বাংলাদেশ বড় ধরনের ভারতীয় পানি আগ্রাসনের সম্মুখীন হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশের মানুষ যখন গঙ্গার পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তখন নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তিস্তায় পানি না পাওয়া এবং টিঁপাইমুখ বাঁধ নিয়ে। ৭ মে, ২০০৯ সংবাদপত্রের খবর, রাজশাহীর কাছে পদ্মা নদীর প্রবাহ বন্ধ হওয়ার পথে। এ অঞ্চলের পানির অন্যতম প্রধান উৎস পদ্মা নদী এখন শুধু বালুচর। কোথাও কোথাও হচ্ছে শস্য চাষ। চরছে গবাদি পশু। ১৯৯৬ সালের পানি চুক্তি অনুযায়ী ভারত ফারাক্কা পয়েন্ট দিয়ে প্রয়োজনীয় পানি ছাড় না করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে রংপুর থেকে পাঠানো অপর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে ‘তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের অনৈতিক ঢিলেমি, হঠকারিতা ও একগুয়েমির ফলে এ নদীর বাংলাদেশ অংশ জুড়ে এখন মরুভূমির প্রতিচ্ছবি।্ একই সাথে টিঁপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টি করেছে অশনি সংক্ষেত।
ভারতের ‘পানি আগ্রাসন’ বুঝতে এ দুটি সংবাদই যথেষ্ট। বাংলাদেশ আজ ভারতের পানি আগ্রাসনের সম্মুখীন। বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বাঞ্চিত করছে ভারত। ভারতের এ ‘পানি আগ্রাসন’ একদিকে যেমন বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে তার ন্যায্য অধিকার থেকে, অন্যদিকে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে ভারত বাংলাদেশকে ‘চাপ’ এর মুখে রেখে তাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে চাইছে। ভারতের এ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় সহযোগিতা করছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবিতে কর্মরত কিছু ভারতীয় বংশদ্ভুত কর্মকর্তা। কিন্তু বাংলাদেশের পানি সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহী নয় ভারত। ভারত বাংলাদেশের এই ’জীবন মরণ সমস্যা’ কে কোনদিন সমস্যা হিসেবে দেখেনি। বরং উপহাস করেছে। যেখানে সার্ক এর আওতায় বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানের একটি উদ্যোগ নেয়া যেতো, সেখানে তা না করে সমস্যাটিকে ’জিইয়ে’ রেখে ভারত তার স্বার্থ উদ্ধার করে নিতে চায়।
বাংলাদেশে প্রবাহিত অধিকাংশ নদীর উৎসস্থল হচ্ছে ভারত। ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহমান নদীর সংখ্যা ৫৪টি। ভারত শুধুমাত্র গঙ্গার পানিই এককভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে না, বরং ব্রক্ষপুত্র ও তিস্তার পানিও প্রত্যাহার করে নিতে চাইছে। ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যার মাধ্যমে ভারত ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করে নেবে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য হবে এক বড় ধরনের হুমকি। আর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হলে, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পরিণত হবে মরুভূমিতে। ভারতের এ ’পানি আগ্রাসন’ আজ বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য পাওনা থেকে শুধু বঞ্চিতই করছে না, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার এক গভীর যড়ষন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
গঙ্গা পানি চুক্তি
গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয় পর্বতের দক্ষিণ ঢালে ২৩ হাজার ফুট উচ্চতায় দক্ষিণ পূর্ব ও তারপর পূর্ব দিকে। ভারতের মধ্যে দিয়ে প্রায় এক হাজার মাইল অতিক্রম করে গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চীন, নেপাল ও ভারতের হিমালয় অঞ্চল থেকে কয়েকটি উপনদী উত্তর দিক থেকে গঙ্গায় পড়েছে। বলা ভালো, গঙ্গার পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র চীন, ভারত ও বাংলাদেশ এবং মেঘনা ভারত ও বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর সমন্বয়ে বাংলাদেশে স্বাদুপানির যে নদীপ্রবাহ বিদ্যমান, তা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নদীপ্রবাহ। গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে দু'দুটো চুক্তি হয়েছে। একটি ১৯৭৭ সালে, অপরটি ১৯৯৬ সালে। ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর আরো কেটে গেছে ১২ বছর। কিন্তু আমরা কী পেয়েছি? ২০০৬ কিংবা ২০০৮ সালে বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পেয়েছে, তার হিসাব না হয় বাদই দিলাম। ২০০৮ সালের পানির হিস্যার যদি পরিসংখ্যান দেই, তা কোন আশার কথা বলেনা। গঙ্গার পানি চুক্তি কার্যত এখন অকার্যকর। চুক্তি করে বাংলাদেশ কখনই লাভবান হয়নি এবং আগামীতে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প
