রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিএনপির সংসদে যোগদান রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারবে কতটুকু





বিএনপির নির্বাচিত ছয়জন সংসদ দস্যের মধ্য থেকে পাঁচজনের সংসদ অধিবেশনে যোগদান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কি আদৌ কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারবে? এ প্রশ্ন এখন অনেকের। তাদের যোগদানকে প্রধানমন্ত্রী স্বাগত জানিয়েছেন এবং মির্জা ফকরুল ইসলাম জানিয়েছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা সংসদে গেছেন। মির্জা ফকরুলের কথার পেছনে ‘যুক্তি’ যাই থাকুক না কেন, এই যোগদান দুটি বড় দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। বিএনপি সংসদে না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখন তারা সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসল। এখন তারা যে ‘যুক্তিই’ দিক না কেন, কর্মীদের মাঝে, এমনকি ২০-দলীয় জোটও এই সিদ্ধান্তকে ভালো চোখে দেখেনি। তারা ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। কর্নেল অলি এটাকে আখ্যায়িত করেছেন হটকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে। কল্যাণ পর্টির মতো ছোট ছোট দলগুলোও তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে দিয়ে কি চলমান রাজনীতিতে কিছু পরিবর্তন আসবে?
বিএনপির সংসদ সদস্যদের সংসদ অধিবেশনে যোগদান এখন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। এক. ২০-দলীয় জোটে বিভক্তি আসতে পারে এবং নতুন আরেকটি জোট গঠিত হতে পারে। দুই. জাতীয় ঐক্যজোটের ‘ভ‚মিকা’ও সীমিত হয়ে আসবে। এখান থেকে বিএনপি নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। খোদ কামাল হোসেনের ভ‚মিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং গণফোরাম আরেক দফা ভেঙেছে। এটি একটি কাগুজে সংগঠনে পরিণত হতে যাচ্ছে। তিন. বেগম জিয়ার ‘জামিনে’ মুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এর সঙ্গে বিএনপির সংসদ সদস্যের সংসদে যোগদানের কোনো সম্পর্ক থাকুক আর নাই থাকুক, মানুষ এটা নিয়ে কথা বলবে। টক শোতে ইতোমধ্যে কথা বলা শুরু হয়েছে। তবে মুক্তি পেতে হয়তো আরও কিছু সময় লাগবে। বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তি নেবেন কি না, কিংবা বিদেশে চিকিৎসা নেবেন কি না, তা নির্ভর করছে একান্তই তার ওপর। জিয়া পরিবার প্যারোলে মুক্তি চাচ্ছে, এমন কথাও চাউর হয়েছে। বেগম জিয়ার বয়স হয়েছে। স্বাস্থ্য আর আগের মতো নেই। ছোট ছেলের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং রাজনীতি, বিশেষ করে বিএনপির আন্দোলনে ব্যর্থতা বেগম জিয়াকে আরও বেশি হতাশাগ্রস্ত করে ফেলেছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। এটা বোধকরি বেগম জিয়া নিজেও উপলব্ধি করেন যে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি হয়তো আর জামিন পাবেন না। এ ক্ষেত্রে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া তার জন্য মঙ্গল এই উপলব্ধি বোধ তার মাঝে আসতে পারে। তিনি বিদেশে বসে দলের নেতৃত্ব দেওয়া ও আন্দোলন সংঘটিত করা এটাও তিনি চিন্তা করতে পারেন। আগে সুস্থতা নিশ্চিত করা, পরে রাজনীতি। এরশাদবিরোধী আন্দোলন বেগম জিয়ার নেতৃত্ব আর আজকের বেগম জিয়া এর মাঝে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তখন বয়স কম ছিল। দুটি বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যৌথ আন্দোলন করেছিল। আর আজ বেগম জিয়া একা, সঙ্গে কোনো বড় দল নেই, উপরন্তু মাঝখানে চলে গেছে ২৯ বছর। বয়স বেড়েছে। হতাশা বেড়েছে। ব্যক্তি জীবনে বিপর্যয় এসেছে বারবার। এটা ঠিক বেগম জিয়া এখনও অবিসংবাদিত নেত্রী। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার বিকল্প বেগম জিয়াই। কামাল হোসেন নন। বিএনপির একটি অংশ এবং ঐক্যফ্রন্টও চাইবে বেগম জিয়া জেলে থাকুন! তাতে করে আন্দোলন করা সহজ। বেগম জিয়ার প্যারোলে মুক্তিতে আন্দোলনে আর কোনো ‘ইস্যু’ থাকে না! তাইতো গণঅনশনে আমরা ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বক্তব্য শুনেছি তারা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে চান। এটা যে শুধুমাত্র একটি ‘সেøাগান’ তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। বেগম জিয়া এক বছরের ওপরে জেলে আছেন। বিএনপি কিংবা ঐক্যফ্রন্ট আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেনি। কর্মীরা আন্দোলনের পক্ষে থাকলেও, বিএনপির নেতাদের আন্দোলনে দেখা যায় না। তারা বয়োবৃদ্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, আন্দোলনে তারা ব্যর্থ। তাই আন্দোলন নয়, বরং আইনি প্রক্রিয়াতেই বেগম জিয়ার মুক্তির উদ্যোগ নিয়েছিল বিএনপি। তাতেও তারা সফল হয়নি। এই যখন পরিস্থিতি তখন বিএনপির নির্বাচিত পাঁচজন সংসদ সদস্য সংসদে যোগ দিয়েছেন। এর আগে সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান সংসদে যোগ দিয়েছেন। এখন বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা তাদের অনুসরণ করলেন। তারেক রহমান এককভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিএনপির সাবেক নেতা ও এলডিপির সভাপতি অলি আহমেদ অত্যন্ত কড়া ভাষায় এর সমালোচনা করেছেন। আর বিএনপি ২০ দল ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ ছাড়া বিএনপির কাছে কোনো বিকল্প ছিল না প্রায় বারো বছর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। দশম জাতীয় সংসদে (২০১৪-১৮) নির্বাচন বিএনপি বয়কট করায় সংসদীয় রাজনীতি থেকে বিএনপি ছিটকে পড়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি অংশ নিলেও, আসন পেয়েছে মাত্র ৬টি। কিন্তু দলের চেয়ারপারসন বেগম জিয়া একদিকে জেলে অন্যদিকে কর্মীদের নামে হাজার হাজার মামলা। সংসদে কথা বলার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপি যদি সংসদে কথা বলার সুযোগটি বেছে নেয়, আমি তাতে অবাক হব না। কেননা সংসদীয় রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা একটিই আর তা হচ্ছে সংসদ। বিএনপি রাজপথে আন্দোলন করে সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারেনি। তাই তাদের সংসদ অধিবেশনে যোগদানকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। তবে প্রশ্ন যে নেই, তা নয়। প্রশ্ন আছে। এবং ২০ দলের শরিকরা সে প্রশ্নটিই তুলেছেন। অনেক দলীয় সিদ্ধান্ত দল যখন ধরে রাখতে পারে না, তখন দল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কাছে একটা ভিন্ন ম্যাসেজ পৌঁছে যায়। বিএনপির ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটল।
বিএনপির সংসদে যোগদানের বিষয়টির একটি ‘পজিটিভ’ দিক আছে। আর তা হচ্ছে বিএনপিকে আস্থায় নিয়ে সংসদীয় রাজনীতিকে শক্তিশালী করা। জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশের সমর্থন রয়েছে এই দলটির প্রতি। এই জনসমর্থন খুব একটা কমেছে বলে মনে হয় না। এখনও বিএনপি জনসভা করলে বিপুল জমায়েত হয়। সুতরাং গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপিকে তাই আস্থায় নেওয়া প্রয়োজন। সংসদীয় রাজনীতিতেও বিএনপির অবস্থান বেশ শক্তিশালী। বিএনপির জন্মের পর থেকেই এখন বিএনপি বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে তার অবস্থান ধরে রেখেছে। একাধিকবার দলে ভাঙন আসলেও, জিয়া পরিবারের হাতেই রয়েছে বিএনপির নেতৃত্ব। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রæয়ারি দেশে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (প্রথম ১৯৭৩ সালে)। ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের সংসদে বিএনপি পেয়েছিল ২০৭ আসন, প্রাপ্ত ভোটের শতকরা ৪১ দশমিক ১৭ ভাগ (আওয়ামী লীগ ৩৯ আসন, ২৪ দশমিক ৫৬ ভাগ ভোট)। জিয়ার মৃত্যু, এরশাদের সাময়িক অভ্যুত্থানের পর ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যাতে বিএনপি অংশ নেয়নি। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পায় ১৫৩ আসন, আর আওয়ামী লীগ ৭৬ আসন। ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই বয়কট করে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১ সালে। ওই নির্বাচনে বিএনপি পায় ১৪০ আসন (৩০.৮১ ভাগ ভোট)। আর আওয়ামী লীগ পায় ৮৮ আসন (৩০.০৮ ভাগ ভোট)। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে, যে সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১৩ দিন। ১৯৯৬ সালেই তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪৬ আসন (৩৭.৪৪ ভাগ ভোট আর পিএনপি পেয়েছিল ১১৬ আসন (৩৩.৬১ ভাগ ভোট)। পরবর্তীতে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০০১, ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০০৮) এই দুটি বড় দলের অবস্থান ছিল এ সময় বিএনপি চারদলীয় জোট ১৯৩ আসন (৪০.৯৭ ভাগ) ও আওয়ামী লীগ ৬২ আসন (৪০.১৩ ভাগ)। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ২৬২ (আওয়ামী লীগ ২৩০) আসন (৫৬.৯ ভাগ ভোট), আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ৩৩ আসন (৩৮.০৬ ভাগ)। কিন্তু এর পরপরই দৃশ্যটি বদলে যায়। তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়। দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যে নির্বাচন বিএনপি তথা চারদলীয় জোট বয়কট করে করেছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জাতীয় ঐক্যজোটের ব্যানারে অংশ নেয়। সংসদীয় রাজনীতির এই পরিসংখ্যান আমাদের বলে দেয় বড় দুটি দলের মাঝে আস্থার সম্পর্কটা থাকা জরুরি। তাতে করে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই আস্থার সম্পর্ক কতটুকু গড়ে উঠবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন। জাতীয় নেতাদের সম্মান দেখানো, কোনো ধরনের মন্তব্য না করা, বিএনপিকে সংসদে কথা বলার সুযোগ দেওয়া এসবই নির্ভর করে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে। এখন উচ্চ আদালতের জামিন মঞ্জুর সাপেক্ষে এবং চিকিৎসকদের মতামত অনুযায়ী বেগম জিয়া যদি বিদেশে যান (?) তাহলে দলটি নেতৃত্বহীন অবস্থায় কীভাবে পরিচালিত হবে সেটাও একটা প্রশ্ন। বিএনপি এখনই অনেকটা নেতৃত্বহীন। দলটির স্থায়ী পরিষদের কোনো ভ‚মিকা দেখা যাচ্ছে না। তরুণ নেতৃত্ব বিএনপির ভেতরে জন্ম হচ্ছে না। এমনি এক পরিস্থিতিতে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করারও কেউ নেই। তাই বিএনপির সংসদ সদস্যদের সংসদে যোগদান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
Daily Somoyer Alo
12.05.2019

0 comments:

Post a Comment