রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

তিস্তা লংমার্চ : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

তিস্তা লংমার্চ শেষ হয়েছে ২৩ এপ্রিল। ৩০ ঘণ্টার এ লংমার্চ ডেকেছিল বিএনপি। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই লংমার্চের প্রাপ্তি কী? সরকারি দল আওয়ামী লীগ এ লংমার্চকে ‘গাড়ি মার্চ’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এতে কোনো বাধা দেয়নি। অতীতে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম লংমার্চ যখন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তখন ওই লংমার্চে বাধা দেয়া হয়েছিল। রাস্তায় এলোপাতাড়ি গাড়ি রেখে লংমার্চকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল। এবার তিস্তার ক্ষেত্রে অবশ্য তেমনটি হয়নি। যদিও একটা অভিযোগ আছে, তিস্তা লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের রংপুরে রাতে থাকার জন্য হোটেলে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু এটি কখনও বড় হয়ে দেখা দেয়নি। মির্জা ফখরুল তিস্তা হেলিপ্যাড পয়েন্টে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতাও করেছেন। তবে পার্থক্যটি হল- এই লংমার্চে বেগম জিয়া ছিলেন অনুপস্থিত। এমনকি ১৯ দলের সিনিয়র নেতাদের কাউকে দেখা যায়নি। তারপরও এ লংমার্চের গুরুত্ব একেবারে কম নয়। যখন তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় পানির পরিমাণ মাত্র ৫০০ কিউসেকে নেমে এসেছিল, তখনই বিএনপি এ লংমার্চের আয়োজন করে।
বিএনপির এ লংমার্চ সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি ছিল না। এ মার্চের উদ্দেশ্য ছিল জনসম্পৃক্ত একটি বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং ভারতের কাছে আমাদের ন্যায্য হিস্যার দাবি জানানো। এটা একটা ভালো দিক। এ লংমার্চ অতীতে, ১৯৭৬ সালের মে মাসে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ফারাক্কা লংমার্চের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বয়োবৃদ্ধ এ নেতা মৃত্যুর কিছুদিন আগে লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়ে রাজশাহীর কানসাটে গিয়েছিলেন। সেদিন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। তবে সেদিনের ফারাক্কা লংমার্চের সঙ্গে আজকের তিস্তা লংমার্চের পার্থক্য রয়েছে। ১৯৭৬ সালে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার পরোক্ষভাবে ওই ফারাক্কা লংমার্চকে সমর্থন করেছিল। আজকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তারা তিস্তা লংমার্চের বিরোধিতা না করলেও তিস্তার পানি কমে যাওয়ার প্রশ্নে প্রচণ্ড নীরব।
তিস্তার লংমার্চকে কেন্দ্র করে দুটি ঘটনা ঘটেছে। এক. লংমার্চের শুরুর দিন হঠাৎ করেই তিস্তা ব্যারাজে পানির প্রবাহ তিন হাজার কিউসেকের উপরে চলে আসে (যেখানে এর আগের দু’সপ্তাহে পাওয়া গিয়েছিল গড়ে ৫০০ কিউসেক)। লংমার্চের পর এ প্রবাহ কমে এসে দাঁড়ায় এক হাজার ৮০০ কিউসেকে। এর অর্থ কী? উজানে বৃষ্টির কোনো খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। তাহলে কি আমরা ধরে নেব লংমার্চকারীদের খুশি করতেই অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়েছে ভারত? দুই. পানির প্রবাহ যখন বাড়ল, তখন সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটি বলল, সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে ডালিয়া পয়েন্টে পানি বেড়ে গেছে। যদিও আমরা কেউ জানলাম না সরকার কোথায় কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে! ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি সর্বশেষ বিমসটেক সম্মেলনেও (২০১৪) মনমোহন সিং আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। ভারতের নয়া সরকারই এ সিদ্ধান্তটি নেবে। তাহলে আমাদের সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী এ ‘কূটনৈতিক তৎপরতার’ তথ্য কোথায় পেলেন? আর এখন যে পানির প্রবাহ আবার কমে গেল, এর ব্যাখ্যা তিনি কী দেবেন?
আমরা লক্ষ্য করছি, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের একটা বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, আমরা দরকষাকষিতে শক্তভাবে আমাদের অবস্থান তুলে ধরতে পারি না। সাম্প্রতিককালে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অতিমাত্রায় ভারতকেন্দ্রিক। ভারত আমাদের কোনো কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হয়, সে রকম কোনো কাজ আমরা করতে চাই না। এটা যে তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা নয়। বরং দেখা গেছে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমরা কোনো ‘শক্ত’ অবস্থানে যেতে পারিনি। ভারত আমাদের ভূমি ব্যবহার করছে তথাকথিত ‘কানেকটিভিটির’ নামে। কিন্তু কোনো ‘ফি’ প্রদান করছে না। উপরন্তু নেপাল কিংবা ভুটানও এ সুবিধা পাচ্ছে না। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়েছে ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তার এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে (অরুনাচল থেকে বিহার) বিদ্যুৎ দেবে। এ ক্ষেত্রে ভারত আদৌ কোনো শুল্ক বা ফি দেবে কি-না, এটা স্পষ্ট নয়। তিস্তার ক্ষেত্রেও তাই সরকার খুব প্রতিবাদী নয়। খুব কঠোর অবস্থানেও যায়নি সরকার। শুধু সরকারের কথা কেন বলি? এইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টিও তিস্তার পানি বণ্টন প্রশ্নে কোনো জোরালো অবস্থানে যায়নি। অথচ জাতীয় পার্টির একটা বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে উত্তরবঙ্গে। এরশাদ নিজে রংপুরের বাসিন্দা। সরকারের অংশীদার জাসদ কিংবা ওয়ার্কার্র্স পার্টিরও কোনো ভূমিকা নেই। তবে বাসদ ও সিপিবি আলাদাভাবে তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে লংমার্চ করেছে।
তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। যেখানে ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হওয়ার কথা, সেখানে পানির অভাবে চাষাবাদ হয়েছে মাত্র ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। রোদে ওই শস্যও পুড়ে গেছে। পানির অভাবে একদিকে যেমন খাদ্য উৎপাদনের ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে তেমনি বাড়ছে মরুকরণ প্রবণতা। উত্তরবঙ্গের মানুষ জানে পানির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। ১৯৭২ সালেই তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। মাঝখানে ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে ও ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তিই হয়নি। এ নদীর পানি বণ্টন আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে হতে হবে। মমতার ‘একগুঁয়েমি’র জন্য পানি বণ্টন বন্ধ থাকতে পারে না। পানি দেয়া বা না দেয়ার সঙ্গে তার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশ পানি পাবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। আর পশ্চিমবঙ্গ যদি বাধা দেয়, তার দায়ভার গিয়ে বর্তাবে ভারত সরকারের ওপর। এতে করে আন্তর্জাতিক আসরে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। ভারত বিশ্বসভায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে চায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর প্রতি তার আচরণ যদি ন্যায়সঙ্গত না হয়, যা জাতিসংঘের আইনে বলা আছে, তাহলে তার ‘নেতৃত্ব’ প্রশ্নের মুখে পড়বে। এমনিতেই ভারতের আচরণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তিস্তায় পানি না দিয়ে উজানে পানি প্রত্যাহার করা হলে তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে ঠেলে দেবে মরুময়তার দিকে। পানির অভাবে যে সংকটের সৃষ্টি হবে, তা বাংলাদেশকে ঠেলে দেবে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি এতে করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তার পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি থাকা বা না থাকাটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী পর্যন্ত এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দু’দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু’দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখন যুক্ত হয়েছে মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টনে সিকিমকে জড়িত করারও প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কারণ সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’।
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন’কে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এ ‘যুক্তি ও ন্যায়ে’র ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে, যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এ নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এ ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ- প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই। তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায়, বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকল।
তিস্তা লংমার্চ করে বিএনপি একটি জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় জনসভায় মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া তিস্তার পানি বণ্টন সম্ভব নয়।’ তারা এও জানিয়েছেন, ‘পানি ছাড়া ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক নয়’ (যুগান্তর, ২৪ এপ্রিল)। স্পষ্টতই এটা ভারতীয় নেতাদের জন্য একটি মেসেজ। তবে ভয়টা হচ্ছে নয়াদিল্লিতে সরকার গঠনে মমতা যদি একটি ফ্যাক্টর হয়ে যান, তাহলে তিস্তা চুক্তি ঝুলে যাবে। মমতা এককভাবে পানি প্রত্যাহার করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে তা সেচ কাজে ব্যবহার করবেন। পানি সেখানকার রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর। এখন দায়িত্বটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের। কেন্দ্র সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারে। কারণ সিকিমও উজানে পানি প্রত্যাহার করে সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত এলাকায় ভারত ন্যূনতম ৮ থেকে ১০ জায়গায় বাঁধ দিয়েছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমছে। এখন বাংলাদেশ যদি শুধু ভারতের দিকে তাকিয়ে থেকে তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তির প্রত্যাশা করে, তাতে সময় ক্ষেপণ হবে মাত্র। ভারতকে চুক্তিতে বাধ্য করতে হলে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টির আন্তর্জাতিকরণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সরকার এখন এ কাজটি করবে কিনা, এটাই হচ্ছে আসল কথা। Daily JUGANTOR ২৯ এপ্রিল, ২০১৪

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সংলাপ এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