গঙ্গার তথাকথিত পানি চুক্তি যখন বাংলাদেশকে তার পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছে, ঠিক তখনই ভারত আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রকল্প খোদ ভারতেই বির্তকের সৃষ্টি করেছে। এই বিশাল নদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ভারতের অভ্যন্তরে ৩৭টি নদীকে ৯ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করার জন্য। প্রকল্পটির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দ এবং গোদাবরিতে। গোদাবরির পানি নিয়ে যাওয়া হবে কৃষ্ণায় এবং সেখানে থেকে পেনার এবং কাবেরীতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। এই বিশাল আন্তঅববাহিকা পানি প্রত্যাহার প্রকল্প সম্পূর্ণ করা হবে ২০০৬ সালের মধ্যে। এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থায় ভয়াবহ প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। এ প্রকল্পে বাংলাদেশের যেসব ক্ষতি হতে পারে তা নিম্নরুপ: ১. ভাতর-বাংলাদেশ সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। দীর্ঘদিন ধরে পাওয়া পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে, ২. বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে তার মিঠা পানির মোট ৮৫ শতাংশই ব্রহ্মপুত্র এবং গঙ্গা নদী থেকে পায়। এককভাবে ব্রহ্মপুত্র থেকেই পাওয়া যায় মোট প্রয়োজনের ৬৫ শতাংশ পানি। সুতরাং ভারতের পরিকল্পনামত পানি প্রত্যাহার করা হলে তা আমাদের দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে, ৩. ভূ-গর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থ পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নেতিবাচক প্রক্রিয়া হবে। ভূ-উপরিস্থ পানি কমে গেলে ভূ-গর্ভস্থ পানি বেশি পরিমাণে উত্তোলন করা হবে এবং এতে আর্সেনিক সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে, ৪. মিঠা পানির মাছের পরিমাণ হ্রাস পাবে এবং জলপথে পরিবহন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ৫. পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোনো কৃষি প্রকল্প হাতে নিতে পারবে না। পানির অভাবে কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ৬. পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আরও আশংকা করছেন দূষিত নদীগুলোর পানি অপেক্ষাকৃত দূষণমুক্ত অন্য নদীগুলোর পানিকেও দূষিত করে তুলবে। বর্তমানে পরিবেশ দূষণের শিকার নদীগুলোর পানি অপেক্ষাকৃত দূষণমুক্ত অন্য নদীগুলোর পানিকেও দূষিত করে তুলবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গঙ্গার দূষিত পানি অন্য নদীর পানিকে দুষিত করে তুলবে। বর্তমানে পরিবেশ দূষণের শিকার নদীগুলোর পানি অন্য নদীগুলোতে মেশালে এ অঞ্চলের পরিবেশ দুষিত হবে, ৭. এসবের চেয়েও মারাত্মক বিষয় হচ্ছে প্রকল্পে নির্মিতব্য বড় বড় বাঁধ গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।
টিঁপাইমুখ বাঁধ
বাংলাদেশের জন্য আরেকটি দুঃখজনক খবর হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের আতঙ্কের। ভারতের টিপাইমুখ হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্টে যে হাই ড্যাম নির্মাণ করা হবে তার উচ্চতা ১৬২ দশমিক ৮ মিটার। এর পানি ধারণ ক্ষমতা ১৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫০০ মেগাওয়াট। এটি নির্মিত হবে প্রায় বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে, আসামের করিমগঞ্জে বরাক নদীর ওপর। এ বরাক নদী হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারার মূল ধারা। সুরমা ও কুশিয়ারা পরে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে আমাদের বিশাল মেঘনা। ইতোমধ্যে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করায় মরে যাচ্ছে প্রমত্তা সুরমা। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের সুরমা নদীর পানি প্রবাহ গত ১০ বছরে শতকরা ৮০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশের সুরমা, কুশিয়ারা অমলশীদে এসে মিলিত হয়েছে। বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারা এ তিন নদীর মিলনস্থল অমলশীদ এক সময় অনেক গভীর ছিল। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুমান অনুযায়ী, বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে বরাক নদী থেকে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ৮৩ দশমিক ৫৯ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ পাঁচ বছর আগে এ প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৩০০ ঘনমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমে ভাঙ্গন রোধে বরাক নদীর দুই তীরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অবকাঠামো নির্মাণের ফলে ধীরে ধীরে সুরমা নদীর প্রধান প্রবাহ কুশিয়ারার দিকে ঘুরে গেছে। এতে বলা হয়, সুরমার ভাটিতে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার মরে গেছে।
বাংলাদেশের পানির হিস্যা ও আন্তর্জাতিক পানি ব্যবহারের আইনগত দিক
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে একটি নদী যদি ২/৩ টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাহলে ঐ নদীর পানি সম্পদের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। যে কোন আন্তর্জাতিক নদীর উপর তীরবর্তী রাষ্ট্রের অধিকার সমঅংশীদারিত্বের নীতির উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক নদী সম্পদের তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সুষম বন্টনের নীতি আজ স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যাবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালে ভিয়েনা সম্মেলন ও ১৯২১ সালে আন্তর্জাতিক দানিযুব নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইনে এই নীতির উল্লেখ রয়েছে। পৃথিবীতে প্রায় ২১৪টি নদী রয়েছে যে নদীগুলো একাধিক দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। মোট ৯টি নদীর কথা জানা যায়, যা ৬টি বা ততোধিক দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। এসব নদী হচ্ছে- দানিয়ুব, নাইজার, নীল, জায়ার, রাইন, জাম্বেজী, আমাজান, লেকচাদ ও মেকং। এক্ষেত্রে কোন একটি একক দেশই এ পানি সম্পদ ভোগ করেনি।
