চলতি বছর গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নতুন
এক মাত্রা পেয়েছে বিভিন্ন দেশে। শুধু বাংলাদেশই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়
থাইল্যান্ড, আর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ ইউক্রেনে গণতান্ত্রিক
সংগ্রাম নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশে বিতর্কিত একটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল
আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থেকে গেছে। অনেকটা একইরকম থাইল্যান্ডের গত ২ ফেব্রুয়ারির
নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয়ে থাই পার্টিই থেকে গেল। বাংলাদেশের মতোই থাইল্যান্ডের
নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টি নির্বাচন বয়কট করে। যদিও বাংলাদেশ
আর থাইল্যান্ডের পরিস্থিতি একসঙ্গে মেলানো যাবে না। তবে ইউক্রেনের পরিস্থিতি আরো
জটিল হয়েছে। সেখানেও গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪ সালে আরো বেশ
ক'টি দেশে আসন্ন নির্বাচন প্রত্যক্ষ করব এবং প্রতিটি দেশেই গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
অনেকটা প্রশ্নের মুখে। ৬ এপ্রিল আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, যেখানে
কারজাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে পারছেন না।
পারছেন না মালিকিও ইরাকে। সেখানে ওই এপ্রিলেই সংসদ নির্বাচন। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও
এপ্রিল-জুনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন, যেখানে সংসদ সদস্যদের ভোটে প্রেসিডেন্ট
নির্বাচিত হবেন। ইন্দোনেশিয় (জুলাই ৯) ও ব্রাজিলের (৫ অক্টোবর) প্রেসিডেন্ট
নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। তবে অনেকেরই দৃষ্টি থাকবে ভারতের দিকে।
এপ্রিলে সেখানে লোকসভার নির্বাচন। আর কংগ্রেস জোট বিজয়ী হলে রাহুল গান্ধী হবেন
প্রধানমন্ত্রী। তার অভিজ্ঞতা নেই। কংগ্রেস জোট ক্ষমতা পেলেও রাহুল গান্ধীর জন্য
বিষয়টি খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী পদে দাবিদার রয়েছে আরো অনেকে।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিজেপির প্রার্থী। গেল বছরের শেষের দিকে
ভারতে পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপির বড় বিজয় রয়েছে নরেন্দ্র মোদির জন্য একটা
সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে নরেন্দ্র মোদির বিজেপির মনোনয়ন লাভ খোদ ভারতের
গণতন্ত্রের জন্য একটি কলঙ্ক। কেননা ২০০২ সালের গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য
মোদিকে অভিযুক্ত করা হয়। ওই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এক হাজার মানুষ প্রাণ
হারিয়েছিলেন। যাদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলমান। গত ১০ বছরেও মোদি এই অভিযোগ কাটিয়ে
উঠতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ থাকায়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে কখনো
ভিসা দেয়নি। আগামী এপ্রিল-মে মাসে ভারতে লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে
ভারতের রাজনীতিতে বেশ কিছুদিন ধরেই একটা প্রবণতা চলছে, আর তা হচ্ছে কোয়ালিশন
রাজনীতি। কংগ্রেসের নেতৃত্বে রয়েছে ইউপিএ বা ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স।
ইউপিএ জোটে রয়েছে বেশ ক'টি আঞ্চলিক দল। বিজেপির নেতৃত্বেও রয়েছে একটি জোট_
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ)। বামদের নেতৃত্বেও রয়েছে একটি জোট।
ধারণা করা হয়, চলতি লোকসভা নির্বাচনের পরও এ জোট রাজনীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত
থাকবে। এককভাবে কংগ্রেস অথবা বিজেপির পক্ষে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাই নেই। তবে এটা
বলতেই হবে দিলি্লর রাজ্য সরকারের নির্বাচনে তখন আদমি পার্টি তথা অরবিন্দ
কেজরিওয়ালার উল্লাস (যিনি এখন দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী) ঘাটলেও, জাতীয় রাজনীতিতে তার
দলের আদৌ কোনো ভূমিকা থাকবে না। কেননা সর্বভারতব্যাপী এই দলের কোনো অস্তিত্ব নেই।
স্থানীয় নির্বাচনে তিনি 'চমক' দেখিয়েছিলেন, কিন্তু লোকসভা নির্বাচনটা একটা ভিন্ন
বিষয়। চলতি বছর ভারতের পাশাপাশি আফগানিস্তান, ইরাক, দক্ষিণ আফ্রিকা, কলম্বিমা,
ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ব্রাজিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হবে, সেখানেও পরিবর্তন আসবে।
