আমাদের
‘জেট-সেট’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৫ মিনিটের এক ফটোসেশনের জন্য নিউইয়র্ক
গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ইউনেস্কোর সংস্কৃতিবিষয়ক সম্মেলনে অংশ নেয়া। যদিও তিনি
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী নন এবং মন্ত্রিসভায় একজন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীও
আছেন, তারপরও আমাদের ‘হাইব্রিড’ (বিরোধী দলের ভাষায়) পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। তার এ সফরের মধ্য দিয়ে আমাদের
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কী অর্জিত হল, তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র
হিসেবে আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণ বিলাসিতা
আমাদের মতো দেশের জন্য ঠিক নয়। গ্রিসের মতো একটি ইউরোপীয় দেশ যেখানে
অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রসাধন করছে, সেখানে আমাদের মতো দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
বিদেশ ভ্রমণের পেছনে রাষ্ট্র যে অর্থ ব্যয় করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন, গ্রিস চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ব্যয় সংকোচন
নীতির অংশ হিসেবে সরকারি টিভি স্টেশন ইআরটি বন্ধ করে দিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তার ঘন ঘন বিদেশ সফর, অহেতুক বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ নেয়া ইত্যাদি নানা কারণে তিনি মূল কাজে তেমন একটা মনোনিবেশ করতে পারছেন না। পররাষ্ট্রনীতিতে অর্জন তাই অতি সামান্যই। মহাজোট সরকারের আমলে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। এক, অতিমাত্রায় ভারতনির্ভরতা, যা পররাষ্ট্রনীতির সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী। দুই, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। তিন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেন্দ্রিক মার্কিন নীতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উষ্ণতা হ্রাস পেয়েছে। জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের আশংকাসহ বেশ কিছু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে। দুর্নীতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন থেকেও কোনো সাহায্য পাচ্ছে না।
পররাষ্ট্রনীতিতে একটা বড় ব্যর্থতা হচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফরে না আসা। জন কেরি ২৪ জুন ভারতে আসছেন। পরদিন তার বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই সফর বাতিল ঘোষিত হয়। বিদেশে ভাবমূর্তি উদ্ধারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যেখানে বড় অবদান রাখার কথা, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংস্কৃতিবিষয়ক সম্মেলনে অংশ নিয়ে অযথা রাষ্ট্রের বহু কষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা নষ্ট করছেন। আজারবাইজানে ফিলিস্তিন সংক্রান্ত সম্মেলনে (যেখানে ফিলিস্তিন বাদে তিনিই একমাত্র মন্ত্রী, নিউইয়র্কেও একমাত্র মন্ত্রী হিসেবে বক্তব্য রাখেন), কিংবা সুইজারল্যান্ডে ‘কাউন্টার টেরোরিজম’ শীর্ষক সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কী অর্জন হয়েছে, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি’, ‘জলবায়ু কূটনীতিতে’ তার সাফল্য অতি সামান্যই। বিদেশে বাংলাদেশের অবস্থানও তিনি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেননি।
মহাজোট সরকারের আমলে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ফি এখনও নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে।
কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। এ দুটি দেশকে ভারতের ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে- এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশী পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খেতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘সাতবোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে, তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এ ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি।
গত সাড়ে চার বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেয়া-নেয়ার ব্যাপারে ভারতের পাল্লাটা ভারি, বাংলাদেশের প্রাপ্তি তুলনামূলক বিচারে কম। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তিস্তা চুক্তি এখনও হয়নি। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধের প্রতিশ্র“তি দেয়া সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারেও কোনো সমাধান হয়নি। ভারত আমাদের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। এতে ১৩টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। এ বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির একটি চুক্তি হলেও তাতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে ওই সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল কম। যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান ও জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধ রোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল।
তবে ধারণা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখনীতে বেরিয়ে এসেছে যে, এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গড়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভাব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে ওঠার আলোকেই হিলারির সফরকে বিশ্লেষণ করতে হবে। হিলারির ওই সফরেও বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ সব পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে দাবি করে আসছে, তা এখন বাতিল হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘টিফা’র বদলে এখন ‘টিকফা’ (ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি) থেকে ভবিষ্যতে এ সাহায্য পাবে- এমন কোনো প্রতিশ্র“তিও আমরা পাইনি। তবে হিলারি ক্লিনটনের একটি বক্তব্যে আমি আশাবাদী। তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘সফ্ট পাওয়ার’ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যে কোনো বিবেচনায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কিংবা আরএমজি সেক্টরে বিশ্ব আসরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। হিলারি ক্লিনটন সেটাই স্বীকার করে গিয়েছিলেন। যারা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত, তাদের উচিত হবে বাংলাদেশের এ অর্জনকে ধরে রাখা।
সমুদ্রসীমায় আমাদের অধিকার নিশ্চিত হওয়ায় এ সম্ভাবনা এখন আরও বাড়ল। তবে যেতে হবে অনেক দূর। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে এরই মধ্যে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। রানা প্লাজায় ১ হাজার ১২৭ জন পোশাক কর্মীর মৃত্যু, গার্মেন্ট শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন চালু, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড, গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমমান বজায় রাখার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ড. ইউনূস ইস্যু। প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। অতি সম্প্রতি দুটি সংবাদ ছাপা হয়েছে, যা আমাদের উদ্বেগের জন্য যথেষ্ট। প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র নিউইর্য়ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিএসপি সুবিধা বাদ দিতে ওবামা প্রশাসনের ওপর শ্রম অধিকার রক্ষায় জড়িত মার্কিন সংগঠনগুলোর চাপ বাড়ছে। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের কেউ কেউ গার্মেন্ট সেক্টরের শ্রমমান ও শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্টের সব আইটেমে জিএসপি সুবিধা পায় না। কিছু পণ্যে জিএসপি সুবিধা পায়। এসব পণ্যের সব আবার বাংলাদেশ রফতানিও করে না। বাংলাদেশ অনেক দিন থেকেই গার্মেন্ট সেক্টরে এ জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছে। চলতি জুনেই এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল। এখন পুরো জিএসপি সুবিধা ঝুলে গেল। দ্বিতীয় আরও একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সম্ভাবনার বিষয়ে। এ সংক্রান্ত রিপোর্টটি ছাপা হয়েছে ৩১ মে। ন্যাটোর ওয়েবসাইটেও এ বিষয়টি আছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ১৫ মে ব্রাসেলসে ন্যাটোর সদর দফতর পরিদর্শন করেছেন এবং ন্যাটোর এ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। এ সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন বাংলাদেশের কোনো পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়নি এবং বাংলাদেশ এ থেকে কতটুকু উপকৃত হতে পারে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করা হয়নি।
তবে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষকরা মোটামুটি ধারণা রাখেন। ন্যাটোর লিসবন শীর্ষ সম্মেলনে ২০১০ সালে এ ধারণাপত্র গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকাণ্ড এখন আর শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা দক্ষিণ এশিয়াতেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ যদি সম্প্রসারিত এ কর্মসূচিতে নিজেকে জড়িত করে, তা যে অভ্যন্তরীণভাবে বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে তা বলাই বাহুল্য। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকাণ্ড ভারত মহাসাগর এলাকায় সম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ নৌবহরের বেশ ক’টি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়বে। সঙ্গত কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একটা প্রশ্নের মধ্যে থেকে যাবে।
তবে এক্ষেত্রে একটি কথা বলা বাঞ্ছনীয়। শেখ হাসিনার প্রথম টার্মের (১৯৯৬-২০০১) পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে বর্তমান টার্মের পররাষ্ট্রনীতির সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে প্রথম টার্মে তিনি যতটা না ‘স্পষ্ট’ ছিলেন, এবার তিনি অনেক বেশি ‘স্পষ্ট’। তবে তার প্রথম টার্মেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নত হয়েছিল। তার প্রথম টার্মে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিও (হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিসটেন্স নিড্স অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ফেব্র“য়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম টার্মে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (১২৪ মিলিয়ন ডলারে), যা পরে নানা বিতর্কের জš§ দেয়। তার দ্বিতীয় টার্মেও সেই ধারাবাহিকতা তিনি রক্ষা করলেন। আসলে জাতীয় স্বার্র্থকে সামনে রেখেই পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া উচিত বেশি। মহাজোট সরকারের আমলে এ স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। শুধু বিদেশ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে এ স্বার্থ অর্জিত হবে না। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেক্টরগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে হবে। মাত্র ৫ ঘণ্টার জন্য নিউইয়র্ক সফর করে মন্ত্রী তার নামের ওপর সুবিচার করতে পারেননি। একুশ শতকে বাংলাদেশের লক্ষ্য কী, অর্জন কী, ‘সফ্ট পাওয়ার’ হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবেÑ এসবের কোনো দিকনির্দেশনা নেই পররাষ্ট্রনীতিতে। শুধু বিদেশ সফর করে পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতা আনা যায় না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তার ঘন ঘন বিদেশ সফর, অহেতুক বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ নেয়া ইত্যাদি নানা কারণে তিনি মূল কাজে তেমন একটা মনোনিবেশ করতে পারছেন না। পররাষ্ট্রনীতিতে অর্জন তাই অতি সামান্যই। মহাজোট সরকারের আমলে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। এক, অতিমাত্রায় ভারতনির্ভরতা, যা পররাষ্ট্রনীতির সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী। দুই, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। তিন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেন্দ্রিক মার্কিন নীতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উষ্ণতা হ্রাস পেয়েছে। জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের আশংকাসহ বেশ কিছু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে। দুর্নীতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন থেকেও কোনো সাহায্য পাচ্ছে না।
পররাষ্ট্রনীতিতে একটা বড় ব্যর্থতা হচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফরে না আসা। জন কেরি ২৪ জুন ভারতে আসছেন। পরদিন তার বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই সফর বাতিল ঘোষিত হয়। বিদেশে ভাবমূর্তি উদ্ধারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যেখানে বড় অবদান রাখার কথা, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংস্কৃতিবিষয়ক সম্মেলনে অংশ নিয়ে অযথা রাষ্ট্রের বহু কষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা নষ্ট করছেন। আজারবাইজানে ফিলিস্তিন সংক্রান্ত সম্মেলনে (যেখানে ফিলিস্তিন বাদে তিনিই একমাত্র মন্ত্রী, নিউইয়র্কেও একমাত্র মন্ত্রী হিসেবে বক্তব্য রাখেন), কিংবা সুইজারল্যান্ডে ‘কাউন্টার টেরোরিজম’ শীর্ষক সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কী অর্জন হয়েছে, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি’, ‘জলবায়ু কূটনীতিতে’ তার সাফল্য অতি সামান্যই। বিদেশে বাংলাদেশের অবস্থানও তিনি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেননি।
মহাজোট সরকারের আমলে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ফি এখনও নির্ধারিত হয়নি। বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে।
কিন্তু দেখা গেল ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। এ দুটি দেশকে ভারতের ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে- এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশী পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খেতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘সাতবোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে, তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এ ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি।
গত সাড়ে চার বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেয়া-নেয়ার ব্যাপারে ভারতের পাল্লাটা ভারি, বাংলাদেশের প্রাপ্তি তুলনামূলক বিচারে কম। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তিস্তা চুক্তি এখনও হয়নি। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধের প্রতিশ্র“তি দেয়া সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারেও কোনো সমাধান হয়নি। ভারত আমাদের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। এতে ১৩টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। এ বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ ভারতের নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির একটি চুক্তি হলেও তাতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে ওই সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল কম। যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান ও জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধ রোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল।
তবে ধারণা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখনীতে বেরিয়ে এসেছে যে, এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গড়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভাব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে ওঠার আলোকেই হিলারির সফরকে বিশ্লেষণ করতে হবে। হিলারির ওই সফরেও বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ সব পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে দাবি করে আসছে, তা এখন বাতিল হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘টিফা’র বদলে এখন ‘টিকফা’ (ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি) থেকে ভবিষ্যতে এ সাহায্য পাবে- এমন কোনো প্রতিশ্র“তিও আমরা পাইনি। তবে হিলারি ক্লিনটনের একটি বক্তব্যে আমি আশাবাদী। তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘সফ্ট পাওয়ার’ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যে কোনো বিবেচনায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কিংবা আরএমজি সেক্টরে বিশ্ব আসরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। হিলারি ক্লিনটন সেটাই স্বীকার করে গিয়েছিলেন। যারা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত, তাদের উচিত হবে বাংলাদেশের এ অর্জনকে ধরে রাখা।
