রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জন কেরির বাংলাদেশ সফর বাতিল প্রসঙ্গে

২৪ জুন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব জন কেরি ভারত সফরে আসছেন। এ সফরে তার বাংলাদেশে আসা নির্ধারিত থাকলেও, শেষ মুহূর্তে তা বাতিল ঘোষিত হয়। তার বাংলাদেশ সফরকাল প্রত্যাশিত হলেও শেষ মুহূর্তে বাতিল ঘোষিত হওয়ায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দু’দেশের মধ্যে সম্প্রতি নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য যতটুকুই জেএসপি সুবিধা পায়, সেই জেএসপি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১০০ এর ওপর পোশাক কর্মীর মৃত্যু, পোশাক শিল্পে প্রশাসন, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকা-ের ঘটনার বিচার না হওয়া ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশী তৈরি পোশাক নিয়ে মার্কিন সমাজে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। উপরন্তু ড. ইউনূস ইস্যুতেও বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকায় নাখোশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ‘টিকফা’ চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ৮ জুন ঢাকায় দু’দেশের মধ্যে এ ‘সংলাপ’-এর দ্বিতীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এ যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তিতে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই’-এ সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আকসা’ বা ‘অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট’ চুক্তি করতে চায়। এ চুক্তিটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি চুক্তি। প্রস্তাবিত এ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ‘গাইডেড মিসাইল’সহ বেশ কয়েক ধরনের আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করবে। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রা বিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার জন্য বাংলাদেশে ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। এদিকে বাংলাদেশ ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ ব্যাখ্যা করেছে। ১৫ মে বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ব্রাসেলসে ন্যাটোর সদর দফতরে মার্কিন কমান্ডারদের সঙ্গে আলোচনায় এ আগ্রহের কথা জানান। তবে এ আগ্রহের ধরন কী হবে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। ন্যাটো ২০১০ সালে তার লিসবন সম্মেলনে ঝঃৎধঃবমরপ ঈড়হপবঢ়ঃ-টি গ্রহণ করেছিল। এ ধারণাপত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। অর্থাৎ ইউরোপের বাইরেও ন্যাটো একটি ভূমিকা রাখতে চায়। অনেকেরই মনে থাকার কথা, গেল বছরের ৩১ মে টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইনে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি গাড়তে চাইছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব লিওন প্যানেট্টা ‘সংগ্রিলা ডায়লগ’-এ (সিঙ্গাপুর, জুন ২০১২) স্পষ্ট করছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রণতরীর সংখ্যা বাড়াবে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে এই রণতরীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬-এ। খুব স্বাভাবিক কারণেই এতে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরীর যাতায়াত বাড়বে। তারা চট্টগ্রাম বন্দরের ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা নেবে। এ জন্যই তারা চাচ্ছে ‘আকসা’ চুক্তিটি। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গোপসাগরভুক্ত এ অঞ্চল ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

অনেকেরই মনে থাকার কথা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরপরই প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মিয়ানমারকে (নভেম্বর ১৯, ২০১২)। মিয়ানমারে প্রথমবারের মতো একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়েছে। এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের ধারাবাহিকতায়ই জন কেরির বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। তিনি না এলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।

বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে নানা কারণে। প্রথমত, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের নৌবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে, সেখানে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে, সেই ‘শূন্যতা’ পূরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘শান্তিরক্ষী’ বাহিনী গঠন করা, যারা ২০১৪ সালে মার্কিন সৈন্যদের পরিবর্তে আফগানিস্তানের শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ইসলামিক কট্টরপন্থিরা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন করে একটি ঘাঁটি গড়তে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মোর্চা গঠন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বিপুল জ্বালানি সম্পদ রয়েছে গভীর সমুদ্রে। মার্কিনি আইওসির এ ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জন্য এ কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অবস্থান করে খুব সহজেই মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় এবং বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী চীনের রাজনৈতিক উত্থানপতনে প্রভাব খাটানো সম্ভব। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পরপরই বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। এ লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আকসা চুক্তি করতে চাচ্ছে। যদিও এখন অবধি বাংলাদেশ তার সমর্থন জানায়নি।

বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরীর দীর্ঘ উপস্থিতি বাংলাদেশকে তার স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্টের আওতায় নিয়ে আসা। এমনকি মালদ্বীপের সঙ্গে প্রস্তাবিত চুক্তির অর্থ একটাই, চীন যে এ অঞ্চল ঘিরে ‘ঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং’ বা ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করছে, তার বিরুদ্ধে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর পার হয়ে অ্যারাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্র পথ, এ পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীন যে তেল আমদানি করে, তার ৮০ ভাগ এই মালাক্কা প্রণালি হয়ে চীনে যায়। তাই সঙ্গত কারণেই চীনের জন্য ভারত মহাসাগরে তার উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাওদারে চীনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিট থাকবে, যা কিনা ভারত মহাসাগরের সব নৌ ম্যুভমেন্ট মনিটর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব আরও বেড়েছে। স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৮০ নটিক্যাল মাইল। আর ইরান সীমান্ত রয়েছে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। চীন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে গাওদার সমুদ্র বন্দর উন্নয়নে। চীন তার দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস এই গাওদার বন্দর দিয়েই পাইপ লাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। চীন শ্রীলংকার হামবানটোটায় একটি গভীর সামদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে। তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে চীন শ্রীলংকা সরকারকে সমর্থন করেছিল। মিয়ানমারের রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর একটি রাডার স্টেশন। সিটওয়েসহ আরও বেশ ক’টি বন্দরে রয়েছে চীনা উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা গড়ে তুলছে, তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চীনের এই জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করা ও চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম একটি পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যে স্ট্র্যাটেজি, তাতে আদৌ পরিবর্তন আসবে না। জন কেরি না এলেও ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা নিয়মিত বাংলাদেশ সফর করছেন এবং আগামীতেও করবেন। এখানে দেখতে হবে, আমরা আমাদের স্বার্থকে কীভাবে নিশ্চিত করতে পারি। সেই জাতীয় স্বার্থ খুব একটা নিশ্চিত হচ্ছে না। মহাজোট সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হলেও, নানা ইস্যুতে এখনও জটিলতা রয়ে গেছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে এখনও রয়ে গেছে ধূম্রজাল। বলা হচ্ছে, সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য ভারত সফরের সময় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে যে সমীকরণ, তাতে পশ্চিম বাংলার আপত্তির মুখে কেন্দ্রীয় সরকার আদৌ চুক্তি করতে পারবে বলে মনে হয় না। উপরন্তু ভারতে ২০১৪ সালে নির্বাচন। এই নির্বাচনে তিস্তা চুক্তি একটি ইস্যু হয়ে যেতে পারে। তবে জন কেরির ভারত সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের চেয়ে ভারতকে গুরুত্ব দেয় বেশি। সেটাই স্বাভাবিক। ভারত উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি। সেখানে মার্কিনি স্বার্থ অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ভারতকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করবে না। এ অঞ্চলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যে অক্ষ গড়ে উঠছে, বাংলাদেশকে সেই অক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এর বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ লাভবান হবে না। তবে মনে রাখতে হবে, ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষকে ব্যবহারে করেই বাংলাদেশকে তার জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। আর সেভাবেই পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন করতে হবে। জন কেরি বাংলাদেশ সফরে এলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ত। এখন সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে, কী করে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়ানো যায়। পররাষ্ট্র নীতির সাফল্য নিহিত সেখানেই।
Daily ALOKITO BANGLADESH

24.06.13

0 comments:

Post a Comment