মেকং নদী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মোট ৬টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে লাওস, থাইল্যান্ড, চীন, কম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম ও বার্মা বা মায়ানমার। এ দেশগুলোর মধ্যে বৈরিতা দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক ব্যবস্থাও ভিন্ন। কিন্তু তবুও দেশগুলো মেকং নদরি পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছিল। নিজ দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত অংশের ভিত্তিতেই পানির ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছিল। রিওগ্রানডে ও কালোরাডো নদী মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এ দু’টি নদীর পানির ব্যবহার নিয়েও দেশ দুটোর মধ্যে বিরোধ ছিল। কিন্তু বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে তারা পানির হিস্যা নির্ধারণ করেছ্।ে ভারত যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এ ধরনের প্রকল্প অবৈধ। আন্তঃনী সংযোগ প্রকল্পের সবক’টি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। তাই এসব নদীর একতরফা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি এবং অগ্রহণযোগ্য।
আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভূক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এবং তা অব্যশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোন ক্ষতি না করে করেই হতে হবে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত একটি অস্বচ্ছ ও স্বেচ্ছাচারমূলক পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশনের ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহে পানি তার নিজের ভৌগোলিক এলাকায় যুক্তি ও ন্যায়পরায়নতার সঙ্গে ব্যবহার করবে। এছাড়া ভারত এ প্রকল্পের মাধ্যমে জলপ্রবাহ কনভেশনের আরও কিছু বিধানের সুস্পষ্ট লংঘন করেছে যেমন-১. প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের পানি ব্যবহার করার সময় পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর যাতে কোন বড় ধরনের ক্ষতি না হয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে; (অনুচ্ছেদ-৭(১)। ২. জলপ্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা, পারস্পরিক সুবিধা লাভ এবং সৎ বিশ্বাসের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের সংরক্ষণ ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেবে (অনুচ্ছেদ-৮); ৩. রাষ্ট্রসমূহ নিয়মিতভবে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত বিনিময় করবে (অনুচ্ছেদ-৯ (১); ৪. অপর রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন প্রকল্প গ্রহণের আগে অবশ্যই তাকে সময়মত অবহিত করতে হবে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, টিপাইমুখী বাঁধ কিংবা গঙ্গার পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইনেরও সুস্পষ্ট লংঘন। জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে কোন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই জীববৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন প্রতিটি প্রকল্পের পরিবশগত প্রভাব নিরূপণ করতে হবে। কিন্তু ভারতের প্রস্তাবিত প্রকল্পের কোন বিস্তারিত পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ প্রক্রিয়ার কথা শোনা যায়নি। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষভাবে জলজ প্রাণীর আবাসভূমি হিসেবে ব্যবহৃত জলাভূমি বিষয়ক কনভেনশনের (রামসার কনভেনশন) ৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে কনভেনশন উদ্ভুত বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রসমূহ পরস্পর পরামর্শ করবে এবং একই সঙ্গে জলাভূমির এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের সংরক্ষণের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়ন করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা নিচ্ছে, যা এ কনভেনশনের সুস্পষ্ট লংঘন।
বাংলাদেশের ক্ষতি
ভারতের ‘পানি রাজনীতি’ তথা বাংলাদেশকে তার ন্যায্য ও আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে গঙ্গা থেকে পানি প্রত্যাহার ও টিঁপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করায় বাংলাদেশ এক বড় ধরনের পরিবেশ ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখেন হয়েছে। নদী ব্যবস্থায় এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। পলি পড়ে উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে দেশের ২০টি নদী ইতোমধ্য অস্তিত্ব হারিযে ফেলেছে। এর মধ্যে ১৩টি মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। কার্যত এগুলো এখন মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে পানির অভাবে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে, তা নীচের একটি পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে। ১. উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২ কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; ২. দক্ষিণাঞ্চেলের প্রায় ৪ কোটি মানুষ ও এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ৪. গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ দেয়া সম্ভব নয়; ৫. অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য জমির উর্বরা শক্তি কমে গেছে; ৬. দেশের প্রায় ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ ও ৪২ শতাংশ গভীর নলকূপ ব্যবাহার করা সম্ভব হচ্ছে না; ৭. গঙ্গার পানি চুক্তির (১৯৯৬) পর বাংলাদেশে গঙ্গার পানির অংশ দাঁড়িয়েছে সেকেন্ডে ২০ হাজার ঘনফুটের কম। অথচ ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে শুস্ক মৌসুমেও বাংলাদেশ ৭০ হাজার কিউসেকের চেয়ে কম পেতো না; ৮. প্রায় ১৫০০ কি.