পশ্চিমা শক্তিগুলো লিবিয়ার বিরুদ্ধে যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে, তার নামকরণ করেছে ‘অপারেশন অডিসি ডন’। আর লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি এই যুদ্ধকে চিহ্নিত করেছেন ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে। এক সপ্তাহ আগে পশ্চিমা শক্তিগুলো এই সামরিক অভিযান শুরু করলেও এখন অব্দি যৌথ বাহিনী তাদের সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেনি। এমনকি এই অভিযান কার নেতৃত্বে পরিচালিত হবে, সেটা নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। যৌথ বাহিনী গাদ্দাফি বাহিনীর অবস্থানের ওপর তাদের বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে এবং গাদ্দাফি দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধের কথা বলছেন। লিবিয়ার পাশাপাশি ইয়েমেনের পরিস্থিতি ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে
। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ ২০১২ সালের মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিলেও আন্দোলনকারীরা তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। সেখানে আন্দোলন নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে।
লিবিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে অন্য আরব দেশগুলোর পরিস্থিতিকে একসঙ্গে মেলানো যাবে না। গণ-আন্দোলনে তিউনিসিয়ায় বেন আলি ও মিসরে হোসনি মোবারকের পতন ঘটলেও সেখানে যৌথ বাহিনী সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু লিবিয়ায় করেছে। যে যুক্তিতে সেখানে যৌথ বাহিনী হস্তক্ষেপ করেছে (বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা), বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন এক চিত্র। যৌথ বাহিনীর মূল টার্গেট হচ্ছে গাদ্দাফির অপসারণ। লিবিয়ার তেল সম্পদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থেই আজ লিবিয়াতে সামরিক আগ্রাসন পরিচালিত হচ্ছে। গাদ্দাফি বলছেন ‘ধর্মযুদ্ধ’ এর কথা। এই ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস অনেক পুরনো। ইতিহাস বলে প্রথম ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১০৯৫ সালে, যা দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর ধরে চলে, যার সমাপ্তি ঘটেছিল ১২৭২ সালে ৯ম ধর্মযুদ্ধ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই ধর্মযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল কট্টরপন্থী খ্রিস্টীয় মতবাদীদের সঙ্গে মুসলমানদের। আজ স্পষ্টতই মুসলমান একটি দেশের বিরুদ্ধে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী কয়েকটি দেশ একত্রিত হয়ে সামরিক হামলা পরিচালনা করে, তখন ‘ধর্মযুদ্ধ’—এর এক নয়া রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। হয়তো ব্যাপক অর্থে এই যুদ্ধকে ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। কিন্তু মুসলমান একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় পশ্চিমা দেশগুলোর হস্তক্ষেপ তথা সামরিক আগ্রাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
লিবিয়ার সঙ্কট স্পষ্টতই সমগ্র আফ্রিকার ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে বদলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র মাত্রেই জানেন ১৮৮৪ সালের বার্লিন সম্মেলনে আফ্রিকাকে বিভক্ত করা হয়েছিল। উত্তর আফ্রিকা, মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় তখন বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফরাসি ভাষাভাষি অঞ্চলে। এখন একুশ শতকে নতুন এক আফ্রিকার জন্ম হতে যাচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। কঙ্গো, রুয়ান্ডা কিংবা আইভরিকোস্টে ফ্রান্সের স্বার্থ ও প্রভাব থাকলেও, এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন লিবিয়ায় একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার। কেননা লিবিয়াকে বলা হয় এ অঞ্চলে যাওয়ার ‘গেটওয়ে’। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ফরাসী ভাষাভাষি তিউনিসিয়ায় সরকারের পতন ঘটেছে। আর আলজেরিয়ায়ও সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে আফ্রিকায় AFRICOM নামে নতুন একটি কমান্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী নাইজার ও সাদ-এর প্রাকৃতিক সম্পদের (কোবাল্ট, ইউরেনিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, প্লাটিনিয়াম) ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে নাইজারের ইউরেনিয়াম সম্পদ দেশটিকে ‘লিবিয়ার মতো একটি পরিস্থিতির’ দিকে আগামীতে ঠেলে দিতে পারে। আজ লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। যে অঞ্চল এক সময় ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ, একুশ শতকে এসে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করবে যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশবাদী চরিত্রের নতুন একটি রূপ। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছিল একটা ধারণাপত্র জবনঁরষফরহম অসবত্রপধহ উবভবহংবং; যেখানে বলা হয়েছে দীর্ঘ যুদ্ধের কথা। আফগানিস্তান ও ইরাকের পর এখন লিবিয়া। আফগানিস্তানে ও ইরাকে এখনও যুদ্ধ চলছে। আর যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে দেশ দুটিতে। আর তাতে করে লাভবান হচ্ছে কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। ইরাকে যেমনটি হয়েছিল। তেল বিক্রি করে দেশটির পুনর্গঠন। ঠিক তেমনটিই হতে যাচ্ছে লিবিয়াতে। লিবিয়ার তেল (ইতালি, ফ্রান্স আর জার্মানির ৮৫ ভাগ তেল আসে লিবিয়া থেকে) সম্পদ তাই যুদ্ধকে উসেক দিয়েছে। এতে করে লিবিয়া ভাগ হয়ে গেলে আমি অবাক হবো না।
এই যুদ্ধে লিবিয়ার জনগণ উপকৃত হবে না। সেখানে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হবে না। বরং এতে লাভবান হবে বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো। আর আমরা, উন্নয়নশীল বিশ্ব এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। কেননা উচ্চমূল্যে আমাদের তেল কিনতে হবে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১১১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সঙ্কট অব্যাহত থাকলে তেলের দাম আরও বাড়বে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তখন অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে এই তেল আমদানি করতে হবে। বলা ভালো আরব বিশ্ব তথা মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে তেলের রিজার্ভ ৬৬ দশমিক ২ ভাগ থেকে ৭৫ দশমিক ৯ ভাগ। এর মাঝে এককভাবে মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে ৫৬ ভাগ তেলের রিজার্ভ। ইউরোপে তেলের রিজার্ভ মাত্র ১ ভাগ, আর উত্তর আমেরিকায় ১৬ ভাগ। সুতরাং লিবিয়াতে যে তেলের বিপুল ভাণ্ডার রয়েছে (প্রমাণিত ৪৬.৪ বিলিয়ন ব্যারেল। কারো মতে, ৬০ বিলিয়ন ব্যারেল), সে ব্যাপারে পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলোর আগ্রহ থাকবে। এই তেল সম্পদের ওপর যদি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা শুধু লাভজনকই নয়, বরং বিশ্বে জ্বালানি নিয়ে যে রাজনীতি, তা নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব। এরই মধ্যে ইরাকের তেলের নিয়ন্ত্রণ ভার চলে গেছে ইন্টারন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানিগুলোর হাতে। তারাই এখন পরোক্ষভাবে ইরাকের সরকার পরিচালনা করছে। বিশ্বের তেলের দ্বিতীয় বৃহত্তম রিজার্ভ রয়েছে ইরাকে। সৌদি আরবে রিজার্ভের পরিমাণ ২৫৯ বিলিয়ন ব্যারেল (বিশ্ব রিজার্ভের ২৪ ভাগ), আর ইরাকের রিজার্ভের পরিমাণ ১১৩ বিলিয়ন ব্যারেল (বিশ্ব রিজার্ভের ১১ ভাগ)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে তেল সম্পদ রয়েছে, তার রিজার্ভের পরিমাণ মাত্র ২৩ বিলিয়ন ব্যারেল, বিশ্ব রিজার্ভের মাত্র ২ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রে তেলের চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছেই। সেখানে প্রতিটি পরিবারে একাধিক গাড়ি রয়েছে। গাড়ির জন্য প্রয়োজন সস্তায় জ্বালানি তেল। এই তেল আসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। সুতরাং বিশ্ব তেল রিজার্ভের ওপর নিয়ন্ত্রণটা যে জরুরি, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। তেলের জন্যই ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা হয়েছিল এবং দেশটি দখল করে নেয়া হয়েছিল। আর আজ এই তেলের জন্যই লিবিয়ায় আক্রমণ হচ্ছে। কিন্তু এরপর কী? ইরাকের মতো লিবিয়ায়ও সরকারের পতন ঘটিয়ে একটি ‘অনুগত’ সরকার প্রতিষ্ঠা করা?