অতিসম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপে গেল বছর দ্বিতীয় দফা ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট নাসিদ তা মেনে নিয়েছেন। গেল বছর পাকিস্তানে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং নওয়াজ শরিফ আরো একবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে পাকিস্তানে। প্রধান বিচারপতি ও সেনাপ্রধান অবসরে গেছেন। প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী নিয়মমাফিক অবসরে যাওয়ার পর তাসাদ্দুক হোসেন জিলানি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। আর জেনারেল কায়ানির টার্ম শেষ হয়ে যাওয়ার পর জেনারেল রাহিল শরিফ নয়া সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে চলতি বছর শরিফের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাহরিক-ই- তালিবানকে নিষ্ক্রিয় করা ও তাদের জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ করা। মূলত তাহরিক-ই তালিবান সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
এ অঞ্চলে এখন ইমরান খানের দল তাহরিক-ই ইনসাফ সরকার গঠন করেছে। ধারণা করা হয়, ইমরান খানের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি দল হিসেবে পরিচিত তাহরিক-ই তালিবানের একটা সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে সীমান্ত অঞ্চলে মার্কিন ড্রোন বিমান হামলা বন্ধ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শরিফ এ হামলা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানালেও তা রক্ষিত হয়নি। এটা খোদ নওয়াজ শরিফের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের জন্য এটা বড় খবর হলো যে একটা নির্বাচিত সরকার তার পাঁচ বছরের টার্ম পূরণ করেছে।
২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। ওবামা এই প্রতিশ্রুতি দিলেও, তিনি প্রতিশ্রুতি কতটুকু রাখতে পারবেন, তা একটা প্রশ্ন। যুক্তফ্রন্ট ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের সাবেক একটা নিরাপত্তা চুক্তি করতে চাইলেও, তা হয়নি। এ ক্ষেত্রে চলতি বছর আফগানিস্তানের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। ৬ এপ্রিল সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কারজাই আর তৃতীয় বারের মতো দাঁড়াতে পারছেন না। অনেকেরই ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটা উপস্থিতি সেখানে থাকবেই। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানেও জঙ্গি তৎপরতা বাড়বে।
পাকিস্তানের কথা শুধু নয়, খোদ নেপালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করল। এ দুটো দেশ নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন সম্পন্ন করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। নেপালে মাওবাদীরা সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচনে ভালো ফলাফল করেনি। তবে ভালো খবর হলো, তারা শেষ পর্যন্ত অধিবেশনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে যেসব দেশ গণতন্ত্রচর্চা করে, তাদের জন্য 'খারাপ' খবর আছে। বিশেষ করে থাইল্যান্ড আর ইউক্রেনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে থাইল্যান্ডে সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতি দুই পক্ষের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে 'রেড শার্ট', আন্দোলন, যারা সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত। আন্দোলন উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী ইংলাক গত ২ ফেব্রুয়ারি কথা নির্বাচন সম্পন্ন করলেন, যেখানে 'হলুদ শার্ট' আন্দোলনকারী তথা ডেমোক্রেটিক পার্টি তা বয়কট করে। একপর্যায়ে সেনাপ্রধান সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এবং সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। 'রেড শার্ট' আর 'হলুদ শার্ট' আন্দোলনের কারণে থাইল্যান্ডের গণতন্ত্র একটি বড় প্রশ্নের মধ্যে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইংলাক এভাবে 'রেড শার্ট', আন্দোলনকারীদের উসকে দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তিনি তার ভাই থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে (সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী) দায়মুক্তি দেয়ার উদ্দেশে সংসদে একটি বিল এনেছেন। ইউক্রেনের অবস্থাও ঠিক তেমনি। ২০০৪ সালের 'কয়লা বিপ্লব' এখন ব্যর্থ হতে চলেছে। ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি বাতিল ও রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি এসব নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইরাকে বিভিচ কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তা একটা বড় প্রশ্ন এখন।
গেল বছর (২০১৩) ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের মৃত্যু ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাসান রুহানির অভিষেক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে 'যুদ্ধ' করে এক সময় হেরে গিয়েছিলেন হুগো শ্যাভেজ। তার মৃত্যুর পর তিনি, 'সমাজতন্ত্রের নতুন এক ধারা' প্রবর্তন করেছিলেন তার স্থায়িত্ব কতটুকু থাকবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয় সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভেনিজুয়েলা হবে একটি 'টেস্ট কেস'।
