দেবেন। তার এ সিদ্ধান্ত ভালো, যৌক্তিক ও প্রশংসিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আবার বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার অবস্থায় ফিরে যাবে। তবে বাইডেনের সামনে সমস্যা আছে অনেক। এক. বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থায় স্থিতিশীলতা আনা। কোভিড-১৯জনিত কারণে উন্নয়নশীল বিশ্বের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এর পরিমাণ ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারে। এ দেশগুলো এখন আর ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। ৮১টি দেশ আইএমএফের কাছে আবেদন করেছে অর্থ ছাড়ের। ২০২১ সালের শেষের দিকে এদের প্রয়োজন হবে অতিরিক্ত আরও ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালেই জাম্বিয়া ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গেছে। জি-২০ভুক্ত দেশগুলো এ ব্যাপারে একটি 'Common Framework' রচনা করলেও মার্কিন কংগ্রসের সমর্থন তাতে পাওয়া যায়নি। সঙ্গত কারণে জো বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা এখানে হবে বড় (Atlantic Council, December 16. 2020) দুই. যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ বড় ধরনের আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেকার সমস্যা বেড়েছে। একমাত্র চীনে কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও OECDভুক্ত প্রতিটি দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এ থেকে উদ্ধার পেতে বাইডেন প্রশাসনকে একটি বড় ভূমিকা নিতে হবে। তিন. হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, তাইওয়ানে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি এবং দক্ষিণ চীন সাগর এলাকায় মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি- এ তিনটি বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অনুসৃত নীতি যদি বাইডেন অনুসরণ করেন, তাহলে তা Ripple Effect (ঢেউ সৃষ্টি হয়ে তা ছড়িয়ে পড়া)-এর মতো বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়বে এবং নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর যে সম্ভাবনা (চীন বনাম যুক্তরাষ্ট্র), তা বৃদ্ধি পাবে। চার. কোভিড-১৯জনিত কারণে বিশ্ব বড় ধরনের খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে। এতে করে ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান, নাইজেরিয়া, এমনকি ইথিওপিয়ার মতো দেশ এক ধরনের দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। খাদ্যদ্রব্যের অতিরিক্ত মূল্য, খাদ্য ঘাটতি এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচ পরিবারের একটি এক ধরনের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক শিশু এখন অভুক্ত থাকছে (Brookings, May 6, 2020)। পাঁচ. লাতিন আমেরিকায় দারিদ্র্য শুধু সেখানকারই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বড় সংকট সৃষ্টি করবে না, বরং তা খোদ যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী সংকট সৃষ্টি, মানুষ আসার ঢল বৃদ্ধি করতে পারে। লাতিন আমেরিকায় ২০২০ সালে ৫২ মিলিয়ন মানুষ দরিদ্র হয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের মতে তাতে আরও যোগ হবে ১৫০ মিলিয়ন মানুষ। সুতরাং চিন্তার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। ছয়. তুরস্কের ‘নব্য অটোমান সাম্রাজ্যের’ তথাকথিত উত্থান জো বাইডেন প্রশাসনের জন্য আরেক চিন্তার কারণ। ন্যাটোতে থেকেও তুরস্ক রাশিয়ার এস-৪০০ মিসাইল ব্যবস্থা ক্রয় করেছে। ফলে সীমিত অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়েছে তুরস্ক। তুরস্ক সোমালিয়া, কাতার, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া ও বলকান এলাকায় সেনা মোতায়েন করেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের এসব অঞ্চলে যে কর্তৃত্ব রয়েছে তাতে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। বিশ্ব রাজনীতির এক কঠিন সংকটের সময় জো বাইডেন আগামী ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। আগামী চার বছর তার জন্য যে সুখের হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই Jugantor 27.12.2020

এশিয়ার ফিলিস্তিন’ ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

জনপ্রিয় নিউজ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করেছে ‘এশিয়ার ফিলিস্তিন’ হিসেবে। গত ৪ ডিসেম্বর ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরের জীবন নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাময়িকীটি ‘এশিয়ার ফিলিস্তিন’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। নিউজ ম্যাগাজিনটি ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিলের একজন কর্মকর্তা আম্বিয়া পারভীনের উদ্ধৃতি দিয়ে এই শব্দটি ব্যবহার করে। অর্থাৎ ইকোনমিস্ট বোঝাতে চাচ্ছে যে রোহিঙ্গাদের ভাগ্য অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের মতো হতে যাচ্ছে! ফিলিস্তিনিরা যেমনি ১৯৪৮ সালে নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বিভিন্ন দেশের শরণার্থী জীবন বেছে নিয়েছিল, ঠিক তেমনি রোহিঙ্গারাও একটি জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে! তবে রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আর ফিলিস্তিন এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ছিল নিজেদের জীবন। ঐতিহাসিকভাবেই তারা সেখানে বসবাস করত। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই। আজকে যেখানে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ওই এলাকাটি ছিল ঐতিহাসিকভাবেই ফিলিস্তিনিদের। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ১৮৮০-এর দশকে সেখানে প্রথম ইহুদি বসতি স্থাপিত হয়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ জে বেলফো ব্রিটিশ জায়ানিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ডকে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠির উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাসে এটাই বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। তাকে কেন্দ্র করে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্ম। এখানে পার্থক্য হলো, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের শতকরা ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীকে সেখান থেকে উৎখাত করা হয়েছে। কিন্তু ‘ইহুদি’দের মতো অন্য কোনো জনগোষ্ঠীকে সেখানে বসতি স্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। তার পরও মিয়ানমারের বৌদ্ধ নেতৃত্বের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার ‘ভার’ বইতে পারে না। ২০১৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ চেষ্টা করছে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে। কিন্তু মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে তা গত তিন বছরেও সম্ভব হয়নি। ফলে বাংলাদেশের কাছে বিকল্প কিছু ছিল না রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানো ছাড়া। কক্সবাজারে তারা যেসব ক্যাম্পে বসবাস করত, তা ছিল অমানবিক। ছোট ছোট খুপরি ঘরে তারা থাকতে বাধ্য হতো। সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসেবার অভাব ছিল। উপরন্তু সেখানে নিত্যদিন সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ত রোহিঙ্গারা। সবচেয়ে বড় কথা, বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপক উপস্থিতি সেখানে একাধিক সংকট সৃষ্টি করেছিল। প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় জনগণ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনগণকে বিতাড়িত করে পুরো এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এদের উপস্থিতি বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী ৪৩০০ একর পাহাড়ি বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। এ থেকে চার হাজার একর পাহাড়ি এলাকা নষ্ট করে সেখানে ক্যাম্প বানানো হয়েছে। টেকনাফ, উখিয়া, হিমচর এলাকায় পুরো বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে। এরা যদি আরও কিছুদিন এখানে অবস্থান করে, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ এলাকায় কোনো গাছগাছালি থাকবে না। কেননা প্রতি মাসে ৬৮০০ টন কাঠ রোহিঙ্গারা ব্যবহার করে রান্নার কাজে। গাছ কেটে তা রান্নার কাজে ব্যবহার করা ছাড়া তাদের কাছে কোনো বিকল্প নেই। তাদের কাছে জ¦ালানির কোনো বিকল্প উৎসও নেই। ইতিমধ্যে এটা প্রমাণিত যে, বিশ^ব্যাপী বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে কক্সবাজারে পুরো পাহাড় কেটে ফেলা, বনাঞ্চল ধ্বংস করার কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পরিবেশের যে ক্ষতি করে ফেলেছে, সে ব্যাপারে জাতিসংঘ কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। পাহাড়ি এলাকার বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে এ অঞ্চলে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে নিম্নাঞ্চলে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়বে, হাজার হাজার মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। সারা বিশ^ আজ যেখানে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, সেখানে কক্সবাজার এলাকায় হাজার হাজার বনাঞ্চল ধ্বংস করে রোহিঙ্গারা বড় ক্ষতি করেছে বাংলাদেশের। দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ জাতিসংঘ যখন ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগের বিরোধিতা করছে, তখন বাংলাদেশের পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি জাতিসংঘ বিবেচনায় নেয়নি। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হচ্ছে। ২৩১২ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। পরে আরও ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ এভাবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করতে পারে কি না? বিদেশি যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সে পরিমাণ সাহায্য বাংলাদেশ পায়নি। ফলে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকেই তা বহন করতে হচ্ছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশ এই ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। যে পরিমাণ অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় হয়, সে অর্থ অন্যত্র উন্নয়নকাজে ব্যয় করা যায়। দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজে ব্যয় করা যায়। বন্যা মোকাবিলায় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা যায়। কভিড-১৯ পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় বিপুল অর্থের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, হাসপাতালগুলোর আধুনিকীকরণ, ভাইরাস নির্ণয়-সংক্রান্ত গবেষণার পরিধি বাড়ানো ইত্যাদি কাজে অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অর্থ বরাদ্দ করতে পারে না। জাতিসংঘ এক ধরনের আপত্তি করেছে বটে, কিন্তু আজ অবধি মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারেনি তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে। জাতিসংঘ বৃহৎ শক্তির স্বার্থ দেখছে। তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন একটা রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যৎ এখন কোন পথে? সারা বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস নিয়ে উৎকণ্ঠিত ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার জীবন একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ২০১৭ সালে যে ‘রোহিঙ্গা ঢল’ এ অঞ্চলের পরিস্থিতিতে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল, গত ২৫ আগস্ট (২০২০) ছিল তার তৃতীয় বার্ষিকী। অর্থাৎ বর্তমান সংকট তিন বছর পার করে চার বছরে ‘পা’ দিল। কিন্তু বিশ্ব এই তিন বছরে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেনি। এটা ঠিক, রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালে যে গণহত্যা ও নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সে ব্যাপারে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’ বা আইসিজে একটি রায় দিয়েছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু ওই রায় সংকট সমাধানে কোনো বড় ভূমিকা পালন করতে পারেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি চুক্তিও হয়েছিল মিয়ানমারের সঙ্গে। কিন্তু এ ব্যাপারেও কোনো অগ্রগতি নেই। বরং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গেল জুন মাসেও রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবর দিয়েছে আলজাজিরা। এক প্রতিবেদনে তারা আমাদের জানিয়েছে, রাখইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০০ রোহিঙ্গা বসতি পুড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এরা বাধ্য হয়েছে রাখাইন ত্যাগ করতে। আরেকটি খবরে দেখা গেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তিনজন সেনা সদস্যকে রাখাইনে ঘটনাবলির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কোর্ট মার্শাল করে শাস্তি দিয়েছে, যদিও এদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি যখন আরও অবনতি ঘটেছে, তখন গত ২৯ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পের সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন। ওই ফোনালাপে তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রকাশিত এসব ঘটনা কতগুলো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। গেল ডিসেম্বরে (২০১৯) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের নিন্দা জানানো হয়েছিল (নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২৮ ডিসেম্বর)। কিন্তু নতুন করে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে মিয়ানমার সাধারণ পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তকে আদৌ কোনো গুরুত্ব দেয়নি। রোহিঙ্গা সংকট একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। আর তা হচ্ছে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার বারবার বলে আসছে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন। সর্বশেষ আসিয়ান নেতাদের টেলি সম্মেলনেও মিয়ানমারের প্রতিনিধি একই কথা বলেছেন। এর অর্থ সারা বিশ্বের মতামতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। মিয়ানমারের কৌশল হচ্ছে রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করা। রোহিঙ্গা বাড়িঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের জমি এখন চীন ও জাপানি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে। রাখাইনে চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে (Kyawkphyu), যেখান থেকে দেশটি বঙ্গোপসাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ওপর নজর রাখতে পারে। এখানে চীনের স্বার্থ অনেক বেশি। সুতরাং চীন কখনোই মিয়ানমারের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেবে না। রোহিঙ্গামুক্ত রাখাইনে চীন তার স্বার্থকে বড় করে দেখছে। গেল ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছিল। তাতে রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধ, কোনো সামরিক ব্যবস্থা না নেওয়া, আলামত নষ্ট না করা, আদালতে চার মাস অন্তর রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। আদালতের আদেশ মিয়ানমার মানছে না। ফলে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশ এই রোহিঙ্গাদের রাখতে পারে না। ভাসানচরে তাদের স্থানান্তর তাই সাময়িক। তাদের নিজ বাসভূমে ফেরত যেতে হবে এটাই বাস্তব। এ ক্ষেত্রে ইকোনমিস্ট রোহিঙ্গাদের ‘এশিয়ার ফিলিস্তিন’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, রোহিঙ্গাদের ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। এরা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত। এরা নিজ দেশে ফেরত যাবে আন্তর্জাতিক কমিউনিটির দায়িত্ব এটাই। বাংলাদেশ মানবতার খাতিরে এদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছে। স্থায়ীভাবে নয়। Desh Rupantor 24.12.2020

করোনার টিকা নিয়ে নানা কথা

বিশ্বে কোভিড-১৯-এর ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ যখন আঘাত করেছে, তখন স্বস্তির জায়গা একটাই-যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এর প্রতিষেধক হিসেবে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। নিঃসন্দেহে করোনার টিকা আবিষ্কার একটা বড় ধরনের অর্জন। কিন্তু এ টিকা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও এটা নিয়ে আগামী দিনে বিতর্ক হতে পারে। বিশ্বব্যাপী যে বিতর্ক তা হচ্ছে, এ টিকা ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মাঝে নতুন এক বৈষম্য সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। অর্থাৎ ধনী রাষ্ট্রগুলো তাদের আর্থিক সক্ষমতার জোরে আগেই এ টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। দ্বিতীয় বিতর্কটি হচ্ছে, এ টিকা কতটুকু নিরাপদ? ভ্যাকসিন প্রতিযোগিতার শীর্ষে যে তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা তাদের কার্যকারিতার হার প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির যৌথ উদ্যোগে ফাইজার ও বায়োএনটেক তাদের ভ্যাকসিনের ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতার ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনভিত্তিক মডার্না জানিয়েছে, তাদের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার ৯৪.৫ শতাংশ। সুইডিশ ফার্ম অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার ৯০ শতাংশ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) ভ্যাকসিনের ঝুঁকির কথাও আমাদের জানিয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাকসিন নেয়ায় এক ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে। তৃতীয়ত যে সমস্যা তা হচ্ছে এর সংরক্ষণ। ফাইজারের যে ভ্যাকসিন, তা সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। ফলে সব দেশ ফাইজারের এ টিকা ব্যবহার করতে পারবে না। বিশেষ করে আফ্রিকা ও উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ এ টিকা তাদের সংগ্রহে রাখতে পারবে না, যদিও মডার্নার ভ্যাকসিন নিয়ে এ ধরনের সমস্যা নেই। মডার্নার ভ্যাকসিন রাখতে হবে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। আবার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও গামালিয়ার (স্পুটনিক-ভি, রাশিয়া) ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এ সমস্যা নেই বলে জানানো হয়েছে। সাধারণ তাপমাত্রায় এ টিকা ৬ মাস পর্যন্ত রাখা যাবে বলে বলা হচ্ছে। চতুর্থত আরেকটি যে সমস্যা তা হচ্ছে, এ ভ্যাকসিন সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে পাবে, নাকি কিনতে হবে? এটা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হয়ে গেছে, কোনো কোম্পানির ভ্যাকসিনই বিনামূল্যে পাওয়া যাবে না, ভ্যাকসিন কিনতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে-ভ্যাকসিন ক্রয় করতে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে, গরিব দেশগুলোর জনগণের পক্ষে তা ক্রয় করা সম্ভব হবে কি না? একটা দৃষ্টান্ত দিই। বাংলাদেশ ভারত থেকে ভ্যাকসিন আনছে। সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে ৩ কোটি ডোজ ওষুধ কিনবে বাংলাদেশ। ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য যে ১ হাজার ২৭১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৭৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের খরচ দাঁড়াবে ৬ ডলার ২৫ সেন্ট। তবে যে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয় তা হল বাংলাদেশে এই ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে তার নাগরিকদের দেয়া হবে কিনা। যদিও একটি সংবাদে বলা হয়েছে, ৫ নভেম্বর ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট, বেক্সিমকো এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহের কথা বলা হয়েছিল। ১৭ কোটি দেশের মানুষের জন্য ৩ কোটি ডোজ কিছুই নয়। প্রত্যেককে দুটি করে (২১ দিন পর দ্বিতীয়টি) ভ্যাকসিন নিতে হবে। এর অর্থ প্রায় ৩৪ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আমাদের দরকার। আরও একটি প্রশ্ন উঠেছে- তা হচ্ছে, জানুয়ারিতে যে ভ্যাকসিন আসবে, তা প্রথম পর্যায়ে কারা কারা পাবে? একটি তালিকা সংবাদপত্রে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যায় নিম্নলিখিতভাবে এ ভ্যাকসিন বরাদ্দ করা হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে। যেমন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও কেবিনেট : ২০ হাজার ডোজ, বঙ্গভবন ও প্রধানমন্ত্রীর অফিস ২০ হাজার, সচিবালয় ৫০ হাজার, অধিদফতর ৫০ হাজার, সেনা, নেভি ও এয়ারফোর্স ২০ হাজার, পুলিশ ১০ হাজার, বিভাগীয় কমিশনার ১০ হাজার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০ হাজার ইত্যাদি। সরকার অবশ্য প্রকাশ্যে এ ধরনের কোনো ঘোষণা দেয়নি। যে কোনো সরকারি নথি থেকে সংবাদটি ফাঁস হয়ে থাকতে পারে। এ সংবাদটি যদি সত্য হয়, তাহলে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে। সামগ্রিকভাবে বড় ও ধনী দেশগুলো আগে টিকা পাবে, গরিব দেশগুলো পাবে না-এই যে বৈষম্য, এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব তেদ্রোস আধানোম গেব্রিয়াসুস। তিনি বলেছেন, আমাদের এ ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’কে প্রতিরোধ করতে হবে। Covax ইতোমধ্যে গরিব ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ২০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারা কতটুকু সফল হবে, সে প্রশ্ন আছেই। ধনী দেশগুলোর অর্থ আছে। তাদের পক্ষে সম্ভব বিপুল অর্থ খরচ করে কোভিড-১৯-এর টিকা ক্রয় করা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার মতো বড় কোম্পানির সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে টিকাটির সফল পরীক্ষা ও বাজারে আসার আগেই। উদ্দেশ্য পরিষ্কার-তাদের আগে টিকা পেতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে-করোনাভাইরাস ধনী ও গরিবের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। তবে অতীত ইতিহাস বলে ২০০৯ সালে যখন মহামারী H1N1 ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন অস্ট্রেলিয়া প্রথম দেশ যারা এর টিকা আবিষ্কার করেছিল এবং ওই টিকার রফতানি নিষিদ্ধ করেছিল। ওই সময়ও বড় দেশগুলো যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ৬ লাখ ডোজ টিকার জন্য আগেই চুক্তি করে বসেছিল। কোভিড-১৯ টিকার জন্যও এমনটি হল। ব্রিটেনের একটি ফার্ম Airfinity আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ১৩০ কোটি ডোজ টিকা নিশ্চিত করেছে এবং আরও ১৫০ কোটি ডোজ টিকা দিতে বাধ্য থাকবে কোম্পানি। যুক্তরাষ্ট্র প্রি-অর্ডার করেছে ৮০ কোটি ডোজের (ছয়টি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে), আর ব্রিটেন ২৮ কোটি ডোজের। ফ্রান্সের ওষুধ কোম্পানি সানোফির সঙ্গে ইইউ চুক্তি করেছে ৩০ কোটি ডোজের। ওষুধের এত বিশাল চাহিদা যে Airfinity’র মতে ২০২২ সালের প্রথমভাগের আগে কোনোমতেই ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এ পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয় টিকা প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান কী হতে পারে। উৎপাদনের আগেই বড় কোম্পানিগুলোর চুক্তি হয়ে আছে। তারা আগে ধনী দেশগুলোকে টিকা সরবরাহ করতে বাধ্য। দরিদ্র দেশগুলো বাদ থেকে যাচ্ছে। তাদের অর্থ নেই, প্রযুক্তি নেই। ফলে বিশ্বে নতুন করে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে। ২০২১ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে এটা হবে অন্যতম আলোচিত বিষয়। বিল ও মেলিন্ডা গেইটস ফাউন্ডেশন এবং ইউরোপের ওয়েলকাম ট্রাস্ট ৮০০ কোটি ডলারের একটি সহায়তার উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মাধ্যমে Covid-19 Tools (ACT) অর্থাৎ কোভিড-১৯-এর দ্রুত মোকাবেলায় যেসব স্বাস্থ্য যন্ত্রপাতি দরকার, তা সংগ্রহ করা হবে এবং সরবরাহ করা হবে। তবে এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারত যুক্ত হয়নি। ভ্যাকসিন একটি বড় পার্থক্য তৈরি করেছে। এর অর্থ হচ্ছে-ধনী দেশগুলোর কাছে অর্থ আছে, আর তারা ওই অর্থ ব্যবহার করছে টিকা সংগ্রহে। এজন্য তারা টিকা উৎপাদনের আগেই প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে তাদের অংশ নিশ্চিত করেছে। এখানে মানবতা প্রধান্য পায়নি। এমনকি ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সব ধরনের চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দিয়ে ওই সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এটাই হচ্ছে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’- নিজের প্রাপ্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া। মানবিকতা এখানে মুখ্য নয়। আমরা H1N1 বা Swine Flu-এর সময়ও এমনটা দেখেছিলাম। ২০০৯ সালে ওই মহামারীতে বিশ্বে মারা গিয়েছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার মানুষ। মহামারীটি শুরু হলে সাত মাসের মাথায় এর টিকা আবিষ্কার হয়। তখন ধনী দেশগুলো ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করে তাদের নিজ নিজ দেশে আগে টিকাটি সরবরাহ করতে। ফলে দেখা গেল, শুধু যে দেশগুলোর ‘ক্রয়ক্ষমতা’ বেশি, তারাই H1N1-এর টিকা পেয়েছে আগে, যে দেশগুলোয় রোগটি দ্রুত সংক্রমিত হয়েছিল, অগ্রাধিকার তালিকায় তারা প্রথমে স্থান পায়নি। করোনার টিকা নিয়ে এ দুর্ভাবনা এখনও শেষ হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে জানুয়ারিতে করোনার টিকা আসবে; কিন্তু এ টিকা কারা পাবে প্রথমে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। করোনা শুধু ধনী আর গরিব রাষ্ট্রের মাঝেই পার্থক্য সৃষ্টি করেনি, বরং মানুষ মানুষেও পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। করোনার টিকা একটি বাস্তবতা। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় করোনার টিকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এ টিকা বাজারে আসার আগেই শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিল এক ধরনের বৈষম্য- যেখানে ধনী রাষ্ট্রগুলো আরও ধনী হয়েছে, আর গরিব রাষ্ট্রগুলো আরও গরিব হয়েছে। আর একুশ শতকের বিশ্ব প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে আরেক রকম বৈষম্য। করোনাভাইরাস ‘মাই নেশন ফার্স্ট’ ধারণার জন্ম দিয়ে এক ধরনের ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়েছে, যেখানে ভ্যাকসিনের প্রাপ্তির প্রশ্নে জন্ম হতে যাচ্ছে এক ধরনের বৈষম্যের। jugsntor 20.12.2020