পরিস্থিতি আজ সম্ভবত সেদিকেই যাচ্ছে। গত একশ’ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের ধরন পর্যালোচনা করলে দু’টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এক. যেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল একটি প্রশাসন গড়ে তোলা, দুই. সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সফল হয়েছে, তা বলা যেতে পারে। ১৯৮৩ সালে গ্রানাডায়, ১৯৮৯ সালে পানামায় সামরিক হস্তক্ষেপের পর দেশ দু’টিতে নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৫-৪৯ সালে পশ্চিম জার্মানিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ জার্মানিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী জাপানে (১৯৪৫-৫২) যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ সেখানেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশে সাহায্য করেছে। কিন্তু অনেক দেশেই যুক্তরাষ্ট্র সফল হয়নি। আফগানিস্তান (২০০১ ও পরবর্তী), হাইতি (১৯৯৪-৯৬), কম্পুচিয়া (১৯৭০-৭৩), দক্ষিণ ভিয়েতনাম (১৯৬৪-৭৩), ডমিনিকান রিপাবলিক (১৯৬৫-৬৬), কিউবায় (১৯১৭-২২) ও নিকারাগুয়ায় (১৯০৯-৩৩) সামরিক হস্তক্ষেপে সাময়িকভাবে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল একটি প্রশাসন গড়ে উঠেছে সত্য; কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একুশ শতকে এসে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে সত্য; কিন্তু সেখানে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। নির্বাচনের পর সাত মাসেরও ওপর সময় লেগেছিল সরকার গঠন করতে। কিন্তু সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়নি। আত্মঘাতী বোমাবাজির নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সেখানে জন্ম হয়েছে। আফগানিস্তানের ঘটনাবলীও ঠিক তেমনি। সেখানে ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতি কারজাই সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখছে মাত্র।
সেখানে তথাকথিত একটি প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আজ যদি ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া হয়, তাহলে পতন ঘটবে কারজাই সরকারের। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপ সেখানে ইসলামী জঙ্গিবাদী চেতনাকে আরও শক্তিশালী করেছে। আফগানিস্তানে তালেবানরা আরও শক্তিশালী হয়েছে। আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল এখন নিয়ন্ত্রণ করে তালেবানরা। আজ লিবিয়ায় ইঙ্গ-মার্কিন হামলার মধ্য দিয়ে দেশটির স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়েছে। দেশটি এখন একটি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আফগানিস্তানে যেমনটি ঘটেছিল, ঠিক তেমনটি হতে পারে লিবিয়ায়। লিবিয়ায় একজন ‘হামিদ কারজাই’কে পাওয়া গেছে। তিনি হচ্ছেন মুস্তাফা আবদেল জলিল, যার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে (পূর্বাঞ্চলে) একটি অন্তর্বর্তীকালীন ন্যাশনাল কাউন্সিল। কিছুদিন আগেও আবদেল জলিল লিবিয়ার বিচারমন্ত্রী ছিলেন। লিবিয়ায় তিনি ‘কারজাইয়ের মতো ভূমিকা’ পালন করতে পারেন বটে, কিন্তু লিবিয়ায় যে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়েছে, তা বন্ধ করতে পারবেন না। আরেকটি ‘দ্বিতীয় আফগানিস্তান’ তৈরি হতে যাচ্ছে লিবিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১০ সালের মে মাসে যে National Security Strategy প্রণয়ন করেছিলেন, সেই আলোকেই বিশ্বব্যাপী ন্যাটোর সেনাবাহিনী মোতায়েনের একটি মহাপরিকল্পনা তৈয়ার করা হচ্ছে। তথাকথিত ‘সন্ত্রাস দমন’ কিংবা ‘মানবিক বিপর্যয়’ এর ধুয়া তুলে স্থায়ীভাবে ন্যাটোর সেনাবাহিনী মোতায়েনের পথ প্রশস্ত হচ্ছে। আফগানিস্তানের পর লিবিয়ায় এখন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ ২০১২ সালের মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিলেও আন্দোলনকারীরা তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। সেখানে আন্দোলন নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে।
লিবিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে অন্য আরব দেশগুলোর পরিস্থিতিকে একসঙ্গে মেলানো যাবে না। গণ-আন্দোলনে তিউনিসিয়ায় বেন আলি ও মিসরে হোসনি মোবারকের পতন ঘটলেও সেখানে যৌথ বাহিনী সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু লিবিয়ায় করেছে। যে যুক্তিতে সেখানে যৌথ বাহিনী হস্তক্ষেপ করেছে (বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা), বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন এক চিত্র। যৌথ বাহিনীর মূল টার্গেট হচ্ছে গাদ্দাফির অপসারণ। লিবিয়ার তেল সম্পদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থেই আজ লিবিয়াতে সামরিক আগ্রাসন পরিচালিত হচ্ছে। গাদ্দাফি বলছেন ‘ধর্মযুদ্ধ’ এর কথা। এই ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস অনেক পুরনো। ইতিহাস বলে প্রথম ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১০৯৫ সালে, যা দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর ধরে চলে, যার সমাপ্তি ঘটেছিল ১২৭২ সালে ৯ম ধর্মযুদ্ধ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই ধর্মযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল কট্টরপন্থী খ্রিস্টীয় মতবাদীদের সঙ্গে মুসলমানদের। আজ স্পষ্টতই মুসলমান একটি দেশের বিরুদ্ধে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী কয়েকটি দেশ একত্রিত হয়ে সামরিক হামলা পরিচালনা করে, তখন ‘ধর্মযুদ্ধ’—এর এক নয়া রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। হয়তো ব্যাপক অর্থে এই যুদ্ধকে ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। কিন্তু মুসলমান একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় পশ্চিমা দেশগুলোর হস্তক্ষেপ তথা সামরিক আগ্রাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
লিবিয়ার সঙ্কট স্পষ্টতই সমগ্র আফ্রিকার ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে বদলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র মাত্রেই জানেন ১৮৮৪ সালের বার্লিন সম্মেলনে আফ্রিকাকে বিভক্ত করা হয়েছিল। উত্তর আফ্রিকা, মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় তখন বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফরাসি ভাষাভাষি অঞ্চলে। এখন একুশ শতকে নতুন এক আফ্রিকার জন্ম হতে যাচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। কঙ্গো, রুয়ান্ডা কিংবা আইভরিকোস্টে ফ্রান্সের স্বার্থ ও প্রভাব থাকলেও, এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন লিবিয়ায় একটি বন্ধুপ্রতিম সরকার। কেননা লিবিয়াকে বলা হয় এ অঞ্চলে যাওয়ার ‘গেটওয়ে’। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ফরাসী ভাষাভাষি তিউনিসিয়ায় সরকারের পতন ঘটেছে। আর আলজেরিয়ায়ও সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে আফ্রিকায় AFRICOM নামে নতুন একটি কমান্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী নাইজার ও সাদ-এর প্রাকৃতিক সম্পদের (কোবাল্ট, ইউরেনিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, প্লাটিনিয়াম) ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে নাইজারের ইউরেনিয়াম সম্পদ দেশটিকে ‘লিবিয়ার মতো একটি পরিস্থিতির’ দিকে আগামীতে ঠেলে দিতে পারে। আজ লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। যে অঞ্চল এক সময় ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ, একুশ শতকে এসে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করবে যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশবাদী চরিত্রের নতুন একটি রূপ। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছিল একটা ধারণাপত্র জবনঁরষফরহম অসবত্রপধহ উবভবহংবং; যেখানে বলা হয়েছে দীর্ঘ যুদ্ধের কথা। আফগানিস্তান ও ইরাকের পর এখন লিবিয়া। আফগানিস্তানে ও ইরাকে এখনও যুদ্ধ চলছে। আর যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে দেশ দুটিতে। আর তাতে করে লাভবান হচ্ছে কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। ইরাকে যেমনটি হয়েছিল। তেল বিক্রি করে দেশটির পুনর্গঠন। ঠিক তেমনটিই হতে যাচ্ছে লিবিয়াতে। লিবিয়ার তেল (ইতালি, ফ্রান্স আর জার্মানির ৮৫ ভাগ তেল আসে লিবিয়া থেকে) সম্পদ তাই যুদ্ধকে উসেক দিয়েছে। এতে করে লিবিয়া ভাগ হয়ে গেলে আমি অবাক হবো না।
এই যুদ্ধে লিবিয়ার জনগণ উপকৃত হবে না। সেখানে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হবে না। বরং এতে লাভবান হবে বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো। আর আমরা, উন্নয়নশীল বিশ্ব এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। কেননা উচ্চমূল্যে আমাদের তেল কিনতে হবে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১১১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সঙ্কট অব্যাহত থাকলে তেলের দাম আরও বাড়বে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তখন অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে এই তেল আমদানি করতে হবে। বলা ভালো আরব বিশ্ব তথা মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে তেলের রিজার্ভ ৬৬ দশমিক ২ ভাগ থেকে ৭৫ দশমিক ৯ ভাগ। এর মাঝে এককভাবে মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে ৫৬ ভাগ তেলের রিজার্ভ। ইউরোপে তেলের রিজার্ভ মাত্র ১ ভাগ, আর উত্তর আমেরিকায় ১৬ ভাগ। সুতরাং লিবিয়াতে যে তেলের বিপুল ভাণ্ডার রয়েছে (প্রমাণিত ৪৬.৪ বিলিয়ন ব্যারেল। কারো মতে, ৬০ বিলিয়ন ব্যারেল), সে ব্যাপারে পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলোর আগ্রহ থাকবে। এই তেল সম্পদের ওপর যদি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা শুধু লাভজনকই নয়, বরং বিশ্বে জ্বালানি নিয়ে যে রাজনীতি, তা নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব। এরই মধ্যে ইরাকের তেলের নিয়ন্ত্রণ ভার চলে গেছে ইন্টারন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানিগুলোর হাতে। তারাই এখন পরোক্ষভাবে ইরাকের সরকার পরিচালনা করছে। বিশ্বের তেলের দ্বিতীয় বৃহত্তম রিজার্ভ রয়েছে ইরাকে। সৌদি আরবে রিজার্ভের পরিমাণ ২৫৯ বিলিয়ন ব্যারেল (বিশ্ব রিজার্ভের ২৪ ভাগ), আর ইরাকের রিজার্ভের পরিমাণ ১১৩ বিলিয়ন ব্যারেল (বিশ্ব রিজার্ভের ১১ ভাগ)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে তেল সম্পদ রয়েছে, তার রিজার্ভের পরিমাণ মাত্র ২৩ বিলিয়ন ব্যারেল, বিশ্ব রিজার্ভের মাত্র ২ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রে তেলের চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছেই। সেখানে প্রতিটি পরিবারে একাধিক গাড়ি রয়েছে। গাড়ির জন্য প্রয়োজন সস্তায় জ্বালানি তেল। এই তেল আসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। সুতরাং বিশ্ব তেল রিজার্ভের ওপর নিয়ন্ত্রণটা যে জরুরি, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। তেলের জন্যই ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা হয়েছিল এবং দেশটি দখল করে নেয়া হয়েছিল। আর আজ এই তেলের জন্যই লিবিয়ায় আক্রমণ হচ্ছে। কিন্তু এরপর কী? ইরাকের মতো লিবিয়ায়ও সরকারের পতন ঘটিয়ে একটি ‘অনুগত’ সরকার প্রতিষ্ঠা করা?