মি. নৌ পথ বন্ধ হয়ে গেছে; ৯. ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় হাজার হাজার হস্তচালিত পাম্প অকেজো হয়ে গেছে; ১০. ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় টিউবওয়েলের পানি খাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে; ১১. বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে; ১৩. মাছের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে; ১৪. লবণাক্ততার কারণে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রায় ১৭ ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় এক সমীক্ষায় উল্লেখ করেছে যে ফারাক্কায় বাঁধ দেয়ার কারণে বাংলদেশের প্রায় ৯৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রত্যেক বছরে লোকসানের পরিমান প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
সমাধান কোন পথে
ভারতীয় পানি আগ্রাসন যে বাংলাদেশেকে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশ যদি আগামি ২০ বছর পরের পরিস্থিতি চিন্তা করে এখনই একটি সুদূরপ্রসারী পকিল্পনা গ্রহণ না করে, তাহলে এ দেশ ২০৩০ সালে দিকে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি সংকট পারমাণবিক সঙ্কটের ভয়াবহতাকেও ম্লান করে দেবে। পানির অভাবে এ দেশে বড় ধরনের সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হবে, যা পার্শ্ববর্তী দেশেকেও আক্রান্ত করতে পারে। তাই সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তাদের আগ্রাসী নীতি পরিত্যাগ করতে হবে।র্ ভারতেও পানির সঙ্কট হয়েছে, এটা অঙ্গীকার করা যাবে না। উভয় দেশের এই যে সঙ্কট, তার সমাধান করতে হবে পারস্পারিক বিশ্বাস ও আস্থা রেখে এবং বহুপাক্ষিক সমঝোতার ভিত্তিতে। পানি সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করা যাবে না। নেপাল জলাধার নির্মাণ করে হিমালয়ের পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা গেলে শুকনো মৌসুমে ফারাক্কায় পানি প্রবাহ ১ লাখ ৩০ হাজার কিউসেক থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাতে করে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই লাভবান হবে। তাছাড়া জলাধারের সাহায্যে নেপাল প্রতি বছর প্রায় সাড়ে দশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম, যা নেপাল বাংলাদেশেও রফতানি করতে পারবে। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে, অর্থাৎ ১৯৭৭ সাল থেকে ৫০ বছর পর। এ ৫০ বছরে জনসংখ্যা বাড়বে তিনগুণ। মোটামুটি হিসাবে পানির প্রয়োজনও বাড়বে তিনগুন। কিন্তু ১৯৭৭ সালে আমরা যে পানি পেয়েছিলাম, ৫০ বছর পর পর্যন্ত পেতে থাকবো তার থেকে কম। আরো একটি কথা -বিশ্বব্যাংক প্রণীত ’বাংলাদেশ কান্ট্রি ওয়াটার রিসোর্সেস এসিসট্যান্স’ নামে একটি ধারণাপত্রের কথা শোনা গিয়েছিল দু’ বছর আগে। তথাকথিক এ অঞ্চলের পানি উন্নয়নের নামে এ ধারণাপত্র তৈরী করা হয়েছিল। ওই ধারণপত্রে গঙ্গার পানি প্রবাহের অপ্রতুলতাকে স্বাীকার করে ব্রহ্মপুত্রের পানির ওপর ভিত্তি করে পানি উন্নয়নের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এটি মূলত ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনাকেই সমর্থন করে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের এ ধারণাপত্র সমর্থন করতে পারে না। গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে যেমনি আগামিতেও আলোচনা হবে, তেমনি ব্রহ্মপুত্রকে কেন্দ্র করেও আলোচনা হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা পানির অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলকে ন্যুনতম ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। আমি ২০৩০ সালকে সামনে রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদি পানি পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রস্তাব রাখছি। সেই সাথে আন্তর্জাতিক নদীর পানির সুষ্ঠ ব্যবহারের স্বার্থে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও চীনের পানি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ফোরাম গঠনেরও প্রস্তাব করছি। একই সাথে সার্ক সনদে পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনা বিষয়টি সংযুক্ত করা দাবি করছি। মনে রাখাতে হবে পানি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এ নিরাপত্তা যাতে বিঘিœত না হয়, সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ***