হাসিনা-মোদি ভার্চুয়াল বৈঠক ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন গত ১৭ ডিসেম্বর। করোনাকালে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এই বৈঠকের গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত advertisement advertisement সম্পর্ক একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত অতিক্রম করছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ৫০তম বছরেও পা রেখেছে বাংলাদেশ। ভার্চুয়াল বৈঠকের পর যে যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তাতে ভারত তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি ও advertisement সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার আশ্বাস আবারও দিয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন- ভারত, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের মধ্যে যে আঞ্চলিক সড়ক হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ যুক্ত হতে চায়। এ ধরনের একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই ভার্চুয়াল বৈঠকের আগে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সিইও ফোরাম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সহযোগিতা, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাইড্রোকার্বন বিষয়ে সহযোগিতা, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হাতি সংরক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতা, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল জাদুঘর ও ভারতীয় জাতীয় জাদুঘরের মধ্যে সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ও বরিশাল স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টসংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি। পরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল সামিটে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় কাজ হয়ে যাওয়া নীলফামারীর চিলাহাটি সীমান্ত থেকে পশ্চিমবঙ্গের হলদিবাড়ী পর্যন্ত রেল যোগাযোগ উদ্বোধন করা হয়। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ভারতের ডাক বিভাগের একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত ও বঙ্গবন্ধু-বাপুজি ডিজিটাল এক্সিবিশনের উদ্বোধন করেন। প্রস্তাবিত ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি নতুন। ভারত যে তার ‘লুকইস্ট’ নীতি গ্রহণ করেছে, সে আলোকেই এই মহাসড়কটি এখন নির্মিত হচ্ছে। তবে এই মহাসড়ক নিয়ে খোদ ভারতেই কিছুটা বিতর্ক আছে। এই মহাসড়কটি শুরু হবে ভারতের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী গড়ৎবয-ঞধসঁ হয়ে মিয়ানমারের মান্দালয় ও নেইপিদো এবং বাগো শহর হয়ে শেষ হবে থাইল্যান্ডের গুধধিফফু-সধব ংড়ঃ শহরে। এই মহাসড়কের কিছু অংশ ভালো থাকলেও একটি অংশ অত্যন্ত খারাপ, যা ভারত এখন পুনর্নির্মাণ করছে। এই মহাসড়কের ব্যাপারে ভারতের স্বার্থ অনেক বেশি। কেননা ভারত যে অঝঊঅঘ-ওহফরধ ঋৎবব ঞৎধফব অৎবধ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তার জন্য এই মহাসড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ভারতীয় পণ্য সড়কপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেতে পারবে এবং মুক্তবাণিজ্যের সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, ভারত এই মহাসড়কটি কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত নিয়ে যেতে চায় ভারতের ঊধংঃ-ডবংঃ ঊপড়হড়সরপ ঈড়ৎৎরফড়ৎ-এর একটা অংশ। এই মহাসড়কটি যদি সম্প্রসারিত হয়, তা হলে ভারত মনে করছে ভারত-আশিয়ান বাণিজ্যে আরও ৭০ মিলিয়ন ডলার যোগ হবে (বর্তমানে এর পরিমাণ ১৪২ মিলিয়ন ডলার। ২০২৫ সালে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় ভারত)। এই মহাসড়কটির ব্যাপারে ভারতের মণিপুর রাজ্যে একটি মামলা চলমান। তবে ভারতের সুপ্রিমকোর্টের একটি বেঞ্চ (প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবডের নেতৃত্বে) রায়ে বলেছেন- মহাসড়কের নির্মাণকাজ চলমান থাকতে পারে (এনডিটিভি, ১১ আগস্ট ২০২০)। ২০১৬ সালে ভারত এই ত্রিদেশীয় মহাসড়কের ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তিবলে ভারত ১২০.৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কধষবধি-ণধমুর সড়ক নির্মাণ করছে। একই সঙ্গে ১৪৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ঞধসঁ-কুরমড়হব-কধষবধি মহাসড়কে ৬৯টি ছোট ছোট ব্রিজ তৈরি করছে। মিয়ানমারে ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। ভারতের ‘লুক ইস্ট’ পলিসির সফলতা নির্ভর করছে মিয়ানমারের ওপর। পাঠক, নিশ্চয়ই কালাদান প্রজেক্টের কথা স্মরণ করতে পারেন। কালাদান প্রজেক্টের আওতায় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বন্দরের সঙ্গে সমুদ্রপথে ভারতের সাত বোন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত মিজোরাম রাজ্যের রাজধানী আইজল সংযুক্ত হয়েছে। কলকাতা থেকে পণ্য ৫৩৯ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের সমুদ্রবন্দর সিটওয়েতে (রাখাইন) নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে কালাদান নদীর ১৫৮ কিলোমিটার অতিক্রম করে নিয়ে যাওয়া হবে নদীবন্দর পালেটাওয়াতে (মিয়ানমারের চীন স্টেট)। এর পর ১৬২ কিলোমিটার মহাসড়ক হয়ে পণ্য যাবে আইজলে। ভারত এ জন্য সিটওয়ে সমুদ্রবন্দর উন্নত করছে, একই সঙ্গে মহাসড়ক উন্নয়নেও বিনিয়োগ করছে। ফলে বোঝাই যায়, মিয়ানমারের ব্যাপারে ভারতের স্বার্থ কেন এত বেশি। এখন বাংলাদেশ ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কে সংযুক্ত হওয়ার প্রস্তাব করছে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় এই প্রস্তাবে ভারত রাজি থাকলেও মিয়ানমার নাও রাজি হতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হলে এই রুট বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারত। বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে সড়কপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যেতে পারত। ওই অঞ্চলে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হতে পারত। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশই লাভবান হতো। প্রস্তাবিত বিসিআইএস করিডরও সাফল্যের মুখ দেখত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় (জুন ২০১৪) কুনমিংয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়কের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। চীনও এ ব্যাপারে তাদের সম্মতি দিয়েছিল। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সড়কপথে চীনা পণ্য বাংলাদেশে আসত। তাতে করে চীনা পণ্যের দাম কমে যেত। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এ প্রকল্পটি ঝুলে আছে। ফলে মিয়ানমার প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন করবে কিনা, এটি একটি প্রশ্ন। ভার্চুয়াল বৈঠকে দুই প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় একসঙ্গে কাজ করার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কোভিড-১৯ সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে নীরবে- এ কথা জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। এই সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি বাংলাদেশের জন্য। কোভিড-১৯ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবিলায় একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা দরকার। এ ক্ষেত্রে ভারতের অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। বলা ভালো, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৩ কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন কিনবে বাংলাদেশ। ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য যে ১ হাজার ২৭১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছিল, তার মাঝে ৭৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও বায়োফার্ম অংঃৎধতবহবপধ কোভিড ১৯-এর যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে, তা এখন ভারতের পুনায় সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত হবে। সেরাম কর্তৃক উৎপাদিত ভ্যাকসিন (১ কোটি ডোজ প্রতি মাসে) দক্ষিণ এশিয়া তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি আশীর্বাদ। ভারত জনবহুল দেশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যাও ১৭ কোটির মতো। সুতরাং এই দুই দেশে করোনা ভ্যাকসিনের (দুই ডোজ নিতে হবে) চাহিদা বিশাল। সুতরাং সেরাম আমাদের চাহিদার একটি অংশ মেটাতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের কোনো ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে এ ভ্যাকসিনটি আগামীতে উৎপাদন করা যায় কিনা, তাও বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক ৫০ বছরে পা দিয়েছে। মার্চ মাসে (২০২১) বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে। এই সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি তার উপস্থিত থাকার কথা জানিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তার উপস্থিতি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা দুই দেশের মাঝে বিরাজমান সমস্যার সমাধান হোক। বিশেষ করে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো ইত্যাদির ব্যাপারে ভারত একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে- এ প্রত্যাশা বাংলাদেশের জনগণের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারত সফর (২০১৭) কিংবা নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর (২০১৫) এবং এখন ভার্চুয়াল বৈঠকেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তিস্তার পানিবণ্টনের। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তিস্তাচুক্তি হয়নি। সমস্যাটা ভারতের। এর সমাধান ভারতকেই করতে হবে। এভাবে বারবার যদি আশ্বাস দেওয়া হয় এবং সমস্যার যদি কোনো সমাধান না হয়, তা হলে তা দুই দেশের বন্ধুত্বের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। অথচ ভারত-নেপাল সীমান্ত কিংবা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এ ধরনের হত্যাকা- হয় না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি এখন সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। এই ঘাটতির পরিমাণ এখন হাজার হাজার কোটি টাকা। ভারতীয় শুল্কনীতির কারণেই বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। সাফটা চুক্তিতে বেশ কয়েকটি পণ্যের ব্যাপারে শুল্কহ্রাসের কথা বলা হলেও, ভারত তা কার্যকর করেনি। ইতিপূর্বে ভারতের পক্ষ থেকে যে ৫১৩টি পণ্যের ছাড় দেওয়া হয়েছে, এর মাঝে ৩৫০টি পণ্য বাংলাদেশের পক্ষে কোনোভাবেই রপ্তানি করা সম্ভব নয়। ভারত বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কহার না কমালেও, বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কহার ধার্য ছিল শতকরা ৩০০ ভাগ। ১৯৯৪-৯৫ সালে তা কমিয়ে আনা হয় ৬০ ভাগে। এখন শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৫ ভাগে। দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দরে ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধায় জাহাজযোগে ভারতীয় পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। অথচ নেপালে ত্রিদেশীয় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ভারত এটা করছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে (ভারত-নেপাল)। শুষ্ক মৌসুমের জন্য বাংলাদেশ (রাজবাড়ীর পাংশা থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত) একটি জলাধার নির্মাণ করতে চায় (গঙ্গা ব্যারাজ), সে ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ‘নেইবারহুড ফাস্ট’ পলিসি। ভার্চুয়াল বৈঠক করে নরেন্দ্র মোদি তার অনুসৃত নীতিকে সামনে নিয়ে গেলেন। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর সমাধান করার। এতেই নিহিত রয়েছে তার ‘নেইবারহুড ফাস্ট’ পলিসির সফলতা। Amader Somoy 20.12,2020