পরিস্থিতি আজ সম্ভবত সেদিকেই যাচ্ছে। গত একশ’ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের ধরন পর্যালোচনা করলে দু’টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এক. যেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল একটি প্রশাসন গড়ে তোলা, দুই. সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সফল হয়েছে, তা বলা যেতে পারে। ১৯৮৩ সালে গ্রানাডায়, ১৯৮৯ সালে পানামায় সামরিক হস্তক্ষেপের পর দেশ দু’টিতে নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৫-৪৯ সালে পশ্চিম জার্মানিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ জার্মানিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী জাপানে (১৯৪৫-৫২) যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ সেখানেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশে সাহায্য করেছে। কিন্তু অনেক দেশেই যুক্তরাষ্ট্র সফল হয়নি। আফগানিস্তান (২০০১ ও পরবর্তী), হাইতি (১৯৯৪-৯৬), কম্পুচিয়া (১৯৭০-৭৩), দক্ষিণ ভিয়েতনাম (১৯৬৪-৭৩), ডমিনিকান রিপাবলিক (১৯৬৫-৬৬), কিউবায় (১৯১৭-২২) ও নিকারাগুয়ায় (১৯০৯-৩৩) সামরিক হস্তক্ষেপে সাময়িকভাবে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল একটি প্রশাসন গড়ে উঠেছে সত্য; কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একুশ শতকে এসে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে সত্য; কিন্তু সেখানে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। নির্বাচনের পর সাত মাসেরও ওপর সময় লেগেছিল সরকার গঠন করতে। কিন্তু সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়নি। আত্মঘাতী বোমাবাজির নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সেখানে জন্ম হয়েছে। আফগানিস্তানের ঘটনাবলীও ঠিক তেমনি। সেখানে ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতি কারজাই সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখছে মাত্র।
সেখানে তথাকথিত একটি প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আজ যদি ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া হয়, তাহলে পতন ঘটবে কারজাই সরকারের। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপ সেখানে ইসলামী জঙ্গিবাদী চেতনাকে আরও শক্তিশালী করেছে। আফগানিস্তানে তালেবানরা আরও শক্তিশালী হয়েছে। আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল এখন নিয়ন্ত্রণ করে তালেবানরা। আজ লিবিয়ায় ইঙ্গ-মার্কিন হামলার মধ্য দিয়ে দেশটির স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়েছে। দেশটি এখন একটি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আফগানিস্তানে যেমনটি ঘটেছিল, ঠিক তেমনটি হতে পারে লিবিয়ায়। লিবিয়ায় একজন ‘হামিদ কারজাই’কে পাওয়া গেছে। তিনি হচ্ছেন মুস্তাফা আবদেল জলিল, যার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে (পূর্বাঞ্চলে) একটি অন্তর্বর্তীকালীন ন্যাশনাল কাউন্সিল। কিছুদিন আগেও আবদেল জলিল লিবিয়ার বিচারমন্ত্রী ছিলেন। লিবিয়ায় তিনি ‘কারজাইয়ের মতো ভূমিকা’ পালন করতে পারেন বটে, কিন্তু লিবিয়ায় যে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়েছে, তা বন্ধ করতে পারবেন না। আরেকটি ‘দ্বিতীয় আফগানিস্তান’ তৈরি হতে যাচ্ছে লিবিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১০ সালের মে মাসে যে National Security Strategy প্রণয়ন করেছিলেন, সেই আলোকেই বিশ্বব্যাপী ন্যাটোর সেনাবাহিনী মোতায়েনের একটি মহাপরিকল্পনা তৈয়ার করা হচ্ছে। তথাকথিত ‘সন্ত্রাস দমন’ কিংবা ‘মানবিক বিপর্যয়’ এর ধুয়া তুলে স্থায়ীভাবে ন্যাটোর সেনাবাহিনী মোতায়েনের পথ প্রশস্ত হচ্ছে। আফগানিস্তানের পর লিবিয়ায় এখন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment