রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিএনপির রাজনীতি ও দশম সংসদের ভবিষ্যৎ

দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছে ২৯ জানুয়ারি। ওই একই দিন বিএনপি সারা দেশে কালো পতাকা দিবস পালন করেছে। বিষয়টি এখন অনেকের কাছেই আলোচনার একটি বিষয়Ñ বিএনপি এখন কী করবে? আর দশম সংসদের ভবিষ্যৎ কতদিনের? বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি একটি শক্তি। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ থেকে শুরু করে নবম সংসদ পর্যন্ত, দীর্ঘ ৩৪ বছর ছয়টি সংসদে (ষষ্ঠ সংসদসহ) বিএনপির প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। যদিও এরশাদ জামানায় অনুষ্ঠিত এ দুটো সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিলেও, ওই সংসদ টিকেছিল ১৭ মাস। আর ১৯৮৮ সালের সংসদ, যেখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কোনো দলই অংশগ্রহণ করেনি, সেই সংসদও টিকেছিল ৩১ মাস। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবর্তমানে ওই সংসদে একটি ‘বিরোধী দল’ও পাওয়া গিয়েছিল। ‘কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিস’ বা ‘কপ’ এর ব্যানারে ওই সংসদে বিরোধী দলের নেতা হয়েছিলেন আসম আবদুর রব। সবাই জানেন, এইচএম এরশাদের সঙ্গে আসম আবদুর রবের সখ্য ছিল এবং কৌশলী এরশাদ সে সখ্যকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। অনেকটা একই দৃশ্যের অবতারণা হতে যাচ্ছে এবার। জাতীয় পার্টি এবার বিরোধী দলে। তবে পার্থক্য এখানেইÑ জাতীয় পার্টি সরকারেও আছে। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসে বোধকরি এবার বাংলাদেশ ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, যেখানে ‘প্রধান বিরোধী দল’ সরকারেও আছে আবার বিরোধী দলেও আছে। এতে করে সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের যে সনাতন ভূমিকা, সেই ‘ভূমিকা’ জাতীয় পার্টি পালন করতে পারবে বলে মনে হয় না। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সরকারের জন্যও ভালো। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে এ বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি। দেশের রাজনীতিতে বিএনপি একটি বড় দল। অতীতেও বিএনপি বিরোধী দলে ছিল। এখন বিএনপিকে বাদ দিয়ে সংসদ গণমানুষের কাছে কতটুকু যেতে পারবে, সে প্রশ্ন থাকবেই। অনেকের কাছে তাই প্রশ্ন উঠেছে, সংসদের বাইরে থেকে বিএনপির ভূমিকা এখন কী হবে? বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করেছে। সেখানে খালেদা জিয়া কোনো কঠোর কর্মসূচি দেননি। নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো দিক সরকারের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় যাওয়ার। তিনি উপলব্ধি করেছেন, হরতাল আর অবরোধে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। আর এই সহিংসতায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। সহিংসতায় সাধারণ মানুষের খুব একটা সমর্থন থাকে না। রাজনীতিতে সহিংসতার বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত একটি বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট আর হাউস অব কমন্সের সিদ্ধান্তগুলো দেখলে বোঝা যাবে, এরা রাজনীতিতে সহিংসতার বিষয়টিকে সমর্থন করেনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই সহিংসতার বিষয়টি বেশ কিছুদিন ধরেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা যে মহাজোট সরকারের সময়েই লক্ষ্য করা গেছে, তা নয়। বরং বিগত জোট সরকারের সময়ও আমরা এটা লক্ষ্য করেছি। তবে ওই মাত্রা বেড়েছে। বাসে পেট্রল বোমা মারা, নিরীহ মানুষকে দগ্ধ করা, এটা কোনো মতেই রাজনীতির কৌশল হতে পারে না। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটা অংশও হতে পারে না। আমরা মিডিয়ার কল্যাণে সংবাদপত্রে দগ্ধ মানুষদের কাহিনী শুনেছি। একজন গীতা সরকারের সাহসী বক্তব্য ছাপা হয়েছিল সংবাদপত্রে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আপনাদের তৈরি করেছি। আপনারা আমাদের তৈরি করেননি। আমরা আমাদের স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না...।’ প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে তার এই হৃদয়ছোঁয়া বক্তব্য সেদিন ঝড় তুলেছিল সারা দেশে। গীতা সরকার যেন সেদিন এ দেশের লাখো লাখো মানুষের কথাই বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা বাসে পেট্রল বোমা ছোড়ে, খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ। গীতা সরকারের ওই ক্ষোভের কথা সংবাদপত্রের পাতাতেই থেকে গেছে। আজ এতদিন পর আমরা জানি না, গীতা সরকাররা কেমন আছেন। আমরা জানি না হরতাল আর অবরোধে যারা মারা গিয়েছিলেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন। সংবাদপত্রগুলোও তেমন একটা খোঁজ নেয় না। আমরা কেউই চাই না, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। একটা স্বস্তির জায়গা এখানেই যে, ১৯ দল আর হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দেয়নি। কিন্তু কতদিনের বিরতি দিল ১৯ দলÑ এ প্রশ্ন তো থাকবেই। তাই সংলাপটা জরুরি। সংসদ বসেছে। সংসদ নেত্রীও পারেন সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে দিতে, যারা ১৯ দলের সঙ্গে সংলাপে বসবেন। মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে কথা বলবেন। সরকার যদি আন্তরিক না হয়, যদি সংলাপ না করে, তাহলে জটিলতা বাড়তে পারে। তবে সংলাপের ব্যাপারে বেশ কিছু জটিলতা রয়ে গেছে। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, কোন বিষয় নিয়ে সংলাপ হবে? একাদশ সংসদ নির্বাচন? কিন্তু কোন পদ্ধতিতে এই নির্বাচন হবে? বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। সাধারণ মানুষ তথা সুশীল সমাজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে থাকলেও, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে সরকার কোনো ছাড় দেয়নি। প্রশ্ন থাকবে, বিএনপি তাহলে সংলাপে কী নিয়ে আলোচনা করবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াতকে নিয়ে। বিএনপি কী জামায়াতকে বাদ দেবে? জামায়াত এখনও একটি বৈধ দল। কোনো পর্যায়ে দলকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। অনেকেরই মনে থাকার কথা, অতীতে এই জামায়াতকে নিয়েই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। এর ব্যাখ্যায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, তখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের পরিস্থিতিকে মেলান যাবে না। এই যুক্তির পেছনে সত্যতা যাই থাকুক, আওয়ামী লীগ-জামায়াত সখ্য তো ইতিহাসের অংশ। আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে, সন্দেহ নেই তাতে। জনমত এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে। তাই জামায়াত সম্পর্কে এখন একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারাই হত্যাকা- আর লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিল, বিএনপি তাদের বিচারও চেয়েছে। তবে বিএনপি চেয়েছে, হত্যাকারী বা লুণ্ঠনকারী যেই হোক, বিচার হোক সবার। একটা জিনিস হয়তো আমরা অনেকেই খেয়াল করিনিÑ জামায়াত সম্পর্কে বারে বারে বলতে গিয়ে আমরা কী পরোক্ষভাবে জামায়াতের নামটা সর্বত্র ছড়িয়ে দিলাম না? যদিও এটা সত্য, জামায়াতের নেতিবাচক ধারণাটাই মানুষ জেনেছে। এ নিয়ে ডকুমেন্টেশনও তৈরি হয়েছে। তবে বাস্তবতা এটাইÑ জামায়াতকে বিদেশি রাষ্ট্র এখনও একটি ইসলামিক দল হিসেবে বিবেচনা করে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিংবা নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ ঢাকায় জামায়াত নেতাদের সঙ্গে দেখাও করেছেন। এখন জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সখ্য সংলাপের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। সরকার বলতে পারে, জামায়াতকে না ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না। কেননা সরকার জামায়াতকে একটি জঙ্গিবাদী সংগঠন হিসেবে মনে করে। সরকারের প্লাস পয়েন্ট এখন একাধিক। তথাকথিত ভোটারবিহীন নির্বাচনের আয়োজন করে সরকার যে দুর্নামের ভাগীদার হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। বিদেশ থেকে একের পর এক অভিনন্দন তথা সমর্থন আসছে। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নির্বাচনের ব্যাপারে দাতা দেশগুলোর রিজার্ভেশন থাকলেও, চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা তাদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে পারবে না। তাই তাদের বাংলাদেশকে প্রয়োজন আছে। সুতরাং জি-২ পর্যায়ে (সরকার-টু-সরকার) সম্পর্ক যে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে সরকারের দায়িত্বটা এখন অনেক বেশি। দাতাদের সমর্থন আর নয়া একটি সরকার গঠন করার মধ্য দিয়ে সরকার যদি আত্মতুষ্টিতে ভোগে, তাহলে সরকার ভুল করবে। সরকারের উচিত হবে এখন বিএনপিকে আস্থায় নেয়া। এটা সরকারের জন্যই মঙ্গল। একই সঙ্গে বিএনপিও এর মধ্য দিয়ে ‘নতুন এক রাজনীতি’ খোঁজার সুযোগ পাবে। স্থিতিশীলতার স্বার্থে এটা বড় প্রয়োজন। অন্যদিকে বিএনপিকে এখন বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে যে গণঅভ্যুত্থান (মিসর, থাইল্যান্ড, ইউক্রেন), তার ঢেউ লাগেনি বাংলাদেশে। বিএনপিকে এখন বিগত দিনের আন্দোলনের হিসাব মেলাতে হবে। আন্দোলনে বিএনপি কর্মীদের মাঠে না থাকা, জেলের ভয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পালিয়ে বেড়ানো সরকারবিরোধী আন্দোলনকে বিএনপি চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই নতুন করে ‘হিসাবের খাতা’ খুলতে হবে। জামায়াত কৌশলী। তারা আপাতত ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাবে। তবে তারা চূড়ান্তভাবে হারিয়ে যাবে, এটা আমার মনে হয় না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও(?) তারা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে। তুরস্কের ইতিহাস আমাদের কাছে আছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা। নব্বইয়ের শেষের দিকে নেকমাতিন এরবাকানের নেতৃত্বে ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল তুরস্কে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী ট্রু পাথ পার্টির একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল তুরস্কে ১৯৯৬ সালে। এরবাকান ছিলেন ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। যদিও সেই সরকার স্থায়ী হয়নি। এক পর্যায়ে ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হলে, তারা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির ব্যানারে সংগঠিত হন এবং পর পর তিনবার সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন। সুতরাং জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও, তারা হারিয়ে যাবেন, এটা আমার মনে হয় না। খালেদা জিয়া নতুন করে কোনো কঠোর কর্মসূচি না দেয়ায় স্পষ্টতই সঙ্কটের জট খোলার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। এমনকি ২১ জানুয়ারি রেলমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারও বলেছেন দ্রুত সংলাপে যাওয়ার। কিন্তু সিনিয়র মন্ত্রীদের কথাবার্তা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান, আমাদের মনে একটা ভয় ধরিয়ে দিয়েছে যে, প্রত্যাশিত এই সংলাপটি নাও হতে পারে! তাই একটি সংলাপ হবে কিংবা একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন ২০১৪ সালেই অনুষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে আস্থাটা রাখতে পারছি না। এখন অনেক সম্ভাবনার জন্ম হবে রাজনীতি নিয়ে। যারা নতুন করে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন(?), তারা চাইবেন ৫ বছরের টার্ম পূরণ করতে। জাতীয় পার্টির সুবিধাভোগী শ্রেণী জানেন, ক্ষমতা হারালে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই তারা সংসদ ভেঙে দিতে চাইবেন না। এটা খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে সরকারি দলের অনেক নেতাকর্মী আছেন, তারা মনে করেন আগামী ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারলে, বিএনপি ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ক্ষমতা আরও দীর্ঘায়িত করা, বিশেষ করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন, আগামীতে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হবে (রাজনৈতিকভাবে) জামায়াতকে, জামায়াত যে নামেই আত্মপ্রকাশ করুক না কেন। জামায়াতের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বেই একটি আধুনিক ইসলামিক ফোর্স (অনেকটা তুরস্কের মডেলে) আত্মপ্রকাশ ঘটবে এবং তারাই হবে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিএনপি অনেকটা ‘রণে ভঙ্গ দিয়েছে’। সুতরাং আওয়ামী লীগ খুব অনায়াসে ৫ বছর ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারবে! একটা ভালো দিক হচ্ছে, বিএনপি নয়া সংসদ ও নয়া সরকারের ব্যাপারে একটা ‘সফট এটিচিউড’ গ্রহণ করেছে। অনেকের ধারণা ছিল, ২৯ জানুয়ারি (যেদিন দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছে) বিএনপি হরতাল দেবে; কিন্তু বিএনপি তা দেয়নি। এর মধ্য দিয়ে মেসেজটি পরিষ্কারÑ বিএনপি এক ধরনের সমঝোতা চায়। আগামী মাসে