টিকা-জাতীয়তাবাদ এবং ধনী-গরিব রাষ্ট্রের বৈষম্য

করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এর টিকা নিয়ে আছে সুখবর, আছে মন্দ খবরও। ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো ফাইজারের তৈরি টিকার ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রায় নব্বই বছর বয়সী মহিলা মার্গারেট প্রথম টিকাটি গ্রহণ করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। এটিই বিশ্বের প্রথম MRNA Vaccine, যা মানুষের শরীরে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, টিকাটি ৯৫ শতাংশ কভিড-১৯ প্রতিরোধ সক্ষম। সাধারণত দুটি টিকা নিতে হবে প্রথম ডোজ নেওয়ার পর ২১তম দিনে দ্বিতীয় ডোজটি নিতে হবে। কিন্তু বড় সমস্যা যা, তা হচ্ছে টিকার সংরক্ষণ। বলা হচ্ছে, এ ধরনের টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। ফলে সব দেশ ফাইজারের এই টিকা ব্যবহার করতে পারবে না। আরও তিনটি কোম্পানির টিকা বাজারে আসছে, তাদের এ সমস্যা নেই। মডার্নার টিকা শতকরা ৯৫ ভাগ সফল এবং তা রাখতে হবে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তবে অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা ও গামালিয়ার (স্পুতনিক ভি) টিকার এ সমস্যা নেই। সাধারণ তাপমাত্রায় এ টিকা ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। করোনর টিকা ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। যেহেতু এই টিকাটি বিনামূল্যে পাওয়া যাবে না, সেহেতু অনেক গরিব দেশের পক্ষে তা এ মুহূর্তে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। ফলে টিকা নিয়ে ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ধনী দেশগুলো টিকা মজুদ করছে। বলা হচ্ছে, ধনী দেশগুলো এক ধরনের ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ ((Vaccine Nationlism))-এর জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ আগে টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। যেমন নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিনের মধ্যে ১০ কোটি টিকা মার্কিন নাগরিকদের দিতে চান। এটাই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’। আগে আমার টিকা নিশ্চিত করা। অন্যরা পাক বা না পাক। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ভ্যাকসিন বা টিকা ছাড়া কভিড-১৯ পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করা যাবে না (যেমনটি হয়েছিল ‘স্মল পক্স’-এর ক্ষেত্রে), তখন বড় বড় ওষুধ কোম্পানি এগিয়ে এলো টিকা গবেষণায় ও উৎপাদনে। ২০২০ সালের মধ্যে এই টিকার পুরোপুরি সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হলো না। কিন্তু এরই মধ্যে ধনী দেশগুলো (ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র) বড় বড় ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে কভিড-১৯-এর টিকা বাজারে আসার আগেই তাদের দেশের জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ টিকাটি তারা আগে নিতে চায়। যেখানে বিশ্ব সংস্থা, GAVI- The Vaccine Alliance, Coatition for Epidemic preparedness Innovations (CEPI) দ্রুত টিকাটি বিশ্বের সব মানুষে কাছে পৌঁছে দিতে চায় (নিঃসন্দেহে যা সময় সাপেক্ষ), সেখানে ধনী রাষ্ট্রগুলো টিকাটি আগে নিতে চায়। এটাই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’। বিশে^র জনসংখ্যা এ মুহূর্তে ৭৮০ কোটি। একটি বিশেষ অঞ্চল বা দেশ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়নি, আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চল। ফলে টিকাটি সবার দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের আগে আর টিকাটি বাজারে আসবে না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত Astrazeneca-এর টিকাটি নিয়ে বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। যাদের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তাদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় কোম্পানি তৃতীয় ট্রায়াল স্থগিত রেখে আবার তা শুরু করেছিল। ফলে যে কোম্পানিগুলো কভিড-১৯-এর টিকা নিয়ে ইতিমধ্যে সফলভাবে ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে (চীন ও রাশিয়ার কোম্পানি), তাদের টিকা কতটুকু ঝুঁকিমুক্ত, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফাইজারের টিকা নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছিল। এখন বড় দেশগুলো আগে টিকা পাবে, গরিব দেশগুলো পাবে না, এই যে বৈষম্য, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ‘হু’ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব টেডরস আদহানোম গেব্রেয়াসুস। তিনি বলেছেন, আমাদের এই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’কে প্রতিহত করতে হবে। পড়াধী ইতিমধ্যে গরিব ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ২০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারা কতটুকু সফল হবে, সে প্রশ্ন আছেই। ধনী দেশগুলোর অর্থ আছে। তাদের পক্ষে সম্ভব বিপুল অর্থ খরচ করে কভিড-১৯ টিকা ক্রয় করা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন, , Astrazeneca-র মতো বড় কোম্পানির সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে টিকাটির সফল পরীক্ষা ও বাজারে আসার আগেই। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার তাদের আগে টিকা পেতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে করোনাভাইরাসও ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। তবে অতীত ইতিহাস বলে, ২০০৯ সালে যখন মহামারী ঐ১ঘ১ ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন অস্ট্রেলিয়া প্রথম দেশ, যারা এর টিকা আবিষ্কার করেছিল এবং ওই টিকা রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল। ওই সময়ও বড় দেশগুলো, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ছয় লাখ ডোজ টিকার জন্য আগেই চুক্তি করে বসেছিল। কভিড-১৯ টিকার জন্যও এমনটি হলো। ব্রিটেনের একটি ফার্ম Airfinity আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ১৩০ কোটি ডোজ টিকা নিশ্চিত করেছে এবং আরও ১৫০ কোটি ডোজ টিকা কোম্পানি দিতে বাধ্য থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র প্রি-অর্ডার করেছে ৮০ কোটি ডোজের (ছয়টি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে), আর ব্রিটেন ২৮ কোটি ডোজের। ফ্রান্সের ওষুধ কোম্পানি সানোফির সঙ্গে ইইউ চুক্তি করেছে ৩০ কোটি ডোজের। ওষুধের এত বিশাল চাহিদা যে, Airfinity-এর মতে ২০২২ সালের প্রথম ভাগের আগে কোনো মতেই ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এই পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয়, টিকা প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান কী হবে? উৎপাদনের আগেই বড় কোম্পানিগুলোর চুক্তি হয়ে আছে। তারা আগে ধনী দেশগুলোকে সরবরাহ করতে বাধ্য। তাহলে আমরা পাব কীভাবে? এ ক্ষেত্রে ভরসা আমাদের চীনা ও রাশান কোম্পানি। এদের সঙ্গে ধনী দেশগুলোর এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তি হয়নি। ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ ‘My nation first’ এর জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ ‘আমার দেশ আগে পাবে’ এই ধারণা নিয়ে এগিয়ে আছে ধনী দেশগুলো, এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকছে গরিব দেশগুলো। ধনী দেশগুলোর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু ‘My nation first’ ধারণার কারণে উপেক্ষিত থাকছে গরিব দেশগুলোর স্বার্থ। Harvard Business Review- এর এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে ‘If Countries with a large number of cases lag to obtain the vaccine and other mediciner, the disease will continue to disrupt global supply chains, and, as a result, economics around the would’ (Rebecca weintraub ২২, ২০২০) এর প্রবন্ধে The Denger of Vaccine Nationalism, may 22, 2020) কভিড-১৯ একটা বৈশ্বিক মহামারী। এ ক্ষেত্রে একটা বৈশ্বিক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেখা গেল, কিছু কিছু দেশ ‘এককভাবে’ চলতে চেষ্টা করছে এবং সম্মিলিতভাবে কোনো স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল গ্রহণ করেনি। কয়েকটি তথ্য দেওয়া যেতে পারে। ইউরোপের দেশগুলো, বিল ও মেলিন্ডা গেইটস ফাউন্ডেশন, ও wellcome Trust 800 কোটি ডলারের একটি সহায়তার উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মাধ্যমে Covid-19 Tools (ACT অর্থাৎ কভিড-১৯-এর দ্রুত মোকাবিলায় যেসব স্বাস্থ্য যন্ত্রপাতি দরকার, তা সংগ্রহ করা হবে এবং সরবরাহ করা হবে। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারত যুক্ত হয়নি। ফ্রান্সের কোম্পানি সানোফির ( (Sanofi)) সিইও পল হাডসন মনে করেন যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে ও টিকা সরবরাহের ব্যাপারে একটি প্রি-অর্ডার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেহেতু তাদের টিকা পাওয়ার অধিকারটি বেশি। ভারতের Serum Institute, যারা টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আছে, সংস্থাটির প্রধান বলেছেন, Serum যা উৎপাদন করবে, তা প্রথমে পাবে ভারতের জনগণ। এরপর তা বহির্বিশ্বের মানুষ পাবে। Astrazeneca, যারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কভিড-১৯ টিকা উৎপাদন করছে, তাদের উৎপাদিত টিকা প্রথমে পাবে ব্রিটেনের মানুষ (প্রায় তিন কোটি ডোজ)। কেননা যুক্তরাজ্য সরকার টিকা উৎপাদনে ৭৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। পরে ট্রাম্প প্রশাসন, এখানে তাদের বিনিয়োগ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদিত টিকার মধ্যে ৩০ কোটি ডোজ পাবে। ট্রাম্প প্রশাসন Operation Warp Speed,, অর্থাৎ দ্রুত মানুষকে টিকা দেওয়ার যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তার আওতায়ই এই টিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে (ওই)। এর অর্থ হচ্ছে ধনী দেশগুলোর কাছে অর্থ আছে, আর তারা ওই অর্থ ব্যবহার করছে টিকা সংগ্রহে। এজন্য তারা টিকা উৎপাদনের আগেই প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে তাদের অংশ আগেই নিশ্চিত তরেছে। এমনকি ট্রাম্প বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাকে সব ধরনের চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে ওই সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এটাই হচ্ছে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ নিজের প্রাপ্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া আগে। মানবিকতা এখানে মুখ্য নয়। আমরা H1N1 ev Swine Flu-এর সময়ও এমনটা দেখেছিলাম। ২০০৯ সালে ওই মহামারীতে বিশ্বে মারা গিয়েছিল ২,৮৪,০০০ মানুষ। মহামারীটি শুরু হলে সাত মাসের মাথায় এর টিকা আবিষ্কার হয়। তখন ধনী দেশগুলো ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করে তাদের নিজ নিজ দেশে আগে টিকাটি সরবরাহ করতে। ফলে দেখা গেল শুধু যে দেশগুলোর ‘ক্রয়ক্ষমতা’ রয়েছে বেশি, তারাই H1N1-এর টিকা পেল আগে। দ্রুত যে দেশগুলো সংক্রমিত হয়েছিল, অগ্রাধিকার তালিকায় তারা প্রথমে টিকা পায়নি। করোনার টিকা নিয়ে এই দুর্ভাবনা এখনো শেষ হয়নি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে জানুয়ারিতে করোনা টিকা আসবে। কিন্তু এই টিকা কারা পাবে প্রথমে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। করোনা শুধু ধনী আর গরিব রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যই সৃষ্টি করেনি, বরং মানুষ মানুষেও পার্থক্য সৃষ্টি করেছে টিকা-জাতীয়তাবাদ এবং ধনী-গরিব রাষ্ট্রের বৈষম্য করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এর টিকা নিয়ে আছে সুখবর, আছে মন্দ খবরও। ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো ফাইজারের তৈরি টিকার ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রায় নব্বই বছর বয়সী মহিলা মার্গারেট প্রথম টিকাটি গ্রহণ করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। এটিই বিশ্বের প্রথম MRNA Vaccine, যা মানুষের শরীরে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, টিকাটি ৯৫ শতাংশ কভিড-১৯ প্রতিরোধ সক্ষম। সাধারণত দুটি টিকা নিতে হবে প্রথম ডোজ নেওয়ার পর ২১তম দিনে দ্বিতীয় ডোজটি নিতে হবে। কিন্তু বড় সমস্যা যা, তা হচ্ছে টিকার সংরক্ষণ। বলা হচ্ছে, এ ধরনের টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। ফলে সব দেশ ফাইজারের এই টিকা ব্যবহার করতে পারবে না। আরও তিনটি কোম্পানির টিকা বাজারে আসছে, তাদের এ সমস্যা নেই। মডার্নার টিকা শতকরা ৯৫ ভাগ সফল এবং তা রাখতে হবে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তবে অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা ও গামালিয়ার (স্পুতনিক ভি) টিকার এ সমস্যা নেই। সাধারণ তাপমাত্রায় এ টিকা ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। করোনর টিকা ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। যেহেতু এই টিকাটি বিনামূল্যে পাওয়া যাবে না, সেহেতু অনেক গরিব দেশের পক্ষে তা এ মুহূর্তে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। ফলে টিকা নিয়ে ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ধনী দেশগুলো টিকা মজুদ করছে। বলা হচ্ছে, ধনী দেশগুলো এক ধরনের ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ ((Vaccine Nationlism))-এর জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ আগে টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। যেমন নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিনের মধ্যে ১০ কোটি টিকা মার্কিন নাগরিকদের দিতে চান। এটাই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’। আগে আমার টিকা নিশ্চিত করা। অন্যরা পাক বা না পাক। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ভ্যাকসিন বা টিকা ছাড়া কভিড-১৯ পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করা যাবে না (যেমনটি হয়েছিল ‘স্মল পক্স’-এর ক্ষেত্রে), তখন বড় বড় ওষুধ কোম্পানি এগিয়ে এলো টিকা গবেষণায় ও উৎপাদনে। ২০২০ সালের মধ্যে এই টিকার পুরোপুরি সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হলো না। কিন্তু এরই মধ্যে ধনী দেশগুলো (ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র) বড় বড় ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে কভিড-১৯-এর টিকা বাজারে আসার আগেই তাদের দেশের জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ টিকাটি তারা আগে নিতে চায়। যেখানে বিশ্ব সংস্থা, GAVI- The Vaccine Alliance, Coatition for Epidemic preparedness Innovations (CEPI) দ্রুত টিকাটি বিশ্বের সব মানুষে কাছে পৌঁছে দিতে চায় (নিঃসন্দেহে যা সময় সাপেক্ষ), সেখানে ধনী রাষ্ট্রগুলো টিকাটি আগে নিতে চায়। এটাই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’। বিশে^র জনসংখ্যা এ মুহূর্তে ৭৮০ কোটি। একটি বিশেষ অঞ্চল বা দেশ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়নি, আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চল। ফলে টিকাটি সবার দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের আগে আর টিকাটি বাজারে আসবে না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত Astrazeneca-এর টিকাটি নিয়ে বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। যাদের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তাদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় কোম্পানি তৃতীয় ট্রায়াল স্থগিত রেখে আবার তা শুরু করেছিল। ফলে যে কোম্পানিগুলো কভিড-১৯-এর টিকা নিয়ে ইতিমধ্যে সফলভাবে ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে (চীন ও রাশিয়ার কোম্পানি), তাদের টিকা কতটুকু ঝুঁকিমুক্ত, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফাইজারের টিকা নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছিল। এখন বড় দেশগুলো আগে টিকা পাবে, গরিব দেশগুলো পাবে না, এই যে বৈষম্য, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ‘হু’ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব টেডরস আদহানোম গেব্রেয়াসুস। তিনি বলেছেন, আমাদের এই ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’কে প্রতিহত করতে হবে। পড়াধী ইতিমধ্যে গরিব ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ২০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারা কতটুকু সফল হবে, সে প্রশ্ন আছেই। ধনী দেশগুলোর অর্থ আছে। তাদের পক্ষে সম্ভব বিপুল অর্থ খরচ করে কভিড-১৯ টিকা ক্রয় করা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন, , Astrazeneca-র মতো বড় কোম্পানির সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে টিকাটির সফল পরীক্ষা ও বাজারে আসার আগেই। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার তাদের আগে টিকা পেতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে করোনাভাইরাসও ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। তবে অতীত ইতিহাস বলে, ২০০৯ সালে যখন মহামারী ঐ১ঘ১ ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন অস্ট্রেলিয়া প্রথম দেশ, যারা এর টিকা আবিষ্কার করেছিল এবং ওই টিকা রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল। ওই সময়ও বড় দেশগুলো, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ছয় লাখ ডোজ টিকার জন্য আগেই চুক্তি করে বসেছিল। কভিড-১৯ টিকার জন্যও এমনটি হলো। ব্রিটেনের একটি ফার্ম Airfinity আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ১৩০ কোটি ডোজ টিকা নিশ্চিত করেছে এবং আরও ১৫০ কোটি ডোজ টিকা কোম্পানি দিতে বাধ্য থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র প্রি-অর্ডার করেছে ৮০ কোটি ডোজের (ছয়টি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে), আর ব্রিটেন ২৮ কোটি ডোজের। ফ্রান্সের ওষুধ কোম্পানি সানোফির সঙ্গে ইইউ চুক্তি করেছে ৩০ কোটি ডোজের। ওষুধের এত বিশাল চাহিদা যে, Airfinity-এর মতে ২০২২ সালের প্রথম ভাগের আগে কোনো মতেই ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এই পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয়, টিকা প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান কী হবে? উৎপাদনের আগেই বড় কোম্পানিগুলোর চুক্তি হয়ে আছে। তারা আগে ধনী দেশগুলোকে সরবরাহ করতে বাধ্য। তাহলে আমরা পাব কীভাবে? এ ক্ষেত্রে ভরসা আমাদের চীনা ও রাশান কোম্পানি। এদের সঙ্গে ধনী দেশগুলোর এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তি হয়নি। ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ ‘My nation first’ এর জন্ম দিয়েছে। অর্থাৎ ‘আমার দেশ আগে পাবে’ এই ধারণা নিয়ে এগিয়ে আছে ধনী দেশগুলো, এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকছে গরিব দেশগুলো। ধনী দেশগুলোর বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু ‘My nation first’ ধারণার কারণে উপেক্ষিত থাকছে গরিব দেশগুলোর স্বার্থ। Harvard Business Review- এর এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে ‘If Countries with a large number of cases lag to obtain the vaccine and other mediciner, the disease will continue to disrupt global supply chains, and, as a result, economics around the would’ (Rebecca weintraub ২২, ২০২০) এর প্রবন্ধে The Denger of Vaccine Nationalism, may 22, 2020) কভিড-১৯ একটা বৈশ্বিক মহামারী। এ ক্ষেত্রে একটা বৈশ্বিক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দেখা গেল, কিছু কিছু দেশ ‘এককভাবে’ চলতে চেষ্টা করছে এবং সম্মিলিতভাবে কোনো স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল গ্রহণ করেনি। কয়েকটি তথ্য দেওয়া যেতে পারে। ইউরোপের দেশগুলো, বিল ও মেলিন্ডা গেইটস ফাউন্ডেশন, ও wellcome Trust 800 কোটি ডলারের একটি সহায়তার উদ্যোগ নিচ্ছে, যার মাধ্যমে Covid-19 Tools (ACT অর্থাৎ কভিড-১৯-এর দ্রুত মোকাবিলায় যেসব স্বাস্থ্য যন্ত্রপাতি দরকার, তা সংগ্রহ করা হবে এবং সরবরাহ করা হবে। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারত যুক্ত হয়নি। ফ্রান্সের কোম্পানি সানোফির ( (Sanofi)) সিইও পল হাডসন মনে করেন যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে ও টিকা সরবরাহের ব্যাপারে একটি প্রি-অর্ডার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেহেতু তাদের টিকা পাওয়ার অধিকারটি বেশি। ভারতের Serum Institute, যারা টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে আছে, সংস্থাটির প্রধান বলেছেন, Serum যা উৎপাদন করবে, তা প্রথমে পাবে ভারতের জনগণ। এরপর তা বহির্বিশ্বের মানুষ পাবে। Astrazeneca, যারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কভিড-১৯ টিকা উৎপাদন করছে, তাদের উৎপাদিত টিকা প্রথমে পাবে ব্রিটেনের মানুষ (প্রায় তিন কোটি ডোজ)। কেননা যুক্তরাজ্য সরকার টিকা উৎপাদনে ৭৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। পরে ট্রাম্প প্রশাসন, এখানে তাদের বিনিয়োগ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদিত টিকার মধ্যে ৩০ কোটি ডোজ পাবে। ট্রাম্প প্রশাসন Operation Warp Speed,, অর্থাৎ দ্রুত মানুষকে টিকা দেওয়ার যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তার আওতায়ই এই টিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে (ওই)। এর অর্থ হচ্ছে ধনী দেশগুলোর কাছে অর্থ আছে, আর তারা ওই অর্থ ব্যবহার করছে টিকা সংগ্রহে। এজন্য তারা টিকা উৎপাদনের আগেই প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে তাদের অংশ আগেই নিশ্চিত তরেছে। এমনকি ট্রাম্প বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাকে সব ধরনের চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে ওই সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এটাই হচ্ছে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ নিজের প্রাপ্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া আগে। মানবিকতা এখানে মুখ্য নয়। আমরা H1N1 ev Swine Flu-এর সময়ও এমনটা দেখেছিলাম। ২০০৯ সালে ওই মহামারীতে বিশ্বে মারা গিয়েছিল ২,৮৪,০০০ মানুষ। মহামারীটি শুরু হলে সাত মাসের মাথায় এর টিকা আবিষ্কার হয়। তখন ধনী দেশগুলো ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করে তাদের নিজ নিজ দেশে আগে টিকাটি সরবরাহ করতে। ফলে দেখা গেল শুধু যে দেশগুলোর ‘ক্রয়ক্ষমতা’ রয়েছে বেশি, তারাই H1N1-এর টিকা পেল আগে। দ্রুত যে দেশগুলো সংক্রমিত হয়েছিল, অগ্রাধিকার তালিকায় তারা প্রথমে টিকা পায়নি। করোনার টিকা নিয়ে এই দুর্ভাবনা এখনো শেষ হয়নি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে জানুয়ারিতে করোনা টিকা আসবে। কিন্তু এই টিকা কারা পাবে প্রথমে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। করোনা শুধু ধনী আর গরিব রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যই সৃষ্টি করেনি, বরং মানুষ মানুষেও পার্থক্য সৃষ্টি করেছে Desh Rupantor 13.12.2020