সমুদ্রসীমায় আমাদের অধিকার নিশ্চিত হওয়ায় এ সম্ভাবনা এখন আরও বাড়ল। তবে যেতে হবে অনেক দূর। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে এরই মধ্যে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। রানা প্লাজায় ১ হাজার ১২৭ জন পোশাক কর্মীর মৃত্যু, গার্মেন্ট শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন চালু, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড, গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমমান বজায় রাখার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ড. ইউনূস ইস্যু। প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। অতি সম্প্রতি দুটি সংবাদ ছাপা হয়েছে, যা আমাদের উদ্বেগের জন্য যথেষ্ট। প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র নিউইর্য়ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিএসপি সুবিধা বাদ দিতে ওবামা প্রশাসনের ওপর শ্রম অধিকার রক্ষায় জড়িত মার্কিন সংগঠনগুলোর চাপ বাড়ছে। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের কেউ কেউ গার্মেন্ট সেক্টরের শ্রমমান ও শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্টের সব আইটেমে জিএসপি সুবিধা পায় না। কিছু পণ্যে জিএসপি সুবিধা পায়। এসব পণ্যের সব আবার বাংলাদেশ রফতানিও করে না। বাংলাদেশ অনেক দিন থেকেই গার্মেন্ট সেক্টরে এ জিএসপি সুবিধা চেয়ে আসছে। চলতি জুনেই এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল। এখন পুরো জিএসপি সুবিধা ঝুলে গেল। দ্বিতীয় আরও একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সম্ভাবনার বিষয়ে। এ সংক্রান্ত রিপোর্টটি ছাপা হয়েছে ৩১ মে। ন্যাটোর ওয়েবসাইটেও এ বিষয়টি আছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ১৫ মে ব্রাসেলসে ন্যাটোর সদর দফতর পরিদর্শন করেছেন এবং ন্যাটোর এ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। এ সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন বাংলাদেশের কোনো পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়নি এবং বাংলাদেশ এ থেকে কতটুকু উপকৃত হতে পারে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করা হয়নি।
তবে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষকরা মোটামুটি ধারণা রাখেন। ন্যাটোর লিসবন শীর্ষ সম্মেলনে ২০১০ সালে এ ধারণাপত্র গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। ন্যাটোর কর্মকাণ্ড এখন আর শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা দক্ষিণ এশিয়াতেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ যদি সম্প্রসারিত এ কর্মসূচিতে নিজেকে জড়িত করে, তা যে অভ্যন্তরীণভাবে বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে তা বলাই বাহুল্য। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনীর এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকাণ্ড ভারত মহাসাগর এলাকায় সম্প্রসারিত করেছে। আগামীতে মার্কিন ষষ্ঠ নৌবহরের বেশ ক’টি জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রসীমায় মোতায়েন করা হবে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়বে। সঙ্গত কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একটা প্রশ্নের মধ্যে থেকে যাবে।
তবে এক্ষেত্রে একটি কথা বলা বাঞ্ছনীয়। শেখ হাসিনার প্রথম টার্মের (১৯৯৬-২০০১) পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে বর্তমান টার্মের পররাষ্ট্রনীতির সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে প্রথম টার্মে তিনি যতটা না ‘স্পষ্ট’ ছিলেন, এবার তিনি অনেক বেশি ‘স্পষ্ট’। তবে তার প্রথম টার্মেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নত হয়েছিল। তার প্রথম টার্মে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিও (হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিসটেন্স নিড্স অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ফেব্র“য়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম টার্মে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (১২৪ মিলিয়ন ডলারে), যা পরে নানা বিতর্কের জš§ দেয়। তার দ্বিতীয় টার্মেও সেই ধারাবাহিকতা তিনি রক্ষা করলেন। আসলে জাতীয় স্বার্র্থকে সামনে রেখেই পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া উচিত বেশি। মহাজোট সরকারের আমলে এ স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। শুধু বিদেশ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে এ স্বার্থ অর্জিত হবে না। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেক্টরগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে হবে। মাত্র ৫ ঘণ্টার জন্য নিউইয়র্ক সফর করে মন্ত্রী তার নামের ওপর সুবিচার করতে পারেননি। একুশ শতকে বাংলাদেশের লক্ষ্য কী, অর্জন কী, ‘সফ্ট পাওয়ার’ হিসেবে বাংলাদেশ কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবেÑ এসবের কোনো দিকনির্দেশনা নেই পররাষ্ট্রনীতিতে। শুধু বিদেশ সফর করে পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতা আনা যায় না।
Daily JUGANTOR
22.06.13
0 comments:
Post a Comment