ভারতের ‘পানি আগ্রাসন’ বুঝতে এ দুটি সংবাদই যথেষ্ট। বাংলাদেশ আজ ভারতের পানি আগ্রাসনের সম্মুখীন। বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বাঞ্চিত করছে ভারত। ভারতের এ ‘পানি আগ্রাসন’ একদিকে যেমন বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে তার ন্যায্য অধিকার থেকে, অন্যদিকে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে ভারত বাংলাদেশকে ‘চাপ’ এর মুখে রেখে তাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে চাইছে। ভারতের এ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় সহযোগিতা করছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবিতে কর্মরত কিছু ভারতীয় বংশদ্ভুত কর্মকর্তা। কিন্তু বাংলাদেশের পানি সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহী নয় ভারত। ভারত বাংলাদেশের এই ’জীবন মরণ সমস্যা’ কে কোনদিন সমস্যা হিসেবে দেখেনি। বরং উপহাস করেছে। যেখানে সার্ক এর আওতায় বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানের একটি উদ্যোগ নেয়া যেতো, সেখানে তা না করে সমস্যাটিকে ’জিইয়ে’ রেখে ভারত তার স্বার্থ উদ্ধার করে নিতে চায়।
বাংলাদেশে প্রবাহিত অধিকাংশ নদীর উৎসস্থল হচ্ছে ভারত। ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহমান নদীর সংখ্যা ৫৪টি। ভারত শুধুমাত্র গঙ্গার পানিই এককভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে না, বরং ব্রক্ষপুত্র ও তিস্তার পানিও প্রত্যাহার করে নিতে চাইছে। ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যার মাধ্যমে ভারত ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করে নেবে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য হবে এক বড় ধরনের হুমকি। আর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হলে, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পরিণত হবে মরুভূমিতে। ভারতের এ ’পানি আগ্রাসন’ আজ বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য পাওনা থেকে শুধু বঞ্চিতই করছে না, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার এক গভীর যড়ষন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
গঙ্গা পানি চুক্তি
গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয় পর্বতের দক্ষিণ ঢালে ২৩ হাজার ফুট উচ্চতায় দক্ষিণ পূর্ব ও তারপর পূর্ব দিকে। ভারতের মধ্যে দিয়ে প্রায় এক হাজার মাইল অতিক্রম করে গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চীন, নেপাল ও ভারতের হিমালয় অঞ্চল থেকে কয়েকটি উপনদী উত্তর দিক থেকে গঙ্গায় পড়েছে। বলা ভালো, গঙ্গার পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র চীন, ভারত ও বাংলাদেশ এবং মেঘনা ভারত ও বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর সমন্বয়ে বাংলাদেশে স্বাদুপানির যে নদীপ্রবাহ বিদ্যমান, তা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নদীপ্রবাহ। গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে দু'দুটো চুক্তি হয়েছে। একটি ১৯৭৭ সালে, অপরটি ১৯৯৬ সালে। ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর আরো কেটে গেছে ১২ বছর। কিন্তু আমরা কী পেয়েছি? ২০০৬ কিংবা ২০০৮ সালে বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পেয়েছে, তার হিসাব না হয় বাদই দিলাম। ২০০৮ সালের পানির হিস্যার যদি পরিসংখ্যান দেই, তা কোন আশার কথা বলেনা। গঙ্গার পানি চুক্তি কার্যত এখন অকার্যকর। চুক্তি করে বাংলাদেশ কখনই লাভবান হয়নি এবং আগামীতে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প
গঙ্গার তথাকথিত পানি চুক্তি যখন বাংলাদেশকে তার পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছে, ঠিক তখনই ভারত আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রকল্প খোদ ভারতেই বির্তকের সৃষ্টি করেছে। এই বিশাল নদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ভারতের অভ্যন্তরে ৩৭টি নদীকে ৯ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করার জন্য। প্রকল্পটির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দ এবং গোদাবরিতে। গোদাবরির পানি নিয়ে যাওয়া হবে কৃষ্ণায় এবং সেখানে থেকে পেনার এবং কাবেরীতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। এই বিশাল আন্তঅববাহিকা পানি প্রত্যাহার প্রকল্প সম্পূর্ণ করা হবে ২০০৬ সালের মধ্যে। এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থায় ভয়াবহ প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। এ প্রকল্পে বাংলাদেশের যেসব ক্ষতি হতে পারে তা নিম্নরুপ: ১. ভাতর-বাংলাদেশ সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। দীর্ঘদিন ধরে পাওয়া পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে, ২. বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে তার মিঠা পানির মোট ৮৫ শতাংশই ব্রহ্মপুত্র এবং গঙ্গা নদী থেকে পায়। এককভাবে ব্রহ্মপুত্র থেকেই পাওয়া যায় মোট প্রয়োজনের ৬৫ শতাংশ পানি। সুতরাং ভারতের পরিকল্পনামত পানি প্রত্যাহার করা হলে তা আমাদের দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে, ৩. ভূ-গর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থ পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নেতিবাচক প্রক্রিয়া হবে। ভূ-উপরিস্থ পানি কমে গেলে ভূ-গর্ভস্থ পানি বেশি পরিমাণে উত্তোলন করা হবে এবং এতে আর্সেনিক সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে, ৪. মিঠা পানির মাছের পরিমাণ হ্রাস পাবে এবং জলপথে পরিবহন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ৫. পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোনো কৃষি প্রকল্প হাতে নিতে পারবে না। পানির অভাবে কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ৬. পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আরও আশংকা করছেন দূষিত নদীগুলোর পানি অপেক্ষাকৃত দূষণমুক্ত অন্য নদীগুলোর পানিকেও দূষিত করে তুলবে। বর্তমানে পরিবেশ দূষণের শিকার নদীগুলোর পানি অপেক্ষাকৃত দূষণমুক্ত অন্য নদীগুলোর পানিকেও দূষিত করে তুলবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গঙ্গার দূষিত পানি অন্য নদীর পানিকে দুষিত করে তুলবে। বর্তমানে পরিবেশ দূষণের শিকার নদীগুলোর পানি অন্য নদীগুলোতে মেশালে এ অঞ্চলের পরিবেশ দুষিত হবে, ৭. এসবের চেয়েও মারাত্মক বিষয় হচ্ছে প্রকল্পে নির্মিতব্য বড় বড় বাঁধ গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।
