রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি কি পরিত্যক্ত?

একাধিক কারণে বাংলাদেশের জন্য পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক আরো উন্নত হবে, যাতে কি না বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক নিম্নতম পর্যায়ে রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু ও সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ, তার সমাধান হয়নি। দ্বিতীয়ত এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক বিশাল বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সৃষ্টি হবে।

চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতা ত্যাগ,
একটি অনির্বাচিত সরকারের দু’বছর ক্ষমতায় থাকা ও ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মহাজোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ১৪ মাস পর যে প্রশ্নটি এখন করা যায় তা হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ যে পূর্বমুখীনীতি গ্রহণ করেছিল তা কি পরিত্যক্ত? মহাজোট সরকার কি পূর্বমুখী নীতি বাতিল করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র হিসেবে বিষয়টি আমার কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আামাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুব একটা অভিজ্ঞ নন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যারা তার সঙ্গে আছেন, তারা তাকে সুপরামর্শ দেন বলেও আমার মনে হয় না। পররাষ্ট্র সচিব কোনো দিন বড় কোনো দেশে রাষ্ট্রদূত না হয়েই পররাষ্ট্র সচিব হয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার চেয়ে অভিজ্ঞ ও সিনিয়র কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও তার নিযুক্তিÑ একটা প্রশ্ন থেকে গেছেই। তাই যে ‘টিমটি’ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাজ করেন তারা তাকে সঠিক সময়ে সঠিক উপদেশটি দেন কি না, আমার তাতে সন্দেহ রয়েছে। পূর্বমুখী নীতির প্রসঙ্গটি এলো এ কারণেই।

আমি গত ১৪ মাস বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করে দেখেছি, ভারতের ওপর অতিমাত্রায় ‘নির্ভরশীলতা’ ছাড়া পররাষ্ট্রনীতির নতুনত্ব কিছু নেই। পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করেছিল চারদলীয় জোট সরকার। এতে পূর্বের অর্থাৎ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছিল। বর্তমান সরকার তো বিগত নির্বাচিত সরকারের প্রায় প্রতিটি বিষয়ই বাতিল করেছে। তাই সঙ্গত কারণেই ধারণা করা স্বাভাবিক যে, পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতিও পরিত্যক্ত। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে আমরা এ কথাটা শুনিনি কখনো। প্রধানমন্ত্রী যখন চীনে গেলেন, তখন গুজব উঠলো, আসলে পূর্বমুখী নয়, বরং কূটনৈতিক সৌজন্যতাবোধ থেকেই প্রধানমন্ত্রীকে যেতে হয়েছিল। আমাদের বৈদেশিক নীতিতে চীনের উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশী। উন্নয়নের অংশীদার। চীনের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় তার চীন সফর ছিল লো প্রোফাইল। যে যুক্তিতে তার ভারত সফর ছিল হাই প্রোফাইল। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে আমাদের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে চীন-বাংলাদেশ মহাসড়কের কথা বলেছেন। আগ্রহ দেখিয়েছেন। কিন্তু আমরা চীন-বাংলাদেশ ঘোষণায় যেটি পেয়েছি, তাতে মহাসড়কের প্রশ্নটি কোথাও নেই। ঢাকায় ফিরে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন, মিয়ানমার হয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক ও রেলযোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে চীন আগ্রহ দেখিয়েছে। একই সঙ্গে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করার ব্যাপারেও তাদের আগ্রহ রয়েছে। দুটি বিষয়ই আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগ্রহ এক জিনিস ও চুক্তি স্বাক্ষর এক জিনিস। আমি ধরে নিচ্ছি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সড়ক নির্মাণের প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। চীন এতে সম্মতি দিলে বা আরো আলাপ-আলোচনা কিংবা এর টেকনিক্যাল দিক ইত্যাদি বিষয় যৌথ ইশতেহারে থাকতো। তাহলে তা নেই কেন? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউ একজন এর ব্যাখ্যা দিলে আমি খুশি হবো।

এ মহাসড়ক নিয়ে আলোচনার আগে আমাদের বুঝতে হবে, ভারত এটি চায় কি না। মনে রাখতে হবে, চীন ২০০৩ সালে ‘কুনমিং উদ্যোগের’ কথা বলেছিল। চীন তার ইউনান প্রদেশ, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রস্তাব করেছিল। বাংলাদেশ ওই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিল। বাংলাদেশ ওই সময় তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতিও প্রণয়ন করেছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য তা ছিল এক নতুন অধ্যায়। কেননা পূর্বের দেশগুলো যা একটি সম্ভাবনার দ্বার সৃষ্টি করেছিল, তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ছিল উপেক্ষিত। পাঠক স্মরণ করার চেষ্টা করুন, বিগত জোট সরকারের সময় (২০০১-২০০৬) মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। শুধু তাই নয়, থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা বাংলাদেশে এসে (২০০২) একই বিমানে করে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে থাইল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন। কূটনীতির ইতিহাসে এটি এক বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের পূর্বমুখী কূটনীতি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ ভারতের ওপর থেকে তার নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারতো। দ্বিতীয় বাংলাদেশি পণ্যের বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হতে পারতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। ভারত চীনের কুনমিং উদ্যোগের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ভারতের ভয় যদি কুনমিং উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এ অঞ্চলে চীনের ‘কর্তৃত্ব’ ও ‘প্রভাব’ বৃদ্ধি পাবে। তাই ভারত এর বিকল্প হিসেবে গঙ্গা-মেকং উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রস্তাব করেছিল। ভারতের ইচ্ছা ও আগ্রহ দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম নির্ধারক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। পাঠকদের আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ভারত ইতিমধ্যে ১০ সদস্যবিশিষ্ট ‘এশিয়ান ডায়ালগ পার্টনারের’ সদস্য হয়েছে। বাংলাদেশ হতে পারেনি। বাংলাদেশ শুধু আসিয়ান রিজিওনাল ফোরামের সদস্য। সেদিন সম্ভবত খুব দূরে নয়, যেদিন ভারত আসিয়ানের পূর্ণ সদস্য হবে। সুতরাং চীন-মিয়ানমার-বাংলাদেশ সড়ক বাংলাদেশের জন্য জরুরি হলেও ভারত তা চাইবে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ ইচ্ছা তাই কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আগামীতে চীন বা মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা হবে বলেও মনে হয় না। তথাকথিত কানেকটিভিটির যুক্তি তুলে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর ও চীনকে তা ব্যবহার করতে দেয়ার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু ভারতের যে এ ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে তা আমাদের স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন যায়যায়দিনের কলকাতা প্রতিনিধি গত ২২ মার্চ তার প্রতিবেদনে। ভবিষ্যতে আদৌ যদি কোনো দিন সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে এবং তা যদি চীনকে ব্যবহার করতে দেয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নেয়, তাহলে তা ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

একাধিক কারণে বাংলাদেশের জন্য পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক আরো উন্নত হবে, যাতে কি না বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক নিম্নতম পর্যায়ে রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু ও সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ, তার সমাধান হয়নি। দ্বিতীয়ত এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক বিশাল বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সৃষ্টি হবে। আগামীতে এ অঞ্চলের বিশাল মুক্ত বাণিজ্য এলাকার সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য তা এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। শুধু পণ্যের বাজারই নয়, বরং জনসম্পদ রপ্তানির এক বড় ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ এখন জ্বালানি ও খাদ্য ঘাটতির দেশ। আমরা আগামীতে ‘জ্বালানি ট্র্যাপে’ পড়তে যাচ্ছি। মিয়ানমার আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র হতে পারে। আমরা মিয়ানমার থেকে জ্বালানি ও সেই সঙ্গে চাল আমদানি করতে পারি। মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস ২০১১ সালে যাবে থাইল্যান্ডে। চীনের ইউনান প্রদেশও মিয়ানমার থেকে গ্যাস নিচ্ছে। ভারতের আগ্রহ রয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার করণে এ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। তবে ভবিষ্যতে যাতে এ সুযোগ নষ্ট না হয়, তার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। চতুর্থত, বাংলাদেশি কৃষকরা মিয়ানমারের জমি ‘লিজ’ নিয়ে সেখানে চাষাবাদ করতে পারেন।

অতীতে মিয়ানমার রাজিও হয়েছিল। আমাদের ব্যর্থতা আমরা এ প্রকল্প নিয়ে বেশিদূর যেতে পারিনি। পঞ্চমত, মিয়ানমার-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। মিয়ানমার সীমান্তে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করে বাংলাদেশ সেখান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনও সম্ভব। বাংলাদেশও এখান থেকে সুবিধা নিতে পারে। তাই চীন তার পূর্বাঞ্চল ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস গাওদার (বেলুচিস্তান) বন্দর দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। প্রয়োজনে বাংলাদেশও এ গ্যাস ব্যবহার করতে পারে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে, যদি বাংলাদেশ পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করে। সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলে ভারতের ওপর আমাদের যে নির্ভরতা, সেই নির্ভরতা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো। তবে এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। পূর্বমুখিতার অর্থ নয় ভারতবিরোধিতা কিংবা ভারতকে বাদ দিয়েও নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দখল করে আছে। ভারতকে আমাদের প্রয়োজন আছে, আমাদের উন্নয়নের স্বার্থেই। কিন্তু ‘অতিমাত্রায়’ নির্ভরশীলতা নানা সঙ্কটের সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতির পূর্বমুখিতা, আমাদের জন্য নতুন এক দিগন্তের সৃষ্টি করতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মধ্য দিয়ে একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হলো পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি পুনরুজ্জীবনের। প্রধানমন্ত্রী যদি মিয়ানমার সফর করেন, তাহলে এটা আরো শক্তিশালী হবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আমাদের উচিত হবে না মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় জড়িত হওয়া। বাংলাদেশের স্বার্থেই মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পরে যে বিষয়টি এখন বেশি করে দেখার বিষয়, তা হচ্ছে বাংলাদেশ পূর্বমুখী নীতি নিয়ে অগ্রসর হয় কি না। আগামী দিনগুলোই প্রমাণ করবে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসে কি না।

ড. তারেক শামসুর রেহমান: আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, জাবি।
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ যায় যায় দিন, ০৩/০৪/১০]

0 comments:

Post a Comment