অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়লেও তা দিয়ে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের কোনো সুযোগ নেই। ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বিশাল বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৫ হাজার ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ শতকরা ১১ দশমিক ৩ ভাগ। এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ। ঋণের সুদের জন্য যে টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেটা সর্বোচ্চ, শতকরা ১২ দশমিক ৫ ভাগ। সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি ওঠে তা হচ্ছে, শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে আমরা উচ্চশিক্ষার কতটুকু মানোন্নয়ন করতে পারব? বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষার মানোন্নয়ন বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় গবেষণা, আইটি সেক্টরের উন্নয়ন এ বরাদ্দ দিয়ে আদৌ সম্ভব নয়। কারণ এ অর্থের মধ্যে ১১ হাজার ৯৩৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় হবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে। আর ১৩ হাজার ১৭৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয় হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য যে বরাদ্দ, তাতে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ এ টাকার খুব সামান্যই ব্যয় হয় উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে।
শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের একটা অংশ বরাদ্দ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। ২০০১-০২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৯৩.৫৭ কোটি টাকা, আর ২০১০-১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০২.২৪ কোটি টাকায়। ২০০১-০২ সালে জাতীয় বাজেটের মাত্র ০.৭৫ ভাগ বরাদ্দ ছিল শিক্ষা খাতে। ২০১০-১১ সালে এ হার বেড়ে হয়েছে ০.৮৪ ভাগ। আবার যদি শুধু শিক্ষা খাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বরাদ্দের দিকে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে, এ বরাদ্দ মাত্র ৭.৮৫ ভাগ (২০০১-০২) থেকে ৮.২২ ভাগ (২০১০-১১)। অর্থাৎ পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। যদিও তুলনামূলক বিচারে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। তারপরও কথা থেকে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে এর চেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব নয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভেবে দেখতে হবে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় বাড়ানো যায় এবং সরকারের ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা কমানো যায়। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজনÑ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, তার খুব কম অংশই ব্যয় হয় গবেষণার কাজে। বরাদ্দকৃত টাকার সিংহভাগ চলে যায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উন্নয়ন খাতে কিংবা গবেষণায় যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, উপাচার্য মহোদয়রা সেই টাকা শিক্ষকদের বেতন দিতে ব্যয় করেছেন।
প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দলীয় কোটায়, স্থানীয় কোটায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। গেল সপ্তাহে একটি জাতীয় দৈনিক ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নিজের মেয়ে, ভাই, আপন ভায়রা, শ্যালিকার মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়েকে শিক্ষক তথা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এ প্রবণতা প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। জাহাঙ্গীরনগর ইতিমধ্যে একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে! ফলে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নয়ন বাজেট থেকে টাকা এনে শিক্ষক তথা কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ২০১১-১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২২২.৪০ কোটি টাকা। এর মাঝে ১৬৫.১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে শুধু শিক্ষকদের বেতন দিতে। ইউজিসি যে টাকা বরাদ্দ করে তা দিয়ে বেতন, পেনশন, সাধারণ খরচ, শিক্ষা খরচ, যানবাহন মেরামত ও মূলধনের চাহিদা মেটানো হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেতন পরিশোধের পর যা থাকে, তা দিয়ে অন্যকিছু করা আর সম্ভব হয় না। ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান হয় না। তাদের ন্যূনতম চাহিদাও মেটাতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও খারাপ। তারা অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশন দিতে পারে না।
তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। একুশ শতকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোপুরি সরকারি অর্থে পরিচালিত হবে কি-না, এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশ একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি কল্যাণকামী অর্থনীতি নয়। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপের কোনো কোনো রাষ্ট্রে (যেমন জার্মানি) কিংবা নরডিকভুক্ত রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্র সব নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ সে পর্যায়ে যেতে পারেনি। ওইসব রাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা একদম ফ্রি। আমরা সেখানে পড়াশোনা করেছি কোনো রকম টিউশন ফি ছাড়াই (শুধু ছাত্র সংসদের জন্য কিছু অর্থ দিতে হয়)। স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি ফ্রি না হলেও বেকার ভাতা সেখানে রয়েছে। জার্মানি বা সুইডেনের অর্থনীতির পক্ষে সম্ভব সাধারণ নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি সে পর্যায়ে নেই। তবে যে পর্যায়ে রাষ্ট্র শিক্ষা খাতকে প্রমোট করে, তা ঠিক আছে। রাষ্ট্র শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ দেবে। তবে এখানে উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।
একুশ শতকে এসে একটা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ছাত্র বেতন না বাড়িয়েও আয় বাড়ানো যায়। এজন্য কতগুলো বিকল্প নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারেন। প্রয়োজন পিপিপি অথবা বেসরকারি খাতকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। যেমন ব্যবসায় প্রশাসন, অর্থনীতি, প্রযুক্তি বিদ্যা, ফার্মেসিতে বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বেসরকারি পুঁজিতে ল্যাব হতে পারে, ছাত্রাবাস নির্মিত হতে পারে, ট্রেনিং প্রোগ্রাম হতে পারে। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী রয়েছেন। প্রয়োজন একটি নীতি প্রণয়ন ও যোগাযোগ। একই সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেকেন্ড ক্যাম্পাস কিংবা সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম (শুধু ব্যবসা প্রশাসন কোর্সই নয়) চালু করে তাদের আয় বাড়াতে পারে। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় এ উদ্যোগ নিতে পারে। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ট্রেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। আর সেই বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে দক্ষ জনশক্তি পেতে পারে বড় বড় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। গার্মেন্টের পর আমাদের একটা সম্ভাবনার খাত হচ্ছে ওষুধ শিল্প। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়েই ফার্মেসি, বায়োটেকনোলজি বিভাগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো বড় বিনিয়োগ করতে পারে। মোট কথা, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয় চলবে। কিন্তু এখানে বিনিয়োগে বেসরকারি খাতকে আমরা উৎসাহিত করতে পারি। বেসরকারি উদ্যোক্তারা ইতিমধ্যে বেশ ক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করছে। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো শিক্ষকও রয়েছেন। উদ্যোক্তারা যদি সেখানে বিনিয়োগ করতে পারেন, তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করবেন না কেন?
আসলে এজন্য যা দরকার তা হচ্ছে সুস্পষ্ট একটি নীতিমালা। ইউজিসি এ নীতিমালাটি তৈরি করতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইউজিসিতে সেই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব নেই। ওখানে যারা যান, তারা যেন অনেকটা ‘চাকরি’ করতে যান! এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের একটা ভুল ‘মেসেজ’ পৌঁছে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। তাদের আন্দোলনে যেতে প্ররোচিত করতে পারে কোনো পক্ষ। কিন্তু আমরা যদি ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার ক্ষেত্র বাড়াতে পারি, যদি চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করতে পারি, আমার ধারণা ছাত্রছাত্রীরা তা মেনে নেবে।