উপজেলা নির্বাচন। এ নির্বাচন দলীয়ভাবে হয় না। তবে সমর্থকরা অংশ নেয়। বিএনপির সমর্থকরা এ নির্বাচনে অংশ নেবে বলে তাদের নেতারা আমাদের জানিয়েছেন। এ নির্বাচনে অংশ না নিলে স্থানীয়ভাবে বিএনপির যে ভিত্তি, তাও হারাতে পারে দলটি। তাই খালেদা জিয়াকে এখন পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণ করে সামনে এগোতে হবে। তার উচিত হবে, এখন জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। খালেদা জিয়া এখন প্রতিটি বিভাগীয় শহরে যাবেনÑ এই সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে এবারের আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন থাকবে। নিশ্চয়ই বিগত আন্দোলন থেকে তিনি শিখেছেন। জনসমর্থন থাকলেও, সরকারের যে পতন ঘটানো যায় না, তা এবার প্রমাণিত হলো। তবে সরকার ও বিরোধী দলÑ উভয়ই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ চায়। আর এটা নিশ্চিত করতে হলে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে ন্যূনতম সহাবস্থান ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই মুহূর্তে এ সহাবস্থানটি নেই। ফলে খুব দ্রুত একটি সংলাপ হবে, মধ্যবর্তী নির্বাচন হবেÑ এটা দৃঢ়ভাবে বলতে পারছি না। অন্তত আগামী দু’বছরের মধ্যে আদৌ কোনো সংলাপ হবে, কিংবা সরকার কিছুটা নমনীয় হবে, এ বিশ্বাসটা রাখতে পারছি না। এ দেশে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। এটা ‘বিবেচনায় নিয়েই’ বিএনপিকে এগোতে হবে। তবে বিএনপি ‘হারিয়ে’ যাবে, আমার তা মনে হয় না। সাধারণ মানুষের মাঝে বিএনপির সমর্থন রয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। পত্র-পত্রিকায় বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়া এখন বিএনপিতে নতুন ‘নেতৃত্ব’ সৃষ্টি করবেন। এর আগে এক ‘নতুন রাজনীতি’র কথা তিনি বলেছিলেন। সেটা কী আমরা তা জানি না। তবে বিগত মাসগুলোতে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা এবং আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে ‘ব্যর্থতা’, বিএনপিকে এখন নতুন করে ‘ঘর সাজাতে হবে’। প্রথমত, বিএনপিতে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ছাত্রদল কিংবা যুবদল থেকে যে নেতৃত্ব আসার কথা ছিল, তা আসেনি। স্থায়ী কমিটিতে পরিবর্তন আনাও জরুরি হয়ে পড়েছে। মওদুদ আহমদ নিজে কোর্টে দাঁড়িয়ে বয়সের কথা বলেছেন। তাই বিএনপিতে তরুণ ও ডায়নামিক নেতৃত্ব দরকার, যারা বিএনপিকে একুশ শতকে নিয়ে যাবে এবং একুশ শতক উপযোগী একটি রাজনীতি জাতিকে উপহার দেবে। দ্বিতীয়ত, বিএনপিকে এখন ‘নয়া রাজনীতি’ উপহার দিতে হবে। হরতাল, অবরোধ দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যায় না। তাই হরতালের বিকল্প ভাবতে হবে। বিএনপি এখন সরকারে নেই। কিন্তু সরকারের বাইরে থেকেও জনমত গড়ে তোলা যায়। তৃতীয়ত, বিএনপিকে এখন সুস্পষ্ট নীতি নিয়ে এগোতে হবে। দলটিকে এখন নতুন কর্মসূচি দিতে হবে। এ কাজটি করার জন্য প্রয়োজন একটি ‘থিংক ট্যাঙ্ক’ গঠন করা। চতুর্থত, বিএনপির নেতৃত্বকে এখন যেতে হবে প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি উপজেলায়। শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক যে রাজনীতি, সে রাজনীতি দিয়ে পুরো জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করা যায় না। আশার কথা, বিএনপি কাউন্সিল করতে যাচ্ছে। ধারণা করছি, ওই কাউন্সিলে ‘আয়নায় নতুন করে নিজেদের দেখতে চাইবে বিএনপি।’ আত্মসমালোচনাটা জরুরি। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে যে দল শতকরা ৪১.১৭ ভাগ (১৯৭৯), ৩০.৮১ ভাগ (১৯৯১), ৩৩.৬১ ভাগ (১৯৯৬), ৪০.৯৭ ভাগ (২০০১) ও ৩২.৪৫ ভাগ ভোট (২০০৮) পায়, সে দলটিকে বাদ রেখে যে সংসদীয় রাজনীতি, সেই সংসদ জনমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। আবার বাস্তবতা হচ্ছে, একটি সংসদ হয়ে গেছে। বিদেশ থেকে সমর্থনও আসছেÑ এই সংসদকে ‘উপেক্ষা’ করাও যাবে না। এখানে তাই ‘রিয়েল পলিটিকস’ এর প্রয়োগটাই আসল। স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিএনপিকে আস্থায় নিতে হবে। সংলাপ শুরু করতে হবে এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটা নীতি ঘোষণা করতে হবে। এটা না হলে ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে মাত্র। দুটো দলের কাছ থেকে প্রত্যাশা তাই অনেক বেশি। Daily ALOKITO BANGLADESH 04.02.14

0 comments:

Post a Comment