সংসদে বাজেট উপস্থাপনের সময় এলেই আমরা যারা শিক্ষকতায় আছি, তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ি শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ল কি বাড়ল না, তা বিশ্লেষণ করতে। এবারও হবে। শিক্ষা খাতে এবারও বাজেট বরাদ্দ বাড়বে, প্রতি বছরই বাড়ছে। শিক্ষা একটা বড় খাত। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, অনেক শিক্ষক, অনেক কর্মচারী। তারপর রয়েছে শত শত কলেজ। কলেজ শিক্ষকরা আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন। কিন্তু বেতন দেয় সরকার। প্রমোশনও দেয় সরকার। আজ এতটা বছর হয়ে গেল কোনো মন্ত্রীকে বলতে শুনলাম না শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য কী করা উচিত। সরকার বেতন দিচ্ছে। দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। কেউ পড়াতে পারল কি পারল না, তা দেখার কেউ নেই। এতদিন শুনতাম দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ। এখন দেখছি দলীয় বিবেচনায় হরদম পিএইচডি আর এমফিলে ভর্তি করানো হচ্ছে! অভিজ্ঞ শিক্ষক আছে কি নেই, এর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আরও অবাক কাণ্ড, যার নিজেরই পিএইচডি নেই, অধ্যাপকও নন, সদ্য পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষক পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক! যার নিজেরই পিএইচডি নেই, এমফিলও নেই, তিনি এখন পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধান করছেন! এমনকি পিএইচডির কোর্সও নিচ্ছেন! জাহাঙ্গীরনগরের এই ঘটনা উপাচার্য মহোদয় জানেন। বিজ্ঞ উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগরকে 'স্বপ্নের জাহাঙ্গীরনগর' বানাতে চেয়েছিলেন। আমরা উৎফুল্ল হয়েছিলাম। কিন্তু সেনা কর্মকর্তারা যে হারে জাহাঙ্গীরনগরের দিকে হাত বাড়াচ্ছেন, আর আমরা তা দিব্যি অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছি, তাতে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে অচিরেই প্রশ্ন উঠবে। দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা দেন অর্থমন্ত্রী। গেলবার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি পুরোটা সময়। বয়স হয়েছে। তবে বিনীতভাবে তাকে একটা কথা বলতে চাই_ শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর অর্থ নয় শিক্ষার মানোন্নয়ন। শিক্ষক সংখ্যা বাড়িয়েও মানোন্নয়ন হবে না। যেহেতু সরকার টাকা দেয়, মানোন্নয়নের ব্যাপারটিকেও সরকারকে ভাবতে হবে। শুধু ডিগ্রি নিয়ে আমরা দেশে উচ্চ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়াতে পারব মাত্র, কিন্তু দেশকে পরিচালনা করার যে যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব তা তৈরি করতে পারব না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন, সরকারি ও বেসরকারি। বেসরকারিতে সরকারের কর্তৃত্ব নেই। কোনো অর্থকড়িও সরকার দেয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেয়। কিন্তু কেমন চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো? সরকার যে টাকা দেয় তার খুব কম অংশই ব্যয় হয় গবেষণার কাজে। বরাদ্দকৃত টাকার সিংহভাগ চলে যায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উপাচার্য মহোদয়রা উন্নয়ন খাতে কিংবা গবেষণায় যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেই টাকা শিক্ষকদের বেতন দিতে ব্যয় করেছেন। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা দলীয় কোটায়, স্থানীয় কোটায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। গেল সপ্তাহে একটি জাতীয় দৈনিক ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নিজের মেয়ে, ভাই, আপন ভায়রা, শ্যালিকার মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়েকে শিক্ষক তথা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এই প্রবণতা প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। জাহাঙ্গীরনগর ইতিমধ্যে একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নয়ন বাজেট থেকে টাকা এনে শিক্ষক তথা কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ২০১১-১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (বিমক) কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২২২.৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬৫.১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে শিক্ষকদের বেতন দিতে। বিমক যে টাকা বরাদ্দ করে তা দিয়ে বেতন, পেনশন, সাধারণ খরচ, শিক্ষা খরচ, যানবাহন মেরামত ও মূলধনের চাহিদা মোটানো হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেতন পরিশোধের পর যা থাকে তা দিয়ে অন্যকিছু করা আর সম্ভব হয় না। ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান হয় না। তাদের নূ্যনতম চাহিদাও মেটাতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও খারাপ। তারা অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশন দিতে পারে না। ঢাকার পাশাপাশি দ্বিতীয় বরাদ্দ পাওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ওই সময় বেতন খাতে ব্যয় করেছে ১০০.৫০ কোটি টাকা (বিমক বরাদ্দ ১৩৯ কোটি), কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩.৫০ কোটি (বিমক বরাদ্দ ১১৩.৭৫ কোটি), বুয়েট ৪৭.৮০ কোটি (৭১.৯০ কোটি), জাহাঙ্গীরনগর ৫২ কোটি (৭৮.৫০ কোটি)। চলতি বছরে এই 'চাপ' আরও বাড়বে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের কারণে। অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগে কিংবা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে ৩৬টি) প্রতিষ্ঠা শিক্ষার মানোন্নয়নকে নির্দেশ করে না। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির যেসব খবর প্রকাশ হয়েছে, তা যদি আমরা বিবেচনায় নেই, তাহলে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকার। এক বিষয়ের ছাত্রকে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন বিভাগ খুলে সেসব বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানে দেখভাল করার কেউ নেই। একুশ শতকে এসে একটা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ছাত্র বেতন না বাড়িয়েও আয় বাড়ানো যায়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মঞ্জুরি কমিশনের নাম পরিবর্তন করে উচ্চশিক্ষা কমিশন করবে। সদস্য সংখ্যা হবে ৯ জন। তাতে মূল উদ্দেশ্য সফল হবে কি? তাতে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে কতটুকু? এতে সরকারের খরচ আরও বাড়ল।
আজ যখন অর্থমন্ত্রী সরকারের সর্বশেষ বাজেট দিতে যাচ্ছেন, তখন আমি চাইব কীভাবে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন করা যায়, তার একটি দিকনির্দেশনা তাতে থাকবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে নানা কাহিনী। এটি কার্যত একটি সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ১০ থেকে ১২ লাখ ছাত্রছাত্রী। কোর্স পড়ানোর মতো শিক্ষক আছে কি নেই, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনার্স কোর্স মায় মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। বছরের সব সময় পরীক্ষা লেগে আছে। ফলে ক্লাস হয় না। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা দিতে হয়। তাদের ভরসা ওই ঢাকার 'বাকুশা' মার্কেটের নোট বই। নোট বই পড়ে, ক্লাস না করেই অনার্স ও মাস্টার্স পাস। কোনো উপাচার্যই এই উদ্যোগটি নেননি_ কীভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানো যায়। সমাধান একটাই, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে (সব কর্মচারীকে আত্তীকরণ করে) ছয় বিভাগে ছয়টি একাডেমিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিভাগের সব কলেজ থাকবে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায়। সেখানে ক্লাস হবে নিয়মিত। ছয় বিভাগে ছয়টি বড় কলেজকে সামনে রেখে এই ধারণা বাস্তবায়ন করা যায়। প্রয়োজন একটি উদ্যোগের। একটি স্বার্থান্বেষী মহল এটি চায় না। গাজীপুরের মূল প্রশাসনিক ভবনে শুধু গবেষণানির্ভর একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়। বিদেশে এ ধরনের 'মডেল বিশ্ববিদ্যালয়' আছে। আমরা অস্ট্রেলিয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিপিপির আওতায় আনা যায় কি-না, অর্থমন্ত্রী বিষয়টি চিন্তা করে দেখতে পারেন। বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন। অনেকেরই এ সম্পর্কে ধারণা নেই। এখানে সরকারি খাতের সঙ্গে বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করতে হবে। এদেশে অনেক বেসরকারি উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। তারা বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করেছেন। তাদের সম্মিলিত চেষ্টার ফলে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে গেছে। যদি উৎসাহিত করা যায় তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিনিয়োগ করতে রাজি হবেন। এ ব্যাপারে মঞ্জুরি কমিশন একটা ধারণাপত্র উপস্থাপন করতে পারে। বেসরকারি বিনিয়োগে ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা যায়। কোনো শিল্পপতির নামে ছাত্রাবাস বা নতুন ভবন তৈরি করা যায়। বিদেশে তো আমরা এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেখেছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি অর্থায়ন অবশ্যই থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি অর্থায়নের সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। শুধু শিক্ষক নিয়োগ শিক্ষার মানোন্নয়ন নির্দেশ করে না।
Daily SAMAKAL
04.06.13
0 comments:
Post a Comment