আরব বিশ্বে 'আরব বসন্ত' যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, সেই সম্ভাবনার এখন 'মৃত্যু' ঘটেছে। 'আরব বসন্ত' সেখানকার দীর্ঘদিনের শাসকদের (তিউনেশিয়ায় জইন আবেদিন বেন আলী, মিসরে হোসনি মোবারক, ইয়েমেনের সালেহ, লিবিয়ায় গাদ্দাফি), ক্ষমতা থেকে উৎখাত করলেও, সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি। উপরন্তু মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। তিউনেশিয়ায় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। চলতি বছর সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে 'আরব বসন্ত' পুরো আরব বিশ্বে জঙ্গিবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটিয়েছে'। বিশেষ করে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে সেখানে একটি বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে ইসলামিক জঙ্গিদের একটি কোয়ালিশন। লিবিয়ায়ও এরা শক্তিশালী। আর ইরাকে জঙ্গিদের তৎপরতা ইরাকের অস্তিত্বকে একটি বড় হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সিরিয়ায় গেল বছর মার্কিন বিমান হামলা এড়ানো গেছে সত্য, কিন্তু যদি সেখানে কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে বিমান হামলা হতে পারে। জেনেভা-২ আলোচনা জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্নের কোনো সমাধান এখনো হয়নি_ আর তা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট আসাদ ক্ষমতায় থাকবেন, নাকি একটা নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পরিহার করবেন। চলতি বছরের মাঝামাঝি সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনে তিনি যদি প্রার্থী না হন, তাহলে সমাধানের একটা পথ বের হতে পারে। তাই জেনেভা-২ আলোচনার দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। তবে চূড়ান্ত বিচারে এ আলোচনায় সিরীয় সরকারের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তা কোনো 'ফল' বয়ে আনবে না_ এমন আশঙ্কাই করা হচ্ছে।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ নিয়ে আরো একটি ভয়_ তা হচ্ছে প্রায় ৫৫ হাজার শরণার্থী বর্তমানে জর্ডানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের যদি দেশে ফিরেয়ে নিয়ে আনার ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে এরা জর্ডানে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে এবং সেখানকার সরকারের পতন ঘটাতে পারে। জাতিসংঘেরই এ শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করে ৫.৩ বিলিয়ন ডলার। দীর্ঘদিন জাতিসংঘের জন্য এ অর্থ ব্যয় বহন করাও সম্ভব নয়। তাই জেনেভা আলোচনায় কোনো ফল পাওয়া না গেলে সীমিত বিমান হামলার (লিবিয়ার মতো) সম্ভাবনা ২০১৪ সালে বাড়বে। এর পাশাপাশি তুরস্কের কী পরিবর্তন আসে, সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের। আগস্টে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই প্রথমবারের মতো সেখানে সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সংবিধানে বাধ্যবাধকতার কারণে এরদোগান তিনবারের বেশি আর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। ধারণা করা হচ্ছে, এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। তুরস্কের রাজনীতির উত্থান-পতনের সঙ্গে সিরিয়ার রাজনীতির একটা সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় স্বার্থ রয়েছে তুরস্কে। কেননা সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনে (যা তুরস্কও চাইছে) তুরস্কের সমর্থন প্রয়োজন পশ্চিমা বিশ্বের। সুতরাং এ অঞ্চলের রাজনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সেই সঙ্গে পূর্ব চীন সাগরে উত্তেজনা কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন (৯ জুলাই) দৃষ্টি কাড়বে অনেকের।
সুতরাং ২০১৩ সালের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের বিশ্ব রাজনীতিতেও উত্তেজনা থাকবে। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের এক-তৃতীয়াংশ (সিনেটের ৩৫) আসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা বোঝা যাবে কে হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী। হিলারি ক্লিনটনের দিকে তাই দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সারা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের যে সংগ্রাম তাতে নতুন মাত্রা এসেছে। প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়েও যে নির্বাচনে আয়োজন করা সম্ভব তা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে। আর ভারতে প্রধান বিরোধী দল বিজেপিকে যদি জনগণ ক্ষমতায় বসায় ও বিতর্কিত রাজনীতিবিদ নরেন্দ্র মোদি যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন (২), তা হবে ভারতের গণতন্ত্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে তাই হাজারটা প্রশ্ন নতুন করে উঠবে।
DAINIK JAIJAIDIN 03.02.2014