একটি ছবি, একটি সংবাদ, অনেক প্রশ্ন

গত ৬ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের (সমকাল) প্রথম পাতার একটি ছবি। একজন রোহিঙ্গা নারী পারভিন আক্তার ভাসানচর থেকে ভিডিওকলে টেকনাফে থাকা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলছেন। তার হাসিমাখা ছবি বলে দেয় ‘নতুন জীবনে’ তিনি খুশি। এক সময় মিয়ানমারের রাখাইনের স্থায়ী বাসিন্দা পারভিন ২০১৭ সালে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। ঠাঁই হয় কুতুপালং ক্যাম্পে। এখন তার নতুন জীবন ভাসানচরে। এ জীবন তার কতদিনের, তা তিনি জানেন না। তবে কুতুপালংয়ের ‘বস্তির জীবনের’ চেয়ে ভাসানচরের জীবন যে অনেক ভালো, তা তার হাসিমাখা মুখের ছবি দেখলেই বোঝা যায়। এ ধরনের ছবি সংবাদপত্রে আর টিভিতে আরও আছে। প্রায় প্রতিদিনই ভাসানচরের ‘নতুন জীবনের’ ছবি ছাপা হচ্ছে, আর তা আমাদের জানান দিচ্ছে সেখানে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিরোধিতা করছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা UNHCR। তাদের অভিযোগ, ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়া হয়নি (ভোয়া, ০৭ ডিসেম্বর, ২০২০)। এক বিবৃতিতে UNHCR বলেছে, ভাসানচরে যে কোনো পুনর্বাসন হওয়া উচিত প্রযুক্তিবিষয়ক সুরক্ষার অধীনে। ভাসানচরে ‘শরণার্থীদের’ বসবাসের নিরাপত্তা, উপযোগিতা ও তা টেকসই কিনা, সেটা নিরপেক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চায় জাতিসংঘ। একই সঙ্গে সুরক্ষা কাঠামো, সহযোগিতা এবং মূল ভূখণ্ডে ফেরার উপযোগিতা যাচাই করে দেখতে চায় তারা (মানবজমিন, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২০)। তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথাও বলতে চায়- একথাও এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন UNHCR-এর হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি। কিছু আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাও রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের বিরোধিতা করছে। একদিকে বাংলাদেশের উদ্যোগ, অন্যদিকে জাতিসংঘের বিরোধিতা কতগুলো প্রশ্নকে এখন সামনে নিয়ে এলো। এক. এ স্থানান্তর যৌক্তি কিনা? এটি যৌক্তিক। কারণ কক্সবাজারে ক্যাম্পে যেভাবে রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছিল, তা ছিল অমানবিক। ছোট ছোট খুপরি ঘরে তারা থাকতে বাধ্য হতো। সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসেবার অভাব ছিল। উপরন্তু সেখানে নিত্যদিন সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ত রোহিঙ্গারা। সবচেয়ে বড় কথা, বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপক উপস্থিতি সেখানে একাধিক সংকট সৃষ্টি করেছিল। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় জনগণ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনগণকে বিতাড়িত করে পুরো এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এদের উপস্থিতি বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী ৪ হাজার ৩০০ একর পাহাড়ি বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। ৩ থেকে ৪ হাজার একর পাহাড়ি এলাকা নষ্ট করে সেখানে ক্যাম্প বানানো হয়েছে। টেকনাফ, উখিয়া, হিমচর এলাকায় পুরো বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে। এরা যদি আরও কিছুদিন সেখানে অবস্থান করে, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ এলাকায় কোনো গাছগাছালি থাকবে না। কারণ প্রতি মাসে ৬ হাজার ৮০০ টন কাঠ রোহিঙ্গারা ব্যবহার করে রান্নার কাজে। গাছ কেটে তা রান্নার কাজে ব্যবহার করা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই। তাদের কাছে জ্বালানির কোনো বিকল্প উৎসও নেই। ইতোমধ্যে এটি প্রমাণিত যে, বিশ্বব্যাপী বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। এক্ষেত্রে কক্সবাজারে পুরো পাহাড় কেটে ফেলা, বনাঞ্চল ধ্বংস করার কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পরিবেশের যে ক্ষতি করে ফেলেছে, সে ব্যাপারে জাতিসংঘ কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। পাহাড়ি এলাকার বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে নিম্নাঞ্চলে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়বে, হাজার হাজার মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। সারা বিশ্ব আজ যেখানে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, সেখানে কক্সবাজার এলাকায় হাজার হাজার বনাঞ্চল ধ্বংস করে রোহিঙ্গারা বড় ক্ষতি করেছে বাংলাদেশের। দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ জাতিসংঘ যখন ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগের বিরোধিতা করছে, তখন বাংলাদেশের পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি জাতিসংঘ বিবেচনায় নেয়নি। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হচ্ছে। ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আরও ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ এভাবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করতে পারে কিনা? বিদেশি যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, সে পরিমাণ সাহায্য বাংলাদেশ পায়নি। ফলে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যয় বাংলাদেশ সরকারকেই বহন করতে হচ্ছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশ এ ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। যে পরিমাণ অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় হয়, সে অর্থ অন্যত্র উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা যায়। দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজে ব্যয় করা যায়। বন্যা মোকাবেলায় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা যায়। কোভিড-১৯-পরবর্তী সংকট মোকাবেলায় বিপুল অর্থের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন, হাসপাতালগুলোর আধুনিকায়ন, ভাইরাস নির্ণয় সংক্রান্ত গবেষণার পরিধি বাড়ানো ইত্যাদি কাজে অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে পারে না। জাতিসংঘ এক ধরনের আপত্তি করেছে বটে; কিন্তু আজ অবধি মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারেনি তাদের নাগরিকদের ফেরত দিতে। জাতিসংঘ বৃহৎ শক্তির স্বার্থ দেখছে। বৃহৎ শক্তি যা চায়, জাতিসংঘ তা-ই করে। বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করা লাখ লাখ রোহিঙ্গার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দিতে যে অর্থ প্রয়োজন, জাতিসংঘ তা সংগ্রহ করতে পারেনি। ইরানের প্রশ্নে জাতিসংঘ স্বার্থ দেখেছিল বৃহৎ শক্তির। অর্থনৈতিক অবরোধের পরিধি বাড়িয়ে বৃহৎ শক্তির স্বার্থই রক্ষা করেছিল জাতিসংঘ। অথচ মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রাথমিক রায়ও গেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারপরও জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো অর্থনৈতিক অবরোধের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। জাতিসংঘের ব্যর্থতা এখানেই। সুতরাং আজ যখন রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের ‘ঘাড়ে চেপে বসেছে’, তখন বাংলাদেশকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এটা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ডও গ্রহণযোগ্য নয়। তারা তাদের স্বার্থে কাজ করে। রোহিঙ্গাদের নাম ভাঙিয়ে তারা অর্থ সংগ্রহ করে এবং এর ছোট একটা অংশ তারা রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করে। কক্সবাজার এলাকায় গেলে দেখা যাবে পাঁচ তারকাবিশিষ্ট হোটেল, রিসোর্টগুলো তাদের দখলে। সুতরাং রোহিঙ্গাদের যদি বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রাখা যায়, লাভটা তাদেরই! অথচ যতদূর জেনেছি, সরকার ভাসানচরে আন্তর্জাতিক এনজিও কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করেছে, প্রয়োজনে সেখানে থেকে কর্মীরা যাতে রোহিঙ্গাদের দেখভাল করতে পারে। কিন্তু তারা সেটা চাইছে না। কক্সবাজারের পাঁচ তারকা হোটেলের বিলাসী জীবন ছেড়ে তারা ভাসানচরে থাকতে চায় না! সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানেই। মাত্র ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে সেখানে নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা এক লাখের। সেখানে অনেক আগে থেকেই বসবাসের এক ধরনের ‘পরিবেশের’ জন্ম হয়েছে। ১০ হাজার মহিষ সেখানে চড়ে বেড়ায়। ভাসানচরের মোট এলাকা ১৩ হাজার একর। বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য জমি ৬ হাজার ৪২৭ একর। আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে উঠেছে মাত্র ১ হাজার ৭০২ একর এলাকায়। ফলে বিশাল এক এলাকা রয়ে গেছে অব্যবহৃত। ১ লাখ রোহিঙ্গার অস্থায়ী বসতি গড়ে তোলা খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। রোহিঙ্গারা কৃষিকাজ, গবাদি পশু লালন-পালন কাজে নিজেদের জড়িত করতে পারে। এতে করে তারা তাদের সময়টা সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে পারে। সেখানে রয়েছে উপযুক্ত বাঁধ, নিরাপত্তা, চিকিৎসাসেবা, দ্রুত যাতায়াতব্যবস্থা, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, খাবার সংরক্ষণ ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক। ফলে খুব দ্রুতই এ অঞ্চলটি যে আধুনিক একটি ছোট শহরে পরিণত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কিছু প্রশ্ন তো আছেই। সরকার শুধু কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে গিয়ে তাদের দায়িত্ব ‘পালন’ করছে, এটা চিন্তা করলে ভুল হবে। অনেক কাজ এখনও বাকি। প্রথমত, রোহিঙ্গা ভাষায় শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, বাংলা ভাষায় নয়। মহিলাদের কুটির শিল্পের কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে, যাতে এনজিওগুলোকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পুরুষদের কৃষিকাজে নিয়োজিত হতে উৎসাহ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তার বিষয়টি জরুরি। সেখানে যাতে কোনো ধরনের জঙ্গি তৎপরতার জন্ম না হয়, যাতে করে মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থা এখানে প্রবেশ করে অপতৎপরতা চালাতে না পারে, সে জন্য বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি সেখানে থাকতে হবে। পুরো দায়িত্বটি ছেড়ে দিতে হবে নৌবাহিনীর হাতে। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের মাঝে সশস্ত্র গ্রুপ রয়েছে। এরা যাতে ওই এলাকায় অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পরে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তৃতীয়ত, পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশকে বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে আরও ‘ভাসানচর’ তৈরি করতে হবে। ভাসানচরে খুব বেশি রোহিঙ্গা স্থানান্তর ঠিক হবে না। পরিত্যক্ত দ্বীপগুলোকে খুব শিগগিরই বসবাসের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। চতুর্থত, ভাসানচরে স্থানান্তর রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নয়। জোর দিতে হবে কূটনীতির ওপর। এ কাজটি আমরা খুব সহজভাবে করছি বলে মনে হয় না। ওয়াশিংটন, ব্রাসেল্স আর জাতিসংঘে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর ‘অ্যাকটিভ ডিপ্লোম্যাসি’ আমার চোখে পড়েনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু কথা বলেন। কথা বলে জাতীয় স্বার্থ আদায় করা যায় না। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বহিঃবিশ্বে আমাদের অবস্থান তুলে ধরা প্রয়োজন। মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। মিয়ানমার চুক্তি করে এদের ফেরত নেয়ার কথা বললেও একজন রোহিঙ্গাকেও তারা ফেরত নেয়নি। আমাদের কূটনৈতিক অসফলতা এখানেই যে আমরা আমাদের মানবিক দিকটি সঠিকভাবে বিশ্বে তুলে ধরতে পারিনি। প্রতি বছর ক্যাম্পে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে। একটি বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী গড়ে উঠছে আমাদের বাসভূমে। এরা বিদেশি নাগরিক। এরা আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। ভাসানচরে এদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে স্থানান্তর করে আমরা কাজটি যেমন সঠিক করেছি, ঠিক তেমনি কূটনৈতিকভাবেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ জায়গাটিতে আমাদের কিছু দুর্বলতা এখনও রয়ে গেছে। Jugantor 13.11.2020