গত ২২ এপ্রিল ঢাকায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় নিরাপত্তা সংলাপ শুরু হয়েছে। এই সংলাপে আঞ্চলিক কৌশলগত সম্পর্ক, সামরিক সহযোগিতা, বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম, সন্ত্রাসবাদ দমন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়। যে সময় এই নিরাপত্তা সংলাপটি অনুষ্ঠিত হলো, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ভারতে নির্বাচন হচ্ছে। মে মাসের শেষদিকে সেখানে একটি নয়া সরকার গঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতায় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা বেশি। যদি বিজেপির নেতৃত্বাধীন একটি জোট ক্ষমতায় আসে, তাহলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয় কিংবা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের মনোভাবের পরিবর্তন হয় কিনা, এটা জানা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জরুরি। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে হামিদ কারজাইয়ের যুগ শেষ হতে চলেছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে কারজাই আর তৃতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে পারেননি। সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচন দ্বিতীয় পর্যায়ে গড়িয়েছে। সুতরাং যিনি আগামীতে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব বহন করুন না কেন, তার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, এ বিষয়টাও জরুরি। কেননা, এ বছরের শেষ নাগাদ আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। কিন্তু তারপরও কিছু মার্কিন সৈন্য সেখানে থাকার কথা। নয়া আফগান প্রেসিডেন্ট বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন, সেই বিষয়টিও জরুরি। উপরন্তু রয়েছে ভারত মহাসাগর এলাকায় মার্কিন নৌবাহিনীর সম্প্রসারিত ভূমিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলেও দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরের ব্যাপারে নতুন করে তাদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু এখন মিয়ানমার, যেখানে রয়েছে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ; এবং বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। এই স্ট্র্যাটেজির আলোকে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সঙ্গেও একটি কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারই শেষ কথা নয়। বরং নতুন আঙ্গিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আমরা প্রত্যক্ষ করব এ অঞ্চলে। পাকিস্তানে একটি নয়া সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও মার্কিন ড্রোন বিমান হামলা বন্ধ হয়নি। আগামীতে আফগানিস্তানে একজন মার্কিন সৈন্য না থাকলেও ড্রোন বিমান হামলা বন্ধ হবে না। এ অঞ্চলের কোনো একটি জায়গায় মার্কিন ঘাঁটি বসবে, যেখান থেকে ড্রোন হামলা পরিচালিত হবে। যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে তাদের যুদ্ধজাহাজ বাড়ানোর সিদ্ধান্তই শুধু নেয়নি, বরং চলতি সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি নৌ মহড়ার আয়োজন করছে, যাতে ভারতের নৌবাহিনী অংশ নিতে পারে। মালদ্বীপের সঙ্গেও একটি ঝঙঋঅ চুক্তি করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ন্যাটো ২০১০ সালে তার লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ন্যাটোর ঝঃৎধঃবমরপ ঈড়হপবঢ়ঃ সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন, তারা জানেন, এই ধারণাপত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকা- এখন আর শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা দক্ষিণ এশিয়ায় সম্প্রসারিত হয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকা- ভারত মহাসাগর এলাকায় সম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ ফ্লিটের বেশ কয়েকটি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। এ কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য মার্কিনি ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। অনেকেরই জানার কথা, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতোমধ্যে একটি অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই তথাকথিত 'অংশীদারিত্ব সংলাপ' চুক্তির আওতায় দৃশ্যত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ দমন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ, শ্রমমান, পণ্যের শুল্ক ইত্যাদি বিষয়ে মতবিনিময় করলেও মূল বিষয় একটাই_ যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় যৌথ কর্মসূচি গ্রহণের আড়ালে এ অঞ্চলে আগামীতে মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। বলা ভালো, প্রতি বছর একবার 'অংশিদারিত্ব সংলাপ চুক্তি'র আওতায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিত হবে। প্রথম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায় ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে। আর দ্বিতীয় পরবর্তী সংলাপ হয় ওয়াশিংটনে ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল। সংলাপ শেষে একটি ব্রিফিং করা হয় বটে, কিন্তু ভেতরের অনেক কথাই জানানো হয় না। বাংলাদেশ এর আগে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তাই গুজবের ডালপালা বেড়েছে এবং আগামীতে তা আরো ছড়াবে। ২০১২ সালের ১৮ জুন ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ায় একটি ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ন্যাটোর ২৫টি সদস্য দেশের বাইরেও মোট ৫৫টি দেশ অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনকে তারা বলছে ঝঃৎধঃবমরপ গরষরঃধৎু চধৎঃহবৎংযরঢ় ঈড়হভবৎবহপব। যারা সরাসরি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র নয়, তারাও এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। ন্যাটোর সঙ্গে কাজ করতে পারে, এমন দেশগুলোকে ন্যাটোর নীতিনির্ধারকরা মোট ৪ ভাগে ভাগ করেছেন_ যারা ন্যাটোর সদস্য নয়, তবে ন্যাটোর সহযোগী। যেমন, ইউরোপের ১২টি দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছে ঞযব চধৎঃহবৎংযরঢ় ভড়ৎ চবধপব। ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত আলজেরিয়া-তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে গবফরঃবৎৎরধহ উরধষড়মঁব গবসনবৎং। সৌদি আরব কিংবা ওমানের মতো দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত হয়েছে ওংঃধহনঁষ ঈড়-ড়ঢ়বৎধঃরড়হ ওহরঃরধঃরাব। অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশগুলোকেও ন্যাটো 'চধৎঃহবৎং অপপৎড়ংং ঃযব এষড়নব'-এর ব্যানারে একত্রিত করেছে। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানও এই ব্যানারে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ন্যাটোর কোনো কর্মকা- নেই। এখন এল সালভাদর এবং কলম্বিয়ার মতো দেশও ন্যাটোর সঙ্গে জড়িত হতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার, ইউরোপে ন্যাটোর কমান্ডার অ্যাডমিরাল স্টাভরিভিস গেল বছর বলেছিলেন, তারা ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশকে নিয়ে ভাবছেন; এবং আশা করছেন, এই দেশ দুটি চধৎঃহবৎং অপপড়ৎংং ঃযব এষড়নব-এর ব্যানারে আগামীতে ন্যাটোর কর্মকা-ে শরিক হবে। ২০১০ সালে ন্যাটো লিসবন সম্মেলনে ন্যাটোর ঝঃৎধঃবমরপ ঈড়হপবঢ়ঃ গ্রহণ করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রোয়েশিয়ান সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল, একুশ শতকে ন্যাটো নতুন এক কৌশলগত ধারণা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। ন্যাটোর ওই ভূমিকা, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষকের মতো কর্তৃত্ব করার প্রবণতা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে প্রভাববলয়কে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের। আর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সেই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দেয়া হয়নি। বরং এর সম্প্রসারণ ঘটেছিল। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ন্যাটো এবং ওয়ারশ জোটের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছিল যে, ইউরোপে একাধিকবার 'পারমাণবিক যুদ্ধ'-এর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই 'যুদ্ধ' হয়নি বটে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পুরোটা সময় এই দুই শক্তির মাঝে প্রতিযোগিতা বজায় ছিল। দুই পরাশক্তিই ইউরোপে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরই এই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এর প্রধান কারণ ছিল একটি_ রাশিয়া এখন আর ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। দুটি আদর্শের (সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদ) মাঝে যে দ্বন্দ্ব ছিল, সেই দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটে, যখন রাশিয়া আদর্শ হিসেবে মুক্তবাজার ও পুঁজিবাদকে গ্রহণ করে। উপরন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অনেক আগেই ১৯৮৮ সালে গরবাচেভ 'ওয়ারশ' সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিলেন। এ কারণে ইউরোপে রাশিয়ার উত্থান যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি নয়। আর তাই নতুন করে এ অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধ সৃষ্টির সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এখন ভারত মহাসাগর হচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষেত্র, যেখানে নতুন করে স্নাযুযুদ্ধের জন্ম হতে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভয় ও শঙ্কা এখন অনেক বেশি। প্রথমত, তত্ত্বগতভাবে চীন এখন আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন এখন বিশ্বকে কর্তৃত্ব করছে। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ায় তা এখন মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করছে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে নিজের অভ্যন্তরীণ বাজারকে সচল রাখছে। এটা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অনেকেরই অপছন্দের। গত ৮ জুন (২০১৩) নয়া চীনা প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এই সফরে ওবামার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তারপরও বেশ কিছু ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে। তৃতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে। এটা মার্কিনিদের চিন্তার কারণ। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে তাদের আশঙ্কার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য এবং সেই সঙ্গে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে না। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণেই তথাকথিত 'অংশীদারিত্ব চুক্তি' করছে যুক্তরাষ্ট্র; এবং ন্যাটোকে ব্যবহার করে এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। আর ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম এক ধরনের কর্মসূচি, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার উপস্থিতিকে নিশ্চিত করতে চায়। তাই যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভারতকে প্রয়োজন রয়েছে ওবামা প্রশাসনের। স্মরণ করা প্রয়োজন, জাতিসংঘের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনে (২০১৩) যোগ দেয়া যে কয়জন সরকারপ্রধানকে ওবামা হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভারত। গত ২৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রকে তার স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে হলে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। ভারত উঠতি শক্তি। সামরিক তো বটেই, অর্থনৈতিক শক্তিও বটে। মার্কিন স্বার্থ বিঘি্নত হবে, যদি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র সেটা কখনোই চাইবে না। বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কখনো একক কোনো নীতি গ্রহণ করেনি। এ ব্যাপারে মার্কিনি নীতি ভারতীয় মনোভাব দ্বারা প্রভাবান্বিত। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা মতভিন্নতা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেকটাই বর্তমান সরকারকে স্বীকার করে নিয়েছে। এ কারণে বর্তমান সংসদ নূ্যনতম দুই-তিন বছর থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে হঠাৎ করে জঙ্গিবাদের উত্থান, জেএমবি সদস্যদের পুলিশের হাত থেকে পলায়ন কিংবা আল-জাওয়াহিরির তথাকথিত অডিওবার্তা যে ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের এতটুকুও বিচলিত করবে না, তা বলা যায় না। এর ওপর গত ২ মার্চ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তথাকথিত ৯টি জঙ্গি সংগঠন 'স্বাধীন বাংলাদেশ কমিটি' নামে একটি কমিটির ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এই সংবাদটির ব্যাপারে সত্যতা যা-ই থাকুক না কেন, ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা সংবাদটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন বলেই আমার ধারণা। সুতরাং পুরো ২০১৪ সালটি বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে বেগম জিয়া ঘোষণা করেছেন, উপজেলা নির্বাচনের পরপরই তিনি আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন। ফলে রাজনীতি আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বাংলাদেশের জঙ্গিরা এটা থেকে সুবিধা নিতে পারে। বিষয়টি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদেরও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিটি 'ডেভেলপমেন্ট'-এর একটির সঙ্গে অপরটির একটি যোগসূত্র আছে। বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে আরব বিশ্বের ইসলামী জঙ্গিদের কতটুকু যোগসূত্রে আছে, তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভালো বলতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে এসব জঙ্গির যে একটা যোগাযোগ থাকতে পারে বা ভবিষ্যতে হতে পারে, তা আশঙ্কা করা যায়। সুতরাং মার্কিন সৈন্যদের আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারে যে 'শূন্যতার' সৃষ্টি হবে (ভ্যাকুয়াম থিওরি), তার সুযোগ নিতে পারে জঙ্গিরা। আর জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে ভারত মহাসাগরে যখন মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়বে, সঙ্গত কারণেই এর 'প্রতিবাদে' জঙ্গিদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ ক্ষেত্রে এ অঞ্চলকে ঘিরে (বিশেষ করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) নতুন এক 'সামরিক সমীকরণের' জন্ম হতে পারে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা এখন ব্যবহৃত হতে পারে মিয়ানমার সরকারের ওপর 'চাপ' প্রয়োগ করার স্বার্থে। তাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় নিরাপত্তা সংলাপের গুরুত্ব অনেক বেশি। Daily JAI JAI DIN 28.04.14

ইউক্রেন-সংকটের গভীরতা বাড়ছে

ইউক্রেন-সংকটের গভীরতা বাড়ছে। ক্রিমিয়ার রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির পর ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। সেখানে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পূর্বাঞ্চলের বেশ কটি শহর দখল করে নিয়েছিল। ক্রিমিয়ার মতো এ শহরগুলোও রাশিয়ার সঙ্গে একত্রিত হতে চায়। সর্বশেষ ঘটনায় ইউক্রেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে শহরগুলো মুক্ত করার জন্য সেখানে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে। সেনাবাহিনীর গুলিতে অন্তত ৫ বিচ্ছিন্নতাবাদী নিহত হয়েছেন। এই অভিযানকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও আমেরিকা পরস্পর বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা রাশিয়ার ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে। এর আগে গত ১৭ এপ্রিল জেনেভায় যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা এখন অকার্যকর। রাশিয়া ইতোমধ্যে পূর্ব ইউক্রেন সীমান্তে তাদের হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর ‘নিরাপত্তা’র স্বার্থে পোল্যান্ড ও বাল্টিক দেশগুলোয় ৬০০ সৈন্য পাঠিয়েছে। স্পষ্টতই ইউক্রেনের ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। অনেকের দৃষ্টি এখন মলদোভার ট্রান্স দানিয়েস্টার অঞ্চলের দিকে। কেননা এ অঞ্চলে রাশান জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। পুতিন এ ক্ষেত্রে কী করবেন? ইউক্রেনে আগামী দিনে বসনিয়ার মতো পরিস্থিতির জন্ম হয় কি না- সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন পুতিন রাশিয়ার সীমান্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমানায় নিয়ে যেতে চান। আর এ লক্ষ্যেই রাশিয়া কাজাকিস্তান ও বেলারুশের সমন্বয়ে একটি ‘ইউনিয়ন স্টেট’ গঠন করেছে। এর মাধ্যমে এক ধরনের ‘কাস্টম ইউনিয়ন’ গঠন করে এ দুটো দেশের অর্থনীতি তথা বাণিজ্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। এ ‘ইউনিয়ন স্টেট’-এ এ অঞ্চলের আরও অনেক রাষ্ট্র আগামীতে যোগ দিতে পারে। সুতরাং রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার সংযুক্তি ও পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। ক্রিমিয়ার ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এশিয়া সফর করেছেন। এশিয়ার নেতাদের সঙ্গে তার আলোচনায় ক্রিমিয়ার বিষয়টি যে প্রাধান্য পেয়েছে, সেটা এক রকম নিশ্চিতই ছিল সবার। ইতোমধ্যে জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ন্যাটো রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পোল্যান্ডে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। সব মিলিয়ে ক্রিমিয়ার ঘটনাবলি স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর সূচনা করলেও যে প্রশ্নের সমাধান এখনও হয়নি, তা হচ্ছে রাশিয়াকে ‘বয়কট’ করে পশ্চিম ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কাটাবে কীভাবে? সেনাবাহিনী পাঠিয়ে, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে বটে, কিন্তু পুরো ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করবে কীভাবে? কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি গ্যাস আমদানি করার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা কি তা বলে? পাঠকমাত্রই জানেন, পশ্চিম ইউরোপ থেকে শুরু করে পুরো পূর্ব ইউরোপ, যে দেশগুলো একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক প্রভাবে ছিল, তারা এখন স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তারা পরিপূর্ণভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাসের রিজার্ভ হচ্ছে রাশিয়ায়। মূলত ৩টি পথে এই গ্যাস যায় ইউরোপে। সাবেক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো, যারা একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্লকে ছিল, তারাও এখন জ্বালানি খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। ৩টি পাইপলাইন, নর্ডস্টিম পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় বছরে ৫৫ বিলিয়ন কিউসিক মিটার (বিসিএম), বেলারুশ লাইনে সরবরাহ করা হয় ৩৬ বিসিএম, আর ইউক্রেন লাইনে সরবরাহ করা হয় ১০৭ বিসিএম। এখন ইইউর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে রাশিয়া যদি এই সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে এক বড় ধরনের জ্বালানি-সংকটে পড়বে ইউরোপ। যদিও রাশিয়ার বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই গ্যাস বিক্রি। এটা সত্য, রাশিয়া অত্যন্ত সস্তায় বেলারুশ ও ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে- এই দেশ দুটো আবার রাশিয়ার গ্যাসের রিজার্ভ গড়ে তুলে সরাসরি পশ্চিম ইউরোপে তা বিক্রি করে কিছু আলাদা অর্থ আয় করে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০০৯ সালে ইউক্রেন ও বেলারুশের সঙ্গে রাশিয়ার এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছিল, যাকে বলা হয়েছিল ‘গ্যাস ওয়ার’ অর্থাৎ গ্যাসযুদ্ধ। ইউক্রেনে অত্যন্ত সহজ মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করত রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেন অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, যা ইউরোপে একটি সংকট তৈরি করে। শুধু গ্যাস নয়, রাশিয়া বেলারুশকে সস্তা মূল্যে তেলও দেয়। ওই তেল আবার বেলারুশ অধিক মূল্যে ইউরোপে বিক্রি করে। উৎুঁযনধ অথবা ঋৎরবহফংযরঢ় পাইপলাইনের মাধ্যমে ওই গ্যাস ও তেল সরবরাহ করা হত। বেলারুশের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হয়েছিল। তারা অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। রাশিয়া পাইপলাইনে গ্যাস ও তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন আবার নতুন আঙ্গিকে ওই ‘গ্যাস ওয়ার’ শুরু হবে। ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া এখন রাশিয়ার অংশ হওয়ায় ইউক্রেন এটাকে ভালো চোখে দেখেনি। ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান পতাকা উঠেছে। সেখানে যে ইউক্রেনের নৌঘাঁটি রয়েছে তা দখল করে নিয়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। ইউক্রেনের সব সম্পত্তি তাদের দখলে। সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে রাশিয়া তার ইউক্রেন পাইপলাইন বন্ধ করে দিতে পারে। আর এটা হলে বুলগেরিয়া, রুমানিয়া আর সার্বিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এ তিন দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। পরিসংখ্যান বলছে, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ সংস্থা গ্যাসপ্রোম (এধংঢ়ৎড়স)-এর ইউক্রেনের কাছে পাওনা রয়েছে ২ মিলিয়ন ডলার। এ টাকা এখন ইউক্রেন কীভাবে শোধ করবে? এ সংকট এখানে যুদ্ধের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। রাশিয়া ইতোমধ্যে ইউক্রেনকে বাইপাস করে কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে একটি পাইপলাইন তৈরি করছে। পুরো ইইউর গ্যাসের চাহিদার ৩০ ভাগ একা জোগান দেয় রাশিয়া। আর জার্মানির ৪০ ভাগ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ওই গ্যাস আগামী দিনে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর হবে ইউরোপের রাজনীতিতে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল, বিশেষ করে ইরাক ও লিবিয়ায়, তার পেছনের মূল কারণ ছিল তেল। ইরাক ও লিবিয়ার তেলের সহজলভ্যতার কারণে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর মদদে সেখানে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। যুদ্ধে ইরাককে ধ্বংস করে দিয়ে এখন মার্কিন কোম্পানিগুলোই ওই তেল বিক্রির টাকায় ইরাক পুনর্গঠনের কাজ করছে। আর লিবিয়ার তেল ও গ্যাস যায় ইতালিতে। গাদ্দাফিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল এ তেল-গ্যাসের কারণেই। সুতরাং রাশিয়ার গ্যাসের ওপর পুরো ইউরোপের নির্ভরতা, সেখানে নতুন করে ‘গ্যাসযুদ্ধ’-এর সূচনা করবে। তবে পার্থক্য একটাই- রাশিয়া ইরাক কিংবা লিবিয়া নয়। পুতিনের পেছনে রয়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। সুতরাং ওবামা এ অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি করে কোনও সুবিধা করতে পারবেন না। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরো পশ্চিম ইউরোপ যখন সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তখন এক পর্যায়ে পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ড মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক রচনা করে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ রাজনীতির এক নয়া দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। ব্রান্ড বুঝতে পেরেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। আজ নতুন আঙ্গিকে এ প্রশ্নটিই উঠেছে- রাশিয়াকে বাদ দিয়ে ইউরোপের নিরাপত্তা অর্থহীন। রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা বিবেচনায় নিয়েই রাশিয়ার সঙ্গে ১৯৯৭ সালে ন্যাটোর একটি চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তিতে ন্যাটোতে রাশিয়াকে পরামর্শকের ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২৭ মে প্যারিসে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন (রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট) ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন। সেই সঙ্গে ন্যাটো সদস্যভুক্ত অন্যসব দেশের সরকারপ্রধানরাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রাশিয়াকে একটি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দেয়। অনেকটাই সেই ‘কনটেইনমেন্ট থিউরির’ মতো রাশিয়াকে ঘিরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে ন্যাটো। ক্রিমিয়ার পার্শ্ববর্তী কৃষ্ণসাগর বা ব্লাক সির পশ্চিমে রুমানিয়ার মিথাইল কোগালনাইসেআনুতে রয়েছে ন্যাটোর বিমান ঘাঁটি। আফগানিস্তানে সেনা রসদ সরবরাহের জন্য এ বিমান ঘাঁটিটি ব্যবহৃত হয়। গত বছর কৃষ্ণসাগরে ন্যাটো ও জর্জিয়ার নৌবাহিনী যৌথভাবে একটি সামরিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল, যা রাশিয়া খুব সহজভাবে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই চাইছে জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগ দিক। এটা যদি হয়, তাহলে রাশিয়ার সীমান্তে উপস্থিত থাকবে মার্কিন সেনাবাহিনী। রাশিয়ার সমর নায়করা এটা মানবেন না। আজকে ইউক্রেনের পরিস্থিতিও অনেকটা তেমনি। রাশিয়া মনে করে ইউক্রেনে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে উৎখাতের পেছনে ওয়াশিংটনের হাত রয়েছে। ইয়ানুকোভিচ ছিলেন রুশপন্থী এবং ইউক্রেনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। আগামী ২৫ মে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সঙ্গত কারণে রাশিয়া চাইবে রুশপন্থী একজন সেখানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে রাশিয়ার বিরোধীরা চাইবে তাদের পছন্দের কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোক। এ ক্ষেত্রে দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ওলেকজান্ডার তুর্চিনভের সম্ভাবনা বেশি। এতে করে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার একটা বিরোধ থেকে গেল। এই বিরোধ এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে মাত্র এবং নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যে এ পরিস্থিতিকে স্নায়ুযুদ্ধ-২ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এখন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যদি ‘পরাজিত’ হয় এবং শহরগুলো যদি ইউক্রেনের সেনাবাহিনী দখল করে নেয়, তাতে করে সাময়িকভাবে হয়তো ইউক্রেনের ‘বিজয়’ হবে। কিন্তু এ অঞ্চল ঘিরে দীর্ঘস্থায়ী একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করবে। Daily Amader Somoy 28.04.14

নির্বাচন ও ভারতীয় গণতন্ত্র

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগেই। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সাত দফা নির্বাচন সম্পন্ন হবে। এরপর বাকি থাকবে ৭ ও ১২ মে। ৭ মে অনুষ্ঠিত হবে সাত রাজ্যের ভোট, ৬৪ আসনে। আর সর্বশেষ ১২ মে তিন রাজ্যে, ৪১ আসনে। এরপর ১৬ মে জানা যাবে নয়াদিল্লির সাত নম্বর রেসকোর্স রোডে কে হতে যাচ্ছেন পরবর্তী বাসিন্দা। প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত এই বাসভবনটিতে শেষ পর্যন্ত একসময়ের রেলওয়ে স্টেশনগুলোতে চা বিক্রেতা নরেন্দ্র মোদিই বাসিন্দা হবেন কি না, সে ব্যাপারটিও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তবে ভারতের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন নানা কারণে এবার আলোচিত হয়েছে। প্রথমত, এত বিপুলসংখ্যক ভোটার নিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোনো নির্বাচন হয় না। প্রায় ৮২ কোটি ভোটার। এর মধ্যে আবার নয়া ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। মহিলা ভোটারের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বেশি। দ্বিতীয়ত, ফিল্মের নায়ক-নায়িকাদের উপস্থিতি এর আগে আর তেমনটি দেখা যায়নি। সিনিয়র নায়িকাদের প্রায় সবাই 'ভোটযুদ্ধে' নেমেছেন। কলকাতার 'হার্টথ্রব' নায়ক দেবও এখন তৃণমূলের প্রার্থী। প্রশ্ন হচ্ছে, লোকসভায় তাঁরা যেতে চান বটে, কিন্তু লোকসভায় তাঁদের ভূমিকা কী হবে? তৃতীয়ত, লোকসভা নির্বাচনে এত বিপুল অর্থ ব্যয় অতীতে কখনো হয়নি। বিজেপির নির্বাচনী বাজেট পাঁচ হাজার কোটি রুপি। কংগ্রেসের তার চার ভাগের এক ভাগ। সব মিলিয়ে প্রধান দলগুলো সবাই মিলে ৩০ হাজার কোটি রুপির ওপরে খরচ করবে এই নির্বাচনে। এর বাইরে রয়েছে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত খরচ। গত পাঁচ বছরে ভারতের নির্বাচন বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি রুপি। এই অর্থের অর্ধেকেরও বেশি কালো টাকা। এই তথ্যটি আমাদের দিয়েছে সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ। চিন্তা করা যায়, ভারতের মতো একটি দেশে যেখানে দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী, সেখানে দলগুলোই এ নির্বাচনে খরচ করছে ৩০ হাজার কোটি রুপি! আমরা সবাই জানি, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। সিনেট নির্বাচনে প্রার্থীরা সরাসরি টাকা গ্রহণ করেন। বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে প্রার্থীদের অনুদান দেয়। এটা বৈধ। ভারতের পরিস্থিতিও অনেকটা তেমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে এখন শত শত 'হাজার কোটিপতি'র জন্ম হয়েছে। তাদের বড় অংশ এখন বিজেপির পেছনে বিনিয়োগ করছে। বোঝাই যায়, তাদের উদ্দেশ্য কী। ভারতের মতো একটি দেশে, যেখানে দারিদ্র্য এখনো একটি প্রধান সমস্যা, সেখানে যখন হাজার হাজার কোটি টাকা শুধু নির্বাচনের মতো অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়, তখন সংগত কারণেই ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। কেননা নির্বাচনে খরচ করা এই টাকার কোনো 'রিটার্ন' নেই। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে সামাজিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা যেত। কয়েকটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৪ সালে যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ২৭.৫ শতাংশ (৪১ কোটি), ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭.০২ শতাংশে (প্রতিদিনের আয় ১ দশমিক ২৫ ডলার হিসাবে)। বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর তিন ভাগের দুই ভাগ বাস করে ভারতে। প্রতিদিন ভারতে পাঁচ হাজার শিশু ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা যায়। ১৮ লাখ শিশু পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায় (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)। এই দরিদ্রতার হার বেশি মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে। যেখানে শিশুমৃত্যুর হার কেরালায় প্রতি এক হাজারে মাত্র ১৪, সেখানে মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৯২ ও ৯১। অনেকে স্মরণ করতে পারেন এ দুটি রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়েই রাজনীতি করেন মায়াবতী (বহেনজি) আর মুলায়ম সিং যাদব। মায়াবতী নিজে দলিত। আর দলিতদের রানি তিনি। এই দলিত শ্রেণিই তাঁর ক্ষমতার উৎস। বিশাল এক আর্থিক সাম্রাজ্য তিনি গড়ে তুলেছেন এই দলিত শ্রেণিকে সামনে রেখে এবং তাদের ব্যবহার করে। ভারতের বর্তমান লোকসংখ্যা ১২০ কোটি। কিন্তু ২০৩০ সালে এই জনসংখ্যা চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারতের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো টয়লেট নেই। ২০১১ সালে একটি পরিসংখ্যান ছাপা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ভারতের ৫৩ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, ৪৭ শতাংশ মানুষের টিভি আছে, আর ৯ শতাংশ মানুষের রয়েছে কম্পিউটার। কিন্তু ৫৩ শতাংশ মানুষের কোনো টয়লেট নেই। ৩৯ শতাংশ মানুষের নেই কোনো 'কিচেন'। আর ৫৭ শতাংশ মানুষের অভ্যন্তরীণ কোনো সূত্র থেকে সুপেয় পানি পাওয়ার কোনো সুবন্দোবস্ত নেই। অথচ সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ না বাড়িয়ে ভারত সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে চলছে। আবারও একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। স্পিরির গবেষণা অনুযায়ী, ভারত এখন বড় অস্ত্র ক্রেতা দেশ। ২০০৬-১০ সাল পর্যন্ত ভারতে অস্ত্র সরবরাহ বেড়েছে ৯ শতাংশ হারে। ২০১৫ সাল নাগাদ ভারত সামরিক খাতে খরচ করবে ৮০ বিলিয়ন ডলার। অস্ত্র খাতে এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে, কিন্তু প্রতিটি শিশুকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি ভারত। কন্যাশিশুরা এখনো পরিবারের বোঝা। কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার কাহিনী একাধিকবার বিদেশে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। ভারতে ৮০ কোটি মানুষের দৈনিক আয় এখনো আড়াই ডলারের নিচে। ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে থাকে। জেন্ডার সমতার দিক থেকে বিশ্বের ১৮৬ দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৩৬ (বাংলাদেশের ১৪৬)। ভারতে নারীরা এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। গুয়াহাটির রাস্তায় অসহায় নারীর বস্ত্রহরণের কাহিনী সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল কিছুদিন আগে। রুমি নাথ নামের এক সংসদ সদস্যের কাহিনী কিংবা মুম্বাইয়ের এক তরুণীর বাসে গণধর্ষণের কাহিনী প্রমাণ করেছিল নারীরা সেখানে কত অসহায়। নারীদের এই অসহায়ত্ব নিয়েই উত্তর প্রদেশে জন্ম হয়েছিল গুলাব গ্যাঙের। ২০০৬ সালে সম্পাত পাল দেবী বুন্দেলখণ্ড গ্রামে নারীদের সংগঠিত করে জন্ম দিয়েছিলেন গুলাব গ্যাঙের। তাঁরা সবাই গোলাপি শাড়ি পরে নিজেরাই বিচারকাজ করতেন। তাই তাঁদের নাম হয়েছিল গুলাব গ্যাং। স্থানীয় পুলিশ আর পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা ছিল অসহায়। তাই তারা নিজেরাই গড়ে তুলেছিল একটি 'মহিলা রক্ষীবাহিনী'। যাঁরা সিনেমা দর্শক, তাঁরা জানেন বুন্দেলখণ্ড গ্রামের সম্পাত পাল দেবীর কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হয়েছে সিনেমা 'গুলাবি গ্যাং'। মাধুরী দীক্ষিত অভিনয় করেছেন সম্পাত পাল দেবীর চরিত্রে। রাজস্থানের মরুভূমিপ্রধান এলাকায় নারীরা এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন। রাষ্ট্র এঁদের নূ্যনতম চাহিদা নিশ্চিত করতে পারেনি দীর্ঘ ৬৭ বছরেও। তাই অমর্ত্য সেন স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন যে সামাজিক খাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভালো। ভারতের এই যে সামাজিক অবস্থান, সেখানে কিনা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই এবারের নির্বাচনে খরচ করছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি রুপি কিংবা তার চেয়েও বেশি! অথচ একজন অর্থনীতিবিদ হিসাব করে বলতে পারেন এত বিপুল অর্থ দিয়ে কত শত সহস্র কন্যাশিশুকে স্কুলে পাঠানো যেত, কত হাজার মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা যেত, কিংবা গ্রামীণ দারিদ্র্য কমানো যেত। ভারতের নির্বাচনের একটা ভালো দিক হচ্ছে, এখানে জনগণই সরকার পরিবর্তন ঘটায়। আমাদের দেশের মতো 'ভোট ডাকাতি' সেখানে হয় না কিংবা বড় দলকে বাদ দিয়েও সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। মাত্র তিনজন নির্বাচন কমিশনার এই নির্বাচন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। সাম্প্রতিককালে এই নির্বাচনে টাকাওয়ালাদের ভিড় বেড়েছে। শত কোটি রুপির মালিক এমন লোকও নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, যার সংখ্যাও শতর ওপরে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে আম আদমি পার্টি ও কেজরিওয়াল আলোচনার ঝড় তুললেও তাঁর নিজ দলের প্রার্থী তালিকায় কোটিপতির সংখ্যা অনেক। ভারতে এই নির্বাচন আজ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. কোটিপতি ব্যবসায়ীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাত্রা বেড়েছে। ফলে ষোড়শ লোকসভায় করপোরেট হাউসের প্রতিনিধিদের সংখ্যা বাড়বে। সত্যিকার অর্থে জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা হ্রাস পাবে। এর ফলে দুর্নীতির মাত্রা আরো বাড়বে। দুই. শোবিজে জড়িতদের সংখ্যাও বাড়বে। এঁরা লোকসভার সদস্যপদকে ব্যবহার করবেন তাঁদের স্বার্থে। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন এতে পিছিয়ে পড়বে। তিন. আঞ্চলিক দলগুলোর গুরুত্ব বাড়বে। সরকার গঠনে এদের প্রয়োজন পড়বে। চার. দীর্ঘদিন পর 'হিন্দুত্ববাদ' আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নির্বাচনে এর একটা প্রভাব থাকবে। পাঁচ. রাহুল গান্ধীর জন্য এই নির্বাচন তাঁর নেতৃত্বের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। সম্ভবত সোনিয়া গান্ধীকে মনমোহন সিংয়ের মতো বিকল্প একজন 'নেতা' খুঁজে বের করতে হবে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এই মুহূর্তে কংগ্রেসের শীর্ষ কোনো পদে নেই। এখন সম্ভবত প্রিয়াঙ্কাকেই কংগ্রেসের হাল ধরতে হবে। প্রিয়াঙ্কাই হতে পারেন তাঁর দাদির (ইন্দিরা গান্ধী) উত্তরসূরি। ছয়. পারিবারিক রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পারিবারিক রাজনীতির ধারা আরো শক্তিশালী হলো। সাত. বিজেপি 'হিন্দুত্ববাদ'কে পুঁজি করলেও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের নীতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। আট. ভারতীয় গণতন্ত্র সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পেলেও এই গণতন্ত্র বেশি মাত্রায় পুঁজিনির্ভর হয়ে পড়েছে। কোটিপতিদের ক্লাবে পরিণত হতে যাচ্ছে ভারতের লোকসভা। Daily Kalerkontho 28.04.14

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিজেদের স্বার্থের বাইরে কোনো সিদ্ধাšত্ম নেয় না

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান বলেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য তারা নিজেদের জাতীয় স্বার্থের বাইরে কোনো সিদ্ধাšত্ম নেয় না। ব্যক্তিগতভাবে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সিদ্ধাšত্ম নেয়া হয় না। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি’র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী ভোট নেয়ার জন্য অনেক কথাই বলছেন। তারা বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে কিছু করতে পারবেন না। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক বিদ্যমান।

বৃহস্পতিবার রাতে ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তের সম্পাদনায় এটিএন বাংলা টেলিভিশনে ‘অন্যদৃষ্টি’ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তারেক শামসুর রহমান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কূটনীতিক ও কলাম লেখক মোহম্মদ জমির।

শামসুর রহমান বলেন, ভারতে এবার যে নির্বাচন হচ্ছে সেখানে বিপুল পরিমাণ টাকার খেলা চলছে। ভারতের ইতিহাসে এতো টাকার খেলা কোনো নির্বাচনে হয়নি। বিজেপির নির্বাচনী বাজেট ৫ হাজর কোটি রুপী। যা কংগ্রেসের চাইতে ৫ গুণ বেশি। নির্বাচন শেষে ১০ হাজার কোটি রুপীতে পৌঁচ্ছাবে। এটি একটি ছোট দেশের বাজেটের সমান।

মোহম্মদ জমির বলেন, ভারতের রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের কথা হয়। ভারতের অনেক চ্যালেঞ্জ আমরা দেখি। অথচ বাংলাদেশের কোনো চ্যালেঞ্জ ভারত দেখে না। তারা জানেনও না বাংলাদেশে তাদের রাজনীতি নিয়ে কী ধরনের আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশে কী হচ্ছে সেটি ভারতের পত্রিকায় বের হয় না।
Daily Amader Shomoy 25.04.2014
Link 

ভারতে 'মোদি ম্যাজিক' কি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনবে

ভারতে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন যতই সমাপ্তির দিকে যাচ্ছে, ততই একটা শঙ্কা তৈরি হচ্ছে যে, 'মোদি ম্যাজিক' কি সেখানে কোনো পরিবর্তন ডেকে আনছে? এই নির্বাচন ভারতে সরকার পরিবর্তনের একটা সম্ভাবনা তৈরি করলেও, পুনরায় ভারতকে কি একটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে টেনে নিয়ে আসছে? বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি কিংবা শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতৃবৃন্দের মন্তব্য এই আশঙ্কা তৈরি করছে যে, ভারতে পুনরায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্ম হতে যাচ্ছে! ভারতে গত ১০ বছরে কংগ্রেস তথা ইউপিএ জোটের শাসনামলে সেখানে কোনো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ছিল না। এখন বিজেপি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা মুসলমানবিদ্বেষী বক্তব্য দিচ্ছেন। সর্বশেষ ঘটনায় পরিষদের নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়ার বিরুদ্ধে এফআরআই দায়ের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তোগাড়িয়া হিন্দু এলাকায় মুসলমানদের সম্পত্তি ক্রয় না করার হুমকি দিয়েছিলেন। বিজেপি নেতাদের বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যও ছাপা হয়েছে পত্র-পত্রিকায়।

সুতরাং নরেন্দ্র মোদি যদি জনমত সমীক্ষাকে 'সত্য' প্রমাণ করে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি গ্রহণ করেন, তাহলে আমাদের কতটুকু আশ্বস্ত তিনি করতে পারবেন, সেই প্রশ্ন থেকেই গেল। প্রথম কয়েক দফা নির্বাচনে 'মোদি ম্যাজিক' তেমন কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। ৭ এপ্রিল আসাম ও ত্রিপুরার ৬ আসন দিয়ে নির্বাচন শুরু হয়েছে। তবে সেখানে কোনো 'মোদি ম্যাজিক' ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে, আসামের লোকসভার ১৪টি আসনে কংগ্রেস ভালো করবে। অন্যদিকে ত্রিপুরার নির্বাচনেও কোনো 'মোদি ঢেউ' ছিল না। এখানে সিপিআই (এম)-এর অবস্থান ভালো। তারা ভালো করবে। বাবরি মসজিদ ইস্যু ও কাশ্মীরের বিষয়টি বিজেপির ইশতেহারে থাকায় তা ভারতের মুসলমানদের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। বিজেপির ইশতেহার সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিতে পারে। সোনিয়া গান্ধী নিজে বলেছেন, বিজেপির সম্প্রদায়িক এজেন্ডা ভারতের একতা ও অখণ্ডতার জন্য মারাত্মক হুমকিসরূপ। ওরা ভারতকে ভাগ করে ফেলতে চায়।

পুনরায় রাম মন্দিরের ইস্যু তুলে বিজেপি মুসলমানদের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ভারতে ১৮ কোটি মুসলমানের বাস। এরা এখন থাকবেন অনিশ্চয়তায়। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দু উগ্রবাদীরা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। উগ্রবাদী হিন্দুরা সেখানে তাদের দেবতা রামের মন্দির নির্মাণ করতে চায়। বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন সহস্রাধিক ব্যক্তি। এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল সারা মুসলিম বিশ্বে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এর প্রতিবাদে হরতাল হয়েছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়ে এ ধরনের ঘটনাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ভারতব্যাপী এর যে প্রতিবাদ হয়েছিল, তাতে করে ভারত সরকার তখন আরএসএস, বজরং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ইসলামী সেবক সংঘ ও জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসীমা রাও। তিনি বাবরি মসজিদ রক্ষা করতে পারেননি। মথুরার ঈদগাহ মসজিদ নিয়েও হিন্দুরা আদালতে মামলা ঠুকেছিল। আজ বিজেপি পুনরায় রাম মন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এতদিন সেখানে যে স্থিতিশীলতা বজায় ছিল, তা একটি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিল। কাশ্মীরের প্রসঙ্গ তুলে অযথাই বিজেপি বিতর্ক সৃষ্টি করল। অনেকে মনে করতে পারেন, ভারত সংযুক্তির সময় কাশ্মীরিদের একটি স্বতন্ত্র সত্তার মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু সে প্রস্তাব কখনোই কার্যকর করা হয়নি। ধীরে ধীরে সংবিধানের সেই ধারা (ধারা ৩৭০) সংশোধন করা হয়েছিল। এখন বিজেপি এ ধারাটিও তুলে দিতে চায়।

বিজেপির ইশতেহারে যেসব উগ্রবাদী কথাবার্তা বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে আপত্তি জানিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস অভিযোগে করেছে যে, বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করছে। তারা এটা বলেছে যে, বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট চেয়েছে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক চরিত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি নেতৃবৃন্দের 'হিন্দু কার্ড' ব্যবহার করা কিংবা বাংলাদেশবিরোধী দু-একটি বক্তব্যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন। বিজেপি জোট যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যে। কেননা বেশ কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আটকে আছে।

তিস্তার পানি চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে বিজেপির অবস্থান আমরা মোটামুটি জানি। চূড়ান্ত বিচারে নরেন্দ্র মোদিকে যদি মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে সরকার গঠনের প্রশ্নে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে হয়, তাহলে মোদি মমতার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না। এতে করে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি চলে যাবে ডিপ ফ্রিজে। আন্তঃনদী সংযোগের কথাও তিনি বলেছেন। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারেও বিজেপির প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। বিজেপির বিরোধিতার কারণেই কংগ্রেস সরকারের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। চুক্তিটি ভারতীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছিল। একটি বিল লোকসভায় উপস্থাপিতও হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির আপত্তির কারণে এটা নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। তখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে_ এটা আমার মনে হয় না। এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ট্রানজিট প্রশ্নে দু'দেশের মধ্যে আস্থার যে ঘাটতি রয়েছে, সে ব্যাপারে নয়া সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব গত মাসের শেষের দিকে নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নির্বাচনের আগে আমাদের পররাষ্ট্র সচিব যখন নয়াদিলি্ল যান, তখন বুঝতে হবে বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি যাচাই করছে। স্পস্টতই তিনি কোনো সুখবর নিয়ে আসতে পারেননি। এটি মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি, কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ বেশ কিছু চুক্তি করেছে। ভারত গত পাঁচ বছর বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে অর্থে তেমন সুবিধা পায়নি। এখন নয়াদিলি্লতে সম্ভাব্য মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের 'সম্পর্ক' কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় সেটা দেখার বিষয়। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট করেই বলা যায়, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের নীতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে খবর বের হয়েছে যে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালনে করিডোর পেতে যাচ্ছে ভারত। অরুণাচল থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে বিহারে। একই সঙ্গে চলতি বছরেই বহুল বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে ভারত। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং সম্ভাব্য মোদি সরকার এসব প্রকল্প বাতিল করবে_ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ তখন তার স্বার্থ আদায়ে কতটুকু উদ্যোগ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। তবে চূড়ান্ত বিচারে মোদি ক্ষমতা পেলেও, অনেক কিছুই তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। কেননা সরকার গঠন করতে হলে তাকে আঞ্চলিক দলগুলোর সহযোগিতা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলো এক ধরনের 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স' হিসেবে কাজ করবে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক কথা বলতে হয়। বিজেপিও বলেছে। ভারত একটি বিশ্বশক্তি হতে চলেছে। ২০৩০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবস্থান হবে দ্বিতীয়। ভারত জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হতে চায়। ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিশ্বের জন্যই একটি মডেল। সুতরাং নরেন্দ্র মোদি ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু করতে পারবেন না। তাই পররাষ্ট্রনীতিতে, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের মনোভাবের পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। নানা কারণে 'মোদি ম্যাজিক' ভারতব্যাপী একটি ঢেউ তুলেছে। এই ঢেউ শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদিকে নয়াদিলি্লর ৭নং রেসকোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বাসভবনে নিয়ে যায় কি-না, সেটাই দেখার বিষয় আমাদের।

গণজাগরণ মঞ্চ কি অস্তিত্ব হারাবে?

সম্প্রতি গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে একাধিক ঘটনা ঘটেছে। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ডা. ইমরান এইচ সরকারকে অব্যাহতি দিয়েছে সংগঠনের অপর এক অংশ। পাল্টা আরেকটি অংশ গণজাগরণ মঞ্চের নামে সংগঠিত হয়েছে। ফলে সঙ্গতকারণেই যে প্রশ্নটি উঠেছে তা হচ্ছে, গণজাগরণ মঞ্চ কি তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে? যে আবেগ ও প্রত্যাশা নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিল, এর প্রয়োজনীয়তা কি ফুরিয়ে গেছে? বলতে দ্বিধা নেই, গণজাগরণ মঞ্চ বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিল অনেকটা ধূমকেতুর মতো। যুদ্ধাপরাধীদের কঠিন শাস্তি প্রদানের দাবিতে গড়ে উঠেছিল এ আন্দোলন। মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করেই এ সংগঠনটির জন্ম। যদিও এর কোনো সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না। কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও বামমনা কিছু ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগেই আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল এ সংগঠনটির। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্র“য়ারি ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক ছিল এর উদ্যোক্তা। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো তখন এগিয়ে এসেছিল। এর পরের ঘটনা ছিল ইতিহাস। শাহবাগ চত্বর হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ চেতনার এক প্রতীক। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে সেদিন যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল, বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতির ইতিহাসে তা ছিল এক বিরল ঘটনা। এক পর্যায়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। কিন্তু কখনোই তারা নেতৃত্ব ছিনিয়ে নেয়নি। বরং ইমরান এইচ সরকার তথা বামমনা ছাত্র নেতাদের গণজাগরণ মঞ্চকে পরিচালনা করতে দিয়েছে। কিন্তু মাত্র এক বছরের মাথায় সেই দৃশ্যপট বদলে গেল। ইমরান এইচ সরকার, যিনি এক সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তিনি অপসারিত হলেন। এটা স্পষ্ট, যে অংশটি ইমরান এইচ সরকারের বিরোধিতা করে আলাদাভাবে সংগঠিত হয়েছে, তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এতে একটা ধারণার জন্ম হওয়া স্বাভাবিক- গণজাগরণ মঞ্চের এ বিভক্তির পেছনে কি সরকারের কোনো হাত আছে? এটা তো স্বীকার করতেই হবে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চ যখন সংগঠিত হয়েছিল, তখন এর পেছনে সরকারের সমর্থন ছিল। সরকারের সমর্থন ছাড়া গণজাগরণ মঞ্চ এতদূর আসতে পারত না। তাহলে এমন কী ঘটল যে কারণে ইমরানকে হিরো থেকে জিরো বানানো হল? এক বছর আগে যখন গণজাগরণ মঞ্চ সংগঠিত হয়েছিল, তখন আমি একাধিক নিবন্ধ লিখেছিলাম। আমি বলার চেষ্টা করেছিলাম, বিশ্বব্যাপী তরুণদের শক্তি হিসেবে যে উত্থান, তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম হয়েছে। ২০১১ সাল থেকেই তরুণরা প্রচলিত রাজনীতির ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্বব্যাপী একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিল। নিউইয়র্কের অক্যুপাই ওয়াল স্টি ট আন্দোলন থেকে শুরু করে কায়রোর তাহরির স্কোয়ার কিংবা ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কোয়ারের তরুণদের অভ্যুদয়ের সঙ্গে শাহবাগ চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ- সবগুলোই মূলত একই সূত্রে গাঁথা। সবাই বিকল্প মিডিয়া, অর্থাৎ অনলাইন মিডিয়াকে ব্যবহার করে শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এর প্রয়োজন ছিল এবং এক সময় এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েও গেছে। গণজাগরণ মঞ্চের প্রয়োজনীয়তা ছিল। আজ এর প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে গেছে। তবে এটা বলা ভালো, বিশ্বব্যাপী তরুণদের যে শক্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছিল, এক এক দেশে তার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। অসমতা, দরিদ্রতা, বৈষম্য আর কর্পোরেট হাউসগুলোর শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিল নিউইয়র্কের তরুণরা। জন্ম দিয়েছিল অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের। সেই আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি শহরে। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের ছোট্ট জুকোট্টি পার্কে সেদিন হাজার হাজার তরুণ আস্তানা গেড়ে দিনের পর দিন প্রতিবাদ করে গেছে। কিন্তু তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আদৌ কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০১৩ সালের জুলাই-আগস্টে আমি সেই জুকোট্টি পার্কে গিয়েছিলাম। সেখানে আর সংগঠকদের কাউকে খুঁজে পাইনি। অনলাইনে তাদের সীমিত অস্তিত্ব রয়েছে বটে। কিন্তু দ্বিতীয় আরেকটি অক্যুপাই মুভমেন্টের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। মিসরে ২০১১ সালের ৮ ফেব্র“য়ারি কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে জন্ম হয়েছিল এক ইতিহাস। তরুণ প্রজন্ম একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। পতন ঘটিয়েছিল মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের। সেদিন ওই আন্দোলনকে সংগঠিত করেছিল অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। বিশেষ করে এপ্রিল ৬ মুভমেন্ট, ইয়থ ফর জাস্টিস অ্যান্ড ফ্রিডম, কোয়ালিশন অব দ্য ইয়থ অব দ্য রেভুলেশন, পপুলার ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট অব দ্য চেঞ্জ-এর কথা উল্লেখ করা যায়। ২৬ বছরের আসমা মাহফুজ ছিলেন এ আন্দোলনের নেত্রী। এ আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলেছিল ইসলামিক ব্রাদারহুড ও মুরসি। কিন্তু সেনাবাহিনী যখন মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তখন আরেকটি তাহরির স্কোয়ারের জন্ম হয়নি। ২০১২ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কোয়ারে তুরস্কের তরুণরা প্রতিবাদী হয়েছিল। তাকসিম গেজি পার্ক তারা দখল করে রেখেছিল দিনের পর দিন। আজ দ্বিতীয় আরেকটি তাকসিম স্কোয়ার জন্ম হয়নি। চীনের বেইজিংয়ের তিয়েন আন মিন স্কোয়ারে ১৯৮৯ সালে (৪ জুন) গণতন্ত্রমনা ছাত্ররা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, দ্বিতীয় আরেকটি তিয়েন আন মিন স্কয়ারের জন্ম হবে কি চীনে? তবে তরুণরা বারবার প্রতিবাদী হয়। নিউইয়র্কে প্রতিবাদী হয়েছিল অসমতা আর দরিদ্রতার বিরুদ্ধে। তাহরির স্কোয়ারের জন্ম হয়েছিল পরিবর্তনের জন্য, একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মিসরের জন্য। তাকসিম স্কোয়ারে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল এরদোগান সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য। বিশেষ বিশেষ প্রেক্ষাপটেই এ আন্দোলন গড়ে ওঠে। আবার স্তিমিতও হয়ে যায়। গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম হয়েছিল বিশেষ একটি প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। এর প্রয়োজনীয়তা এখন আর নেই। একটা আন্দোলন স্থায়িত্ব পায় যদি তার কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে থাকে। গণজাগরণ মঞ্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকেই একমাত্র মুখ্য করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও এ দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্য কমানো, দুর্নীতি রোধ, শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার, মানবাধিকার, যা সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেসব ব্যাপারে গণজাগরণ মঞ্চ কোনো কর্মসূচি দেয়নি। নয়াদিল্লিতে কেজরিওয়াল দুর্নীতির কথা বলে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক অভিলাষ তার পতনকেই ত্বরান্বিত করেছে। আম আদমি পার্টির নির্বাচনে (লোকসভা) ভরাডুবি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তিনি এটাকে একটা সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে পারতেন, যেমনটি চেয়েছিলেন তার আদর্শিক গুরু আন্না হাজারে। কিন্তু ক্ষমতার মসনদ কেজরিওয়ালকে এখন আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। ইমরান সরকার সেই ভুলগুলোই করেছিলেন। প্রথমত, তিনি গণজাগরণ মঞ্চকে একটি রাজনৈতিক সংগঠনে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। বিপুল জনপ্রিয়তা তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। সম্ভবত তিনি দিল্লির কেজরিওয়ালের উত্থানে উৎসাহিত হয়েছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে দল গঠন করার কথা না বললেও আকার-ইঙ্গিতে তা বুঝিয়েছিলেন। তার ভুলটা ছিল এখানেই। বাংলাদেশ আর দিল্লি এক নয়। ব্যক্তি ইমরান একটি দল করতেই পারেন। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চকে ব্যবহার করা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। সাধারণ মানুষ গণজাগরণ মঞ্চকে দেখতে চেয়েছে একটি সামাজিক সংগঠন হিসেবে। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীকে আলটিমেটাম দিয়ে, সর্বত্র পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিয়ে কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার প্রশ্ন তুলে তিনি সরকারের নীতি-নির্ধারকদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তার অবস্থানে থেকে এটা তিনি করতে পারেন না। তৃতীয়ত, লাখো কণ্ঠের জাতীয় সঙ্গীত-এ ইসলামী ব্যাংকের টাকা নেয়াকে কেন্দ্র করে তিনি সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, লাখো কণ্ঠের সোনার বাংলায় খরচ হয়েছিল ৩০ কোটি টাকা। ৫৩টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করা হয়েছে, কিন্তু এ তালিকায় ইসলামী ব্যাংক নেই। সুতরাং ইমরানের বক্তব্য সরাসরি গ্রহণ করে নেয়া যায় না এবং এটাও তিনি পারেন না। কোনো অনুষ্ঠানের জন্য ওই ব্যাংক থেকে চাঁদা নেয়া কোনো অপরাধ হতে পারে না। চতুর্থত, তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এটা তো সত্য, অনেক মানুষ, প্রবাসী বাঙালিরা, বড় বড় ব্যবসায়ী গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের জন্য চাঁদা দিয়েছেন। অনেক চাঁদা ইমরান সরাসরি গ্রহণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো স্বচ্ছতা রক্ষিত হয়নি। কোন খাতে কী পরিমাণ টাকা ব্যয় হয়েছে, তারও কোনো হিসাব নেই। স্বচ্ছতার খাতিরেই চাঁদার পূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা উচিত। তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা জমা রয়েছে কি-না, তাও স্পষ্ট করা উচিত। পঞ্চমত, কিছুদিন আগে গোপনে তিনি কানাডা পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে ছাড়পত্র দেয়নি। এ ব্যাপারটিরও খোলাসা হওয়া প্রয়োজন। ইতিহাসের এক প্রয়োজনেই গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম হয়েছিল। এর এ মুহূর্তে প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমার মনে হয় না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। আদালতের কার্যক্রম নিয়ে কথা বলা আদালত অবমাননার শামিল। ডা. ইমরান এইচ সরকার এটি যদি না বুঝে থাকেন, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আইনকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেয়া উচিত। ইমরান রাজনীতি করুন, কোনো দলে যোগ দিন কিংবা নিজেই একটি দল গঠন করুন (যা সম্ভবত তার কোনো কোনো উপদেষ্টা চাচ্ছেন)- কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চকে ব্যবহার করে নয়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, কামাল পাশা চৌধুরী আলাদাভাবে সংগঠিত হওয়ায় গণজাগরণ মঞ্চের আবেদন এখন অনেক কমে যাবে। যে বিশাল জনপ্রিয়তা নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ আবির্র্ভূত হয়েছিল, তাতে এখন ধস নামবে। আর কামাল পাশা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন অংশ এখন পরিচিত হবে গণজাগরণ লীগ হিসেবে! গণজাগরণ মঞ্চকে সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্তও ভুল। স্পষ্টতই ডা. ইমরান এখন আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাবেন না। যেদিন পুলিশ তাকে পিটিয়েছিল এবং যে ছবি প্রতিটি পত্রপ্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, সেদিনই ডা. ইমরানের রাজনৈতিক মৃত্যু হয়েছে। বিশাল জনপ্রিয়তাকে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে পরিচালিত করতে পারেননি। তার উগ্রতা, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বক্তব্য ইমরানের অবস্থানকে প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ক্ষুদ্র যে অংশের সঙ্গে তিনি এখনও সম্পর্কিত, অচিরেই আমরা দেখব তারাও তাকে পরিত্যাগ করেছে। ইমরান এইচ সরকার আমাদের অনেক আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে রাজনীতিক হিসেবে দেখতে চায়নি। তিনি মূলধারার রাজনীতি করলে ভালো করতেন। আমরা ভুলে যাই, অতীত বড় নির্মম। ড. কামাল হোসেনের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও মূলধারায় না থেকে তিনি ব্যক্তি কামাল হোসেনই থেকে গেছেন। স্বাধীনতার পতাকা যিনি তুলেছিলেন, সেই আসম আবদুর রবকে এখন পত্রিকার সিঙ্গেল কলামেও খুঁজে পাওয়া যায় না। ইতিহাস বড় নির্মম। এখন ইমরান এইচ সরকার যদি নিজেকে গুটিয়ে নেন, তিনি ভালো করবেন। নতুবা বিতর্কের মাত্রা বাড়বে। সর্বশেষ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় তিনি আরও নানা জটিলতায় জড়িয়ে যেতে পারেন। ইতিহাসে তার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজনীয়তা এ মুুহূর্তে আর নেই। Daily Jugantor ২২ এপ্রিল, ২০১৪

তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ কোন পথে

ভারতের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনী প্রচারণায় আবারও তিস্তার পানি বণ্টনের প্রস্তাবটি উঠেছে। মমতা ব্যানার্জি আবারও এ প্রশ্নটি তুলেছেন। বলেছেন, তিস্তায় জল নেই। বাংলাদেশকে জল দিই কীভাবে? সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে ১৬ মে'র পর নির্বাচনের একটা ফল পাওয়া গেলেও তাতে করে তিস্তা চুক্তি প্রশ্নে কোনো সুসংবাদ থাকার সম্ভাবনা নেই। নয়া সরকারের প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে মমতা ব্যানার্জির সমর্থনের প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে নয়া সরকার মমতা ব্যানার্জিকে অসন্তুষ্ট করে কোনো তিস্তা চুক্তি করবে না। মমতা ভোটের রাজনীতি করেন। ভোটের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক আইন তার কাছে মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষকে সন্তুষ্ট করা। এটা করতে গিয়ে তিনি আবারও বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা নিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা_ তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ নদীর পানি বণ্টন আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে হতে হবে। মমতার 'পাগলামো'র জন্য পানি বণ্টন বন্ধ থাকতে পারে না। পানি দেয়া, না দেয়ার সঙ্গে তার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশ পানি পাবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। আর পশ্চিমবঙ্গ যদি বাধা দেয়, তার দায়ভার গিয়ে বর্তাবে ভারত সরকারের ওপর। এতে করে আন্তর্জাতিক আসরে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। ভারত বিশ্ব সভায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে চায়। এক্ষেত্রে প্রতিবেশীর প্রতি তার আচরণ যদি ন্যায়সঙ্গত না হয়, যা জাতিসংঘের আইনে বলা আছে, তাহলে তার 'নেতৃত্ব' প্রশ্নের মুখে থাকবে। এমনিতেই ভারতের আচরণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকে। এক্ষেত্রে তিস্তায় পানি না দিয়ে উজানে পানি প্রত্যাহার করা হলে তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে ঠেলে দেবে মরুময়তার দিকে। পানির অভাবে যে সঙ্কটের সৃষ্টি হবে, তা বাংলাদেশকে ঠেলে দেবে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতি-নির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সঙ্কটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি_ এটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর গাড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দু'দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু'দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখন যুক্ত হয়েছে মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি 'রাজনৈতিক ইস্যু'। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের 'অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন'কে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এ 'যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তি'টি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ 'জলপ্রবাহ কনভেনশন' নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এ নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে 'যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার' কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এ 'যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা'র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই। তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায়, বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকল। গত এক সপ্তাহে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে নানা সংবাদ ছাপা হয়েছে। যেখানে পানি পাওয়ার কথা ৫ হাজার কিউসেক, তা এখন এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০০ কিউসেকে, অর্থাৎ মাত্র ১০ ভাগের ১ ভাগ পানি বাংলাদেশ পেয়েছে। এর ফলে উত্তরবঙ্গের ১২ উপজেলার ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির বোরো ধান পানির অভাবে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। তিস্তায় যে বাংলাদেশ পানি পাবে না, তা স্পষ্ট করেছেন ভারতের নেতারা। ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ২১ মার্চ নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক। সেখানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র সচিব সবার সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তারা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, 'লোকসভার আগে আর তিস্তা নিয়ে আলোচনা নয়'। এটা কূটনৈতিক ভাষা। আদৌ তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ ১. নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজেপির নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হতে পারে, যারা বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল থাকবে আঞ্চলিক দলগুলোর ওপর, ২. মমতার তৃণমূল কংগ্রেস একটি ফ্যাক্টর হবে। তাদের পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দেয়া বিচিত্র নয়, ৩. বিকল্প সম্ভাবনা হচ্ছে তৃতীয় জোটের (ফেডারেলিস্ট ফ্রন্ট) নেতৃত্বে একটি সংখ্যালঘু সরকার, যেমনটি অতীতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে মমতা হবেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও শুধু মমতার আপত্তির কারণে কোনো চুক্তি হয়নি। আগামীতেও তাই হবে। মমতা কোনো চুক্তি করতে দেবেন না। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য পথ একটিই_ আন্তর্জাতিক আসরে বিষয়টি তুলে ধরা। শুধু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ যদি নিশ্চুপ থাকে এবং যদি উত্তরবঙ্গের কৃষকদের পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, সেটা হবে আমাদের সরকারের এক চরম ব্যর্থতা। সরকার নিশ্চয়ই উত্তরবঙ্গের কৃষকদের বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। আমরা অতীতেও দেখেছি, আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া ভারত বাংলাদেশকে এতটুকু ছাড় দেয়নি। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারত একতরফাভাবে ফারাক্কার পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ফলে বাংলাদেশ বাধ্য হয়ে ফারাক্কা প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরে। ১৯৭৬ সালে ইস্তাম্বুলে ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রশ্নটি উত্থাপন করায় সদস্য দেশগুলো তা সমর্থন করে। একইভাবে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে বাংলাদেশ ফারাক্কা প্রশ্ন আবারও উত্থাপন করে। পরে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ৩১তম অধিবেশনে প্রশ্নটি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেনেগাল, অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার অনুরোধে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক কমিটি বাংলাদেশ ও ভারতকে অনুরোধ করে বিষয়টি নিজেদের মাঝে মীমাংসা করার। পরে সিরিয়া, মিসর, শ্রীলঙ্কা, আলজেরিয়া এবং গায়ানার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও ভারত ফারাক্কা প্রশ্নে জরুরি আলোচনার জন্য ঢাকায় একটি বৈঠকে বসতে রাজি হয়েছিল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এক বিবৃতিতে ওই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে ঢাকায় ফারাক্কায় পানি বণ্টন সংক্রান্ত প্রথম চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। পরে ফারাক্কা প্রশ্নে আগে দুটো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তাতে করে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়নি। কেননা ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহের গড় ধরে পানির হিস্যা নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু ফারাক্কায় পানির প্রবাহ বাড়েনি। চুক্তি অনুযায়ী যতটুকু পানি থাকার কথা তাও আমরা পাচ্ছি না। এরই মধ্যে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে যে, পানি না থাকার কারণে শুকিয়ে গেছে পদ্মাসহ এর ৪টি শাখা নদী। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর। বেকার হয়ে পড়েছেন নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এছাড়া পানিতে লবণাক্ততার আশঙ্কায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে খনন করা হচ্ছে গড়াই নদী। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী পদ্মা নদীর শাখা নদী হিসেবে গড়াই, হিসনা, কালীগঙ্গা ও মাথাভাঙ্গা নদী প্রায় পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। (যায়যায়দিন ১৪ এপ্রিল, ২০১৪)। সুতরাং তিস্তার ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ নিয়ে আবার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন মোদি। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, আন্তঃনদী সংযোগের কারণে গুজরাট খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষ শঙ্কায় থাকবে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত দ্রুত একটি টাস্কফোর্স গঠন করা, যাতে করে তথ্য-উপাত্তসহ তিস্তা, ফারাক্কা ও ব্রহ্মপুত্রের পানির হিস্যা নিয়ে আমরা ভারতের সঙ্গে শক্ত অবস্থানে যেতে পারি। ভারতের 'চাপ' এর কাছে আমরা যদি নতিস্বীকার করি, তাহলে আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারব না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। নির্বাচনী ফল দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আমরা চাই, আমাদের ন্যায্য হিস্যা। মমতা ব্যানার্জির একগুঁয়েমির কারণে আমরা কোটি কোটি মানুষকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারি না। পানি না পেলে উত্তরবঙ্গের চাষাবাদই শুধু ব্যাহত হবে না, বরং মরুকরণ প্রক্রিয়ার বিস্তৃতি ঘটবে। আগামী ৩০ বছর পানির অভাবে এ অঞ্চল পরিণত হবে মরুভূমিতে। নয়াদিলি্লতে যে সরকারই আসুক না কেন, আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় নেব। এখনই প্রস্তুতি নেয়া জরুরি। Daily Alokito Bangladesh 20.04.14

ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কি পরিবর্তন আসছে?