টিঁপাইমুখ বাঁধ
বাংলাদেশের জন্য আরেকটি দুঃখজনক খবর হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের আতঙ্কের। ভারতের টিপাইমুখ হাইড্রোইলেকট্রিক প্রজেক্টে যে হাই ড্যাম নির্মাণ করা হবে তার উচ্চতা ১৬২ দশমিক ৮ মিটার। এর পানি ধারণ ক্ষমতা ১৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫০০ মেগাওয়াট। এটি নির্মিত হবে প্রায় বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে, আসামের করিমগঞ্জে বরাক নদীর ওপর। এ বরাক নদী হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারার মূল ধারা। সুরমা ও কুশিয়ারা পরে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে আমাদের বিশাল মেঘনা। ইতোমধ্যে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করায় মরে যাচ্ছে প্রমত্তা সুরমা। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের সুরমা নদীর পানি প্রবাহ গত ১০ বছরে শতকরা ৮০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশের সুরমা, কুশিয়ারা অমলশীদে এসে মিলিত হয়েছে। বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারা এ তিন নদীর মিলনস্থল অমলশীদ এক সময় অনেক গভীর ছিল। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুমান অনুযায়ী, বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে বরাক নদী থেকে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ৮৩ দশমিক ৫৯ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ পাঁচ বছর আগে এ প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৩০০ ঘনমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমে ভাঙ্গন রোধে বরাক নদীর দুই তীরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অবকাঠামো নির্মাণের ফলে ধীরে ধীরে সুরমা নদীর প্রধান প্রবাহ কুশিয়ারার দিকে ঘুরে গেছে। এতে বলা হয়, সুরমার ভাটিতে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার মরে গেছে।
বাংলাদেশের পানির হিস্যা ও আন্তর্জাতিক পানি ব্যবহারের আইনগত দিক
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে একটি নদী যদি ২/৩ টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাহলে ঐ নদীর পানি সম্পদের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। যে কোন আন্তর্জাতিক নদীর উপর তীরবর্তী রাষ্ট্রের অধিকার সমঅংশীদারিত্বের নীতির উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক নদী সম্পদের তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সুষম বন্টনের নীতি আজ স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যাবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালে ভিয়েনা সম্মেলন ও ১৯২১ সালে আন্তর্জাতিক দানিযুব নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইনে এই নীতির উল্লেখ রয়েছে। পৃথিবীতে প্রায় ২১৪টি নদী রয়েছে যে নদীগুলো একাধিক দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। মোট ৯টি নদীর কথা জানা যায়, যা ৬টি বা ততোধিক দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। এসব নদী হচ্ছে- দানিয়ুব, নাইজার, নীল, জায়ার, রাইন, জাম্বেজী, আমাজান, লেকচাদ ও মেকং। এক্ষেত্রে কোন একটি একক দেশই এ পানি সম্পদ ভোগ করেনি।
মেকং নদী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মোট ৬টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে লাওস, থাইল্যান্ড, চীন, কম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম ও বার্মা বা মায়ানমার। এ দেশগুলোর মধ্যে বৈরিতা দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক ব্যবস্থাও ভিন্ন। কিন্তু তবুও দেশগুলো মেকং নদরি পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছিল। নিজ দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত অংশের ভিত্তিতেই পানির ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছিল। রিওগ্রানডে ও কালোরাডো নদী মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এ দু’টি নদীর পানির ব্যবহার নিয়েও দেশ দুটোর মধ্যে বিরোধ ছিল। কিন্তু বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে তারা পানির হিস্যা নির্ধারণ করেছ্।ে ভারত যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এ ধরনের প্রকল্প অবৈধ। আন্তঃনী সংযোগ প্রকল্পের সবক’টি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। তাই এসব নদীর একতরফা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি এবং অগ্রহণযোগ্য।
আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভূক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এবং তা অব্যশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোন ক্ষতি না করে করেই হতে হবে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত একটি অস্বচ্ছ ও স্বেচ্ছাচারমূলক পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশনের ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহে পানি তার নিজের ভৌগোলিক এলাকায় যুক্তি ও ন্যায়পরায়নতার সঙ্গে ব্যবহার করবে। এছাড়া ভারত এ প্রকল্পের মাধ্যমে জলপ্রবাহ কনভেশনের আরও কিছু বিধানের সুস্পষ্ট লংঘন করেছে যেমন-১. প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের পানি ব্যবহার করার সময় পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর যাতে কোন বড় ধরনের ক্ষতি না হয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে; (অনুচ্ছেদ-৭(১)। ২. জলপ্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা, পারস্পরিক সুবিধা লাভ এবং সৎ বিশ্বাসের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের সংরক্ষণ ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেবে (অনুচ্ছেদ-৮); ৩. রাষ্ট্রসমূহ নিয়মিতভবে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত বিনিময় করবে (অনুচ্ছেদ-৯ (১); ৪. অপর রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন প্রকল্প গ্রহণের আগে অবশ্যই তাকে সময়মত অবহিত করতে হবে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, টিপাইমুখী বাঁধ কিংবা গঙ্গার পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইনেরও সুস্পষ্ট লংঘন। জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে কোন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই জীববৈচিত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন প্রতিটি প্রকল্পের পরিবশগত প্রভাব নিরূপণ করতে হবে। কিন্তু ভারতের প্রস্তাবিত প্রকল্পের কোন বিস্তারিত পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ প্রক্রিয়ার কথা শোনা যায়নি। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষভাবে জলজ প্রাণীর আবাসভূমি হিসেবে ব্যবহৃত জলাভূমি বিষয়ক কনভেনশনের (রামসার কনভেনশন) ৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে কনভেনশন উদ্ভুত বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রসমূহ পরস্পর পরামর্শ করবে এবং একই সঙ্গে জলাভূমির এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের সংরক্ষণের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়ন করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা নিচ্ছে, যা এ কনভেনশনের সুস্পষ্ট লংঘন।
বাংলাদেশের ক্ষতি
ভারতের ‘পানি রাজনীতি’ তথা বাংলাদেশকে তার ন্যায্য ও আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে গঙ্গা থেকে পানি প্রত্যাহার ও টিঁপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করায় বাংলাদেশ এক বড় ধরনের পরিবেশ ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখেন হয়েছে। নদী ব্যবস্থায় এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। পলি পড়ে উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে দেশের ২০টি নদী ইতোমধ্য অস্তিত্ব হারিযে ফেলেছে। এর মধ্যে ১৩টি মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। কার্যত এগুলো এখন মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে পানির অভাবে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে, তা নীচের একটি পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে। ১. উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২ কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; ২. দক্ষিণাঞ্চেলের প্রায় ৪ কোটি মানুষ ও এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ৪. গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ দেয়া সম্ভব নয়; ৫. অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য জমির উর্বরা শক্তি কমে গেছে; ৬. দেশের প্রায় ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ ও ৪২ শতাংশ গভীর নলকূপ ব্যবাহার করা সম্ভব হচ্ছে না; ৭. গঙ্গার পানি চুক্তির (১৯৯৬) পর বাংলাদেশে গঙ্গার পানির অংশ দাঁড়িয়েছে সেকেন্ডে ২০ হাজার ঘনফুটের কম। অথচ ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে শুস্ক মৌসুমেও বাংলাদেশ ৭০ হাজার কিউসেকের চেয়ে কম পেতো না; ৮. প্রায় ১৫০০ কি.মি. নৌ পথ বন্ধ হয়ে গেছে; ৯. ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় হাজার হাজার হস্তচালিত পাম্প অকেজো হয়ে গেছে; ১০. ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় টিউবওয়েলের পানি খাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে; ১১. বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে; ১৩. মাছের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে; ১৪. লবণাক্ততার কারণে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রায় ১৭ ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় এক সমীক্ষায় উল্লেখ করেছে যে ফারাক্কায় বাঁধ দেয়ার কারণে বাংলদেশের প্রায় ৯৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রত্যেক বছরে লোকসানের পরিমান প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
সমাধান কোন পথে