ট্রাম্পের বিদায় ও জনতুষ্টিবাদের ভবিষ্যৎ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি নাম বারবার সংবাদপত্রের আলোচনায় এসেছে। হাঙ্গেরির ভিক্টর উরবান, পোল্যান্ডের জারোসলাভ কাজানিস্ক্রি, ব্রাজিলের বলসোনারো, ব্রিটেনের বরিস জনসন ও নাইজেল ফারাজ, ফ্রান্সের লি পেন এবং ইতালির মাত্তিও সালভিনির নাম গত চার বছরে ট্রাম্পের পাশাপাশি উচ্চারিত হয়েছে। ট্রাম্পকে তারা আদর্শ হিসেবে মানতেন এবং তাকে অনুসরণ করতেন। তারা নিজ নিজ দেশে ‘পপুলিজম’ বা জনতুষ্টিবাদের জন্ম দিয়েছিলেন। যেমন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, তার আদর্শ হচ্ছেন ট্রাম্প। তিনিও ট্রাম্পের মতো মনে করতেন করোনাভাইরাস বলে কিছু নেই। ট্রাম্পের মতো মুখে মাস্ক ব্যবহার তিনি করেন না এবং জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি কোনো করোনা টিকা গ্রহণ করবেন না। এখন ট্রাম্পের বিদায়ের পর তাদের কী হবে? বলসোনারো, ভিক্টর উরবান, স্লোভেনিয়ার জানেজ জানসা- তাদেরও পতন কি আসন্ন? ট্রাম্প তার শাসনামলে যে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির (যাকে অনেকে ট্রাম্পইজম হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন) জন্ম দিয়েছিলেন, তার বিদায়ের মধ্য দিয়ে এর কি অবসান ঘটবে? এসব এখন আলোচনার বিষয়। ট্রাম্প বলতেন ‘America First’, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম। সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে যুক্তরাষ্ট্র, তাদের কথায় বিশ্ব চলবে। কিন্তু ট্রাম্পের কথায় বিশ্ব চলেনি। বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তির দেশ হওয়া সত্ত্বেও কোভিড-১৯-এর কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এর কারণ হচ্ছে, ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে আদৌ গুরুত্ব দেননি। তিনি নিজে স্বাস্থ্যবিধি মানতেন না। এখনও মানেন না, যখন যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আঘাত করেছে। আমরা হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও বেলারুশের দৃষ্টান্ত দিতে পারব, যেখানে করোনাভাইরাসকে ইস্যু করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছে। গত ৩০ মার্চের (২০২০) হাঙ্গেরির পার্লামেন্টে একটি আইন পাস হয়েছে। এ আইন বলে প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর উরবানকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে জরুরি প্রয়োজনে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের কারণে হাঙ্গেরির পার্লামেন্ট এ সিদ্ধান্ত নিল। এ আইন বলে তিনি ডিক্রি জারি করে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায়ও থাকতে পারবেন। তার কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে পার্লামেন্টে জবাবদিহি করতে হবে না। তিনি ইচ্ছা করলে দেশে প্রচলিত যে আইন রয়েছে, সেই আইনের বিরুদ্ধে যেতে পারবেন। প্রয়োজন হলে সংবিধান স্থগিত রাখতে পারবেন। ভিক্টর উরবান করোনাভাইরাসের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। এটা হচ্ছে একটা দৃষ্টান্ত, যেখানে ক্ষমতাসীনরা পৃথিবীর কয়েকটি দেশে এ ধরনের আইন পার্লামেন্টে পাস করিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। করোনাভাইরাস তাদের সবার জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। নিঃসন্দেহে করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী একটি বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছে। এ সংকটকে কেন্দ্র করে এ থেকে সুবিধা নেয়া, পার্লামেন্টে বিশেষ আইন পাস করে সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেয়া প্রকারান্তরে একনায়কতন্ত্রী মানসিকতারই প্রতিফলন। উল্লেখ্য, একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব ইউরোপে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল- এর ইতিহাস মানুষ জানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদের ভস্মস্তূপ থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। এখন সেই ইউরোপেই, পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতন তথা ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশন’ (সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ায় ভাসলাভ হাভেলের নেতৃত্বে) সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বীজ বপন করলেও ভিক্টর উরবানের মতো ব্যক্তিরা এখন তার ‘কবর’ রচনা করতে চলেছেন। ২০১৮ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। শুধু হাঙ্গেরিতে উরবানের ঘটনাকে আমরা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ভাবতে পারতাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব সামনে রেখে বেশ কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমরা বিশ্লেষণ করেছি। তাতে আমরা একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ করেছি; অর্থাৎ সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ আইন প্রণয়ন, শীর্ষ নেতৃত্বের ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, পার্লামেন্টের ক্ষমতা কমানো, বিরোধী নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা ইত্যাদি। আমরা আজারবাইজান, রাশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, পোল্যান্ড, ইসরাইল বা তুরস্কেরও দৃষ্টান্ত দিতে পারব। এসব দেশ গণতন্ত্রের প্রতি ‘কমিটমেন্টে’র কথা বলেছে। তাদের স্ব-স্ব দেশের সংবিধানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের সুযোগে তারা এখন নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করছেন। শীর্ষ নেতৃত্বের হাতকে শক্তিশালী করা হয়েছে। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। করোনাকালে আমরা বেলারুশের সর্বশেষ ঘটনা উল্লেখ করতে পারব। এ দেশটি একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে বেলারুশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন আলেকজান্ডার লুকাসেনকো। ১৯৯৪ সাল থেকেই তিনি ক্ষমতায়। পঞ্চমবারের মতো তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন ২০১৫ সালে। এবং ষষ্ঠবারের জন্য ৯ আগস্ট (২০২০) তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বলে ঘোষণা করা হলেও নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও ভোট ডাকাতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাভিতলানা সিকানউস্কায়া, যিনি প্রাণের ভয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ১৭ আগস্ট (২০২০) সেখানে স্মরণকালের বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিক্ষোভে ব্যাপক শ্রমিক সমাবেশ ঘটেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলছে। দীর্ঘ ২৬ বছরের শাসনামলে লুকাসেনকো এককভাবে দেশ চালাচ্ছেন। কোভিড-১৯-এর সুযোগ নিয়ে তিনি অনেক ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে আজারবাইজানের দীর্ঘদিনের শাসক ইলহাম আলিয়েভ ক্ষমতায় আছেন ২০০৩ সাল থেকে। তার বাবা হায়দার আলিয়েভও সেদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইলহাম করোনাভাইরাসের কারণে সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করেছেন। তাদের অফিস বন্ধ করে দিয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৫ এপ্রিল (২০২০)। অথচ জাতিসংঘ ও হু’র পক্ষ থেকে বারবার সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হয়েছিল। সিঙ্গাপুর সরকার নাগরিকদের ‘ডাটা’ সংগ্রহ করছে, যা মানুষ মেনে নিয়েছে বলেই মনে হয়। এ কারণেই সিঙ্গাপুরে মৃতের সংখ্যা কম। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুর্তাতে জুলাই মাসে (২০২০) আইন পাস করে নিজের হাতে অনেক ক্ষমতা নিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে ‘সামাজিক দূরত্বে’র বিষয়টি বাস্তবায়ন করছেন। প্রয়োজনে তিনি গুলি করারও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি প্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে জরুরি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করতে প্রধানমন্ত্রী নতুন ডিক্রি জারি করেছেন। এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রযুত চান-ওচা তার ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করছেন। হাঙ্গেরির মতো পোল্যান্ডও একদলীয় পথে হাঁটছে। ক্ষমতাসীন ‘ল’ অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’ সব ধরনের উপদেশ ও সাজেশন উপেক্ষা করে জুন মাসে (২০২০) প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। সেখানে আদৌ কোনো ‘লকডাউন’ কাজ করেনি। করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে বিরোধী দলকে কোনো নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে না দিয়ে দলীয় প্রার্থী আন্দ্রেই দুদাকে পাস করিয়ে এনেছে দলটি। সেখানে নতুন আইন প্রণয়ন করে সরকারকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তুর্কমেনিস্তানে করোনা শব্দটি পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে আইন করে। কম্বোডিয়ায় হুন সেন করোনার সুযোগে নিজের ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করেছেন। বিরোধী দল ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টির শীর্ষস্থানীয় সব নেতাকে গ্রেফতার করে তিনি কার্যত দেশটিতে একদলীয় শাসন চালু করেছেন। হুন সেন ১৯৮৫ সাল থেকে ক্ষমতায়। আমরা আরও কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতে পারব, যেসব দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করেছেন। ইসরাইলে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ‘ক্রিমিনাল চার্জ’ থাকা সত্ত্বেও তিনি আইন করে বিরোধীদলীয় সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছেন, যাতে তার বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন গড়ে না ওঠে। তিনি বিরোধী দলকে ভেঙে এখন একটি কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বলতে দ্বিধা নেই, এদের সবারই আদর্শ হচ্ছেন ট্রাম্প। এরা ট্রাম্পের আদর্শকে ধারণ করে জনতুষ্টিবাদের জন্ম দিয়েছেন। অ্যান্টি-ইসলামিজম, বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণ, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করা, কিংবা এককভাবে ক্ষমতা চালানো- এসবই হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ। এ ক্ষেত্রে অদ্ভুত এক মিল আছে তাদের সবার মাঝে। এখন ট্রাম্পের বিদায়ের ফলে এদের কি হবে? ট্রাম্পের বিদায় কি সেখানে গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দেবে? ট্রাম্পের সঙ্গে এদের পার্থক্য একটাই- যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এখনও শক্তিশালী থাকায় হাজারও ফন্দি-ফিকির করেও ট্রাম্প ক্ষতায় থাকতে পারছেন না। কিন্তু ভিক্টর উরবান, আর হুন সেনরা ক্ষমতায় আছেন এবং থাকছেন। গণতান্ত্রিক কোনো মূল্যবোধ এ ক্ষেত্রে কাজ করছে না। ট্রাম্পের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আদৌ বিদায় ঘটবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। তবে এটা তো ঠিক, করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে এসব নেতা প্রশাসনকে যেভাবে সাজিয়েছেন, ট্রাম্পের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সাজানো প্রশাসন হঠাৎ করেই ভেঙে পড়বে না। ‘কালার রেভ্যুলেশন’ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। বেলারুশ কিংবা থাইল্যান্ডের পরিস্থিতি বলে দেয় পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। বেলারুশ ও থাইল্যান্ডে গণআন্দোলন হলেও সরকারের পরিবর্তন হয়নি সেখানে। কম্বোডিয়ায় দীর্ঘদিনের শাসক হুন সেন তার ছেলেকে (হুন মানেত) ক্ষমতায় বসানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। তার ছেলে এখন সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। করোনাভাইরাসের কারণে রাজনীতি সেখানে এখন নিয়ন্ত্রিত। তথাকথিত গণতন্ত্র সেখানে আছে বটে; কিন্তু ওই গণতন্ত্রে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই। বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই। সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রিত। আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা আদৌ সম্ভব হবে কিনা, এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। করোনাভাইরাস একটি বাস্তবতা। কিন্তু করোনার সুযোগ নিয়ে তথাকথিত ‘পপুলিজমে’র জন্ম সাময়িকভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারলেও জনগণের মঙ্গলের জন্য এটা কোনো ‘মডেল’ হতে পারে না। ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ একনায়কতন্ত্র চালু করতে চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। তবে যে রাজনীতির তিনি জন্ম দিয়ে গেছেন, তা হঠাৎ করেই চলে যাবে না। বলা হচ্ছে, ট্রাম্প চলে গেলেও ‘ট্রাম্পইজম’ থাকবে! অর্থাৎ তার কট্টর মতাদর্শের প্রভাব কিছুটা হলেও থেকে যাবে। উরবানরা ইউরোপে ‘অ্যান্টি-ইসলামে’র ধুয়া তুলে সেখানকার জনগণকে বিভক্ত করে ফেলেছেন। একদিকে খ্রিস্টধর্ম, অন্যদিকে ইসলাম। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা (শরণার্থী) সেখানে আশ্রয় পায়নি। এখন তাদের অনুপ্রেরণার জায়গাটা হয়তো থাকল না; কিন্তু আদর্শ তো থেকে গেল। মুসলিমবিদ্বেষ তো হঠাৎ করে চলে যাবে না। হয়তো আরও বেশ কিছুটা সময় লাগবে ইউরোপকে আগের জায়গায় ফিরে যেতে। ফলে আশঙ্কা করছি, ট্রাম্প চলে গেলেও ‘পপুলিজম’ থেকে যাবে এবং ২০২১ সালে এটা হবে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বিষয় Jugantor 6.12.2020

ট্রাম্প-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু বদলাবে?

যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাইডেন নিজেকে তৈরি করছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার। তিনি ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের নাম ঘোষণা করতে শুরু করেছেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় উঠেছে, তা হচ্ছে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বকে কতটুকু বদলাতে পারবেন? ট্রাম্প গত চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বড় ধরনের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। তার গোঁয়ার্তুমি, ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া, শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসির নামে সমাজকে বিভক্ত করা, করোনা ভাইরাস মহামারীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হিসেবে বিবেচনা করা, স্বাস্থ্য সেক্টরকে অবহেলা করা এবং একই সঙ্গে বিশ্ব নেতৃত্ব হারানো- এসব কর্মকা- খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই অনেক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এ থেকে বাইডেন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনবেন? অক্সফোর্ডের ডিকশনারিতে এবার যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ শব্দটি যোগ হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু কেন্দ্র করে বর্ণবাদবিরোধী যে আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল এবং যা ছড়িয়ে গিয়েছিল সারাবিশ্বে, তা স্থান করে নিয়েছে ডিকশনারির পাতায়। ট্রাম্পের ভুল নীতির কারণে এই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ট্রাম্প এই বর্ণবিরোধকে উসকে দিয়েছিলেন। শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর লোকদের হাতে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ানো কিংবা পাহারা দেওয়ার ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। স্পষ্টতই মার্কিন সমাজ কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ- এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। তবে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ ছিল অনেক দিন থেকেই। কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দরিদ্রতা বাড়ছিল। চাকরি তথা ব্যবসা ক্ষেত্রে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল তুলনামূলকভাবে কম। এই করোনা পরিস্থিতির সময়েও শ্বেতাঙ্গরা আরও ধনী হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গরা তুলনামূলক বিচারে আরও গরিব হয়েছে (দেখুন Inequality in America)। এতে দেখা যায় কীভাবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে সেখানে। করোনা ভাইরাসেও (কোভিড-১৯) শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত, মৃত্যুহার ও চাকরি হারানোর হার বেশি (আরবান ওয়ার, ১০ এপ্রিল ২০২০)। গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন (২০ মে, ২০২০) থেকে জানা গেছে, করোনা ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে যত মানুষ মারা গেছে (আক্রান্ত ১৪৩১৩৯৪১ জন; মৃত্যু ২৭৯৮৬৫; ৩ ডিসেম্বর ২০২০), তাদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুর হার শ্বেতাঙ্গ মৃত্যুর চেয়ে তিনগুণ বেশি। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের (ইৎড়ড়শরহমং ষহংঃরঃঁঃব) তথ্যমতে, প্রতি ৫ জন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের মধ্যে একজনের কোনো হেলথ ইন্স্যুরেন্স অর্থাৎ স্বাস্থ্যবীমা নেই। তারা নিয়মিত চিকিৎসা পান না। মৃত্যুর এটি একটি বড় কারণ। ফলে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যে ক্ষোভ থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশ (২১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০১৯)। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেনি। করোনা ভাইরাসের সময় এ বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ যখন বৃদ্ধি পায়- তখন দেখা গেল হাসপাতালগুলোয় যথেষ্ট পরিমাণ আইসিইউ বেড নেই, ভেন্টিলেটর নেই, মাস্ক নেই, ডাক্তার তথা নার্সদের জন্য পিপিই নেই। শুধু ভেন্টিলেটরের অভাবে শত শত মানুষ সেখানে মারা গেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ৬ ট্রিলিয়ন ডলার খচর করেছে আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের পেছনে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা আরও উন্নত করা যেত, সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেত। এতে স্বাস্থ্য সেক্টরে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছিল, তা কমিয়ে আনা যেত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতি, বিশেষ করে ‘ওবামা কেয়ার’ বাতিল করে দেওয়ায় এই বৈষম্য আরও বেড়েছে। ট্রাম্প স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বীমা কোম্পানি তথা ওষুধ কোম্পানিগুলোর পক্ষে কাজ করে গেছেন। ফলে কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও এ ক্ষেত্রে এর কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কৃষ্ণাঙ্গ অসন্তোষ উসকে যাওয়ার পেছনে ট্রাম্পের অনেক বক্তব্য দায়ী। আন্দোলনকারীদের তিনি হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি এই আন্দোলনকে চিহ্নিত করেছিলেন Domestic terror অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস হিসেবে (নিউইয়র্ক টাইমস)। যেখানে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকা-ে তার সহানুভূতি দেখানোর কথা, সেখানে তিনি তাদের সন্ত্রাসী, এমনকি সেনাবাহিনী নামিয়ে আন্দোলন দমন করার কথাও বলেছিলেন। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প প্রশাসনের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও’ব্রায়েনও আন্দোলনকারীদের ‘বহিরাগত জঙ্গি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ ধরনের বক্তব্য ছিল মূল ঘটনাকে আড়াল করার শামিল। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনাবলিকে পর্যবেক্ষকরা আখ্যায়িত করেছে Racism and Racial Terrorism Has Fueled Nationawide Anger হিসেবে (অ্যামিওডম্যান, ট্রুথআউন্ট, ১ জুন)। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে যে বর্ণবাদ এখনো আছে, সেটিই উসকে দিয়েছে জর্জ ফ্লয়েডের এই মৃত্যু। আরেকজন বিশ্লেষক উইলিয়াম রিভাস পিট এ আন্দোলনকে একটি ‘বিপ্লব’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। এক ধরনের ‘কালার রেভ্যলুশন’-এর কথাও বলছেন কেউ কেউ। নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় ধরনের সংকটে আছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা চরমে উঠেছে। ইতোমধ্যে ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে এনেছেন। অথচ করোনা ভাইরাস একটি বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এখানে চীন, যুক্তরাষ্ট্র তথা শীর্ষ ধনী দেশগুলোর মধ্যে একটা সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করে ট্রাম্প একা চলতে চেয়েছিলেন- যা করোনা ভাইরাস মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট ছিল না। এমনই এক পরিস্থিতিতে ইষধপশ খরাব Black Live Matters ট্রাম্পবিরোধী আন্দোলনে নতুন একটি মাত্রা পেয়েছিল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন বেশি বিভক্ত। এই বিভক্তির দেয়াল তুলেছেন ট্রাম্প। ইঙ্গিতটি স্পষ্ট- ট্রাম্প এ বিভক্তিকে উসকে দিয়েছিলেন। মার্কিন সমাজে বর্ণবৈষম্য আছে। অতীতে সব প্রেসিডেন্টের আমলেই এ বৈষম্য কমানোর তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বারাক ওবামা নিজে কৃষ্ণাঙ্গ (মিশ্র বলা ভালো) হিসেবে পরিচয় দিলেও তার আমলেও বৈষম্য কমাতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি। আর ট্রাম্পের আমলে তা বেড়ে যায়। এ কারণে একের পর এক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার ঘটনা যখন ঘটছিল, ঠিক তখনই জ্বলে ওঠে Black Live Matters আন্দোলন। এখন বাইডেন প্রশাসন এই বৈষম্য কমাতে কী উদ্যোগ নেবেন? এটি ঠিক, কৃষ্ণাঙ্গরা ব্যাপকভাবে বাইডেনকে সমর্থন করেছিলেন। ফলে তাদের একটি প্রত্যাশা থাকবেই যে, বাইডেন তাদের জন্য কিছু করবেন। তবে কাজটি খুব সহজ নয়। ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিং বৈষম্য কমানোর জন্য আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। এত বছর পরও ওই বৈষম্য কমেনি- এটিই দুঃখের কথা। শুধু বর্ণবাদকে ট্রাম্প উসকে দিয়েছিলেন, এটি বললে ভুল হবে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে ভেঙে দিয়েছেন। যে গণতন্ত্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে ‘সবক’ দেয়, ঋণের শর্ত হিসেবে গণতন্ত্রের শর্তের কথা বলে- সেখানে নিজ দেশেই গণতন্ত্র আজ বিপন্ন। Information clearing House নামে একটি নিউজ পোর্টালে রামজি বারুদ ট্রাম্পের শাসনামলে বিখ্যাত ম্যাগাজিন Economist এর Democracy Index এর তথ্য উল্লেখ করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র Full Democracy অর্থাৎ পূর্ণ গণতন্ত্র থেকে Flawed Democracy অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রে পরিণত হয়েছে (প্রবন্ধের শিরোনাম Whats the future of U.S, Democracy ? November 23, ২০২০)। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র বেশিমাত্রায় বৈষম্য, মেরুকরণ ও সহিংসতার জন্ম দিয়েছে। জি-৭ভুক্ত দেশের মধ্যে আয়বৈষম্যের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে রয়েছে- এ কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। খুব সহজে এই পরিস্থিতি বদলে যাবে বলে মনে হয় না। আরেক বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি Truthout এ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এর শিরোনাম Trump has revealed the extrem fragility of American Democracy (২৫ নভেম্বর)। তার মন্তব্য, , If the U.S, were to apply for membership in the European Union today, it would probably be rejected. The radically undemocratic character ofthe Senate would be sufficient reason , । কী ভয়ঙ্কর কথা! যুক্তরাষ্ট্র যদি তত্ত্বগতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদের জন্য আবেদন করে, তা হলে গণতান্ত্রিক আচরণের জন্য তাদের আবেদন অগ্রাহ্য হবে। এটি একটি কথার কথা। এটি বলে চমস্কি বোঝাতে চেয়েছেন, গণতন্ত্রের পথ থেকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দূরে সরে গেছে। ফলে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে তার বর্তমান অবস্থান থেকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারবেন, সেটি একটি প্রশ্ন বটে। তবে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক। মানুষ প্রত্যাশা করে, বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে তার আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবেন। তবে কাজটি সহজ নয়। Amader Somoy 4.12.2020

করোনায় বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও আয়বৈষম্য

করোনার বৈশ্বিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। ইউরোপে কোথাও কোথাও ‘দ্বিতীয় ঢেউ’, আবার কোথাও ‘তৃতীয় ঢেউ’ হচ্ছে। এর প্রতিবাদে লন্ডনে বড় বিক্ষোভ পর্যন্ত হয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটেছে। মৃত্যুর মিছিলে সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও সরকারিভাবে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে, তাতে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। আমরা এটাকে ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ বলি আর না বলি, বাস্তবতা হচ্ছে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়নি। এখন একমাত্র ভরসা হচ্ছে করোনা ভ্যাকসিন। অর্থাৎ করোনা টিকাই হচ্ছে একমাত্র প্রতিষেধক। টিকা ছাড়া কোনো মুক্তি নেই। এই টিকা নিয়েও বিশ্বব্যাপী চলছে এক ধরনের ‘ব্যবসা’ ও ‘বৈষম্য’। অর্থাৎ টিকাপ্রাপ্তি ও টিকাপ্রাপ্তির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। আরও কথা আছে। যেখানে বিশ্বের প্রতিটি দেশে করোনা আঘাত করেছে, সেখানে সব দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকার গরিব দেশগুলো এই টিকা সবাই পাবে কি না, এটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা এই টিকা প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ নগদ অর্থ দিয়ে কিনতে হবে। সেই অর্থ গরিব দেশগুলো কোত্থেকে সংগ্রহ করবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। Truthout নামে একটি নিউজ পোর্টাল আমাদের জানাচ্ছে, যে পাঁচটি টিকা অনুমোদন পেতে যাচ্ছে, তাদের উৎপাদিত টিকা বিশ্বের তিন ভাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুই ভাগ জনগোষ্ঠীর কাছে ২০২২ সালের আগে পৌঁছানো সম্ভব হবে না (১৭ নভেম্বর)। এর অর্থ হচ্ছে টিকা নিয়ে যে বৈষম্য তা আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করবে। একদিকে টিকা নিয়ে বৈষম্য যখন তৈরি হয়েছে, তখন বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যও কোনো সুখবর নেই। মৃত্যুর মিছিল যখন বাড়ছে, তখন বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে চলেছেন। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেমনি প্রযোজ্য, ঠিক তেমনি প্রযোজ্য ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। তাদের সম্পদ বৃদ্ধি হচ্ছে। অথচ গরিব মানুষ দিনে দিনে আরও গরিব হয়েছে। ধনী ও গরিব মানুষের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে আয়ের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ কভিড-১৯-এর কারণে ব্যবসার প্রসারও বেড়েছে, যাতে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীতে সারা বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা এখন ১৪ লাখ অতিক্রম করেছে (১৪,৬০,৭৯২, ২৯ নভেম্বর)। এখন আশ্চর্যজনকভাবে বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ আরও বেড়েছে। ভারতের মতো দেশে শত কোটিপতির সংখ্যা শুধু বাড়েইনি, তাদের সম্পদও বেড়েছে। কতগুলো পরিসংখ্যান দিলে আমাদের বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বিলিয়নিয়ারদের শীর্ষে রয়েছেন জেফ বেজোস, যিনি ‘আমাজন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। ৫৬ বছর বয়সী জেফ বেজোসের সম্পদের পরিমাণ এখন ১৭৫.৩ বিলিয়ন ডলার, যা অনেক দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। আমাজন এই প্যানডেমিকের সময় সম্পদ বৃদ্ধি করেছে দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে এই সময় তাদের আয় ছিল ২.৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তাদের আয় বেড়েছে দ্বিগুণ, ৫.২ বিলিয়ন ডলার ( The Verge, July 30,2020 ). শুধু আমাজনের কথা কেন বলি? বিল গেটস (মাইক্রোসফট) তার সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে ৯৮ বিলিয়ন ডলারে। ধনীদের তালিকায় তার অবস্থান দ্বিতীয়। তৃতীয় অবস্থানে আছেন ওয়ারেন বাফেট (বার্কশায়ার হাথাওয়ে), তার সম্পদের পরিমাণ ৬৭.৫ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ওরাকলের লেরি এলিসন, ফেইসবুকের মার্ক জাকারবার্গ, সবার সম্পদ বেড়েছে। আরেকটি পরিসংখ্যানে আমরা দেখতে পাই, করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বেশি মানুষ মারা গেলেও, সেখানে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা চীনের পরে (চীনে ৭৯৯ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ৬২৬ জন। ভারতে ১৩৭ জন। সূত্র Statista )। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন, তেমনটি নয়। ফোর্বস যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে প্রথম ১৫ জন বিলিয়নিয়ারের মধ্যে ফ্রান্সের আছে দুজন, স্পেনের একজন, মেক্সিকোর একজন। করোনাকালে ভারতেও ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সেখানেও ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। ভারতে গত ছয় মাসে নতুন ১৫ জন বিলিয়নিয়ারের জন্ম হয়েছে। ভারতে মোট বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা এখন ১৩৭। এই ১৩৭ জনের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি ডলার। তালিকার শীর্ষে রয়েছেন মুকেশ আম্বানি (৮৮২০ কোটি ডলার)। পরের অবস্থানগুলো যথাক্রমে শিব বাদার (৮৮২০ কোটি ডলার), গৌতম আদানি (১৮৬০ কোটি ডলার), রাধাকৃষ্ণ দামানি (১৫২০ কোটি ডলার)। নতুন শত কোটিপতির তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তারা হচ্ছেন বিমল কুমার জ্ঞানচন্দানি, বিনি বনসল, রাধোশ্যাম গোয়েনকা প্রমুখ (আনন্দবাজার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)। করোনাকালে ভারতে শত কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতিবিদরা সেখানে ধনী ও গরিবদের মধ্যে পার্থক্য আরও বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবেই দেখছেন। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে দেব? একদিকে করোনাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যাচ্ছে না, মৃত্যুর সংখ্যা এখনো বাড়ছে। অন্যদিকে ধনীদের সংখ্যাও বাড়ছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন। অথচ ভারতের অর্থনীতি ভালো নয়। ভারতে জিডিপি গত ৪০ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। কাজ হারিয়েছে ৪১ লাখ মানুষ (আইএলও তথ্য মতে)। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ২৩.৯ শতাংশ। আর্থিক সংকটের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মুকেশ আম্বানির ‘রিলায়েন্স’ গ্রুপ গুগল, ফেইসবুকের মতো অনলাইন সংস্থায় বিনিয়োগ করেছে ও তার মূলধন বেড়েছে। করোনাভাইরাস ভারতে ধনীদের আরও ধনী করেছে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশেও করোনাকালে কোটিপতিদের সংখ্যা বেড়েছে। গত মার্চ থেকে জুন (২০২০) এই চার মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৩৭ জন। মার্চে এ সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন। করোনার সময় ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে (বিডিটুডে, ১৬ সেপ্টেম্বর)। আবার যুুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতির দিকে ফিরে যাই। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এই নভেম্বরেই দ্বিতীয় আরেকটি ‘ওয়েভ’ বা ঢেউ যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হেনেছে। স্বাস্থ্যসেবায় অব্যবস্থাপনা সেখানে চরমে। মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার জন্য নোয়াম চমস্কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দায়ী করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার কলেজের প্রফেসর থমাস মাগাস্টাড্ট ২৮ সেপ্টেম্বর নিউজ পোর্টাল Nations of Change এ যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ‘Failed State , বা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন করোনাকালেও যুক্তরাষ্ট্রে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে, গরিব আরও গরিব হয়েছে। Families of USA এর তথ্য মতে মহামারীর সময় ৫৪ লাখ মানুষ তাদের যে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ছিল, তা হারিয়েছে। চাকরি না থাকায় অনেকেই এখন আর ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম দিতে পারছেন না। কভিড-১৯-এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে নিম্ন আয়ের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হার্ভার্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক রাজ চেট্টি কভিড-১৯ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাতে তিনি দেখিয়েছেন, নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের বছরে আয় ২৭ হাজার ডলারের নিচে, তাদের মধ্যে ১১ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। কিন্তু যাদের আয় বছরে ৬০ হাজার ডলারের ওপরে, তাদের মধ্যে চাকরি হারানোর সংখ্যা ৩ ভাগের ১ ভাগ। অধ্যাপক থমাস মাগাস্টাড্ট তার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের চাকরি চলে গেছে, অথবা বেতন কমেছে, সেখানে প্রধান নির্বাহীদের বেতন বেড়েছে ৯৪০ ভাগ। চিন্তা করা যায়? এই করোনাভাইরাসকেও ব্যবসায়ীরা পুঁজি করছেন। তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করছেন। তারা আরও ধনী হয়েছেন। যেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে বিশ্বে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের সম্পদও বেড়েছে। আইএমএফের আশঙ্কা বিশ্ব অর্থনীতি এবার সংকুচিত হবে ৫.২ শতাংশ। কিন্তু করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ ইতিমধ্যে ইউরোপে আঘাত হেনেছে। স্পেন, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড কিংবা জার্মানিতে আবার সীমিত ‘লকডাউন’ চালু হয়েছে। বার, রেস্টুরেন্ট খোলার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির সংকোচনের হার ৫.২ শতাংশকেও ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশও এতে করে আক্রান্ত হবে। করোনায় বাংলাদেশের জিডিপি কমবে ০.০১ শতাংশ। এডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যে ক্ষতি হবে, তার পরিমাণ ৮৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। কিন্তু প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করোনায় মানুষের মাসিক আয় কমেছে ২০.২৪ শতাংশ। করোনার সময় প্রায় ৫২ দশমিক ৫৮ শতাংশ পরিবার বা খানা কোনো না কোনোভাবে খাদ্যদ্রব্য ভোগের পরিমাণ ২০২০ সালের মার্চের তুলনায় কমিয়েছে। বিবিএসের জরিপে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয় বিশ্ব এখনো করোনামুক্ত হয়নি এবং করোনাভাইরাসের উপস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে থাকলই। একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল নভেম্বরেই করোনা টিকা পাওয়া যাবে। কিন্তু টিকা নিয়ে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কেননা যাদের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তারা অসুস্থ হয়ে পড়ায়, টিকার ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। উপরন্তু বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে এই টিকা কত দিনে পৌঁছানো সম্ভব হবে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন এখন Desh Rupantor 3.12.2020

