রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ট্রাম্পের বিদায় বাইডেনের শুরু

ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আর জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েছেন। ২০ জানুয়ারি এ খবর সারা বিশ্বের সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘নতুন একটি দিনের’ সূচনা হয়েছে বটে, কিন্তু রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা। ট্রাম্প বিদায় নিলেও তার ‘লিগেসি’ যুক্তরাষ্ট্র কতদিন বয়ে বেড়াবে কিংবা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বাইডেন ‘ঐক্যের ডাক’ দিলেও এ ঐক্য তিনি আদৌ ধরে রাখতে পারবেন কি না, এ প্রশ্নটি বারবার আলোচিত হতে থাকবে। একজন প্রেসিডেন্টের বিদায়, আরেকজন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ-এটি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিকে ঘিরে রয়েছে কিছু প্রথা, কিছু ‘কনভেনশন’ কিছু নিয়মকানুন। কিন্তু ৪৬তম প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে কিংবা তারও আগে যা ঘটল, তা প্রেসিডেন্সিকে শুধু কলুষিতই করল না বরং একটা ‘কালো দাগ’ রেখে গেল, যা থেকে বেরিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। অত্যন্ত দাম্ভিক, উগ্র মেজাজি, নিয়মকানুন না মানা, প্রেসিডেন্সিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে মনে করা, আইনের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে হুমকির মুখে রাখা ইত্যাদি একজন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্প গেল চার বছর যা করে গেলেন, অতীতের কোনো প্রেসিডেন্ট এমনটা করেননি। প্রথা অনুযায়ী বিদায়ি প্রেসিডেন্ট শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে শুধু যে উপস্থিত থাকেন তা নয়; আগের দিন বিদায়ি প্রেসিডেন্ট নয়া প্রেসিডেন্টকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানান, নয়া প্রেসিডেন্টকে ওয়াশিংটনে আনতে প্রেসিডেন্টের নিজস্ব বিমান (Air Force-one) পাঠান, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর একসঙ্গে লাঞ্চ করেন। এবার তেমন কিছুই হলো না। তিনি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেন না। বিমান পাঠালেন না। যাওয়ার আগে বললেন, তিনি আবার আসবেন। বিদায়ি ভাষণে তিনি যা বললেন, তা ছিল সর্বৈব মিথ্যা। তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন-তার চার বছরের শাসনকালকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘শ্রেষ্ঠ শাসনকাল’ হিসাবে। ফিরিস্তি দিয়েছেন ব্যাপক উন্নয়ন ও পরিবর্তনের, যা ছিল সর্বৈব মিথ্যা। পরিসংখ্যানই বলে দেয়, তিনি সত্য বলেননি (Politifact)। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে তিনি যতবেশি বিতর্কিত হয়েছেন, অতীতে অন্য কোনো প্রেসিডেন্ট এভাবে বিতর্কিত হননি। কবছর আগেও তার নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা সারা বিশ্ব জেনেছিল। জনৈক বারবনিতার সঙ্গে তার ‘দৈহিক সম্পর্ক’ ও তা সংবাদমাধ্যমে যাতে প্রকাশ না পায়, তার জন্য মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা, একের পর এক শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করা, নির্বাচনে বাইরের শক্তির দ্বারা প্রভাব খাটানোর উদ্যোগ, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা ইত্যাদি ঘটনায় তিনি বারবার আলোচিত হয়েছেন। তার শাসনামলে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়েছে, যার কারণে জন্ম হয়েছিল ‘ব্লাক লাইভ ম্যাটারস’ আন্দোলনের। একপর্যায়ে এ আন্দোলন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যা পরিণত হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের মুখপাত্র হিসাবে। সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত তিনি দুটো কারণে। এক. একজন ধনী ব্যক্তি হয়েও (তার সম্পদের পরিমাণ ২.৫ বিলিয়ন ডলার) তিনি কর পরিশোধ করেছেন মাত্র ৭৫০ ডলার (২০১৭)। দুই. নির্বাচনে হেরে গেলে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে, তিনি ফন্দিফিকিরের আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে পারেন। সেটা তিনি করেছিলেনও! প্রথমে আইনগতভাবে তিনি জো বাইডেনের বিজয়কে ঠেকাতে চান। ভোট গণনাকে চ্যালেঞ্জ করে মোট ৬৩টি মামলা হয়েছিল। তাতে মাত্র একটিতে তিনি আদালতের রায় পেয়েছিলেন। আদালতের রায় পেতে ব্যর্থ হয়ে তিনি উসকে দেন তার সমর্থকদের ‘ক্যাপিটল হিল’ (সংসদ ভবন) দখল করতে। সেটি ছিল কলঙ্কজনক একটি ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ক্যাপিটল হিলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার (প্রথমবারে ব্রিটিশ সেনা কর্তৃক ১৮১৪ সালের ২৪ আগস্ট) ঘটনা ঘটেছে সত্য, কিন্তু উগ্রবাদীদের দ্বারা তা দখল করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ওই ঘটনাকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘সিভিলিয়ান সামরিক অভ্যুত্থান’ (৬ জানুয়ারি, ২০২১) হিসাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আইন, সমাজ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তাকে এটা করতে দেয়নি। এখন তিনি বলছেন, তিনি ফিরে আসবেন! কিন্তু কীভাবে? তৃতীয় একটি দল তিনি গঠন করবেন? তার মতো আরেকজন ধনী ব্যবসায়ী রস পেঁরো চেষ্টা করেছিলেন ১৯৯২ সালে। গঠন করেছিলেন ‘আমেরিকান ইনডিপেনডেন্ট’ নামে একটি দল, যার কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। একসময় উইগ পার্টির পক্ষ থেকে কেউ কেউ প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন (উইলিয়াম হ্যারিসন ১৮৪১, জন টেলর ১৮৪১, জেচারি টেলর ১৮৪৯, মিলার্ড ফিলমোর ১৮৫০)। এখন আর উইগ পার্টির কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে একজন ‘উন্মাদ’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ফিরে আসার’ হুমকি শুধু কাগজে কলমেই থেকে যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জো বাইডেন কতদূর যেতে পারবেন? ট্রাম্প একটি বিভক্ত সমাজকে রেখে গেছেন। গণতন্ত্রের ‘মৃত্যু’ ঘটিয়ে তিনি বিদায় নিয়েছেন। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি করেছেন। এখান থেকে সমাজকে একত্রিত রাখা, সবাইকে আস্থায় নিয়ে ‘নতুন এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র’ গড়ার কাজটি নয়া প্রেসিডেন্টের জন্য সহজ নয়। তবে তিনি যে সিরিয়াস, তা প্রথম দিনেই প্রমাণ করেছেন। প্রথম দিনেই ১৭টি প্রশাসনিক আদেশ জারি করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আবার যোগ দেওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কপ-২১ চুক্তিতে (প্যারিসে স্বাক্ষরিত) আবার যোগদান, শিশু ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত উঅঈঅ আইন (Deferred Action for Childhood Arrivals) বাতিল করা, মাস্ক পরা, সাতটি মুসলিম দেশের অধিবাসীদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত ঋণ মওকুফ করারও একটি উদ্যোগ তিনি নিতে যাচ্ছেন। এসব আদেশের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আবার বহুপাক্ষিকতায় ফিরে গেল। কোভিড-১৯ মোকাবিলা ও বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাস করতে হলে বহুপাক্ষিকতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জো বাইডেনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। প্রথমত, তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে আমরা জিএসপি সুবিধা চাই। যুক্তরাষ্ট্র কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা দিলেও তৈরি পোশাকে এ সুবিধা দেয় না। শতকরা ১৫ দশমিক ৬২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে। জিএসপি সুবিধা পেলে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের তৈরি পোশাকের বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে। একই সঙ্গে বিশাল নারী কর্মীদের কাজের একটা সংস্থান হবে। যুক্তরাষ্ট্র নারীর অধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। সুতরাং জিএসপি সুবিধা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের নারী জনগোষ্ঠীর প্রতি সম্মান জানাতে পারে জো বাইডেনের প্রশাসন। দ্বিতীয়ত, বিদায়ি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও বাংলাদেশে ‘আল কায়দার ঘাটি আছে’ এ ধরনের একটি মিথ্যা ও অসত্য দাবি তুলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে অভিজ্ঞ অ্যান্টনি ক্লিনকেন নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। আমাদের প্রত্যাশা-জঙ্গিবাদবিরোধী বাংলাদেশের যে অবস্থান, ক্লিনকেন তা সমর্থন করবেন। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবমুখী একটি সমর্থন প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশ চায় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে যাবে, তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা হবে এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানো হবে। এক্ষেত্রে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা যায় কি না, যুক্তরাষ্ট্র তা ভেবে দেখতে পারে। চতুর্থত, জো বাইডেন জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তিতে (কপ-২১, ২০১৫) ফিরে যাওয়ার দলিলে স্বাক্ষর করেছেন। বাংলাদেশের জন্য এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। এর মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে যে ক্ষতি হয়েছে, তা মোকাবিলার জন্য ৯.