অতিসম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপে গেল বছর দ্বিতীয় দফা ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট নাসিদ তা মেনে নিয়েছেন। গেল বছর পাকিস্তানে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং নওয়াজ শরিফ আরো একবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে পাকিস্তানে। প্রধান বিচারপতি ও সেনাপ্রধান অবসরে গেছেন। প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী নিয়মমাফিক অবসরে যাওয়ার পর তাসাদ্দুক হোসেন জিলানি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। আর জেনারেল কায়ানির টার্ম শেষ হয়ে যাওয়ার পর জেনারেল রাহিল শরিফ নয়া সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে চলতি বছর শরিফের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাহরিক-ই- তালিবানকে নিষ্ক্রিয় করা ও তাদের জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ করা। মূলত তাহরিক-ই তালিবান সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
এ অঞ্চলে এখন ইমরান খানের দল তাহরিক-ই ইনসাফ সরকার গঠন করেছে। ধারণা করা হয়, ইমরান খানের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি দল হিসেবে পরিচিত তাহরিক-ই তালিবানের একটা সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে সীমান্ত অঞ্চলে মার্কিন ড্রোন বিমান হামলা বন্ধ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শরিফ এ হামলা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানালেও তা রক্ষিত হয়নি। এটা খোদ নওয়াজ শরিফের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের জন্য এটা বড় খবর হলো যে একটা নির্বাচিত সরকার তার পাঁচ বছরের টার্ম পূরণ করেছে।
২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। ওবামা এই প্রতিশ্রুতি দিলেও, তিনি প্রতিশ্রুতি কতটুকু রাখতে পারবেন, তা একটা প্রশ্ন। যুক্তফ্রন্ট ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের সাবেক একটা নিরাপত্তা চুক্তি করতে চাইলেও, তা হয়নি। এ ক্ষেত্রে চলতি বছর আফগানিস্তানের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। ৬ এপ্রিল সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কারজাই আর তৃতীয় বারের মতো দাঁড়াতে পারছেন না। অনেকেরই ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটা উপস্থিতি সেখানে থাকবেই। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানেও জঙ্গি তৎপরতা বাড়বে।
পাকিস্তানের কথা শুধু নয়, খোদ নেপালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করল। এ দুটো দেশ নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন সম্পন্ন করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। নেপালে মাওবাদীরা সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচনে ভালো ফলাফল করেনি। তবে ভালো খবর হলো, তারা শেষ পর্যন্ত অধিবেশনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে যেসব দেশ গণতন্ত্রচর্চা করে, তাদের জন্য 'খারাপ' খবর আছে। বিশেষ করে থাইল্যান্ড আর ইউক্রেনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে থাইল্যান্ডে সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতি দুই পক্ষের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে 'রেড শার্ট', আন্দোলন, যারা সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত। আন্দোলন উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী ইংলাক গত ২ ফেব্রুয়ারি কথা নির্বাচন সম্পন্ন করলেন, যেখানে 'হলুদ শার্ট' আন্দোলনকারী তথা ডেমোক্রেটিক পার্টি তা বয়কট করে। একপর্যায়ে সেনাপ্রধান সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এবং সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। 'রেড শার্ট' আর 'হলুদ শার্ট' আন্দোলনের কারণে থাইল্যান্ডের গণতন্ত্র একটি বড় প্রশ্নের মধ্যে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইংলাক এভাবে 'রেড শার্ট', আন্দোলনকারীদের উসকে দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তিনি তার ভাই থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে (সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী) দায়মুক্তি দেয়ার উদ্দেশে সংসদে একটি বিল এনেছেন। ইউক্রেনের অবস্থাও ঠিক তেমনি। ২০০৪ সালের 'কয়লা বিপ্লব' এখন ব্যর্থ হতে চলেছে। ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি বাতিল ও রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি এসব নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইরাকে বিভিচ কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তা একটা বড় প্রশ্ন এখন।
গেল বছর (২০১৩) ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের মৃত্যু ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাসান রুহানির অভিষেক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে 'যুদ্ধ' করে এক সময় হেরে গিয়েছিলেন হুগো শ্যাভেজ। তার মৃত্যুর পর তিনি, 'সমাজতন্ত্রের নতুন এক ধারা' প্রবর্তন করেছিলেন তার স্থায়িত্ব কতটুকু থাকবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয় সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভেনিজুয়েলা হবে একটি 'টেস্ট কেস'।