বাইডেনের সামনে আন্তর্জাতিক রাজনীতির চ্যালেঞ্জগুলো

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করবেন, তখন তাকে বিশ্ব রাজনীতির অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এর মাঝে আছে বেশ কিছু আঞ্চলিক রাজনীতি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভূমিকা কাম্য। যেমন কয়েকটি আঞ্চলিক এবং সেই সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতির কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এ মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইয়েমেন সংকট আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক আলোচিত হলেও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের ইয়েমেনের বিরুদ্ধে বিমান হামলা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ বিমান হামলায় সেখানে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার শিশু ওষুধের অভাবে ইতোমধ্যে মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে মানবিক সাহায্য শুরু করবে- এ প্রত্যাশা সবার। মার্কিন কংগ্রেস একটি War Powers Resolution পাস করলেও ট্রাম্প তাতে ভেটো দেন। এ আইনের মাধ্যমে কংগ্রেস ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্পের সৌদি আরব প্রীতির কারণে যুদ্ধ বন্ধ করা যায়নি। বাইডেন প্রশাসনের এখন দায়িত্ব হবে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের উদ্যোগ নেয়া। আরব আমিরাত লিবিয়ায় জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করায় লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধের কোনো সমাধান হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে Leahy Law অনুযায়ী সেদেশের কোনো অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওইসব দেশে কোনো অস্ত্র রফতানি করতে পারবে না, যে দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। অথচ এ আইন ভঙ্গ করে আরব আমিরাতের সঙ্গে ২৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি করেছিলেন ট্রাম্প প্রশাসন। আমিরাত যেখানে ইয়েমেনে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত সেখানে আইন অনুযায়ী (Leahy Law) আমিরাতে অস্ত্র বিক্রি করা যাবে না। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের Arms Export Control Act অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশকে ওই দেশের নিজের নিরাপত্তা ও সীমান্ত রক্ষার জন্যই শুধু অস্ত্র বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে বিক্রি করা অস্ত্র নিজ দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহৃত হয়নি। ব্যবহৃত হয়েছে ইয়েমেনে গণহত্যায়। বাইডেন প্রশাসনকে এখন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। কারণ অভিযোগে আছে, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত ইসরাইলের স্বার্থে কাজ করছে। এখন বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলি স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না, নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হারিসের স্বামী ইহুদি ধর্মাবলম্বী এবং কমলা হারিস অতীতে একাধিকবার ইসরাইলের স্বার্থে কথা বলেছেন। ইউটিউবে তার বক্তৃতা আছে, যেখানে কমলা হারিস ইসরাইলের নিরাপত্তার স্বার্থে ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহ ও দেশটির নিরাপত্তার পক্ষে কথা বলেছেন। এখন বাইডেন কি তার ভাইস প্রেসিডেন্টকে অস্বীকার করতে পারবেন? মনে হয় না। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে ইসরাইলের রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ট্রাম্পের এই নীতি ইসরাইলে জনপ্রিয় হলেও ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করে ট্রাম্প ইসরাইলের সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন। অথচ ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ছিল প্রো-ইসরাইলি, অর্থাৎ ইসরাইল ঘেঁষা। কিন্তু বাইডেন কি তা অনুসরণ করবেন? বাইডেনের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার। তিনি কী করবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সঙ্গে ইরান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি (Joint Comprehensive Plan of Action- JCPOA) থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত জার্মানি মেনে নেয়নি। অথচ জার্মানি JCPOA-এর সদস্য। এখানে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আবারও JCPOA চুক্তিতে ফিরে যাবে। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে কিছু অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। ইরান কোভিড-১৯ মোকাবেলায় আইএমএফ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্পের বিরোধিতার কারণে ওই পরিমাণ অর্থ ছাড় করা হয়নি। এখন বাইডেন যদি অর্থ ছাড়করণের অনুমতি দেন, তাহলে তা ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে কিছুটা অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হবে। বাইডেন আরও যেসব বিষয় বিবেচনায় নেবেন, তার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়-ইনের ‘Permanent Peace Regime’-এর ব্যাপারে উদ্যোগ, রাশিয়ার সঙ্গে নতুন START আলোচনা শুরু এবং ট্রাম্প প্রশাসনের বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক কর্মসূচি স্থগিত করা, ছয়টি মুসলমানপ্রধান দেশের ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা বাতিল করা, কিউবার ব্যাপারে ওবামা প্রশাসনের নীতিতে ফিরে যাওয়া ও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা, সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমানো, সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমানোর ব্যাপারে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য বারবারা লি প্রস্তাবিত বিলের প্রতি সমর্থন দিয়ে (বছরে এ খাতে বাজেট ৩৫০ বিলিয়ন ডলার কমানো) প্রতিরক্ষা বাজেটে অর্থের পরিমাণ কমিয়ে ওই পরিমাণ অর্থ স্বাস্থ্য খাতে, শিক্ষায়, ক্লিন এনার্জিতে বরাদ্দ করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্র আবার যোগ দেবে এবং কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী একটি ভূমিকা রাখবে। ট্রাম্পের ‘একলা চলো’ নীতি যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্রকে তার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হবে। সবাই জানে, ইউরোপ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেডিশনাল মিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে সমর্থন করা ও অব্যাহত ‘সোভিয়েত ভীতি’কে সামনে রেখে সামরিক জোট ন্যাটো গঠন করা এবং সমাজতন্ত্রের হাত থেকে পশ্চিম ইউরোপকে রক্ষা করা- এসব ছিল মার্কিন স্ট্র্যাটেজির অংশ। ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত এ স্ট্র্যাটেজিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ সম্পর্কের কিছুটা ক্ষতি হয়। ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েনে যে ব্যয় হয়, তা ওইসব দেশকে বহন করতে হবে বলে দাবি করেছিলেন ট্রাম্প, যা কিনা ওই দেশগুলো মেনে নেয়নি। ফলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ক্ষতি হয়। একই সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপে উৎপাদিত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছিল, যা পশ্চিম ইউরোপের নেতৃবৃন্দ মেনে নেননি। ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার এটাও ছিল অন্যতম কারণ। ট্রাম্পের উত্থান ইউরোপ এবং ব্রাজিলের মতো দেশে ‘পপুলিজম’ বা জনতুষ্টিবাদের জন্ম দিয়েছে। ইউরোপে ভিক্টর উরবান (হাঙ্গেরি), জারোসলাভ কাজানিস্ক্রি (পোল্যান্ড), জানেজ জানসা (স্লোভেনিয়া), বরিস জনসন ও নাইজেল ফারাজ (ব্রিটেন), মারিয়া লি পেন (ফ্রান্স), জেইর বলসোনারো (ব্রাজিল) ও মাথিও সালভিনির (ইতালি) মতো নেতার উত্থান ঘটেছিল, যারা ট্রাম্পের আদর্শকে ধারণ করে নিজ নিজ দেশে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়েছেন। তারা নিজ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছেন। তাদের ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা কী হবে, তাও লক্ষ করার বিষয়। একই সঙ্গে চীনের ব্যাপারেও সদ্য গঠিত রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের (আরসিইপি) বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা হবে অন্যতম আলোচিত বিষয়। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো এর সদস্য। এখানে বলা ভালো, জো বাইডেন একজন সিনেটর হিসেবে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সিনেট কমিটিতে কাজ করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি ২০০১-০৩ ও ২০০৭-০৯ মেয়াদে দু’দুবার সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির সদস্য ছিলেন। ফলে বৈদেশিক সম্পর্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সম্পর্কে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ আলোকেই বলা যায়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এখন দেখার পালা এ অঞ্চলে তিনি কীভাবে মার্কিন স্বার্থ আদায়ে উদ্যোগী হবেন। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। সাধারণ হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি হচ্ছে চীনের (১৪.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার)। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি দেশকে এককাতারে নিয়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার প্রভাব বলয় বিস্তার করছে বলে অনেকে মনে করেন। যদিও এটা ঠিক, অতীতে চীন কখনও কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল না। দেশটির আধিপত্য বিস্তারের কোনো ইতিহাসও নেই। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চীনের এ কর্মসূচির ব্যাপারে সন্দিহান। ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি খুবই জরুরি। এ অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্বও। দক্ষিণ চীন সাগরে তেলের রিজার্ভ রয়েছে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ব্যারেল, আর গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্যে দিয়ে চীনের জ্বালানি চাহিদা অনেকটাই মিটবে। যুক্তরাষ্ট্রও চায় এই জ্বালানি সম্পদের ভাগিদার হতে। সুতরাং এখানেও একটা চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যিক ও মালবাহী জাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরের জলপথ ব্যবহার করে চলাচল করে। এ কারণেই এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় বেইজিং, যা মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। তাই চীনকে মোকাবেলা করতে জাপানকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতি আরেকটি কারণ। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভয়টা ওই দেশকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীনের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে তার নৌবাহিনীকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করাতে পারে, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সামরিক কৌশলগত জলসীমা হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা রয়েছে ভারত মহাসারগীয় অঞ্চলে ৬০ ভাগ সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করায়। এক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন এ ধরনের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাইডেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন বেশি। জো বাইডেনের এশিয়া নীতি আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই Regional Comprehensive Economic Partnership (RCEP) নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। গত ১৫ নভেম্বর আসিয়ান সম্মেলনে এই মুক্ত বাণিজ্য জোটটি গঠিত হয়। তবে মনে রাখতে হবে চীনের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার ব্যাপারে আসিয়ান নেতৃবৃন্দ ২০১২ সাল থেকেই আলোচনা চালিয়ে আসছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক কমানো, সরবরাহ শৃঙ্খলা শক্তিশালী করা এবং ই-কমার্সের জন্য নতুন বিধিবিধান চালু করা। আরসিইপির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ এবং সেই সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তবে এটি কার্যকর হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। কারণ চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর সংসদে তা অনুমোদিত হতে হবে। নানা কারণে আরসিইপি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী এবং এক-তৃতীয়াংশ জিডিপি এ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আসবে। চুক্তিবদ্ধ ১৫টি দেশে বাস করে ২২০ কোটি মানুষ। একটি বড় বাজার। বৈশ্বিক জিডিপিতে অঞ্চলটির সম্মিলিত অবদান ৩০ শতাংশের বেশি। দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। কোভিড-১৯-পরবর্তী যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠছে এবং চীনের নেতৃত্বে যে নতুন এক ‘বিশ্বায়ন’ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, আরসিইপি এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখবে। এখানে বলা ভালো, এ অঞ্চলে ঘিরে ওবামা প্রশাসনের আমলে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে ২০১৭ সালে বেরিয়ে এসেছিলেন। ট্রাম্প বিশ্বকে একটি অস্থিরতার জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এখন জো বাইডেনকে ফিরে আসতে হবে। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বা বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ)-এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির একটা সমন্বয় প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাইডেন যদি ট্রাম্পের নীতি অনুসরণ করেন, যদি চীনকে ‘একঘরে’ করার ট্রাম্পের নীতি সমর্থন করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেন, তাহলে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব বাড়বে বৈ কমবে না। বাইডেন তার ‘America Back’ ধারণার কথা বলেছেন। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি না দিলেও প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবেন। এ থেকে ফিরে আসবেন না (গার্ডিয়ান, ২৫ নভেম্বর)। এখন দেখার বিষয়, বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি উঠতি শক্তিগুলো, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে আদৌ কোনো দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান কিনা। Jugantor 29.11.2020