ভারতীয় পানি আগ্রাসন যে বাংলাদেশেকে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশ যদি আগামি ২০ বছর পরের পরিস্থিতি চিন্তা করে এখনই একটি সুদূরপ্রসারী পকিল্পনা গ্রহণ না করে, তাহলে এ দেশ ২০৩০ সালে দিকে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি সংকট পারমাণবিক সঙ্কটের ভয়াবহতাকেও ম্লান করে দেবে। পানির অভাবে এ দেশে বড় ধরনের সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হবে, যা পার্শ্ববর্তী দেশেকেও আক্রান্ত করতে পারে। তাই সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তাদের আগ্রাসী নীতি পরিত্যাগ করতে হবে।র্ ভারতেও পানির সঙ্কট হয়েছে, এটা অঙ্গীকার করা যাবে না। উভয় দেশের এই যে সঙ্কট, তার সমাধান করতে হবে পারস্পারিক বিশ্বাস ও আস্থা রেখে এবং বহুপাক্ষিক সমঝোতার ভিত্তিতে। পানি সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করা যাবে না। নেপাল জলাধার নির্মাণ করে হিমালয়ের পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা গেলে শুকনো মৌসুমে ফারাক্কায় পানি প্রবাহ ১ লাখ ৩০ হাজার কিউসেক থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাতে করে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই লাভবান হবে। তাছাড়া জলাধারের সাহায্যে নেপাল প্রতি বছর প্রায় সাড়ে দশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম, যা নেপাল বাংলাদেশেও রফতানি করতে পারবে। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত পানি চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে, অর্থাৎ ১৯৭৭ সাল থেকে ৫০ বছর পর। এ ৫০ বছরে জনসংখ্যা বাড়বে তিনগুণ। মোটামুটি হিসাবে পানির প্রয়োজনও বাড়বে তিনগুন। কিন্তু ১৯৭৭ সালে আমরা যে পানি পেয়েছিলাম, ৫০ বছর পর পর্যন্ত পেতে থাকবো তার থেকে কম। আরো একটি কথা -বিশ্বব্যাংক প্রণীত ’বাংলাদেশ কান্ট্রি ওয়াটার রিসোর্সেস এসিসট্যান্স’ নামে একটি ধারণাপত্রের কথা শোনা গিয়েছিল দু’ বছর আগে। তথাকথিক এ অঞ্চলের পানি উন্নয়নের নামে এ ধারণাপত্র তৈরী করা হয়েছিল। ওই ধারণপত্রে গঙ্গার পানি প্রবাহের অপ্রতুলতাকে স্বাীকার করে ব্রহ্মপুত্রের পানির ওপর ভিত্তি করে পানি উন্নয়নের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এটি মূলত ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনাকেই সমর্থন করে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের এ ধারণাপত্র সমর্থন করতে পারে না। গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে যেমনি আগামিতেও আলোচনা হবে, তেমনি ব্রহ্মপুত্রকে কেন্দ্র করেও আলোচনা হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা পানির অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলকে ন্যুনতম ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। আমি ২০৩০ সালকে সামনে রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদি পানি পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রস্তাব রাখছি। সেই সাথে আন্তর্জাতিক নদীর পানির সুষ্ঠ ব্যবহারের স্বার্থে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও চীনের পানি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ফোরাম গঠনেরও প্রস্তাব করছি। একই সাথে সার্ক সনদে পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনা বিষয়টি সংযুক্ত করা দাবি করছি। মনে রাখাতে হবে পানি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এ নিরাপত্তা যাতে বিঘিœত না হয়, সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ***
নীল-স্বর্ণ স্রোতস্বিনীঃ যুদ্ধ হবে
ReplyDeleteনূর মোহাম্মদ কাজী
ওগো মোর উজান বান্ধব,
সকল নদীতে মোর বাঁধিয়াছ বাঁধ- এ কেমন কাজ!
মা গংগাকে বাঁধিয়াছ মরণ ফাঁদ- ফারাক্কায়।
টিপাইমুখ বাঁধ, নকশাল বিদ্রোহ, আসামের গণঅসন্তোষ,
চিতার আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে সেভেন সিস্টারস।
খড়গ কৃপান তলে কেন আজ প্রিয় বাংলাদেশ?
ছিল মোর নীল-স্বর্ণ স্রোতস্বিনী-
নদ-নদী, খাল-বিল, দক্ষিনের চর,
পদ্মা-মেঘনা-যমুনার উত্তাল তরংগমালা,
মাছেদের ঝাঁকঃ ইলিশ, কাতল, রুই, চান্দা, টেংরা, কই;
সবুজাব শষ্য-ক্ষেত্র-ধান, পাট, মুশরী, কলাই,
কৃষকের হাসি, পাখীদের গান;
দোয়েল-কোকিল-শ্যামা, ময়ূরের নাচ,
জীবন-বৈচিত্রে ভরা বাংলার সবুজ প্রান্তর,
সুন্দরী কাঠের বন-সুন্দর বন, চট্টলা পাহাড়,
সুনয়না হরিণীর ভালবাসা, তিমি ও কুমির,
আরো ছিল সাহস-গাম্বীর্যে ভরা বাংলার বাঘ;
সবকিছু তছনছ হয়ে গেল তব নষ্ট প্রেমে।
ওগো মোর উজানের মাঝি,
এখনও সময় আছে, নদীরে আমার অবারিত স্রোত দাও।
নদীদের স্রোতরাশি জীবনদায়িনীঃ এ যেন গো নীল স্বর্ণখনি,
কোটি কোটি জীবনের শ্বাস ও প্রশ্বাস, জীব-পরিবেশ,
সব কিছু টিকিয়ে রেখেছে এই প্রিয় স্রোতধারা।
অবারিত স্রোত ছাড়া আমাদের বাঁচিবার কোন পথ নাই।
তাই বলি বন্ধু ওগো শুন,
তব সাথে যুদ্ধ হবে জলস্রোত নিয়ে স্বরবে-নীরবে।
কোটি কোটি মানুষের, প্রাণীদের আর্তনাদ শুনে,
জলের দেবতা এসে মুক্তিযোদ্ধা হবে।
পশু-পাখী, কাক-চিল যত সরিশৃব,
এই যুদ্ধে অংশ নেবে।
তব নষ্ট-প্রেম ভেসে যাবে জলের আঁধারে।
রক্তলাল হবে ফের পদ্মা-মেঘনা-যমুনার নীল-স্রোতরাশি।
• পানির অপর নাম নীল-স্বর্ণ (Blue Gold)। বিশ্বব্যাপী এখন আধিপত্যবাদী শক্তি এ নীল-স্বর্ণ দখলের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে।মিঠাপানির দেশ বাংলাদেশ তারই শিকার। এ কবিতার রচয়িতা ১৯৭৬ সালের ফারাক্কা লংমার্চে মজলুম জন নেতা মওলানা ভাসানীর সহযোদ্ধা ছিলেন এবং লংমার্চ পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন।
Thank you very much.
ReplyDelete