৮ বিলিয়ন ডলারের যে Green Climate Fund গঠিত হয়েছে; সেখান থেকে অর্থ সাহায্যের পথ প্রশস্ত হতে পারে। পঞ্চম, ট্রাম্প প্রশাসন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের নৌ উপস্থিতি ও তৎপরতা বৃদ্ধি করেছিল। এটা অনেকটাই ছিল চীনবিরোধী একটি তৎপরতা। এ কারণে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সামরিক চুক্তি করেছিল। বাংলাদেশ চীনবিরোধী যে কোনো তৎপরতায় শরিক হতে পারে না। ষষ্ঠ, ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ একটি Strategic dialogue চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। প্রতিবছর একবার করে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে আসছে, বাংলাদেশ ‘সোফা’ ও ‘আকসা’ চুক্তি করুক। সোফা অর্থাৎ ‘স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস অ্যাগ্রিমেন্ট ও আকসা অর্থাৎ ‘অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট-এ উভয় চুক্তির ধরন সামরিক। বাইডেন প্রশাসন এ দুই চুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবে না, বাংলাদেশ এটা প্রত্যাশা করে। সপ্তম, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যোগ দিতে যাচ্ছে। আমরা চাই কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যে ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে, তা বাংলাদেশসহ গরিব দেশগুলো বিনামূল্যে পাক-এটি বাইডেন প্রশাসন নিশ্চিত করুক। আশার কথা, বাইডেন ‘COVAX’ এ যোগ দিতে যাচ্ছেন, যাদের মাধ্যমে গরিব দেশগুলো ভ্যাকসিন পেতে পারে। অষ্টম, বলা হচ্ছে-বাইডেন প্রশাসন ইমিগ্রেন্টদের ব্যাপারে আরও নমনীয় হবে এবং ১ কোটি ১০ লাখ লোককে নাগরিকত্ব দেবে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য এটা একটা শুভ সংবাদ। জো বাইডেন শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন এটা গণতন্ত্রের দিন; ইতিহাস ও আশার একটি দিন। এ মুহূর্তে গণতন্ত্র বিজয়ী হয়েছে এবং গণতন্ত্র বিরাজমান। তার ঐক্য ও গণতন্ত্র সংহত করার ডাক একটি ভালো উদ্যোগ বলে সবাই স্বাগত জানিয়েছেন। ৭৮ বছর বয়সে এসে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। ইতিহাসে এর আগে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট হিসাবে হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করেছিলেন রোনাল্ড রিগ্যান ১৯৮১ সালে, ৬৯ বছর বয়সে। বাইডেনকে তার বয়স নিয়ে নির্বাচনকালীনও কথা শুনতে হয়েছে। এর জবাবে তিনি একবার বলেছিলেন, I am an adult and I will bring back normalcy and I will bring back a sense of decency and demonstrate maturity (NYT, Jan 18, 2021)। বয়স্ক মানুষ শোভনতা ও পরিপক্কতা প্রদর্শন করতে পারে- এটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন। ৪ বছর পর ২০২৪ সালের নভেম্বরে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তার বয়স দাঁড়াবে ৮২। ৮২ বছর বয়সেও নির্বাচন করা সম্ভব। রানী এলিজাবেথ ৯৪ বছর বয়সে, কিউবার রাউল কাস্ত্রো ৮৯ বছর বয়সে, ক্যামেরুনের পল বিয়া ৮৮ বছর বয়সে, সৌদি রাজা সালমান বিন আবদুল আজিজ ৮৫ বছর বয়সেও রাষ্ট্রপরিচালনা করে গেছেন। সুতরাং, বাইডেন নয় কেন? তবে সবার দৃষ্টি থাকবে কমলা হ্যারিসের দিকে। একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট, নারী, ইমিগ্রেন্টের সন্তান (বাবা জামাইকান, মা ভারতীয়), ৫৬ বছর বয়স যার-তিনি কি তৈরি হচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট পদের জন্য। যদিও জো বাইডেন সেই অর্থে ইমিগ্রেন্ট। তার দাদা-পরদাদারাও এসেছিলেন আয়ারল্যান্ড থেকে। তবে পার্থক্য হলো গায়ের রঙে-কমলা কৃষ্ণাঙ্গ ও নারী। একজন নারী ও কৃষ্ণাঙ্গকে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ প্রেসিডেন্ট হিসাবে এখনো মেনে নেবে বলে মনে হয় না; যে কারণে জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘নতুন যুগে’ প্রবেশ করল। এখন দেখার পালা, জো বাইডেন কতটুকু পরিবর্তন আনেন? Jugantor 24.1.2021

কতদূর যেতে পারবেন জো বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন জো বাইডেন। কিন্তু যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিনি শপথ নিলেন এবং যে পরিস্থিতির তিনি মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন, আগামী দিনগুলোয় তা যে কোনো বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিভক্ত সমাজ, উগ্র শ্বেতাঙ্গ রাজনীতির উত্থান, কোভিড ১৯-এ বিধ্বস্ত মার্কিন সমাজ, ভঙ্গুর অর্থনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো- এসব বিষয় মোকাবিলা ও নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা জো বাইডেনকে ২০২১ সালে যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অভিজ্ঞ (তিনি দীর্ঘদিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান ও মেম্বার ছিলেন) জো বাইডেনের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো- স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনীতি। বুধবার তিনি যখন শপথ নেন, তখন যুক্তরাষ্টে কোভিড ১৯-এ মৃতের সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছে (২০ জানুয়ারি) ৪ লাখ ১১ হাজার ৪৪০ আর আক্রান্ত ২ কোটি ৪৮ লাখ ৪ হাজার ৭৩৯ জন। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা থেকে বাইডেন প্রশাসন শিক্ষা নিয়েছে। ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ বরাদ্দের ঘোষণা তিনি দিয়েছেন (ভ্যাকসিন প্রোগ্রামের জন্য ২০ বিলিয়ন ডলার, কোভিড-১৯ টেস্টের জন্য জাতীয় পর্যায়ে ৫০ বিলিয়ন, উপজাতির কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য ২০ বিলিয়ন, স্কুল চালুর জন্য ১৩০ বিলিয়ন, পিপিই সরবরাহের জন্য ২৫ বিলিয়ন)। অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারে এ সেক্টরকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। শত শত মানুষ চাকরি হারিয়েছে। উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বেকারত্বের হার শতকরা ১৫ ভাগে থাকলেও এখন তা নেমে এসেছে ৭.৯ শতাংশে। শেয়ারবাজারের নিম্নগতি এখনো লক্ষণীয়। দরিদ্রতার গড় হার ১০.৫ শতাংশ (কৃষ্ণাঙ্গ ১৮.৮ শতাংশ, শ্বেতাঙ্গ ৭.৫ শতাংশ)। গড় প্রবৃদ্ধি ২.৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, সেপ্টেম্বর (২০২০) পর্যন্ত এর পরিমাণ ২৬.৯৫ ট্রিলিয়ন ডলার। জাপান ও চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ১.২৯ ট্রিলিয়ন ও ১০.০৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বড় অর্থনীতি, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এ অর্থনীতি এখন ঝুঁকির মুখে। ফলে অর্থনীতি একটি বড় সেক্টর- যেখানে জো বাইডেনকে হাত দিতে হবে। আশার কথা, অর্থনীতিকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। অর্থনীতিকে যে তিনি কত গুরুত্ব দেবেন, এর বড় প্রমাণ সাবেক ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান জানেট ইয়েলেনকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদান। ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। অর্থনীতি ভালো বোঝেন। সঙ্গত কারণেই তার মনোনয়ন প্রশংসিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম একজন মহিলা অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন। বাইডেনের শপথগ্রহণের পর ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে জো বাইডেনের ভূমিকা কী হবে? দক্ষিণ এশিয়া, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগর- এই তিন অঞ্চল ঘিরে আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতি আবর্তিত হবে। এ তিনটি অঞ্চল- একটির সঙ্গে অন্যটির যোগসূত্র আছে এবং এই অঞ্চলে উত্তেজনা আছে। বৃহৎ শক্তির মধ্যকার ‘প্রভাববলয় বিস্তার’-এ প্রতিযোগিতাও আছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে এ অঞ্চল ঘিরে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ রচিত হয়েছিল। এই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারত। ভারত কেন্দ্র করে ট্রাম্প প্রশাসন যে নীতি প্রণয়ন করেছিল, এতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণও চেয়েছিল ওই প্রশাসন। ওই স্ট্র্যাটেজির উদ্দেশ্য একটাই- চীনকে ঘিরে ফেলা। এ স্ট্র্যাটেজি পুরনো ঈড়হঃধরহসবহঃ চড়ষরপু-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়- যখন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী রচিত স্ট্র্যাটেজির সফল বাস্তবায়ন আমরা দেখেছি ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে। অর্থাৎ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ছিল লক্ষ্য। এখনো সেই Containtment Policy
নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এবারের টার্গেট চীন। চীনকে দুর্বল করা, চীনকে ঘিরে ফেলা, চীনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উসকে দেওয়া- এসবই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ। তাই আমরা দেখি ছটঅউ-কে সক্রিয় হতে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি সাক্ষরিত হতে কিংবা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের উপস্থিতিকে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে। এসব কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে চীন-ভারত উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে একদিকে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সুযোগ পেয়েছে এ অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব ও উপস্থিতি বাড়াতে নতুন একটি নৌফ্লিট গঠন করতে চাচ্ছে। বিদায়ী নেভি সচিব কেনেথ ব্রেইটথওয়েইটের কথায় এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। জাপানের ইয়োকোসুকা বন্দরে অবস্থানরত সপ্তম ফ্লিট দিয়ে ভারত মহাসাগরে পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন আরেকটি ফ্লিট গঠিত হলে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নেভি আরও শক্তিশালী হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত হয়, তা হলে ভারত মহাসাগরকেন্দ্রিক রাজনীতি আরও উত্তপ্ত হবে। অথচ ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলো ভারত মহাসাগরকে একটি শান্তির এলাকা হিসেবেই দেখতে চায়। শ্রীলংকার নয়া সরকার গত ২২ অক্টোবর দায়িত্ব নিয়ে এ আহ্বান জানায়। ১৯৭১ সালে শ্রীলংকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর পাঁচ দশক পর প্রেসিডেন্ট গোতবায়া রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন সরকার পুনরায় এ আহ্বান জানায়। তিনি এ আহ্বানটি জানালেন এমন এক সময় যখন চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা এখনো রয়েছে। লাদাখে যখন উত্তেজনা হ্রাস পায়নি, তখন ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে তার নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীনের সঙ্গে পার্শ¦বর্তী দেশগুলোর দ্বন্দ্ব চলছে। এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রয়েছে। সেখানে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত টহল দেয়। চীন সম্প্রতি ওই এলাকায় একটি নৌবাহিনীর মহড়া সম্পন্ন করেছে। ভারত মহাসাগর নিয়ে চীন-ভারত উত্তেজনা রয়েছে। চীনা স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ‘চীনা স্বার্থকে’ চ্যালেঞ্জ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন আনছে। এখানে ভারত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পার্টনার। এদিকে ২০২০-এর ৬ অক্টোবর জাপানের টোকিওতে ছটঅউ ছঁধফৎরষধঃবৎধষ ঝবপঁৎরঃু উরধষড়মঁব-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া ছটঅউ-এর সদস্য। ছটঅউ-এর উদ্যোগে এর আগে একটি নৌমহড়াও অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যার, বিশেষ করে লাদাখ অঞ্চলের সমস্যার কোনো সমাধান এখনো হয়নি। এ ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি কী- সেটি একটি প্রশ্ন। জলবায়ু পরিবর্তন এই শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত একটি বিষয়। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাগর-মহাসাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে মরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ায়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটি বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে প্যারিস কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। পরে ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কপ-২১ চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছিল। ১৭০টি দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করেছিল। অথচ ট্রাম্প প্রশাসন এ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কপ ২১-এ বিশ্বের ১৯৫টি দেশ রাজি হয়েছিল ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখবে। জো বাইডেন বলেছেন, তিনি কপ-২১ চুক্তিতে ফিরে যাবেন। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন বাইডেন। তা বিশ্বে তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে। advertisement ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে পশ্চিম ইউরোপ তথা ন্যাটোভুক্ত দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। তিনি জার্মানি থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলেছেন। ন্যাটোর দেশগুলোকে ন্যাটোয় দেওয়া অনুদানের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছেন। তার মুসলমান বিদ্বেষের কারণে কয়েকটি মুসলমান দেশের নাগরিকের যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছে। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি সমঝোতা থেকে ট্রাম্প বেরিয়ে গেছেন। এতে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক ঝুঁকি কমেনি, বরং বেড়েছে। তার প্রো-ইসরায়েলি নীতি ফিলিস্তিনি সংকটকে আরও গভীরে নিয়ে গিয়েছিল। ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের ব্যাপার ট্রাম্প প্রশাসন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। Amader Somoy 21.1.2021
advertisement মোদ্দা কথা- ট্রাম্প গেল চার বছরে বিশ্বকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তা থেকে বেরিয়ে না এলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব আসরে একা হয়ে যাবে। গত ১৫ নভেম্বর (২০২০) চীনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বড় বাণিজ্যিক জোট-কম্প্রিহেনসিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ বা আরসিইপি। এখানে যুক্তরাষ্ট্র নেই। একুশ শতক হচ্ছে চীনের। অংরধহ ঈবহঃঁৎু-এর কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। ঊনিশ শতক ছিল ব্রিটেনের। বিশ শতক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। আর একুশ শতক হবে এশিয়ার। এশিয়ার তিনটি বড় অর্থনীতি- চীন, ভারত ও জাপান আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতি নির্ধারণ করবে। ১৯৫০ সালে বিশ্বে যত মানুষ বসবাস করত, এর অর্ধেক বাস করত এশিয়ায়। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির মাত্র ২০ শতাংশ ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ২০২০ সালে এসে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) এশিয়ার মোট অর্থনীতি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মোট অর্থনীতির চেয়ে বেশি। ফলে বাইডেনের আগামী চার বছর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে চীনসহ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল। আশার কথা, বাইডেন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের নয়া মার্কিন নীতি প্রণয়নের জন্য একজন ঝানু কূটনৈতিক কুর্ট ক্যাম্পবেলকে নিয়োগ দিয়েছেন। বাইডেন নিজে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অভিজ্ঞ। সুতরাং তার চার বছরের শাসনামলে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল যে গুরুত্ব পাবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তবে প্রশ্ন তো আছেই। হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাওয়ার আগে বিদায়ী ভাষণে ট্রাম্প একজন ‘নয়া প্রেসিডেন্ট’কে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বটে কিন্তু জো বাইডেনকে ব্যক্তিগতভাবে শুভেচ্ছা জানাননি। তার নামও উল্লেখ করেননি। এমনকি প্রথা অনুযায়ী তিনি বাইডেন দম্পতিকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাননি এবং শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিতও ছিলেন না। এটি একটা বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। বিদায়ী ভাষণে তিনি আবারও কোভিড ১৯-কে ‘চীনা ভাইরাস’ হিসেবে উল্লেখ করে চীনের ব্যাপারে তার বিতৃষ্ণা আবারও প্রকাশ করলেন। মার্কিন ইতিহাসে তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট- যিনি দুই-দুইবার অভিশংসনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। একজন বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প বিদায় নিলেন। একই সঙ্গে জো বাইডেন আজ শপথ নিলেন বিশাল এক সম্ভাবনা জাগিয়ে। তাই আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

জো বাইডেন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

আজ বুধবার ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণ করবেন জো বাইডেন। তিনি ডেমোক্র্যাটদলীয় এবং ওবামার পর (২০০৯-১৭) একজন ডেমোক্র্যাট হিসেবে আবার হোয়াইট হাউজে যাচ্ছেন। ইতিহাস বলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ডেমোক্র্যাটদলীয় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন সপ্তম প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জ্যাকসন (১৮২৯-৩৭)। এর আগের ছয়জন প্রেসিডেন্টের পরিচিত ছিল ফেডারেলিস্ট পার্টি তথা ডেমোক্রেটিক-রিপাবলিকান পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে। তবে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাইডেনের পার্থক্য এখানেই যে, ট্রাম্প কোনো দিন নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। তিনি ব্যবসায়ী, প্রচুর অর্থের মালিক। আর অনেকটা অর্থের জোরেই তিনি রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থিতা নিশ্চিত করে ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু জো বাইডেন একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করার আগে তিনি ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেলাওয়ারা স্টেট থেকে নির্বাচিত একজন সিনেটর ছিলেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি সিনেটর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে ছিলেন এবং এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, যা ট্রাম্পের ছিল না। তবে তার আজকের শপথগ্রহণের কাজটি ‘সুখের’ হচ্ছে না। কারণ ৩ নভেম্বরের (২০২০) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত দুমাসে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটে চলছিল, তা খোদ যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে কলঙ্কিত করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে গেলে, এটা মানতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তিনি আইনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। মোট ৬৩টি মামলা হয়েছিল নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে। তার মধ্যে একটিতে তার পক্ষে রায় পড়ে, বাকি ৬২টিতে তিনি হেরে যান। এরপর ঘটে ইতিহাসের এক কেলেঙ্কারি ট্রাম্প তার সমর্থকদের প্ররোচিত করেন সংসদ ভবন (ক্যাপিটল হিল) দখল করতে। ৬ জানুয়ারি তার সমর্থকরা সীমিত সময়ের জন্য এটি দখল করে নেয়। ওই ঘটনায় চারজন নিহত হন। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত করে প্রতিনিধি পরিষদ তাকে ‘ইমপিচ’ করে (যদিও সিনেটে তিনি ‘ইমপিচড’ হননি)। ইতিহাসে তিনি একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি দু-দুবার ‘ইমপিচড’ বা অভিশংসিত হলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির জন্য এটা একটা খারাপ খবর নিঃসন্দেহে। এমনই এক পরিস্থিতিতে সমগ্র মার্কিন সমাজ যখন দ্বিধাবিভক্ত, ঠিক তখনই জো বাইডেন শপথ নেবেন আজ। আরও একটি খারাপ খবর হচ্ছে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের অনুপস্থিতি। এটা একটা ‘কনভেনশন’ যে, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। ট্রাম্প আজ থাকবেন না। এটা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের যে সৌন্দর্য, তা ম্লান করল। যুক্তরাষ্ট্রের গত ১৫০ বছরের ইতিহাসে ট্রাম্প হচ্ছেন পঞ্চম প্রেসিডেন্ট, যিনি নয়া প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে থাকছেন না। এর আগে জন অ্যাডামস, জন কুইন্সি অ্যাডামস, মার্কিন ভন ব্যুরেন এবং এন্ড্রু জনসনও নয়া প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে থাকেননি। জন অ্যাডামস (দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট, ১৭৯৭-১৮০১) নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন থমাস জেফারসনের (তৃতীয় প্রেসিডেন্ট) কাছে। তার সন্তান জন কুইন্সি অ্যাডামস (ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট, ১৮২৫-২৯) হেরে গিয়েছিলেন এন্ড্রু জ্যাকসনের (সপ্তম) কাছে। মার্টিন ভন ব্যুরেন (অষ্টম প্রেসিডেন্ট, ১৮৩৭-৪১) হেরে গিয়েছিলেন উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসনের কাছে (নবম প্রেসিডেন্ট) এবং এন্ড্রু জনসন (১৭তম প্রেসিডেন্ট, ১৮৬৫-৬৯) হেরে গিয়েছিলেন উইলিসিস গ্রান্টের কাছে (১৮তম প্রেসিডেন্ট)। হেরে গিয়ে এরা কেউই নয়া প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেননি। তবে উড্রো উইলসনের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন। তিনি ১৯১৩-২১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন (২৮তম প্রেসিডেন্ট)। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন গামালিয়েন হাডিংয়ের শপথ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। কেননা তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। জো বাইডেন একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। তার সামনে চ্যালেঞ্জ অনেকগুলো। প্রথম চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তিনি ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি আর্থিক প্যাকেজের কথা ঘোষণা করেছেন। যাকে তিনি বলছেন, ,Amercan Rescue Plan’। এর আওতায় ব্যক্তিকে আর্থিক সহায়তা, ভ্যাকসিন ক্রয়ে অর্থ বরাদ্দ, স্টেট সহায়তা অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কভিড-১৯ মোকাবিলার কাজটি তিনি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করতে পারবেন যদি তিনি সামরিক খাতে যে ব্যয় বরাদ্দ, তা কমান। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট ৭২১.৫ বিলিয়ন ডলার। Statista আমাদের জানাচ্ছে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করা অর্থ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় নিম্নলিখিত কাজগুলো করা যায় : ১) একটি Virginia সাবমেরিনের বিনিময়ে (মূল্য ২৮০০ মিলিয়ন) ৯,১৮০টি পূর্ণ অ্যাম্বুলেন্স ক্রয়, ২)Fremm ধরনের ফ্রিগেট (৯৩৬ মিলিয়ন) এর বদলে ১০,৬৬২ জন ডাক্তারের বেতন, ৩) ঋ-৩৫ যুদ্ধবিমানের (৮৯ মিলিয়ন) পরিবর্তে ৩,২৪৪ আইসিইউ বেড ক্রয়, ৪)Trident II ও মিসাইলের (৩১ মিলিয়ন) পরিবর্তে ১৭ মিলিয়ন মাস্ক কেনা, ৫) Leopard ২ ধরনের ট্যাংকের বদলে ৪৪০টি ভেন্টিলেটর কেনা যায় (April 27, 2020)। তথ্য ও উপাত্ত যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে বাইডেন প্রশাসন কখনোই প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমাতে পারবেন না। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালের পর আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়াযুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মতে এই যুদ্ধে খরচ হয়েছিল ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮টি দেশে তাদের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। বিপুল অর্থ ব্যয় হয় এসবের পেছনে। সুতরাং কভিড-১৯ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা খাতে আদৌ অর্থ বরাদ্দ কমাবে কি নাসেটাই বড় প্রশ্ন এখন। উগ্র শে^তাঙ্গবাদের জন্ম দিয়ে ট্রাম্প মার্কিন সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছিলেন। এখন ট্রাম্প না থাকলেও এই উগ্র শে^তাঙ্গবাদ বা কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে ‘ট্রাম্পইজম’ থেকে যাবে সমাজে। সমাজ থেকে এই ট্রাম্পইজম, উৎখাত করা চাট্টিখানি কথা নয়। উপরন্তু সিনেট যদি বাইডেনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর ট্রাম্পকে ‘ইমপিচ’ না করে, তাহলে ২০২৪ সালের পববর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার আবার প্রার্থী হওয়া আটকানো যাবে না। ইতিহাসে এ ধরনের দৃষ্টান্ত আছে। হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নিলেও ট্রাম্প সক্রিয় থাকবেন এবং তার সমর্থকদের তিনি সংগঠিত করতে চেষ্টা করবেন। বাইডেনের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে আগের জায়গায় নিয়ে আসা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বাইডেনের জন্য। করোনার কারণে হাজার হাজার লোক চাকরি হারিয়েছে। এদের জন্য একটা আস্থার জায়গা তৈরি করা দরকার। চাকরি নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা। পরিসংখ্যান আমাদের জানাচ্ছে, ১৯৩৩ সালে সর্বোচ্চ ২৪.৯ শতাংশ ছিল বেকারত্বের হার। ১৯৪৪ সালে ছিল সবচেয়ে কম, ১.২ শতাংশ। কভিড-১৯-এর কারণে (২০২০), তা ১০.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে (howmuch.net)। ২০২১ সালে বাইডেন অর্থনীতির চাকা কতটুকু ঘোরাতে পারবেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। চীনের সঙ্গে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’-এর যদি সমাপ্তি না হয়, তাহলে অর্থনীতির চাকাও ঘুরবে না। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ এখন ১.০৫ ট্রিলিয়ন ডলার (মোট বৈদেশিক ঋণ ৭.০৭ ট্রিলিয়ন ডলার)। এটাও একটা সংকট তৈরি করতে পারে। কভিড-১৯ বিশ্বায়নকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বায়ন যে প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছিল, তা পূরণ করতে পারেনি। অমর্ত্য সেন কভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে যে ‘নতুন পৃথিবীর’ কথা বলছেন, সেখানে স্পষ্টতই চীন একটি বড় ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। চীনের নেতৃত্বে বিশ্বায়নের যে প্রক্রিয়া শুরু হবে, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে, এ ব্যাপারেও লক্ষ থাকবে অনেকের। চীনের নেতৃত্বে একটি ‘ভ্যাকসিন সিল্ক রোড’-এর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বিস্তারিত আমরা জানি না। তবে আমরা জানি কভিড-পরবর্তী যুগে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতা জরুরি। সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন কিশোর মাহাবুবানি, যিনি ঐধং পযরহধ ড়িহ গ্রন্থটি লিখে বড় ধরনের ঝড় তুলেছেন। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এই শিক্ষক বাইডেন প্রশাসনের স্ট্র্যাটেজি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘In the Process, it will also find a more intelligent and thoughtful strategy towards China that would bring back many of America’s allies and friends’। স্পষ্ট বক্তব্য। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে হবে, যা ট্রাম্প নষ্ট করেছিলেন, যাতে করে যুক্তরাষ্ট্র তার পুরনো বন্ধুদের ফিরিয়ে আনতে পারে। একুশ শতক হচ্ছে চীনের। Asian Century-এর কথা বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। ঊনিশ শতক ছিল ব্রিটেনের। বিশ শতক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। আর একুশ শতক হবে এশিয়ার। এশিয়ার তিনটি বড় অর্থনীতি, চীন, ভারত ও জাপান আগামী দিনের বিশ^ রাজনীতি নির্ধারণ করবে। ১৯৫০ সালে বিশ্বে যত মানুষ বসবাস করত, তার অর্ধেক বাস করত এশিয়ায়। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির মাত্র ২০ ভাগ ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ২০২০ সালে এসে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) এশিয়ার মোট অর্থনীতি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মোট অর্থনীতির চেয়ে বেশি। ফলে বাইডেনের আগামী চার বছর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে চীনসহ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল। আশার কথা, বাইডেন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে নয়া মার্কিননীতি প্রণয়নের জন্য একজন ঝানু কূটনীতিক কুর্ট ক্যাম্পবেলকে নিয়োগ দিয়েছেন। বাইডেন নিজে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অভিজ্ঞ। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য যে নীতি প্রণয়ন করেছিলেন, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল চীন। ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ভারতের সঙ্গে কৌশলগত চুক্তি (QUAD-কে (Quod Rilateral Security Dialogue,, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি সামরিক জোট) সক্রিয় করা ইত্যাদির মাধ্যমে ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে নতুন করে এক ধরনের i Containment Policy (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে একই নীতি নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র) প্রণয়ন করেছিলেন। এখন বাইডেন সে ‘অবস্থান’ থেকে বেরিয়ে আসবেন কি না সেটাই দেখার বিষয়। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিস সম্প্রতি একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘Whither America? (Project Syndicate ‘কোথায় আমেরিকা’? তার সমাপনী মন্তব্য, ‘যে অবস্থায় ট্রাম্প আমেরিকাকে রেখে যাচ্ছেন, তা কাটিয়ে উঠতে একজন প্রেসিডেন্ট বাইডেন নয়, বরং বেশ কয়েকটি প্রেসিডেনশিয়াল টার্মের প্রয়োজন হবে’ (১২ জানুয়ারি)। আরেকজন অর্থনীতিবিদ নওরেল রউবিনিও মন্তব্য করেছেন এভাবে ‘America is the new center of global Instability’ (ওই)। তার বক্তব্য স্পষ্ট যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম অস্থিতিশীল একটি কেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে! ‘ট্রাম্পইজম’ ফিরে আসার আশঙ্কাও তিনি দেখছেন। নিঃসন্দেহে এ ধরনের মন্তব্য নয়া প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিন্তার খোরাক জোগাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, গত চার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি কতটুকু শিখেছেন? বলার অপেক্ষা রাখে না বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য এখন অনেক বেশি। Desh Rupantor 20.1.2021

বাইডেনের প্রেসিডেন্সি ও একটি বিভক্ত সমাজ

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০ জানুয়ারি বুধবার শপথ গ্রহণ করবেন। কিন্তু তার আগেই একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তা খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ ভাবমূর্তি উদ্ধারে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই দেখার বিষয়। ৩ নভেম্বর যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে ব্যাপক ব্যবধানে হেরে যান ট্রাম্প। কিন্তু এরপর থেকেই ঘটতে থাকে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা। তিনি বলার চেষ্টা করেন নির্বাচনে তার ‘বিজয়’ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে! বিষয়টি নিয়ে তিনি কোর্টে পর্যন্ত যান। কিন্তু কোনো কোর্টেই ট্রাম্পের সমর্থকদের ‘ভোট কারচুপির’ বক্তব্য গ্রহণ করা হয়নি। এরপর ট্রাম্প তার সমর্থকদের কংগ্রেস ভবন ‘ক্যাপিটল হিল’ দখল করার আহ্বান জানান। এ ধরনের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। শত শত লোক পুলিশ বেষ্টনী ভেঙে গত ৬ জানুয়ারি কংগ্রেস ভবন দখল করে নিয়েছিল। এটা ছিল অকল্পনীয় ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক সমাজে পরাজিত একজন প্রার্থী এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারেন, তা কেউই চিন্তা করেননি। কিন্তু ট্রাম্পের মতো একজন প্রেসিডেন্ট এ কাজটি করলেন। তিনি যে তার সমর্থকদের উসকে দিয়েছিলেন, এর প্রমাণও আছে। এমনকি এ ঘটনায় ট্রাম্প ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লেও প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন-তিনি কোনো অন্যায় করেননি। ওই ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ দ্বিতীয়বারের মতো তাকে ‘ইমপিচ’ করার উদ্যোগ নেয়। অবশ্য প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে সাময়িকভাবে ভাইস প্রেসিডেন্টের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে। এ ব্যাপারে প্রতিনিধি পরিষদের গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্টকে দায়িত্ব গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি একটি চিঠি দিলেও পেন্স তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরে ট্রাম্পকে ‘ইমপিচ’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতিনিধি পরিষদের সভায় শেষ পর্যন্ত ২৩২-১৯৭ (৫ জন ভোট দেননি) ভোটে ট্রাম্পকে ‘ইমপিচ’ করা হয় দ্বিতীয়বারের মতো। ‘ইমপিচমেন্ট’-এর সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘He (Trump) threatened the integrity of the democratic system, interfered with peaceful transition of power, and imperiled a coordinate branch of government.’ তবে চূড়ান্ত বিচারে ট্রাম্প ‘ইমপিচড’ বা অভিশংসিত হবেন না। কেননা, সিনেটের মেজরিটি লিডার মিচ ম্যাককনেল জানিয়ে দিয়েছেন-অভিশংসন বিষয়ে সিনেটে কোনো ভোটাভুটি হবে না। ফলে চূড়ান্ত বিচারে ট্রাম্প অভিশংসিত হচ্ছেন না; তবে নিঃসন্দেহে নয়া প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করার মাত্র এক সপ্তাহ আগে প্রতিনিধি পরিষদে তার অভিশংসনের ঘটনা ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সবার দৃষ্টি এখন ২০ তারিখের দিকে। ওইদিন ট্রাম্প সমর্থকরা বড় বিক্ষোভ করতে পারে। শপথের দিন বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কাও করছেন অনেকে। যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের জন্য এ মুহূর্তে সমস্যা দুটি-বর্ণবাদ ও গুন্ডাতন্ত্র। বর্ণবাদের ইতিহাস অনেক পুরোনো। মার্টিন লুথার কিং এ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ইতিহাসের পাতায় তার নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু বর্ণবাদ এখনো আছে। আর ট্রাম্প এ বর্ণবাদকে উসকে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, তার আমলে তিনি উচ্ছৃঙ্খল জনগোষ্ঠীকে (যারা তার সমর্থক) নিয়ে তিনি আলাদা একটি ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করেছিলেন, যারা প্রচলিত আইন ও আইনের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছিল। আর এভাবেই ট্রাম্প ‘মার্কিনি গণতন্ত্র’কে জিম্মি করেছিলেন। আব্রাহাম লিংকন যাকে বলেছিলেন Mob rule অর্থাৎ উচ্ছৃঙ্খল জনগোষ্ঠীর শাসন; সেই ‘শাসন’ই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। গেল বছর মিনিয়াপোলিস থেকে পোর্টল্যান্ড (ওরিগন) শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর গুন্ডাতন্ত্র প্রত্যক্ষ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ। এর প্রতিবাদে জন্ম হয়েছিল ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ আন্দোলনের, যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল আটলান্টিকের ওপারে ইউরোপের দেশগুলোয়ও। আর এভাবেই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদকে উসকে দিয়েছিলেন। এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বর্ণবাদ যে কত শক্তভাবে অবস্থান করছে; ২৫ মে (২০২০) জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ড ছিল তার সর্বশেষ উদাহরণ। এ বর্ণবাদ নিয়ে শত শত গবেষণাপত্র ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এসব গবেষণাপত্রে দেখা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। ইতিহাস বলে, ১৬১৯ সালে আজকের যে ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্য, সেখানে প্রথম আফ্রিকান নাগরিকদের দাস ব্যবসার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল। পর্তুগিজ দাস ব্যবসায়ীরা আজকের অ্যাঙ্গোলা থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের চুরি করে নিয়ে এসেছিল। পরে সাগরে ব্রিটিশ ডাকাতরা পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তাদের ছিনিয়ে নিয়েছিল। এর পরের ইতিহাস সবাই জানে-কৃষ্ণাঙ্গরা যুক্তরাষ্ট্রে দাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৮৬৫ সালে এই দাস ব্যবসার বিলুপ্তি ঘোষণা করা হলেও কৃষ্ণাঙ্গদের (মোট জনসংখ্যার ১৩ ভাগ) জীবনযাত্রার মানের কোনো উন্নতি হয়নি। কৃষ্ণাঙ্গরা প্রতিটি ক্ষেত্রে, শিক্ষায়, চাকরিতে, ব্যবসায় আজও অবহেলিত। এমনকি করোনাভাইরাসে তুলনামূলক বিচারে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর হার শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে বেশি। কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকেরই কোনো ‘স্বাস্থ্যবিমা’ নেই। ফলে অবহেলা, বিচার না পাওয়া, বেকারত্ব, অবর্ণনীয় জীবনযাপন কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে বারবার রাস্তায় টেনে নিয়ে এসেছে। কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বারবার সমতা বজায় রাখা ও তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির দাবি জানানো হলেও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ক্ষোভ ছিল, তাই আবারও সেটা বিস্ফোরিত হয়েছিল। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ২০১৪ সালে নিউইয়র্কে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক এরিক গার্নারের মৃত্যুর কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ যখন গার্নারের গলা চেপে ধরেছিল, গার্নারকেও বলতে শোনা গিয়েছিল ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ জর্জ ফ্লয়েডও একই প্রক্রিয়ায় একই কথা বলেছিলেন এবং পুলিশ হেফাজতে মারা গিয়েছিলেন। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর খবরটিও সামনে চলে এসেছে। ‘ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স’-এর তথ্যমতে, ২০১৯ সালে পুলিশ হেফাজতে যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন ১ হাজার মানুষ; যাদের মধ্যে শতকরা ২৪ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ। অথচ জনসংখ্যার মাত্র ১৩ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ; কিন্তু পুলিশ হেফাজতে তাদের মৃত্যুহার বেশি। এমনকি ১৯৮০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যারা জেলে ছিলেন, তাদের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায়- জেলে বন্দি জনগোষ্ঠীর ৩৪ ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ। গবেষণায় দেখা গেছে, পুলিশ হেফাজতে যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিটেনের চেয়ে ৬ ভাগ আর জার্মানির চেয়ে ৪ ভাগ বেশি মানুষ মারা যায়। আরও দুঃখজনক খবর হচ্ছে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পুলিশ নির্যাতনের (যুক্তরাষ্ট্রে) ঘটনায় শতকরা ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের আদৌ কোনো বিচার হয়নি। বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে বিভক্ত করেছে। বলা হচ্ছে, ‘মহামারির মধ্যে এ বর্ণবাদ আরেকটি মহামারি’। দুঃখজনক হচ্ছে এটাই-যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ২৪৪ বছরের ইতিহাসে জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে তাদের ন্যূনতম অধিকারের দাবিতে এখনো আন্দোলনে নামতে হয়। তবে এবারের আন্দোলনের চরিত্র ছিল একটু ভিন্নতর। এ আন্দোলন একটি বৈশ্বিক রূপও পেয়েছিল। লন্ডনসহ বিশ্বের বড় বড় শহরে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। নয়া প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য এটা হবে একটা চ্যালেঞ্জ-তিনি কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের আস্থায় নেবেন। ট্রাম্প যেভাবে মার্কিন সমাজকে বিভক্ত করে ফেলেছিলেন, এ থেকে মার্কিন সমাজ কীভাবে বেরিয়ে আসবে-সেটা এ মুহূর্তে একটা বড় প্রশ্ন। একদিকে ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’-শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ও এ আধিপত্যকে কেন্দ্র করে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের জন্ম; অন্যদিকে অবহেলিত কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী-এ দুয়ের মাঝে তিনি কীভাবে সমন্বয় করবেন? তাকে উভয় সম্প্রদায়কেই আস্থায় নিতে হবে। বাইডেনের জন্য এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ট্রাম্পের অনেক নীতি বিশ্ব আসরে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বেশ নষ্ট করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কোভিড-১৯-এর ‘দ্বিতীয় ঢেউ’। এই নিবন্ধ যখন লিখছি, তখন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩,৯৩,৯২৮ জন আর আক্রান্ত ২,৩৬,১৬,৩৪৫ জন (১৪ জানুয়ারি)। বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। অথচ ট্রাম্পের ভ্রান্তনীতির কারণে করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। আফগান আগ্রাসনের পর থেকে (২০০১ থেকে) যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের পেছনে খরচ করেছে ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়াতে যুদ্ধে এই অর্থ খরচ হয়েছে (সিএনবিসি, ২০ নভেম্বর, ২০১৯)। একটি নিউজ পোর্টালের মতে, এই যুদ্ধে ইরাকের মারা গেছে ১৪,৫৫,৫৯০ জন আর মার্কিন সেনা মারা গেছে ৪৮০১ জন। অন্যান্য দেশের সেনা মৃত্যুর সংখ্যা ৩,৪৮৭ জন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেটরের অভাবে হাজার হাজার মানুষ মারা গেল, সেখানে যুদ্ধে খরচ হয়ে গেল ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে কত ভেন্টিলেটর কেনা যেত? নিউইয়র্কের গভর্নর কুমো বলেছেন, সংকটের সময় একটি ভেন্টিলেটরের দাম ৫০ হাজার ডলারে পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিল। অথচ মাত্র ৩ হাজার ডলার দিয়ে একটি ভেন্টিলেটর তৈরি করা সম্ভব। বাইডেনকে তাই এদিকে নজর দিতে হবে। করোনার সময় অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। চাকরির বাজার সৃষ্টি করা বাইডেনের জন্য হবে আরেকটি চ্যালেঞ্জ। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৩৩ সালে সর্বোচ্চ ২৪.৯ ভাগ ছিল বেকারত্বের হার। ১৯৪৪ সালে ছিল সবচেয়ে কম, ১.২ ভাগ। কোভিড-১৯-এর কারণে (২০২০) তা ১০.৩ ভাগে দাঁড়িয়েছে (howmuch.net)। ২০২১ সালে বাইডেন অর্থনীতির চাকা কতটুকু ঘোরাতে পারবেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। চীনের সঙ্গে ‘বাণিজ্যযুদ্ধের’ যদি সমাপ্তি না হয়, তাহলে অর্থনীতির চাকাও ঘুরবে না। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ এখন ১.০৫ ট্রিলিয়ন ডলার (মোট বৈদেশিক ঋণ ৭.০৭ ট্রিলিয়ন ডলার)। এটাও একটা সংকট তৈরি করতে পারে। কোভিড-১৯ বিশ্বায়নকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বায়ন যে প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছিল, তা পূরণ করতে পারেনি। অমর্ত্য সেন কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে যে ‘নতুন পৃথিবীর’ কথা বলছেন, সেখানে স্পষ্টতই চীন একটি বড় ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। চীনের নেতৃত্বে বিশ্বায়নের যে প্রক্রিয়া শুরু হবে, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে, এ ব্যাপারেও মনোযোগ থাকবে অনেকের। চীনের নেতৃত্বে একটি ‘ভ্যাকসিন সিল্ক বোর্ড’-এর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বিস্তারিত আমরা জানি না। ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন এনেছিলেন। এটা এখন কোন পর্যায়ে যায়, তা-ও দেখার বিষয়। সব মিলিয়ে বাইডেনের প্রেন্সিডেন্সি হবে ২০২১ সালের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। Jugantor 18.1.2021

মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য একটি কালো দিন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে বুধবার যা ঘটল, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৪ বছরের ইতিহাসে একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে বুধবার যা ঘটল, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৪ বছরের ইতিহাসে একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। নিয়মমাফিক ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রায়কে অনুমোদন দেওয়ার জন্য ক্যাপিটল হিলে কংগ্রেস সদস্যরা যখন সমবেত হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনা। ট্রাম্প সমর্থকরা ভবনটি দখল করে নিল। পিস্তল উঁচিয়ে লন্ডভন্ড করল ভবনের বেশকিছু রুম, যেখানে কংগ্রেস সদস্যদের অফিস। শুধু তা-ই নয়, প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির অফিস কক্ষ দখল করে তার চেয়ারে বসে সেলফিও তুলল কেউ কেউ। বিক্ষোভের ঘটনায় মারাও গেলেন চারজন। একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। জো বাইডেন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট পেয়েছিলেন ৩০৬ আর ট্রাম্প পেয়েছিলেন ২৩২। এরপর একের পর এক ‘নাটক’ করে চলছিলেন ট্রাম্প। দেশব্যাপী তার সমর্থকদের দিয়ে তিনি ৬২টিরও বেশি মামলা করেছিলেন নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু একটিতেও তিনি বিজয়ী হতে পারেননি। নিয়ম অনুযায়ী মার্কিন কংগ্রেস (উচ্চকক্ষ ও নিুকক্ষ) যৌথ বৈঠকে এই ফলাফল অনুমোদন করবে। আর এটা আটকাতেই ট্রাম্প তার সমর্থকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ক্যাপিটল হিলে জমায়েত হতে। তারপরই ঘটল এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এই ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় বয়ে গেলেও মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য এটা ছিল একটি কালো দিন। একজন ব্যক্তি, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতা ধরে রাখার নানা কৌশল গণতন্ত্রকে যে কত বড় ক্ষতি করতে পারে-এই ঘটনা তার বড় প্রমাণ। সংবিধান অনুযায়ী যৌথ সভায় ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স সভাপতিত্ব করেন। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের অনুরোধ উপেক্ষা করে পেন্স জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনুমোদন করেন। ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নেবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রচর্চার ইতিহাসে গেল বুধবারের ঘটনা একটি কালো ‘দাগ’ হয়ে থাকবে। এ ধরনের ঘটনা খোদ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সুশাসনের জন্য এক ধরনের অশনিসংকেত। এই ঘটনা দক্ষিণপন্থিদের উৎসাহ জোগাবে প্রচলিত আইন ও সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করতে। কেননা ট্রাম্পের জমানায় উগ্র দক্ষিণপন্থিরা শক্তিশালী হয়েছে। তার শাসনামলে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ণবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আশঙ্কা যে জায়গায় তা হচ্ছে, ট্রাম্পের বিদায়ের পরও মার্কিন সমাজে এই বর্ণবাদ থেকে যাবে আরও কিছুদিনের জন্য, যা সমাজব্যবস্থাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে রাখবে। ট্রাম্প যে ‘রাজনীতি’ মার্কিন সমাজে সৃষ্টি করে গেলেন, এই ক্ষত সারিয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে। ভয়ের কারণ আরও একটি-ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করলেও হারিয়ে যাবেন না। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন। ২০২৪ সালের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি যদি পুনরায় রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন চান, আমি অবাক হব না। তার প্লাস পয়েন্ট একটা-তিনি রিপাবলিকান শিবিরে তার সমর্থকদের নিয়ে একটা বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এরা তার পাশে থাকবে। ফলে তিনি যদি আগামী দিনগুলোয় রিপাবলিকান পার্টিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যান, কিংবা তার সমর্থকদের বের করে এনে আরেকটি পার্টির জন্ম দেন, আমি তাতে অবাক হব না। দ্বিতীয়ত, একজন উগ্র মানসিকতাসম্পন্ন ও খ্যাপাটে লোক সমাজ ও রাষ্ট্রের যে কত ক্ষতি করতে পারেন, ট্রাম্প তার বড় প্রমাণ। রাষ্ট্রপরিচালনায় ব্যক্তিস্বার্থকে তিনি বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় আদর্শ, রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি কখনো। তিনি নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে অনেক ক্ষতি করলেন। তৃতীয়ত, তার যে আদর্শ, তাকে অনেকে জনতুষ্টিবাদ হিসেবে অভিহিত করেন এবং ক্ষমতা ধরে রাখার সব অপকৌশল, বিশ্বের কিছু কিছু দেশে তার একটি সমর্থকশ্রেণি তৈরি করেছিল। ব্রাজিল, ব্রিটেন, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডের নেতারা তাকে অনুসরণ করছেন। ওইসব দেশেও গণতন্ত্রের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন তাদের নেতারা। এখন ট্রাম্পের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে এদের বিদায় কতটুকু নিশ্চিত হবে, এটা একটা প্রশ্ন। চতুর্থত, সমর্থকদের দিয়ে কংগ্রেস ভবন দখল করা মার্কিন সমাজে এক ধরনের ‘গুন্ডাতন্ত্রের’ জন্ম দিয়েছে। এই ‘গুন্ডাতন্ত্র’ রাষ্ট্রব্যবস্থাকেও হুমকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। পঞ্চমত, পর্যবেক্ষকরা কেউ কেউ এই ঘটনাকে এক ধরনের ‘সিভিলিয়ান কুদেতা’ বা সিভিলিয়ান সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন (আটলান্টিক, ৬ জানুয়ারি)। এটা গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য ‘ওয়েকআপ’ কল। ক্ষমতাসীন শক্তি নির্বাচনে হেরে গেলে তার সমর্থকদের নিয়ে কত বড় ‘ঘটনা’ ঘটাতে পারেন, বুধবারের ঘটনা তার একটি প্রমাণ। যষ্ঠ, ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডে অতীতে তাকে ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সে যাত্রায় তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন বটে। কিন্তু জো বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার পর কিংবা ২০ তারিখের আগেও তিনি পুনরায় ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন হতে পারেন (এনবিসি)। সপ্তম, ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত তার আপত্তি রেখেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। তার ভাষ্যমতে, ‘নির্বাচনে কারচুপি’-এই বিষয়টি নিয়ে তিনি আগামী দিনে ‘রাজনীতির জল’ ঘোলা করতে পারেন। একজন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদায় নেবেন। কিন্তু গেল চার বছরে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি করে গেলেন, তা খুব সহজেই কাটিয়ে ওঠা কষ্টকর। তিনি একটি বিভক্ত সমাজের জন্ম দিয়ে গেলেন। জো বাইডেন এই বিভক্তি কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন, তা এক বড় প্রশ্ন। অতীতে ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন হওয়া, ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ মুহূর্তে তার ফেসবুক, টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া, ব্যক্তি ট্রাম্পকে যতটা না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে প্রেসিডেন্ট পদটিকে। একজন প্রেসিডেন্ট যিনি বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবেন, তিনি বিতর্কের মধ্যে এবং অসম্মানজনকভাবে বিদায় নিতে যাচ্ছেন। অতীতে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এভাবে বিদায় নেননি। যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন (রিপাবলিকান, ১৮৬১-১৮৬৫) একবার বলেছিলেন, গড়ন rule begets mob rule (Daily Signal, 6 January)। উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসন উচ্ছৃঙ্খলতারই জন্ম দেয়। বুধবার ক্যাপিটল হিলে শত শত উচ্ছৃঙ্খল জনতার প্রবেশ ও আইনপ্রণেতাদের চ্যালেঞ্জ করা প্রায় ১৫৯ বছর আগে আব্রাহাম লিংকনের কথারই প্রতিধ্বনিত করল। এই উচ্ছৃঙ্খলতা গণতন্ত্র নয়। এটা গুন্ডাতন্ত্র। গণতন্ত্র চর্চার জন্য এই উচ্ছৃঙ্খলতা কখনই কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনতে পারে না। Jugantor 8.1.2021

বিশ্বে গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায় করোনাভাইরাস

চলতি বছর অনেক বিষয়ের সঙ্গে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ অন্যতম একটি আলোচিত বিষয় হয়ে থাকবে। এ করোনাভাইরাস বিশ্বের অনেক দেশে গণতন্ত্রের বিকাশকে যে বাধাগ্রস্ত করেছে, তা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। গণতন্ত্রের ওপর নজরদারি সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া’ কর্তৃক প্রকাশিত এক গবেষণায় এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বে প্রতি ১০টি দেশের মধ্যে ছয়টিরও বেশি করোনা মহামারীর কারণে এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকিস্বরূপ। গেল বছরের (২০২০) মাঝামাঝি এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। তাদের তৈরি করা সূচকে বাংলাদেশেরও নাম রয়েছে। তবে আশার কথা, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরিস্থিতি আমাদের চেয়েও নাজুক। সংস্থাটি বলছে, ৬১ শতাংশ দেশ এমন কড়াকড়ি আরোপ করেছে, যা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য হয় অবৈধ বা অন্যায্য কিংবা অপ্রয়োজনীয়। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ৪৩ শতাংশ দেশ এ ক্যাটাগরিতে পড়ে। ৯০ শতাংশ কর্তৃত্বপরায়ণ দেশের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। বস্তুত, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এক ধরনের অশনিসংকেত। সনাতন গণতান্ত্রিক সমাজে যে প্র্যাকটিস, অর্থাৎ মুক্তচিন্তা, অবাধ ভোটাধিকার, আইনের শাসন-এ সবই কোনো কোনো দেশে ব্যাহত হচ্ছে। কোভিড-১৯কে কেন্দ্র করে ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করা, বিশেষ আইন চালু করা, সংবিধানে পরিবর্তন এনে (রাশিয়া) ক্ষমতায় থাকাকে দীর্ঘায়িত করা- এ ধরনের প্রবণতা অনেক দেশে লক্ষ করা যায়। International IDEA Supporting Democracy Worldwide-এর মতে, Governments around the world have assembled emergency powers to respond to the Covid-19 pandemic, at times underminig human rights and democratic processes। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও International IDEA’র সমন্বয়ে ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে The †lobal Monitor of Covid-19's Impact on Democracy and Human Rights নামে একটি উদ্যোগ, যারা ১৬২টি দেশে কোভিড-১৯ কীভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আঘাত করছে, তা মনিটর করছে। ১৪ আগস্ট (২০২০) তাদের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশিয়ায় যেসব দেশে Authoritarian regime বা কর্তৃত্ববাদী শাসন রয়েছে, সেখানে মহামারির সময় কিছু কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগজনক। সুইডেনের গোথেনবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের V-Dem Institute বিশ্বের গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে কাজ করে। তারা ডেমোক্রেসি রিপোর্ট ২০২০ প্রকাশ করেছে। V-Dem বা Varieties of Democracy তাদের রিপোর্টে বলছে : ১. ২০০১ সালের পর থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রবণতা বেড়েছে। ৯২টি দেশ (বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৪ ভাগ) এখন কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায়; ২. হাঙ্গেরি এখন নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায় (electoral authoritarian regime); ৩. বিশ্বের বড় অর্থনীতি ও এক সময়ের সামরিক বাহিনীর দেশ ব্রাজিল, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায়; ৪. ভারত বিশ্বে একটি বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিতি পেলেও দেশটি তার গণতান্ত্রিক স্ট্যাটাস হারিয়ে ফেলেছে। এর কারণ হচ্ছে- মিডিয়ার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন, সিভিল সোসাইটির ক্ষমতা হ্রাস, উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ইত্যাদি; ৫. ৩১টি দেশে মিডিয়ার ওপর হামলা ও মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত স্পষ্ট হয়েছে, যা দুবছর আগে ছিল মাত্র ১৯টি দেশে; ৬. সুষ্ঠু নির্বাচনের ইনডেক্সে (Clean Elections Index) ১৬টি দেশের অবনতি হয়েছে; ৭. ৩৭টি দেশে মিডিয়া সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে এবং সিভিল সোসাইটির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে; ৮. বিশ্বে ২০০৯ সালে গণতান্ত্রিক শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল শতকরা ৫৪ ভাগ মানুষ, ২০১৯ সালে এর পরিমাণ শতকরা ৪৯ ভাগ। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অবনতি হয়েছে; ৯. ২০০৯ সালে বিশ্বের শতকরা ৬ ভাগ মানুষ কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায় ছিল, ২০১৯ সালে এর পরিমাণ শতকরা ৩৪ ভাগ; ১০. ২০০৯ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বে শতকরা ২৭ ভাগ দেশে আন্দোলন হয়েছে, ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৪৪ ভাগ। V-Dem Institute তাদের প্রতিবেদনে ১০টি দেশের নাম উল্লেখ করেছে, যারা লিবারেল ডেমোক্রেসি হিসেবে পরিচিত ছিল; কিন্তু ২০১৯ সালে এসে কর্তৃত্ববাদী শাসনে পরিণত হয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে হাঙ্গেরি, তুরস্ক, পোল্যান্ড, সার্বিয়া, ব্রাজিল, ভারত, মালি, থাইল্যান্ড, নিকারাগুয়া ও জাম্বিয়া। লিবারেল ডেমোক্রেসি সূচকে ২০০৯ সালে এ দেশগুলো পরিচিত ছিল লিবারেল ডেমোক্রেসি অথবা ইলেক্টোরাল ডেমোক্রেসি হিসেবে। কিন্তু ২০১৯ সালে এসে তাতে পরিবর্তন আসে; তাদের পরিচিতি এখন ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি অথবা গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র হিসেবে। ওইসব দেশে নিয়মমাফিক নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু সেই নির্বাচনে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম দিয়ে (তুরস্ক, ভারত, ব্রাজিল) ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। নির্বাচন হয়েছে বটে; কিন্তু নির্বাচনে বহুদলীয় অংশগ্রহণ ছিল না, বরং একদলীয় কর্তৃত্ববাদী আচরণ আমরা লক্ষ করি। তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন অব্যাহত রেখেছেন এবং তিনি তার কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্য দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকদের পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন। বিশ্বের বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের নাম বারবার উচ্চারিত হয়। কিন্তু মোদির উত্থানের পরপরই ভারতের গণতান্ত্রিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রের বিকাশকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভারতে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের বদলে জন্ম হয়েছে ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ এক সরকারব্যবস্থা, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য বেমানান। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসনারোর (জানুয়ারি ২০১৯ থেকে প্রেসিডেন্ট) রাজনৈতিক দল সোশ্যাল লিবারেল পার্টি সেখানে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হচ্ছেন তার আদর্শ। বলসনারো ট্রাম্পকেই অনুসরণ করেন। এক সময়ের লিবারেল মতাদর্শে বিশ্বাসী বলসনারো নির্বাচনকে ব্যবহার করছেন তার ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে। দেখা গেছে, কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব তাদের সুযোগ করে দিয়েছে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার। এ মহামারির মধ্যেও কোথাও কোথাও নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণা সীমিত করে, বিরোধীদের তৎপরতায় বিধিনিষেধ আরোপ করে ক্ষমতাসীনরা পার পেয়ে গেছেন এবং নিজ দেশে এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু করেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের উত্থান বিশ্বে গণতান্ত্রিক চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ‘ফ্রিডম হাউস’ তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, ১৯৯৫ সালের পর এই প্রথম সবচেয়ে কম দেশের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যাদেরকে সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক দেশ বলা যাবে। গণতন্ত্রের যাত্রাপথ থেকে বেরিয়ে আসার এই যে প্রবণতা, যেখানে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করছেন, তাকে বলা হচ্ছে de-democratiæation (Cas Mudde এবং Cristobal Rovira Kaltwasser)। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে যাওয়া, গণতন্ত্র চর্চাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলোকে বিসর্জন দেওয়া। ফ্রিডম হাউসের রিপোর্টে ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, মন্টেনেগরোর গণতান্ত্রিক বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে কয়েকটি দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে সেখানে শাসনব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এসেছে (কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা), তা উল্লেখ করা হয়েছে (আজারবাইজান, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরঘিজিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান)। তবে সেই সঙ্গে এ অঞ্চলের বেশ ক’টি দেশ যে গণতন্ত্র সংহত করেছে, তাও উল্লেখ করা হয়েছে (স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্টোনিয়া)। এখন স্লোভেনিয়া কিংবা লিথুয়ানিয়ার গণতন্ত্র সুসংহত করার মডেল ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য মডেল হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা, সেটাই একটা প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। এক সময় সাহায্যের অন্যতম শর্ত হিসেবে গণতন্ত্র চালু করা কিংবা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে প্রমোট করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হতো। এখন জো বাইডেন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপর গুরুত্ব দেবেন কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। গণতান্ত্রিক ‘ডিক্লাইন’ বা অধঃপতনের জন্য কোভিড-১৯কে দায়ী করা হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা এই মহামারিটি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। ২০২১ সালেও তারা এটা ব্যবহার করবেন। বিখ্যাত নিউজ ম্যাগাজিন টাইম-এর এক প্রতিবেদনেও (২ অক্টোবর, ২০২০) উল্লেখ আছে সে কথা। ইউরোপের একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান ‘দ্য সেন্টার ফর ইকোনমিক পলিসি রিসার্চ’ তাদের এক গবেষণাপত্রে মন্তব্য করেছে এভাবে- ‘Democracy has been in recession for over a decade and many fear that Covid-19 will accelerate this trend' (VOXEU/CEPR, Covid-19 and the future of democracy, 20 May, 2020)। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। গণতন্ত্রের অধঃপতন শুরু হয়েছিল, তা অব্যাহত থাকবে। সুতরাং ২০২১ সালটি গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের উত্থান ‘পপুলিজম’ বা জনতুষ্টিবাদকে শক্তিশালী করেছিল। এতে গণতন্ত্রের ক্ষতি হয়েছিল। এখন বাইডেনের উত্থান গণতন্ত্রের বিকাশকে শক্তিশালী করবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। Jugantor 3.1.2021

বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে কতটুকু

গেল ২৭ ডিসেম্বর করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যাপী মোট ১৭ লাখ ৬৬ হাজার ৭৯৬ জনের মৃত্যু ও জো বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ের পর যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে নতুন বছরে আদৌ কি কোনো পরিবর্তন আসবে? এই দুটো বিষয় ছিল ২০২০ সালের আলোচনার অন্যতম বিষয়। কভিড-১৯ সারা বছর দাপিয়ে বেড়িয়েছে এবং নভেম্বরে এসে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম কভিড-১৯-এর ‘দ্বিতীয় ঢেউ’। এই ‘ঢেউ’ আবারও ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হেনেছে। শুধু তাই নয়, অ্যানটার্কটিকায় এই প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে ২০২১ সালেও করোনাভাইরাস দাপিয়ে বেড়াবে। অন্যদিকে নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয় সহজ ছিল না। চূড়ান্ত ফলাফলে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে চলতি ২০২১ সাল সারা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে তার দিকে তিনি বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারবেন কি না, কিংবা আনলে কতটুকু পরিবর্তন আনবেন তিনি? বিশ্ব এখনো সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস সারা বছরে বিশ্ববাসীকে একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যে রেখেছিল। একদিকে মৃত্যু, অন্যদিকে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের অভাব এবং নভেম্বরে করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ সারা বিশ্বকে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ডিসেম্বরে এসে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও তার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হলেও, উন্নয়নশীল বিশে^র দেশগুলো এই ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে। চলতি ২০২১ সালে উন্নয়শীল বিশে^র দেশগুলোর সবাই ভ্যাকসিন পাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। এই ভ্যাকসিন উন্নত বিশ্ব ও উন্নয়নশীল বিশে^র মধ্যে একটা পার্থক্য তৈরি করেছে। চলতি ২০২১ সালের এই পার্থক্য ঘুঁচে যাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। স্পষ্টতই ২০২১ সালেও করোনাভাইরাস কভিড-১৯ হবে আলোচনার অন্যতম বিষয়। আমরা ২০২১ সালে দেখব এক ভিন্ন জগৎ। অর্থাৎ নতুন ধরনের এক বিশ্বায়নের জন্ম হতে যাচ্ছে, যেখানে করপোরেট হাউজগুলোর আধিপত্য থাকবে না। ধনী দেশগুলোর কর্তৃত্ব থাকবে না। ২০২১ সালে দুনিয়া প্রত্যক্ষ করবে ‘বি-বিশ্বায়নের’ নানা উদ্যোগ। এই উদ্যোগগুলো হবে আলোচনার অন্যতম বিষয়। কিছু দৃষ্টান্ত দিই। কভিড-১৯ পুরো বিশ্বব্যবস্থায় বড় সংকট সৃষ্টি করেছিল, যা কাটিয়ে ওঠা যায়নি। করোনাভাইরাস বিশে^র সর্বত্র গরিব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিদিনের আয় ১ দশমিক ৯০ ডলার ধরে এই আয় নিশ্চিত করতে না পারায় ২০২০ সালে লাখ লাখ লোক আরও গরিব হয়ে গেছে (২০২১ সালে পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে এই সংখ্যা ২৩.৪ মিলিয়ন, লাতিন আমেরিকাতে ২৯.১ মিলিয়ন, মধ্যপ্রাচ্যে ৩১.৮ মিলিয়ন ধরা হয়েছে। সূত্র : বিশ্বব্যাংক)। গরিব দেশগুলো এক ধরনের ‘ঋণের ফাঁদ’-এ পড়বে। অর্থাৎ তারা ঋণ শোধ করতে পারবে না। গরিব দেশগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেবে। বেকারত্ব বেড়ে যাবে। একে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে। সর্বত্র ‘ডিজিটালাইজেশন’-এর ফলে মানুষ কাজ হারাবে। বাধ্যতামূলক ছুটিতে যেতে বাধ্য হবে। কাজের ঘণ্টা কমে যাওয়ায় আয় কমে যাবে। স্বাস্থ্যসেবায় খরচ বেড়ে যাবে। স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে। বিশ্বব্যাংকের মতে, আগে যেখানে এ খাতে প্রতিদিন ব্যয় হতো ১.৯০ ডলার, এখন তা বাড়বে ৩.২০ ডলার প্রতিদিন (দক্ষিণ এশিয়া)। করোনা সময়কালে ১৬০টি দেশের ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন শিশুর স্কুলে যায়া বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ‘শিক্ষার যে অধিকার’, তা থেকে শিশুরা বঞ্চিত হয়েছে। নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া তাদের জন্য হবে কঠিন। কভিড-১৯-এর কারণে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। কিন্তু এখানে বড় বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। ‘জেন্ডার গ্যাপ’ বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে; যা অব্যাহত থাকবে। কভিড-১৯-এর কারণে কাজের সন্ধানে মানুষ শহরমুখী হয়েছে এবং এ সংখ্যা ২০২১ সালে বাড়বে এবং শহরের পরিবেশের জন্য তা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। গরিব দেশগুলো তাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সংকুচিত করতে বাধ্য হয়েছে এবং এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। এমনই এক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করবেন। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের আস্থা এবং সেই সঙ্গে বিশ্বকে করোনা পূর্বকালীন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া এ দুটো বিষয় থাকবে তার অগ্রাধিকার তালিকায়। একটি স্থিতিশীল বিশ্ব মানুষ দেখতে চায়। প্রত্যাশাও করে তার কাছ থেকে। তবে বাইডেনের জন্য সমস্যা আছে অনেকগুলো। এক. বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থায় স্থিতিশীলতা আনা। কভিড-১৯-জনিত কারণে উন্নয়নশীল বিশে^র ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এর পরিমাণ ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারে। এই দেশগুলো এখন আর ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। ৮১টি দেশ আইএমএফের কাছে আবেদন করেছে অর্থছাড়ের। ২০২১ সালের শেষের দিকে এদের প্রয়োজন হবে অতিরিক্ত আরও সাত ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালেই জাম্বিয়া ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গেছে। জি-২০-ভুক্ত দেশগুলো এ ব্যাপারে একটি ‘Common Framework’ রচনা করলেও, মার্কিন কংগ্রেসের সমর্থন তাতে পাওয়া যায়নি। সংগত কারণেই জো বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা এখানে হবে বড় (Atlantic Council, December 16, 2020)। ২. যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ বড় ধরনের আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেকার সমস্যা বেড়েছে। একমাত্র চীনে কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। চীন একমাত্র দেশ, যেখানে করোনাভাইরাস অর্থনীতিকে তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু চীনের দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ছিল ব্যর্থ। বাইডেন প্রশাসনকে তাই কভিড-পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় তার দক্ষতা দেখাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে। এটা কতটুকু সফল হবে, তা দেখার বিষয়। বাইডেন প্রশাসনের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে বিশ্বকে স্থিতিশীল রাখতে, এমনকি করোনামুক্ত পৃথিবীর জন্য যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতা জরুরি। অর্থনীতির ক্ষেত্রে পরস্পর নির্ভরশীল একটা সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা-পরবর্তী বিশে^ ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতির এক নম্বর অবস্থান থেকে ছিটকে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র। ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান থাকবে দুই নম্বরে। চীনের অবস্থান থকবে এক নম্বরে। ভারতের বর্তমান অবস্থান (২০২০) বিশে^র ৬ নম্বরে। কিন্তু ২০৩০ ও ২০৩৫ সালে ভারতের অবস্থান থাকবে তৃতীয়। ২০৩০ সালে এই দেশগুলোর জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩১৭৩১ বিলিয়ন ডলার (চীন), ২২৯২০ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্র ও ৭৯৭২ বিলিয়ন ডলার (ভারত)। কিন্তু চীন ও যুক্তরাষ্ট্র কভিড-১৯ পরবর্তী যুগে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও ভারত পারবে কি না এটা একটা প্রশ্ন। কভিড যুগে ভারতের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। এ ক্ষেত্রে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যদি পরস্পর নির্ভরশীল একটা সম্পর্ক গড়ে না ওঠে, তাহলে বিশ্ব অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। বাইডেন প্রশাসনের দায়িত্ব ও কর্তব্য তাই অনেক বেশি। বিশ্লেষকরা বাইডেন প্রশাসনের জন্য ১০টি করণীয় নির্ধারণ করেছেন, যা বিশে^ স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট। ইয়েমেন সংকট আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক আলোচিত হলেও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের ইয়েমেনের বিরুদ্ধে বিমান হামলা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এই বিমান হামলায় সেখানে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার শিশু ওষুধের অভাবে ইতিমধ্যে মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে মানবিক সাহায্য শুরু করবে এই প্রত্যাশা সবার। মার্কিন কংগ্রেস একটি War Powers Resolution পাস করলেও ট্রাম্প তাতে ভেটো দেন। এই আইনের মাধ্যমে কংগ্রেস ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্পের সৌদি আরবপ্রীতির কারণে যুদ্ধ বন্ধ করা যায়নি। বাইডেন প্রশাসনের এখন দায়িত্ব হবে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া। আরব আমিরাত লিবিয়ায় জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করায় লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধের কোনো সমাধান হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে খবধযু ষধি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওইসব দেশে কোনো অস্ত্র রপ্তানি করতে পারবে না, যে দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। অথচ এই আইন ভঙ্গ করে আরব আমিরাতের সঙ্গে ২৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। আমিরাত যেখানে ইয়েমেনে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, সেখানে আইন অনুযায়ী (Leahy law) আমিরাতকে অস্ত্র বিক্রি করা যাবে না। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের Arms Export Control Act অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশকে ওই দেশের নিজের নিরাপত্তা ও সীমান্ত রক্ষার জন্যই শুধু অস্ত্র বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে বিক্রি করা অস্ত্র নিজ দেশের নিরাপত্তা স্বার্থে ব্যবহৃত হয়নি। ব্যবহৃত হয়েছে ইয়েমেনে গণহত্যায়। বাইডেন প্রশাসনকে এখন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। কেননা অভিযোগ আছে, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত ইসরায়েলের স্বার্থে কাজ করছে। এখন বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলি স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারবে কি না সেটাই দেখার বিষয়। এটা ভুলে গেলে চলবে না নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হারিসের স্বামী ইহুদি ধর্মাবলম্বী এবং কমলা হারিস অতীতে একাধিকবার ইসরায়েলের স্বার্থে কথা বলেছেন। ইউটিউবে তার বক্তৃতা আছে, যেখানে কমলা হারিস ইসরায়েলের নিরাপত্তার স্বার্থে ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ ও দেশটির নিরাপত্তার পক্ষে কথা বলেছেন। এখন বাইডেন কি তার ভাইস প্রেসিডেন্টকে অস্বীকার করতে পারবেন? মনে হয় না। শুধু তা-ই নয়। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ট্রাম্পের এই নীতি ইসরায়েলে জনপ্রিয় হলেও ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করে ট্রাম্প ইসরায়েলের সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন। অথচ ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যের নীতি ছিল প্রো-ইসরায়েলি, অর্থাৎ ইসরায়েলঘেঁষা। কিন্তু বাইডেন কি তা করবেন? বাইডেনের জন্য একটা সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার। তিনি কী করবেন, সেটাই দেখার বিষয়। মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সঙ্গে ইরান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত জার্মানি মেনে নেয়নি। অথচ জার্মান JCPOA ev Joint comprehensive plan of Action -এর সদস্য। এখানে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আবারও ঔঈচঙঅ চুক্তিতে ফিরে যাবে। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে কিছু অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। ইরান কভিড-১৯ মোকাবিলায় আইএমএফ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্পের বিরোধিতার কারণে এই পরিমাণ অর্থ ছাড়করণ হয়নি। এখন বাইডেন যদি অর্থ ছাড়করণের অনুমতি দেন, তাহলে তা দুদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কভিড-১৯ মোকাবিলা আর বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি এই দুটো বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হবে ২০২১ সালের বিশ্ব রাজনীতি। এ ক্ষেত্রে বাইডেন কী ভূমিকা নেন, সেটাই হচ্ছে মূল বিষয়। তবে তিনি ট্রাম্প অনুসৃত নীতি থেকে বেরিয়ে আসবেন এটাই প্রত্যাশা করছেন সবাই। Desh Rupantor 3.1.2021