মূল বিষয়টি হচ্ছে, শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার মানের উন্নতির জন্য বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, আমাদের অর্থমন্ত্রী বললেন, বরাদ্দকৃত অর্থে ১ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩২৫ মাদ্রাসা ও ৬০০ কলেজের অবকাঠামো নির্মাণ করবেন। আরও ২০ হাজার ৫০০ প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট, ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া তিনি সরবরাহ করবেন। স্কুলের অবকাঠামো নির্মাণে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। সেটা রাষ্ট্র অবশ্যই করবে। কিন্তু স্কুলে ল্যাপটপ? মাল্টিমিডিয়া? অর্থমন্ত্রী কি জানেন ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি শিক্ষক রয়েছে? ল্যাপটপ চালানোর জন্য ক’জন প্রশিক্ষক স্কুলগুলোতে আছেন? রাষ্ট্র কি প্রতিটি স্কুলে আইটি শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে? এ বিষয়টি খুবই জরুরি। স্কুলে মাল্টিমিডিয়া না দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাল্টিমিডিয়া দেয়া উচিত। প্রতিটি রুমে (যেখানে ক্লাস হয়) যদি ল্যাপটপসহ মাল্টিমিডিয়া স্থাপন করা যায়, আমার ধারণা, এতে শিক্ষার মানের অনেক উন্নতি হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি সেক্টরে দক্ষ জনশক্তি রয়েছে। মাল্টিমিডিয়াগুলো ব্যবহƒত হবে, কোনো অবস্থাতেই ‘শো-পিস’ হিসেবে থেকে যাবে না।
বাজেটে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য না থাকায় আমি রীতিমতো হতাশ হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে দলীয় কর্মীদের চাকরির একটা জায়গা হিসেবে। দলীয়করণ, আÍীয়করণ, স্থানীয়করণ ইত্যাদির কারণে উচ্চশিক্ষা আজ প্রশ্নের মুখে। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে আমরা উচ্চশিক্ষাকে এখন প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। শুধু তাই নয়, অজপাড়াগাঁয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে একধরনের বৈষম্যও তৈরি করেছি। রাজনৈতিক বিবেচনায় এমফিল, পিএইচডি কোর্সে ছাত্র ভর্তি করিয়ে উচ্চশিক্ষাকে আমরা হাস্যাস্পদ করে তুলেছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এক্ষেত্রে অসহায়। শিক্ষামন্ত্রী জাতীয় শিক্ষা নিয়ে গর্ব করেন। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী কি উচ্চশিক্ষার হালহকিকত সম্পর্কে জ্ঞাত? আমার ধারণা, তার করার কিছু নেই। তিনি অসহায় ও অসৎ রাজনীতির কাছে জিম্মি! এ প্রবণতা চলতে থাকলে আগামীতে আমরা লাখ লাখ মাস্টার্স ডিগ্রিধারী তৈরি করব, হাজার হাজার পিএইচডি ডিগ্রিধারী বেরুবে, কিন্তু তাতে করে শিক্ষার মানোন্নয়ন কতটুকু হবে? অর্থমন্ত্রী আবার পার্লামেন্টে দাঁড়াবেন। বাজেটে বরাদ্দকৃত খাতগুলো সম্পর্কে বক্তব্য রাখবেন। উচ্চশিক্ষার এ বিষয়টি সম্পর্কে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু তা আমাকে আশাবাদী করে না।
Daily JUGANTOR
14.06.13
শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের একটা অংশ বরাদ্দ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। ২০০১-০২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৯৩.৫৭ কোটি টাকা, আর ২০১০-১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০২.২৪ কোটি টাকায়। ২০০১-০২ সালে জাতীয় বাজেটের মাত্র ০.৭৫ ভাগ বরাদ্দ ছিল শিক্ষা খাতে। ২০১০-১১ সালে এ হার বেড়ে হয়েছে ০.৮৪ ভাগ। আবার যদি শুধু শিক্ষা খাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বরাদ্দের দিকে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে, এ বরাদ্দ মাত্র ৭.৮৫ ভাগ (২০০১-০২) থেকে ৮.২২ ভাগ (২০১০-১১)। অর্থাৎ পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। যদিও তুলনামূলক বিচারে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। তারপরও কথা থেকে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে এর চেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব নয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভেবে দেখতে হবে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় বাড়ানো যায় এবং সরকারের ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা কমানো যায়। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজনÑ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, তার খুব কম অংশই ব্যয় হয় গবেষণার কাজে। বরাদ্দকৃত টাকার সিংহভাগ চলে যায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উন্নয়ন খাতে কিংবা গবেষণায় যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, উপাচার্য মহোদয়রা সেই টাকা শিক্ষকদের বেতন দিতে ব্যয় করেছেন।
প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দলীয় কোটায়, স্থানীয় কোটায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। গেল সপ্তাহে একটি জাতীয় দৈনিক ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নিজের মেয়ে, ভাই, আপন ভায়রা, শ্যালিকার মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়েকে শিক্ষক তথা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এ প্রবণতা প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। জাহাঙ্গীরনগর ইতিমধ্যে একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে! ফলে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নয়ন বাজেট থেকে টাকা এনে শিক্ষক তথা কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ২০১১-১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২২২.৪০ কোটি টাকা। এর মাঝে ১৬৫.১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে শুধু শিক্ষকদের বেতন দিতে। ইউজিসি যে টাকা বরাদ্দ করে তা দিয়ে বেতন, পেনশন, সাধারণ খরচ, শিক্ষা খরচ, যানবাহন মেরামত ও মূলধনের চাহিদা মেটানো হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেতন পরিশোধের পর যা থাকে, তা দিয়ে অন্যকিছু করা আর সম্ভব হয় না। ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান হয় না। তাদের ন্যূনতম চাহিদাও মেটাতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও খারাপ। তারা অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশন দিতে পারে না।
তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। একুশ শতকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোপুরি সরকারি অর্থে পরিচালিত হবে কি-না, এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশ একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি কল্যাণকামী অর্থনীতি নয়। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপের কোনো কোনো রাষ্ট্রে (যেমন জার্মানি) কিংবা নরডিকভুক্ত রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্র সব নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ সে পর্যায়ে যেতে পারেনি। ওইসব রাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা একদম ফ্রি। আমরা সেখানে পড়াশোনা করেছি কোনো রকম টিউশন ফি ছাড়াই (শুধু ছাত্র সংসদের জন্য কিছু অর্থ দিতে হয়)। স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি ফ্রি না হলেও বেকার ভাতা সেখানে রয়েছে। জার্মানি বা সুইডেনের অর্থনীতির পক্ষে সম্ভব সাধারণ নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি সে পর্যায়ে নেই। তবে যে পর্যায়ে রাষ্ট্র শিক্ষা খাতকে প্রমোট করে, তা ঠিক আছে। রাষ্ট্র শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ দেবে। তবে এখানে উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।
একুশ শতকে এসে একটা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ছাত্র বেতন না বাড়িয়েও আয় বাড়ানো যায়। এজন্য কতগুলো বিকল্প নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারেন। প্রয়োজন পিপিপি অথবা বেসরকারি খাতকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। যেমন ব্যবসায় প্রশাসন, অর্থনীতি, প্রযুক্তি বিদ্যা, ফার্মেসিতে বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বেসরকারি পুঁজিতে ল্যাব হতে পারে, ছাত্রাবাস নির্মিত হতে পারে, ট্রেনিং প্রোগ্রাম হতে পারে। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী রয়েছেন। প্রয়োজন একটি নীতি প্রণয়ন ও যোগাযোগ। একই সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেকেন্ড ক্যাম্পাস কিংবা সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম (শুধু ব্যবসা প্রশাসন কোর্সই নয়) চালু করে তাদের আয় বাড়াতে পারে। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় এ উদ্যোগ নিতে পারে। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ট্রেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। আর সেই বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে দক্ষ জনশক্তি পেতে পারে বড় বড় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। গার্মেন্টের পর আমাদের একটা সম্ভাবনার খাত হচ্ছে ওষুধ শিল্প। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়েই ফার্মেসি, বায়োটেকনোলজি বিভাগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো বড় বিনিয়োগ করতে পারে। মোট কথা, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয় চলবে। কিন্তু এখানে বিনিয়োগে বেসরকারি খাতকে আমরা উৎসাহিত করতে পারি। বেসরকারি উদ্যোক্তারা ইতিমধ্যে বেশ ক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করছে। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো শিক্ষকও রয়েছেন। উদ্যোক্তারা যদি সেখানে বিনিয়োগ করতে পারেন, তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করবেন না কেন?