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট যদি বিজয়ী হয়, তাহলে নরেন্দ্র মোদি হতে যাচ্ছেন ভারতের ১৪তম প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটবে মনমোহন সিংয়ের ৯ বছর ৩১৪ দিনের শাসনের। যদিও এটা অনেক আগেই নিশ্চিত ছিল যে, কংগ্রেস নির্বাচনে জিতলেও মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হবেন না। কিন্তু ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংবাদপত্রে এটা চাউর হয়ে গেছে যে, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় মোদির বিজয়কে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য বিপদ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্যও রয়েছে খারাপ খবর। মোদির দুজন উপদেষ্টা বলেছেন, মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে আঞ্চলিক বিরোধ নিয়ে প্রতিবেশী দেশ চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে কঠোর আচরণ করা হবে। অন্যদিকে বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে নতুন করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। রাজনাথ সিং সম্প্রতি বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে যেসব অভিবাসী এসে আসাম বা অন্যান্য জায়গায় বসতি গড়েছে, তাদের অবৈধ ঘোষণা ও তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার এই বক্তব্য বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এই সংবাদটিকে কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বলতে পারব না; কিন্তু তাঁদের কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। এমনকি প্রধান বিরোধী দল ও তার শীর্ষস্থানীয় নেতারাও এর প্রতিবাদ জানাননি বা কোনো মন্তব্য করেননি। যেকোনো বিবেচনায় এটা একটা উসকানিমূলক মন্তব্য, যা আমাদের নানা চিন্তার খোরাক জোগাবে।

এটা তো ঠিক- শতবর্ষ ধরেই এই দুই অঞ্চলের মানুষ দুই দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া করেছে। ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে অনেক বাঙালি পরিবার কলকাতায় বসতি গড়েছে। তাদের সন্তানরা এখন ভারতের মূল ধারায় শরিক হয়েছে। এদের আর বাংলাদেশি বাঙালি বলা যাবে না। ঠিক তেমনি আসামের সঙ্গে সিলেটের একটা যোগসূত্র আছে। পারিবারিকভাবেও এই দুই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। এখন বাঙালি বলে কাউকে কাউকে যদি ফেরত পাঠানো হয়, তাহলে তা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে বাধ্য। তিস্তার পানি চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে বিজেপির অবস্থান আমরা মোটামুটি জানি। চূড়ান্ত বিচারে নরেন্দ্র মোদিকে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সরকার গঠনের প্রশ্নে কোনো 'কমপ্রোমাইজ' করতে হয়, তাহলে মোদি মমতার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না। এতে করে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি চলে যাবে 'ডিপ ফ্রিজে'। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারেও বিজেপির প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। বিজেপির বিরোধিতার কারণেই কংগ্রেস সরকারের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। চুক্তিটি ভারতীয় মন্ত্রিসভায়ও অনুমোদিত হয়েছিল। একটি বিল লোকসভায় উপস্থাপিতও হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির আপত্তির কারণে এটা নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। তখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে- এটা আমার মনে হয় না। এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ট্রানজিট প্রশ্নে দুই দেশের মধ্যে আস্থার যে ঘাটতি রয়েছে, সে ব্যাপারে নয়া সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না। আমাদের পররাষ্ট্রসচিব গেল মাসের শেষের দিকে নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নির্বাচনের আগে আমাদের পররাষ্ট্রসচিব যখন নয়াদিল্লি যান, তখন বুঝতে হবে, বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি যাচাই করছে। স্পষ্টতই তিনি কোনো সুখবর নিয়ে আসতে পারেননি। এটা মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি, কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ বেশ কিছু চুক্তি করেছে। ভারত গেল পাঁচ বছর বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে অর্থে তেমন সুবিধা পায়নি। এখন নয়াদিল্লিতে সম্ভাব্য মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের 'সম্পর্ক' কী হবে, এ ব্যাপারে এখনই একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। সরকারের উচিত হবে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি 'ভারতীয় ডেস্ক' সৃষ্টি করা ও একটি টিম গঠন করা, যারা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেবে। এটা এখন মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যায়, যদি নয়াদিল্লিতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন একটি সরকার গঠিত হয়, তাহলে তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বাংলাদেশকে প্রস্তুতিটা এখনই নিতে হবে।
সম্ভবত ভারতের মানুষ একটি পরিবর্তন চাচ্ছে। কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনে ভারতে দুর্নীতি বেড়েছে। এটাকেই ইস্যু করেছে বিজেপি। এরই মধ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির বৈরিতা বেড়েছে। মোদি নিজে সোনিয়া গান্ধীর নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একজন সংসদ সদস্য সোনিয়া ও রাহুলকে ইতালিতে ফেরত পাঠানোরও হুমকি দিয়েছেন। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদিকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো দরকার- এমন মন্তব্যও করেছেন কেউ কেউ। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদি অভিযুক্ত হয়েছিলেন, যে দাঙ্গায় কয়েক হাজার মুসলমান নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিল। এখন সেই মোদিই চলে আসছেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। যে মোদিকে একসময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার দেশে প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, সেই মোদি এখন হতে যাচ্ছের ভারতের প্রধানমন্ত্রী! এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে!

জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার আগেই মোদির উপদেষ্টারা যখন প্রতিবেশী দেশ চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী মনোভাব ব্যক্ত করেন, তখন এটা বোঝাই যায়, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসছে। নির্বাচনী প্রচারণায় চীনকে তার সম্প্রসারণবাদী মনোভাবের লাগাম টেনে ধরতে বলেছেন মোদি। অনেকেই জানেন, ভারতের অরুণাচল রাজ্য নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের বিরোধ রয়েছে। গত ৯ বছরের ইউপিএ সরকারের জমানায় চীন-ভারত সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হলেও, চীন কখনোই অরুণাচল রাজ্যের ওপর তাদের দাবি পরিত্যাগ করেনি। এমনকি নয়া চীনা প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের সময়ও চীনা প্রধানমন্ত্রী অরুণাচলে তাঁদের অধিকারের প্রসঙ্গটি লুকিয়ে রাখেননি। গত মাসে মোদি অরুণাচলে এক জনসভায় বলেছিলেন, 'মাটির নামে শপথ করছি, দেশ রক্ষা করব।' স্পষ্টতই মোদি একটা ইঙ্গিত দিলেন যে অরুণাচলের ব্যাপারে ভারত তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, তাতে ভারতের চীনের প্রয়োজন রয়েছে। দেশ দুটো অর্থনৈতিক সংস্থা 'ব্রিকস'-এর সদস্য। 'ব্রিকস' হচ্ছে আগামী দশকের অন্যতম অর্থনৈতিক জোট। এই অর্থনীতি ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই মুহূর্তে চীন বিশ্বের দুই নম্বর অর্থনীতির দেশ। আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে চীন-ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিসম্প্রতি ক্রিমিয়া ইস্যুতে রাশিয়ার ভূমিকাকে সমর্থন করেছে চীন ও ভারত। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে (ক্রিমিয়া প্রশ্নে) চীন ও ভারত (বাংলাদেশও) ভোটদানে বিরত থাকে। এর অর্থ- পরোক্ষভাবে রাশিয়ার ভূমিকাকে সমর্থন করেছে চীন ও ভারত। বলা ভালো, রাশিয়াও 'ব্রিকস'-এর সদস্য। সুতরাং মুখে বললেও বাস্তব ক্ষেত্রে মোদি কতটুকু চীনবিরোধিতায় নামবেন, এটা একটা প্রশ্ন। তবে পাকিস্তান প্রশ্নে মোদি কঠোর হতে পারেন। ভারত ও পাকিস্তান তিন-তিনবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। ২০০১ সালেও চতুর্থবারের মতো আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সেই যুদ্ধ হয়নি। এবং বেশ কয়েক বছর ধরে দুই দেশের সীমান্তে শান্তি বজায় রয়েছে। এখন মোদির যেকোনো সিদ্ধান্ত সীমান্তে উত্তেজনা বাড়াবে মাত্র। মোদি তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় ভারতের ভেতরে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর অভিযোগ এনেছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সুতরাং পাকিস্তান থাকবে এক ধরনের অনিশ্চয়তায়।
বিশ্ব আসরে ভারত একটি ভূমিকা পালন করছে। ২০১৪-পরবর্তী আফগানিস্তানে ভারত পালন করবে একটি বড় ভূমিকা। সেখানে ভারতের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। এমনকি ভারতের বিমানবাহিনীর একটি ঘাঁটিও রয়েছে আফগানিস্তানে। এ অবস্থান মোদি ধরে রাখবেন। তবে তিনি অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন। অর্থনৈতিক কূটনীতি প্রাধান্য পাবে। এবং ধারণা করছি, মনমোহন সিংয়ের সময় রচিত অর্থনৈতিক কূটনীতিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন মোদি। বিশাল এক কর্মকাণ্ড নিয়ে ৭ এপ্রিল শুরু হয়েছে ষোড়শ লোকসভার নির্বাচন। পৃথিবীতে আর কোথাও এত বড় নির্বাচনযজ্ঞ হয়নি। ৮১ কোটি ৪৫ লাখ ভোটার মোট ৯ দফায় ভোট দেবেন। ফলাফল জানা যাবে ১৬ মে। তাই বিতর্কিত ও গুজরাট দাঙ্গার (২০০২) সঙ্গে জড়িত ও অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদি যদি ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন, তাতে ভারতের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী পরিবর্তন আসে, সে ব্যাপারে লক্ষ থাকবে অনেকের।
Daily KALERKONTHO
16.04.14

নরেন্দ্র মোদি না তৃতীয় ফ্রন্ট

ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর নাম কি নরেন্দ্র মোদি, নাকি তৃতীয় ফ্রন্টের কেউ? মমতা ব্যানার্জি, নাকি মায়াবতী? অঙ্কের হিসাবটা এখনও মিলছে না, সে সুযোগও নেই। কেননা ভোট গণনা হবে ১৬ মে। আগেই জানা যাবে কে হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। তবে বলাই বাহুল্য, নরেন্দ্র মোদির পাল্লাটা বেশ ভারী। তারপরও একটা হিসাব-নিকেষের বিষয় আছে। যদি ‘ম্যাজিক ফিগার’ ২৭২টি আসন বিজেপি তথা এনডিএ জোট না পায়, তাহলে তৃতীয় ফ্রন্টের যে কাউকে সমর্থন করতে পারে কংগ্রেস। ফলে একটি দর্শন সরকার গঠিত হতে পারে সেখানে। ভারতে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে যতগুলো জনমত সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনও একটিতেও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটকে সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। আসনপ্রাপ্তির দিন থেকে জনমত জরিপে কংগ্রেস বিজেপির কাছ থেকে পিছিয়ে আছে ন্যূনতম একটা আসনে। এর মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে নেহরু সাম্রাজ্যের পতন হতে যাচ্ছে। কেননা কংগ্রেস বিজয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী হতেন নেহরু পরিবারের সর্বশেষ প্রতিনিধি রাহুল গান্ধি, সম্পর্কে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নাতি, আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির জ্যেষ্ঠ সন্তান। বিশাল এক সম্ভাবনা নিয়ে তিনি এসেছিলেন। তারুণ্যের প্রতীক তিনি। কিন্তু ভারতীয় ভোটাররা তার তারুণ্যে আকৃষ্ট হননি। ইতোমধ্যে যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে রাহুল গান্ধি কি ব্যর্থ হলেন? সাম্প্রতিক সময়গুলোয় তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন। বারানসিতে গিয়ে সেখানকার রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে রাস্তায় এসে বৈঠক করেছেন (একদিন রিকশা চালানোর কথাও বলেছেন তিনি)। দিল্লি রেলস্টেশনে গিয়ে কুলিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ভূপালে নারীদের সঙ্গে বৈঠক করার সময় হিজড়াদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ফুটপাতের হকারদেরও ডেকেছেন নিজের বাসায়। মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গবাদে উপজাতিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন— তেমনি বৈঠক করেছেন শিল্পপতিদের সঙ্গেও। এতে বোঝা যায়, রাহুল নতুন ইমেজ নিয়ে এসেছেন। তৃণমূলপর্যায়ে গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনমানের উন্নতি করতে চান তিনি। ভারতে এদের সংখ্যাই প্রায় ৭০ কোটি। এদের নিয়ে বিহারের লালুপ্রসাদ, মায়াবতী আর মুলায়েম সিংহরা রাজনীতি করেন। মায়াবতী এদের নিয়ে রাজনীতি করে বিশাল এক আর্থিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। এরা একটি শক্তি।বিশ্বব্যাংকের (২০১৩) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৩ ভাগের ২ ভাগ গরিব মানুষ বাস করে ভারতে। সুতরাং রাহুল গান্ধি এদের টার্গেট করেছেন। কিন্তু তাতেও তিনি নিজের তথা দলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারেননি। তাই রাহুল গান্ধির ভবিষ্যত্ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, কংগ্রেস যদি রাহুলের পরিবর্তে ছোট বোন প্রিয়াংকা ভদ্রকে ‘প্রমোট’ করত, তাহলে বোধকরি ভালো ফল পাওয়া যেত। প্রিয়াংকা বরাবরই মা সোনিয়া গান্ধির নির্বাচনি এলাকার (রায়বেরলি) দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনে কখনও প্রার্থী হন না। তবে ভারতের রাজনীতিতে নেহরু পরিবার বরাবরই একটি ‘ভোটব্যাংক’। কংগ্রেস নেতারা বরাবরই নেহরু পরিবারকে ব্যবহার করেছেন। রাজনীতিতে এই পরিবারের একক কর্তৃত্ব গড়ে তুলেছিলেন ইন্দিরা গান্ধির দাদা মতিলাল নেহরু। আর রাহুল গান্ধি হচ্ছেন ইন্দিরা গান্ধির নাতি। মতিলাল নেহরু ১৯২১ সালে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধির বাবা জওহরলাল নেহরুও ছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি। জওহরলাল জীবদ্দশায় মেয়ে ইন্দিরাকে কংগ্রেসের সভাপতি বানিয়েছিলেন ১৯৫৯ সালে। আর সেই একই প্রক্রিয়ায় রাহুলের বাবা রাজীব গান্ধিও কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে। পরে তিনি কংগ্রেসের সভাপতিও হন। এখন কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধি। মায়ের নেতৃত্বেই রাহুল প্রথমে একজন সাধারণ সম্পাদক ও পরে অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি ভবিষ্যত্ প্রধানমন্ত্রী, এটি নির্ধারিতই ছিল। মনমোহন সিংও স্পষ্ট করেছিলেন তা। কিন্তু অঙ্কের হিসাবটা কেন যেন বদলে যাচ্ছে! এই ব্যর্থতা কী রাহুলের? মানুষ কি পরিবর্তন চাচ্ছে? শেষ অব্দি কি মোদিই প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন? নাকি জন্ম নিতে যাচ্ছে একটি ‘ঝুলন্ত পার্লামেন্ট’? ভারতের রাজনীতির যারা কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন একাদশ লোকসভা নির্বাচনের পর একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায় যে সরকার তার স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। একাদশ লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালের মে মাসে আর দ্বাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। একাদশ লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপির নেতৃত্বে একটি সরকার সেখানে গঠিত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। তার প্রধানমন্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ১৩ দিন। বাজপেয়ি পদত্যাগ করলে জনতা দলের নেতৃত্বে একটি যুক্তফ্রন্ট সরকার সেখানে গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হন দেবগৌড়া। দেবগৌড়া সরকারকে সমর্থন করেছিল কংগ্রেস। কংগ্রেসের আস্থা হারিয়ে ভোটে হেরে যান দেবগৌড়া। পরে গুজরাল যুক্তফ্রন্টের নেতা নির্বাচিত হলে কংগ্রেস তাকে সমর্থন করে। কিন্তু জৈন কমিশনের রিপোর্ট (রাজীব গান্ধির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এআইডিএমপের জড়িত থাকার প্রমাণ) প্রকাশিত হলে পতন ঘটে গুজরাল সরকারের (২৮ নভেম্বর ১৯৯৭)। দ্বাদশ লোকসভা নির্বাচনেও কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটে। তারা আসন পেয়েছিল ১৪২, (দশম লোকসভায় ২৩২ ও ২৫২, ১১৩, ১৪২) যেখানে বিজেপি পেয়েছিল ১৮২ আসন। ত্রয়োদশ লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার সেখানে গঠিত হয়েছিল। তাদের শরিক ছিল আঞ্চলিক দলগুলো। আঞ্চলিক দলগুলোর সহযোগিতা নিয়েই বাজপেয়ির পক্ষে সম্ভব হয়েছিল সরকার গঠন করার। ২০০৪ সালে ১৪তম ও ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত ১৫তম লোকসভা নির্বাচনে পর-পর দুই টার্ম ইউপিএ জোট বিজয়ী হয়েছিল। এবং দু-দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মনমোহন সিং। আগে বিজেপির উত্থান নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। সর্বভারতব্যাপী কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী এখন এই বিজেপি। অথচ ১৯৮৪ সালে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন। ১৯৮৯ সালে তা সরে দাঁড়ায় ৮৮টিতে। আর ১৯৯১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৭টিতে। ১৯৯৬ সালে এ সংখ্যা ১৬২, ১৯৯৮ সালে ১৮২। পর্যায়ক্রমে বিজেপি যে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে এবং কংগ্রেসের বিকল্প একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের দাঁড় করতে পেরেছে, পরিসংখ্যানই আমাদের এ কথা বলে। এ ক্ষেত্রে ১৬তম লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজেপি যদি পুনরায় সরকার গঠন করে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জনমত জরিপ যদি সত্য হয় এবং কংগ্রেস যদি হেরে যায়, তাহলে রাহুল গান্ধির জন্য তা হবে একটা বড় ধরনের পরাজয়। একই সঙ্গে তার নেতৃত্বের জন্য সৃষ্টি হবে বড় ধরনের হুমকি। মোদি যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে আমাদের কোনও স্বস্তি এনে দেবে না। বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যের জন্য মোদি ইতোমধ্যে সমালোচিত হয়েছেন। ৩১ মার্চ আসামে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশি ভোটারদের জায়গা করে দিতেই আসামের বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে এবং গণ্ডারের বসতি ধ্বংস হচ্ছে। ২২ ফেব্রুয়ারি আসামের শিলচরে তিনি বলেছিলেন, হিন্দু অভিবাসীদের আশ্রয়শিবির বন্ধ করে পুনর্বাসন করা হবে। বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্যও ছাপা হয়েছে এভাবে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে যেসব অভিবাসী এসে আসাম বা অন্যান্য জায়গায় বসতি গড়েছে, তাদের অবৈধ ঘোষণা ও তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের অশনিসংকেত। আমাদের একটা বড় সমস্যা, আলোচনায় দরকষাকষিতে আমরা খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারিনি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ কথাটা প্রয়োগ। গত ৫ বছরে আমাদের জাতীয় স্বার্থে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। সাফল্যের ক্ষেত্রে ভারতের পাল্লাটা ভারী। এখন মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হবে না। মোদি বিজয়ী হলেও তার জন্য আগামী দিনগুলো খুব সুখের হবে না। ভারতে মুসলমানদের আস্থা তিনি অর্জন করতে পারেননি। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ৩ ব্যক্তি মমতা ব্যানার্জি, মায়াবতী ও জয়ললিতা— এদের কারও সঙ্গেই মোদির সম্পর্ক ভালো নয়। কংগ্রেসের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা দেশরক্ষা মন্ত্রী এটোনিও এমন কথাও বলেছেন, প্রয়োজনে তারা মমতা ব্যানার্জিকে প্রধানমন্ত্রী পদে সমর্থন করবেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্নকথা। বিজেপির সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ২৭২ আসন। বিজেপি বা এনডিএ জোট ২৭২ আসন না পেলেও ছোট-ছোট দলের সমর্থন নিয়ে বিজেপি সরকার গঠন করতে পারে। মোদির জন্য বড় সমস্যা হবে, বহির্বিশ্বে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার ইমেজ পুনরুদ্ধার করা। সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের মানবাধিকার কমিশনের এক শুনানিতে বিজেপির প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি বিজয়ী হলে ভারতের মুসলমান ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে তার সরকারের আচরণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের রিপাবলিকান দলীয় সদস্য জো পিটস বলেছেন, ভারতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকারীদের ছাড় দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তিনি বলেন, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার তর্কাতীত উত্থানে ভারতের প্রতিটি সরকারই কোনও না কোনওভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় ধর্মীয় সহিংসতা। ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর থেকে গুজরাটে অব্যাহত মেরুকরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ডেমোক্রেটদলীয় মুসলমান আইনপ্রণেতা কেইস এলিসন। বলা ভালো, গুজরাট দাঙ্গার জন্য মোদি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৫ সালে মোদিকে ভিসা দিতে অস্বীকার করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখন বলছে, তারা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে ভিসা দেবে। সবকিছু মিলিয়ে ভারতীয় নির্বাচন নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা রয়েছে। ৭ তারিখে শুরু হওয়া এ নির্বাচন ইতোমধ্যে ৪ ধাপ অতিক্রম করেছে। ১৭ এপ্রিল থেকে শুরু হবে মূল প্রতিযোগিতা। আর ১৩ রাজ্যে ১৪২টি আসনে নির্বাচন হবে। এরপর ২৪ এপ্রিল ১২ রাজ্যে ১১৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। এসব আসনে যারা ভালো করবে, দিল্লির মসনদ তাদের। ভারতের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। তবে সরকার গঠন করার মতো আসন পাবে না বিজেপি তথা এনডিএ জোট। তাদের আঞ্চলিক দলগুলোর সমর্থন চাইতে হবে। ফলে দিল্লিতে এটি দুর্বল সরকার হবে। কংগ্রেসের ভরাডুবি রাহুল গান্ধির নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। সম্ভবত কংগ্রেসকে মনমোহন সিংয়ের মতো গ্রহণযোগ্য একজন নেতা খুঁজে বের করতে হবে। শেষ পর্যন্ত যদি মোদি সরকার গঠন করতে সমর্থন হন, এ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বৃদ্ধি পাবে। চার. নরেন্দ্র মোদির বিকল্প তৃতীয় শক্তি হিসেবে আঞ্চলিক দলগুলোর কেউ (মমতা, জয়ললিতা কিংবা মায়াবতী) যদি সরকার গঠন করে, তাহলেও আমাদের খুশি হওয়ার কোনও কারণ নেই। পাঁচ. আগামীতে যেই সরকার গঠন করুক, ভারতীয় নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। Daily Amader Somoy
 16.04.14