আরব বিশ্বে 'আরব বসন্ত' যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, সেই সম্ভাবনার এখন 'মৃত্যু' ঘটেছে। 'আরব বসন্ত' সেখানকার দীর্ঘদিনের শাসকদের (তিউনেশিয়ায় জইন আবেদিন বেন আলী, মিসরে হোসনি মোবারক, ইয়েমেনের সালেহ, লিবিয়ায় গাদ্দাফি), ক্ষমতা থেকে উৎখাত করলেও, সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি। উপরন্তু মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। তিউনেশিয়ায় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। চলতি বছর সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে 'আরব বসন্ত' পুরো আরব বিশ্বে জঙ্গিবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটিয়েছে'। বিশেষ করে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে সেখানে একটি বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে ইসলামিক জঙ্গিদের একটি কোয়ালিশন। লিবিয়ায়ও এরা শক্তিশালী। আর ইরাকে জঙ্গিদের তৎপরতা ইরাকের অস্তিত্বকে একটি বড় হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সিরিয়ায় গেল বছর মার্কিন বিমান হামলা এড়ানো গেছে সত্য, কিন্তু যদি সেখানে কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে বিমান হামলা হতে পারে। জেনেভা-২ আলোচনা জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্নের কোনো সমাধান এখনো হয়নি_ আর তা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট আসাদ ক্ষমতায় থাকবেন, নাকি একটা নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পরিহার করবেন। চলতি বছরের মাঝামাঝি সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনে তিনি যদি প্রার্থী না হন, তাহলে সমাধানের একটা পথ বের হতে পারে। তাই জেনেভা-২ আলোচনার দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। তবে চূড়ান্ত বিচারে এ আলোচনায় সিরীয় সরকারের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তা কোনো 'ফল' বয়ে আনবে না_ এমন আশঙ্কাই করা হচ্ছে।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ নিয়ে আরো একটি ভয়_ তা হচ্ছে প্রায় ৫৫ হাজার শরণার্থী বর্তমানে জর্ডানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের যদি দেশে ফিরেয়ে নিয়ে আনার ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে এরা জর্ডানে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে এবং সেখানকার সরকারের পতন ঘটাতে পারে। জাতিসংঘেরই এ শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করে ৫.৩ বিলিয়ন ডলার। দীর্ঘদিন জাতিসংঘের জন্য এ অর্থ ব্যয় বহন করাও সম্ভব নয়। তাই জেনেভা আলোচনায় কোনো ফল পাওয়া না গেলে সীমিত বিমান হামলার (লিবিয়ার মতো) সম্ভাবনা ২০১৪ সালে বাড়বে। এর পাশাপাশি তুরস্কের কী পরিবর্তন আসে, সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের। আগস্টে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই প্রথমবারের মতো সেখানে সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সংবিধানে বাধ্যবাধকতার কারণে এরদোগান তিনবারের বেশি আর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। ধারণা করা হচ্ছে, এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। তুরস্কের রাজনীতির উত্থান-পতনের সঙ্গে সিরিয়ার রাজনীতির একটা সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় স্বার্থ রয়েছে তুরস্কে। কেননা সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনে (যা তুরস্কও চাইছে) তুরস্কের সমর্থন প্রয়োজন পশ্চিমা বিশ্বের। সুতরাং এ অঞ্চলের রাজনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সেই সঙ্গে পূর্ব চীন সাগরে উত্তেজনা কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন (৯ জুলাই) দৃষ্টি কাড়বে অনেকের।
সুতরাং ২০১৩ সালের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের বিশ্ব রাজনীতিতেও উত্তেজনা থাকবে। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের এক-তৃতীয়াংশ (সিনেটের ৩৫) আসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা বোঝা যাবে কে হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী। হিলারি ক্লিনটনের দিকে তাই দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সারা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের যে সংগ্রাম তাতে নতুন মাত্রা এসেছে। প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়েও যে নির্বাচনে আয়োজন করা সম্ভব তা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে। আর ভারতে প্রধান বিরোধী দল বিজেপিকে যদি জনগণ ক্ষমতায় বসায় ও বিতর্কিত রাজনীতিবিদ নরেন্দ্র মোদি যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন (২), তা হবে ভারতের গণতন্ত্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে তাই হাজারটা প্রশ্ন নতুন করে উঠবে।
0 comments:
Post a Comment