আসলে এজন্য যা দরকার তা হচ্ছে সুস্পষ্ট একটি নীতিমালা। ইউজিসি এ নীতিমালাটি তৈরি করতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইউজিসিতে সেই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব নেই। ওখানে যারা যান, তারা যেন অনেকটা ‘চাকরি’ করতে যান! এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের একটা ভুল ‘মেসেজ’ পৌঁছে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। তাদের আন্দোলনে যেতে প্ররোচিত করতে পারে কোনো পক্ষ। কিন্তু আমরা যদি ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার ক্ষেত্র বাড়াতে পারি, যদি চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করতে পারি, আমার ধারণা ছাত্রছাত্রীরা তা মেনে নেবে।
মূল বিষয়টি হচ্ছে, শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার মানের উন্নতির জন্য বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, আমাদের অর্থমন্ত্রী বললেন, বরাদ্দকৃত অর্থে ১ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩২৫ মাদ্রাসা ও ৬০০ কলেজের অবকাঠামো নির্মাণ করবেন। আরও ২০ হাজার ৫০০ প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট, ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া তিনি সরবরাহ করবেন। স্কুলের অবকাঠামো নির্মাণে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। সেটা রাষ্ট্র অবশ্যই করবে। কিন্তু স্কুলে ল্যাপটপ? মাল্টিমিডিয়া? অর্থমন্ত্রী কি জানেন ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি শিক্ষক রয়েছে? ল্যাপটপ চালানোর জন্য ক’জন প্রশিক্ষক স্কুলগুলোতে আছেন? রাষ্ট্র কি প্রতিটি স্কুলে আইটি শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে? এ বিষয়টি খুবই জরুরি। স্কুলে মাল্টিমিডিয়া না দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাল্টিমিডিয়া দেয়া উচিত। প্রতিটি রুমে (যেখানে ক্লাস হয়) যদি ল্যাপটপসহ মাল্টিমিডিয়া স্থাপন করা যায়, আমার ধারণা, এতে শিক্ষার মানের অনেক উন্নতি হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি সেক্টরে দক্ষ জনশক্তি রয়েছে। মাল্টিমিডিয়াগুলো ব্যবহƒত হবে, কোনো অবস্থাতেই ‘শো-পিস’ হিসেবে থেকে যাবে না।
বাজেটে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য না থাকায় আমি রীতিমতো হতাশ হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে দলীয় কর্মীদের চাকরির একটা জায়গা হিসেবে। দলীয়করণ, আÍীয়করণ, স্থানীয়করণ ইত্যাদির কারণে উচ্চশিক্ষা আজ প্রশ্নের মুখে। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে আমরা উচ্চশিক্ষাকে এখন প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। শুধু তাই নয়, অজপাড়াগাঁয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে একধরনের বৈষম্যও তৈরি করেছি। রাজনৈতিক বিবেচনায় এমফিল, পিএইচডি কোর্সে ছাত্র ভর্তি করিয়ে উচ্চশিক্ষাকে আমরা হাস্যাস্পদ করে তুলেছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এক্ষেত্রে অসহায়। শিক্ষামন্ত্রী জাতীয় শিক্ষা নিয়ে গর্ব করেন। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী কি উচ্চশিক্ষার হালহকিকত সম্পর্কে জ্ঞাত? আমার ধারণা, তার করার কিছু নেই। তিনি অসহায় ও অসৎ রাজনীতির কাছে জিম্মি! এ প্রবণতা চলতে থাকলে আগামীতে আমরা লাখ লাখ মাস্টার্স ডিগ্রিধারী তৈরি করব, হাজার হাজার পিএইচডি ডিগ্রিধারী বেরুবে, কিন্তু তাতে করে শিক্ষার মানোন্নয়ন কতটুকু হবে? অর্থমন্ত্রী আবার পার্লামেন্টে দাঁড়াবেন। বাজেটে বরাদ্দকৃত খাতগুলো সম্পর্কে বক্তব্য রাখবেন। উচ্চশিক্ষার এ বিষয়টি সম্পর্কে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু তা আমাকে আশাবাদী করে না।
Daily JUGANTOR
14.06.13
0 comments:
Post a Comment