মোদি ম্যাজিক প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জন করবে কি?

ভারতব্যাপী ‘মোদি ম্যাজিক’ একটি বড় আবেদন সৃষ্টি করতে পারলেও যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এ ম্যাজিকে কতটুকু আশ্বস্ত হতে পারছে? ৭ থেকে ১০ এপ্রিল তিন দফা ভারতে নির্বাচন হয়ে গেল। ১২ এপ্রিল ৩ রাজ্যে নির্বাচন হবে ৫টি আসনে। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হবে ১৭ এপ্রিল থেকে। ওইদিন ১৪২টি আসনে নির্বাচন হবে। ২৪ এপ্রিল হবে ১১৭টি আসনে আর ৩০ এপ্রিল ৮৯টি আসেন। এরই মধ্যে বিজেপি তার নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। ওই ইশতেহারে বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের প্রতিশ্র“তি কিংবা জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের সংবিধানে যে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে, তা বাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ দুটি বিষয় খোদ ভারতে এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য এক ধরনের আতংক সৃষ্টি করেছে। বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তেমন কিছু বলা হয়নি। কিন্তু বিজেপির সভাপতি এক জনসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যে কথা বলেছেন, তা আগামীতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে।সুতরাং নরেন্দ্র মোদি যদি জনমত সমীক্ষাকে সত্য প্রমাণ করে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে আমাদের কতটুকু আশ্বস্ত তিনি করতে পারবেন, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। প্রথম দু’দফা নির্বাচনে মোদি ম্যাজিক তেমন কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। আসামে ও ত্রিপুরার ৬ আসনে নির্বাচন হয়েছে। সেখানে কোনো মোদি ম্যাজিক ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে, আসামে লোকসভার ১৪টি আসনে কংগ্রেস ভালো করবে। অন্যদিকে ত্রিপুরার নির্বাচনেও কোনো মোদি ঢেউ ছিল না। সেখানে সিপিআইয়ের (এম) অবস্থা ভালো। তারা ভালো করবে।বাবরি মসজিদ ইস্যু ও কাশ্মীরের বিষয়টি ভারতে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিতে পারে। সোনিয়া গান্ধী নিজে বলেছেন, বিজেপির সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা ভারতের একতা ও অখণ্ডতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। ওরা ভারতকে ভাগ করে ফেলতে চায়।আবারও রামমন্দিরের ইস্যু তুলে বিজেপি মুসলমানদের মাঝে এক ধরনের আতংক সৃষ্টি করল। ভারতে ১৮ কোটি মুসলমানের বাস। তারা এখন থাকবেন অনিশ্চয়তায়। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দু উগ্রবাদীরা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। উগ্রবাদী হিন্দুরা সেখানে তাদের কল্পিত দেবতা রামের মন্দির নির্মাণ করতে চায়। বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন সহস্রাধিক ব্যক্তি। এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল সারা মুসলিম বিশ্বে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এর প্রতিবাদে হরতাল হয়েছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়ে এ ধরনের ঘটনাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ভারতব্যাপী এর যে প্রতিবাদ হয়েছিল, তাতে করে ভারত সরকার তখন আরএসএস, বজরং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ইসলামী সেবক সংঘ, জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসীমা রাও। তিনি বাবরি মসজিদ রক্ষা করতে পারেননি। মথুরার ইদগাহ মসজিদ নিয়েও হিন্দুরা আদালতে মামলা ঠুকেছিল। আজ আবার বিজেপি রামমন্দির নির্মাণের প্রতিশ্র“তি দিয়ে এতদিন সেখানে যে স্থিতিশীলতা বজায় ছিল, তা একটি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিল। কাশ্মীরের প্রসঙ্গ তুলে অযথাই বিজেপি বিতর্ক সৃষ্টি করল। অনেকের মনে থাকতে পারে, ভারত সংযুক্তির সময় কাশ্মীরীদের একটি স্বতন্ত্র সত্তার মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব কখনোই কার্যকর করা হয়নি। ধীরে ধীরে সংবিধানের সেই ধারা (ধারা ৩৭০) সংশোধন করা হয়েছে। এখন বিজেপি এ ধারাটিও তুলে দিতে চায়বিজেপির ইশতেহারে যেসব উগ্রবাদী কথাবার্তা বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে আপত্তি জানিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস অভিযোগ করেছে, বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করছে। তারা আরও বলেছে, বিজেপি ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট চেয়েছে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক চরিত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে বদলি করলেও কংগ্রেসের ওই লিখিত অভিযোগের ব্যাপারে কমিশন এখন অব্দি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ফলে মোদি হিন্দুত্ববাদকে ব্যবহার করে তার প্রচারণা এখনও অব্যাহত রেখেছেন। উল্লেখ্য, বাবরি মসজিদ ভেঙে (৬ ডিসেম্বর ১৯৯২) রামমন্দির নির্মাণ অভিযানের অন্যতম সংগঠক হিসেবে জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে জোরালো অভিষেক ঘটেছিল বিজেপি নেতা মোদির। এরপর ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে। যদিও আদালতে তা প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু মুসলমান বিদ্বেষী মনোভাব থেকে তিনি কখনও বের হয়ে আসতে পারেননি। তার নির্বাচনী অঙ্গীকারের তালিকায় তাই তিনি স্পষ্ট করেছেন রামমন্দির নির্মাণের বিষয়টি। সুতরাং ভারতের মুসলমানরা আগামীতে আরও খারাপ পরিস্থিতির আশংকা করছেন।আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় মোদির বিজয়কে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য বিপদ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্যও রয়েছে খারাপ খবর। মোদির দু’জন উপদেষ্টা বলেছেন, মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে আঞ্চলিক বিরোধ নিয়ে প্রতিবেশী দেশ চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত কঠোর আচরণ করবে। অন্যদিকে বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে পারে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে যেসব অভিবাসী এসে আসাম বা অন্যান্য জায়গায় বসতি গড়েছে, তাদের অবৈধ ঘোষণা এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার এ বক্তব্য বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ সংবাদটিকে কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বলতে পারব না, কিন্তু তাদের কোনো মন্তব্য আমার চোখে পড়েনি। এমনকি প্রধান বিরোধী দল ও তার শীর্ষ নেতারাও এর প্রতিবাদ জানাননি বা কোনো মন্তব্য করেননি। যে কোনো বিবেচনায় এটা একটা উসকানিমূলক মন্তব্য, যা আমাদের নানা চিন্তার খোরাক জোগাবে।নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য বিজয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় নীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। এটা তো ঠিক, শতবর্ষ ধরেই এ দুই অঞ্চলের মানুষ দু’দেশে আসা-যাওয়া করছেন। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে অনেক বাঙালি পরিবার কলকাতায় বসতি গড়েছেন। তাদের সন্তানরা এখন ভারতের মূলধারায় শরিক হয়েছেন। তাদের আর বাংলাদেশী বাঙালি বলা যাবে না। ঠিক তেমনি আসামের সঙ্গে সিলেটের একটা যোগসূত্র আছে। পারিবারিকভাবেও এ দুই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। এখন বাঙালি বলে কাউকে যদি ফেরত পাঠানো হয়(?) তাহলে তা দু’দেশের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে বাধ্য। তিস্তার পানি চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে বিজেপির অবস্থান আমরা মোটামুটি জানি। চূড়ান্ত বিচারে নরেন্দ্র মোদিকে যদি মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে সরকার গঠনের প্রশ্নে কোনো কমপ্রোমাইজ করতে হয়, তাহলে মোদি মমতার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না। এতে করে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি চলে যাবে ‘ডিপ ফ্রিজে’। আন্তঃনদী সংযোগের কথাও তিনি বলেছেন। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারেও বিজেপির প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। বিজেপির বিরোধিতার কারণেই কংগ্রেস সরকারের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। চুক্তিটি ভারতীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছিল। একটি বিল লোকসভায় উপস্থাপিতও হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির আপত্তির কারণে এ নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। সম্ভাব্য বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে, এটা আমার মনে হয় না। এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ট্রানজিট প্রশ্নে দু’দেশের মাঝে আস্থার যে ঘাটতি রয়েছে, সে ব্যাপারে নয়া সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না।আমাদের পররাষ্ট্র সচিব গেল মাসের শেষদিকে নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নির্বাচনের আগে আমাদের পররাষ্ট্র সচিব যখন নয়াদিল্লি যান, তখন বুঝতে হবে বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি যাচাই করছে। স্পষ্টতই তিনি কোনো সুখবর নিয়ে আসতে পারেননি। এটা মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি, কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ বেশকিছু চুক্তি করেছে। ভারত গেল পাঁচ বছর বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে অর্থে তেমন সুবিধা পায়নি। এখন নয়াদিল্লিতে সম্ভাব্য মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা দেখার বিষয়। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট করেই বলা যায়, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে খবর বের হয়েছে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালনে করিডোর পেতে যাচ্ছে ভারত। আসাম থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে বিহারে। একই সঙ্গে চলতি বছরই বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে ভারত। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং সম্ভাব্য মোদি সরকার এসব প্রকল্প বাতিল করবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ তখন তার স্বার্থ আদায়ে কতটুকু উদ্যোগ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।ভারতের মানুষ একটি পরিবর্তন চাচ্ছে। রাহুল গান্ধীর একটা বড় ব্যর্থতা যে, তিনি তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হলেও মানুষ আকৃষ্ট হয়েছে মোদির অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে। তবে যে পরিবর্তন আসছে, সেই পরিবর্তনের স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ভারত আবারও সেই একাদশ সংসদের সময়কার পরিস্থিতির দিকে ফিরে যাচ্ছে কিনা, সেটাই অনেকের কাছে বড় প্রশ্ন এখন। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের মে মাসে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সংসদ তিনজন প্রধানমন্ত্রীর জন্ম দিয়েছিল (বাজপেয়ী, দেবগৌড়া, গুজরাল)। এবার ভারতে কী পরিবর্তন আসে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও এক মাস। ১৬ মে আমরা জানতে পারব ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর নাম। তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, নয়াদিল্লিতে সরকার পরিবর্তন হলেও ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে এর প্রভাব পড়বে না। তিনি ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, সরকার পরিবর্তন হলেও কোনো দেশেরই পররাষ্ট্রনীতি বা স্বার্থের পরিবর্তন হয় না। তাই কোনো দেশের সরকার পরিবর্তন হলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেও কোনো প্রভাব পড়বে না। তাছাড়া দুই দেশের সম্পর্ক নির্ভর করে দ্বিপক্ষীয় বোঝাবুঝির ওপর, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।কূটনৈতিক ভাষায় শরণ একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কথা তিনি বলেছেন। এটাই হল আসল কথা। মোদির অতি হিন্দুত্ববাদ তাকে আরও আগ্রাসী করে তুলতে পারে। ফলে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে। অরুনাচল নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের সমস্যা রয়েছে। চীন এখনও এ অঞ্চলের ওপর তার দাবি অব্যাহত রাখছে। এখানে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রয়েছে। তবে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। বাংলাদেশ সরকার ভারতকে অনেক দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য। তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছার যে কথা ভারতীয় হাইকমিশনার বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে আগামীতে সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটুকু প্রতিফলিত হয়, সে বিষয়েই বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ থাকবে বেশি Daily JUGANTOR 12.04.14

গল্পটা আম্মা দিদি আর বহেনজির


গল্পটা 'আম্মা', 'দিদি' আর 'বহেনজি'র। এ তিন মহিলা এখন ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক। ভারতে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে। শেষ হবে ১২ মে। আর ১৬ মে জানা যাবে কে হতে যাচ্ছেন দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। রাজনীতির মারপ্যাঁচে এ তিন মহিলার একজন যদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেননা এনডিএ 'ম্যাজিক ফিগার' ২৭২টি আসন পাবে, তা জনমত জরিপে প্রমাণিত হয়নি। তবে বিজেপি যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হবে, তা মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছে জনমত জরিপে। অন্যদিকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হতে যাওয়া কংগ্রেস এখন এক কূটচাল চালছে। শুরু হয়েছে 'মোদি খেদাও অভিযান'। তাই দৃষ্টি এখন এ তিন মহিলার দিকে। মমতা ব্যানার্জিকে প্রধানমন্ত্রী করতেও আপত্তি নেই কংগ্রেসের। তবে বিষয়টি অত সহজ নয়। আঞ্চলিক দলগুলো একটা ফ্যাক্টর হয়ে যেতে পারে। এসব ছোট ছোট দলের সমন্বয় করেও মোদি সরকার গঠন করতে পারেন। আঞ্চলিক রাজনীতিতে সমাজবাদী পার্টি, কাজেম সমাজবাদী পার্টি, জনতা দল, তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, সিজু জনতা দল, তেলেগু দেশম, রাষ্ট্রীয় লোকদল, আকালি দল কোথাও কোথাও বেশ শক্তিশালী। সর্বশেষ ১৫তম সংসদে এদের আসনসংখ্যা ৪ থেকে ২২-এর মধ্যে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলোর মধ্যে শিবসেনা, ডিএমডিকে, এসডিএমকে, লোক জনশক্তি, আকালি দল আবার এনডিএ জোটভুক্ত। এদের সমন্বয়ে যদি ২৭২ আসনের সমর্থন নিশ্চিত না হয়, তাহলে অন্য ছোট দলগুলোর দিকে তাকাবে বিজেপি। আর কংগ্রেসের চেষ্টা হবে তাদের বিরত রাখা। দুটো বড় জোট, একদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ, অন্যদিকে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ_ এ দুই জোটের বাইরে বাম মনারা তৃতীয় জোটের সৃষ্টি করলেও তা আদৌ কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। তৃতীয় জোটের পক্ষে ক্ষমতার আশপাশে থাকারও কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে এ তিন মহিলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। এদের একটি অলিখিত জোটও রয়েছে।
সাধারণত জরিপ সত্য বলেই প্রমাণিত হয়। কিন্তু একটা বিষয় এখন স্পষ্ট_ বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের জনসমর্থন বেড়েছে। এর পেছনে কি হিন্দুত্ববাদ, ব্যক্তি মোদির অর্থনীতিবিষয়ক কর্মকা- নাকি ইউপিএ সরকারের আমলে ব্যাপক দুর্নীতি কাজ করছে, তা এ মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে ভারতীয় পত্রপত্রিকায় নানা বিশ্লেষণধর্মী মতামত প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে। তবে কংগ্রেস যে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে, এটা নিয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।
এখন নির্বাচন ঘিরে অনেক 'কিন্তু' এবং 'যদি'র জন্ম হয়েছে। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ যদি 'ম্যাজিক ফিগার' ২৭২টি আসন পায় (মোট আসন ৫৪৩), তাহলে এ জোট এককভাবেই সরকার গঠন করবে। এ ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি হতে যাচ্ছেন ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু যদি এনডিএ এর চেয়ে কম আসন পায়, তখন? এখানে অনেক সম্ভাবনা আছে। এক. নরেন্দ্র মোদি মমতা ব্যানার্জির সহযোগিতা চাইতে পারেন। কেননা লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের আসন সংখ্যা ৪২। এ ক্ষেত্রে জনমত জরিপ অনুযায়ী তৃণমূল কংগ্রেস ২৮টি আসন পেতে পারে। সরকার গঠনের জন্য মমতা ব্যানার্জি তখন একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন। নির্বাচনী প্রচারণায় মমতা একদিকে কংগ্রেসকে যেমনি সমালোচনা করেছেন, তেমনি বিজেপিরও সমালোচনা করেছেন। কয়েকটি আঞ্চলিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে অলিখিত চতুর্থ জোট 'ফেডারেলিস্ট ফ্রন্ট'। অতীতে মমতা বিজেপির সঙ্গেই ছিলেন। আবার বিজেপি সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে আলাদা অবস্থান নিয়েছিলেন। পরে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ থেকেও মন্ত্রী হয়েছিলেন। সেখান থেকেও পদত্যাগ করেন। এই হচ্ছেন মমতা। যেখানে স্বার্থ বেশি, সেখানে তিনি থাকেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিনিময়ে তিনি এনডিএ-তে যোগ না দিয়েও মোদিকে সরকার গঠনে সাহায্য করতে পারেন। তাই ভারতের রাজনীতিতে এ মুহূর্তে তিন মহিলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। 'আম্মা' (জয়ললিতা), 'বহেনজি' (মায়াবতী), 'দিদি' (মমতা ব্যানার্জি)। জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে, তৃণমূলের পাশাপাশি এডিএমকে পেতে পারে ২১ আর পিএসপি ১৮ আসন। এর বাইরে আছে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের দল বিজেডি। তারা ১৭ আসন পেতে পারে। ফলে সরকার গঠনে এসব আঞ্চলিক দল একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে মোদিকে ঠেকাতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ এ তিন মহিলার একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন করতে পারে। তবে বিষয়টা খুব সহজ নয়। মমতা, মায়াবতী কিংবা জয়ললিতার (তিনজনই অবিবাহিত) মধ্য থেকে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা একটা সমস্যা তৈরি করতে পারে।
একটি 'ঝুলন্ত পার্লামেন্ট'-এর জন্ম হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। ১৯৯৬ সালের বাজপেয়ির (বিজেপি) ১৩ দিনের (১১তম সংসদ) প্রধানমন্ত্রিত্বের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। কিংবা ১৯৯৭ সালে জনতা দলের দেবগৌড়া সরকার (১১তম সংসদ, ৩২৮ দিন), আই কে গুজরালের (১৯৯৮) ৩৩২ দিনের সরকারকে কংগ্রেস সমর্থন করেছিল। আমরা আরো একটু পেছনের দিকে যেতে পারি। মোরারজি দেশাই (১৯৭৭) তার টার্ম পূরণ করতে পারেননি। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ২ বছর ১২৬ দিন (ষষ্ঠ সংসদ)। চরণ সিং ক্ষমতায় ছিলেন (১৯৭৯) মাত্র ১৭০ দিন (ষষ্ঠ সংসদ)। সেই ইতিহাসেরই কি পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে এবার? তবে জনমত জরিপ এটা স্পষ্ট করেছে যে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএর ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সমসাময়িক ভারতীয় রাজনীতির জন্য এটা হবে একটা বড় চমক। আরো দুঃখজনক হচ্ছে, রাহুল গান্ধী যে প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিলেন, সে প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারেননি। যেখানে জনমতে দেখা গেছে মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান ৫৪ শতাংশ মানুষ, সেখানে রাহুল গান্ধীকে চান মাত্র ১৮ ভাগ মানুষ। নেহেরু পরিবারের প্রতি এটা একটা অসম্মান। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয় বছর ৩১৫ দিনের ইউপিএ সরকারের বিদায় অনিবার্য হয়ে উঠছে। বিগত ১৪ ও ১৫ তম সংসদে কংগ্রেস বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মনমোহন সিং এর আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন না। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, রাহুল হচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। এখন দেখা গেল মনমোহন সিংয়ের এ আশা অধরাই থেকে যাবে। সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বিজয়ী হয়েছিল ২০১টি আসনে, আর বিজেপি ১১২টিতে। এর বাইরে সমাজবাদী পার্টি (মুলায়ম সিং যাদব) ২২, বহুজন সমাজবাদী ২১, জনতা দল ১৯, তৃণমূল ১৮, ডিএমকে ১৬, সিপিএম ১৬, সিজু জনতা দল ১৪, শিবসেনা ১০, ওআইএডিএমকে ৯, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস ৮, তেলেগু দেশম ৬টি আসন পেয়েছিল। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোটে (ইউপিএ) রয়েছে ডিএমকে, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ন্যাশনাল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ। এ জোটের জন্ম হয়েছিল ২০০৪ সালে। অন্যদিকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-তে রয়েছে (জন্ম ১৯৯৮) শিবসেনা, ডিএমডিকে, এমডিএমকে, লোক জনশক্তি, আকালি দল প্রভৃতি।
মায়াবতী দলিতদের পুঁজি করে উত্তরপ্রদেশে বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। নিজে দলিত, অর্থাৎ নিম্নবর্ণের মানুষ হলেও মাস্টার্স ডিগ্রিধারী এবং কোনো দিন সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করেননি। রাজনীতি করে বিশাল এক আর্থিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। মমতা আর সাবেক অভিনেত্রী জয়ললিতাও এ থেকে পৃথক নন। এদের মধ্যে আবার অদ্ভুত এক মিলও রয়েছে। এরা সবাই চিরকুমারী। এ তিনজন মহিলা তিনটি রাজ্যের বর্তমান ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং সেখানকার সাধারণ মানুষকে পুঁজি করে রাজনীতি করলেও তারা স্ব স্ব রাজ্যের বৈষম্য, নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে পারেননি।
মায়াবতীর উত্তরপ্রদেশের কথাই বলা যেতে পারে। এ রাজ্যের বুন্দেলখ- গ্রামের গুলাব গ্যাংয়ের কথা বাংলাদেশের মানুষ পত্রপত্রিকা পড়ে জেনেছেন এতদিনে। অন্যায়ের প্রতিবাদে, নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে সাধারণ এক নারী সম্পাত পাল দেবী সংগঠিত করেছিলেন গ্রামের নারীদের। গোলাপি শাড়ি সবাই পরতেন যার কারণে এ বাহিনীর নামকরণ হলো গুলাব গ্যাং। লাঠি হাতে তাদের মিছিলের ছবি ও তাদের ওপর এক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল লন্ডনের গার্ডিয়ানে। সম্প্রতি গুলাব গ্যাংয়ের কাহিনী নিয়ে মুম্বাইয়ে একটি ছবিও হয়েছে। মাধুরী দীক্ষিত অভিনয় করেছেন সম্পাত পাল দেবীর ভূমিকায়। এটা একটা বাস্তব কাহিনী। মায়াবতীরা সাধারণ নারীদের বিরুদ্ধে অন্যায়কে পুঁজি করেই বহুজন সমাজবাদী পার্টিকে সংগঠিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। এখন অবশ্য তিনি আর মুখ্যমন্ত্রী নন। কিন্তু তিনি নিজে দলিত হয়েও দলিতদের নূ্যনতম অধিকার নিশ্চিত করতে পারেননি। ভারতের গণতন্ত্রের এটাই বড় সমস্যা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে বৈষম্য অনেক বেশি। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেনের ধারণা এখানে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তার নিজ দেশেই তার তত্ত্ব খাটেনি (যে দেশে গণতন্ত্র রয়েছে, সে দেশে দারিদ্র্য নেই!)। একটা পরিসংখ্যান দিই। ২০০৪ সালে ভারতে ৪১ কোটি লোক দরিদ্র ছিল, জনসংখ্যার মোট ২৭ দশমিক ৫ ভাগ। আর ২০১০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ০২ ভাগ। যারা জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিদিন ১ দশমিক ২৫ ডলার আয় করেন, সেই হিসাবে দরিদ্রের এ সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিদিন ৫ হাজার শিশু ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা যায়। প্রায় ১৯ লাখ শিশু পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায় (প্রতি বছর)। বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষের ৩ ভাগের ২ ভাগ বাস করে ভারতে। ভারতের 'গণতন্ত্র' এ দারিদ্র্য দূর করতে পারেনি। এখনো নারীরা সেখানে নিরাপদ নন, ধর্ষিত হন প্রকাশ্যেই। ভারতের গণতন্ত্রের এটা একটা কালো দিক। ৭ এপ্রিল ছিল ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দিন।
পর্যায়ক্রমে মোট নয় দফায় এ নির্বাচন শেষ হবে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মায়াবতীরা আরো ক্ষমতাবান হবেন। নয়া দিলি্লতে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হবে। তাতে করে 'গুলাব গ্যাং'-দের খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাষ্ট্র নারীদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। স্পষ্টতই একটি বড় পরিবর্তন আসছে ভারতীয় রাজনীতিতে। কংগ্রেসের ভরাডুবি হতে যাচ্ছে। ১৬ মে আমরা জানতে পারব কে হতে যাচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
Daily JAI JAI DIN10.04.14