রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বেগম জিয়া কী মেসেজ দিলেন

বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া কী মেসেজ দিলেন গত ২০ জানুয়ারির জনসভায়? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় তিনি যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তার মাঝে নতুনত্ব কিছু নেই। তবে একাধিক কারণে আমার কাছে এই কথাবার্তার গুরুত্ব অনেক। প্রথমত, ওই জনসভায় জামায়াতের উপস্থিতি আদৌ ছিল না। তাদের নেতারা বক্তব্যও রাখেননি। সরকার বিএনপিকে অনুমতি দিয়েছিল এক শর্তে আর তা হচ্ছে জামায়াত কর্মীদের আনা যাবে না কিংবা জামায়াত নেতারা বক্তব্য দিতে পারবেন না। এর আগে বিদেশি দূতরা, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে বিএনপির উচিত হবে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও শর্ত দিয়েছিলেন বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে, যদি বিএনপি জামায়াতকে ছেড়ে আসে। এখন বিএনপি এই কাজটি করল। সরকার বিএনপির এই উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দেয় কি-না, সেটাই দেখার বিষয়। দ্বিতীয়ত, বেগম জিয়া দশম জাতীয় সংসদকে ‘অবৈধ সংসদ’ বলেছেন। তিনি ‘প্রহসনের নির্বাচনে অংশ না নেয়ায়’ জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। নয়া নির্বাচনেরও দাবি তিনি করেছেন। কিন্তু বেগম জিয়ার এই বক্তব্যের তিনটি প্রতিক্রিয়া আমরা পেয়েছি। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী এবং খাদ্যমন্ত্রী অনেকটা একই সুরে বলেছেন, নির্বাচন চাইলে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আওয়ামী লীগের অনেক নীতি-নির্ধারকও একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে আসছেন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে। কিন্তু ভিন্ন কথাও শুনেছি এরশাদের মুখ থেকে। ২০ তারিখে তিনি বলেছেন, নয়া নির্বাচন কমিশনের অধীনে দ্রুত নির্বাচন হবে। এরশাদ এখন ৫৩ হাজার টাকা বেতনে মন্ত্রীর মর্যাদায় সরকারের বিশেষ দূত। এখন এই ‘বিশেষ দূত’ই বললেন ‘দ্রুত নির্বাচনের’ কথা। এখন কোন বক্তব্যকে আমরা গুরুত্ব দেব? এটা সত্য প্রধানমন্ত্রী একাদশ সংসদ সম্পর্কে কোনো আগাম মন্তব্য করেননি। এখন যে বিষয়টি আমাদের শঙ্কার কারণ, তা হচ্ছে আমরা কী ২০১৯ সালকেই পরবর্তী নির্বাচনের সময়সীমা ধরে নেব? সংবিধান সে কথাই বলে। কিন্তু বাস্তবতা কি তা বলে? একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি, এটা বোধকরি খোদ আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও বিশ্বাস করেন। তাহলে ‘এই সংসদ’ নিয়ে কী পাঁচ বছর টিকে থাকা যাবে? তাতে কি অস্থিতিশীলতা বাড়বে না? তৃতীয়ত, বেগম জিয়া বলেছেন তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। এর ব্যাখ্যা সরকার হয়তো দেবে। তবে অভিযোগটি তো গুরুতর। গত এক মাসে দেশে কী হয়েছে, তা মোটামুটিভাবে মিডিয়ার কল্যাণে আমরা সবাই জানি। বেগম জিয়াকে তার বাসস্থান থেকে বের হতে না দেয়া, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেতে বাধা দান-এসব তো মিডিয়ার কল্যাণেই আমরা জেনেছি। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী যখন অভিযোগ করেন, তখন তা গুরুত্ব পায় বৈকি! নিঃসন্দেহে এটা কাম্য নয়। চতুর্থত, বেগম জিয়া বলেছেন, ‘যৌথবাহিনীর নামে বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে।’ এ অভিযোগটিও গুরুত্বপূর্ণ। অতি সাম্প্রতিককালে একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সরকার এ ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা দিলে ভালো করবে। আরেকটি অভিযোগ বেগম জিয়ার। সেটি হচ্ছে ‘সংখ্যালঘুদের ওপর সরকার হামলা করছে।’ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্থান পাচ্ছে। সুতরাং এটাকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বেগম জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বক্তৃতা দেয়ার আগে আমরা ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস আর লন্ডন থেকে তিনটি প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ৬ দফার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এর আগে সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান মেনডেজ চিঠি দিয়েছিলেন দুই নেত্রীকে। সিনেটের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ব্রিটেনের হাউস অব কমনসও একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের ব্যাপারে। মোটা দাগে এই তিনটি প্রস্তাব যদি বিশ্লেষণ করি, তাতে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে আমরা অদ্ভুত একটি মিল খুঁজে পাই। এগুলো হচ্ছে ১. অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন। ২. অবিলম্বে স্থগিত হয়ে যাওয়া সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু করা। ৩. সহিংসতা বন্ধ করা। এখানে সবাই একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বললেও বর্তমান দশম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা কেউ বলেনি। তবে যে ভাষা তারা ব্যবহার করেছেন তাতে ধারণা করা এটা স্বাভাবিক যে, দশম সংসদ গঠন প্রক্রিয়ায় এরা খুশি নন। সব দলের অংশগ্রহণ এতে হয়নি, এমন অভিমতও দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরা। এ ক্ষেত্রে ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে গৃহীত সিদ্ধান্তে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা হয়েছে, যা অন্য কেউ বলেনি। এটা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ‘সন্ত্রাসে জড়িত দল নিষিদ্ধ করা উচিত’ বলে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তাও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এ ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ দলকে বোঝানো হয়নি। সাম্প্রতিককালে সহিংস ঘটনাবলির জন্য জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম অভিযুক্ত। সাধারণ মানুষের মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দেবে-ইইউ’র এই সিদ্ধান্ত কি জামায়াতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে? সরকার কি সিদ্ধান্তটি নেবে? সরকারের হাতে একাধিক ‘অপশন’ আছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার। কী করবে সরকার এখন তা স্পষ্ট নয়। এসব প্রস্তাব ও সিনেটর মেনডেজের চিঠির মধ্য দিয়ে একটি মেসেজ আমরা পাচ্ছি আর তা হচ্ছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটানোর একটা পথ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে ‘সংলাপ’ শুরু করা। এদিকে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দুটি বড় দলের মাঝে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে আংশিক ব্রিটিশ সহযোগিতা হারাতে পারে বাংলাদেশ। এসব মন্তব্য বিবেচনায় নিতে হবে। সরকার হার্ড লাইনে গেলে ভুল করবে। গত ১৩ জানুয়ারি বিএনপির নেতারা ঢাকায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে কূটনীতিকরা মন্তব্য করেছেন যে, দশম সংসদ নির্বাচনে গণরায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। তারা সহিংসতা পরিহার করে সব দলের প্রতি সমঝোতার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। সহিংসতা কোনো সমাধান নয়। জাতির জন্য, সমাজের জন্য এই সহিংসতা কোনো ভালো ফল বয়ে আনে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে বিরোধী দলের মধ্যে এই উপলব্ধিবোধটুকু আসতে হবে। তবে এটা ভালো খবর যে, নির্বাচনের পর পরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। নির্বাচনের পর তেমন সহিংসতার খবর আসছে না। এ ব্যাপারে সরকার তেমন শক্ত অবস্থানে যায়নি। ওপরে উল্লিখিত তিনটি সিদ্ধান্তেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার প্রসঙ্গটি এসেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, নির্বাচনের আগে ও পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আক্রান্ত হয়েছেন বেশি। আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি নির্বাচনের আগে ও পরে এই সম্প্রদায়ের লোকদের টার্গেট করে আক্রমণ করা হয়। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এমন অপকাণ্ড অতীতে বারবার হয়েছে। এবারো হলো এবং অভিযোগ আছে এই সহিংস ঘটনার জন্য সরকারি দলের লোকজনও জড়িত। এমনি ধরনের একটি অভিযোগ এনেছেন হিন্দু-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জনৈক নেতা। বিষয়টাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত যেই থাকুক, সে রাষ্ট্রের শত্রু, সমাজের শত্রু। আমরা চাইব সরকার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে এসব ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে। এ ঘটনায়ও বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। বিদেশের পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে যখন কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তখন আগামীতে বিএনপির ভূমিকাও ভবিষ্যতে আরো প্রশ্নের মুখে পড়বে। আশার কথা, বিএনপি কোনো হরতাল আর অবরোধের কর্মসূচি দেয়নি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার। বেগম জিয়া উপলব্ধি করেছেন যে, হরতাল আর অবরোধে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। আর এই সহিংসতায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। সহিংসতায় সাধারণ মানুষের যেমনি সমর্থন থাকে না, ঠিক তেমনি বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও সমর্থন করে না। এখন বিএনপির সভায় জামায়াতকে আমন্ত্রণ না জানানো এবং জামায়াতের কোনো নেতা বক্তৃতা না দেয়ায় স্পষ্টতই বেগম জিয়া একটি মেসেজ দিলেন-আর তা হচ্ছে সংলাপের ব্যাপারে তিনি সিরিয়াস। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি যে উদারতা দেখিয়েছে, সরকার সেই উদারতা দেখাবে কিনা। বল তো এখন সরকারের কোর্টে। জামায়াতের ব্যাপারে সরকার কী করবে, তাও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আইনানুযায়ী সরকারের কাছে একাধিক সুযোগ রয়েছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার। সংবিধানের ৩৮ (গ) ও (খ) রিপ্রেজেনটেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স ১৯৭২ দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮-এর ধারা-উপ-ধারা বলে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি পর্যবেক্ষণ কিংবা উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলার ফয়সালা করে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। আগামী নির্বাচনে জামায়াত নামে কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আইনগত ও সাংবিধানিকভাবেই হওয়া উচিত। এটাকে সংলাপের পূর্বশর্ত আরোপ করা উচিত নয়। তবে এটা তো ঠিক বিএনপির নেতৃস্থানীয়দের মাঝে এই উপলব্ধিবোধ এসেছে যে, বিএনপির জামায়াতকে পরিত্যাগ করা উচিত। কিন্তু আমার ভাবনা অন্য জায়গায়। যদি সংলাপ হয়ও, তাতে কি কোনো ‘ফল’ আসবে? সংলাপে মূল আলোচ্য বিষয় কী? একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন? তাতে সরকার হয়তো রাজি হবে। কিন্তু নির্বাচনটা হবে কোন সরকারের অধীনে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার? সংবিধানে তো সেভাবেই লেখা আছে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই তো নির্বাচন হওয়ার কথা! বিএনপি তা কি মানবে? যদি এটা বিএনপিকে মানতেই হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিল না কেন? আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি সংবিধানে বর্ণিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফর্মুলা বাদ দিয়ে (যেখানে শেখ হাসিনাই থেকে যাবেন সরকারপ্রধান হিসেবে), অন্য যে কোনো ফর্মুলায় বিএনপি রাজি হবে। ফলে সংলাপ হলেও তা কোনো ফল দেবে না-আমার আশঙ্কা এখানেই। সরকার এখন চাইবে দশম সংসদকে পাঁচ বছর টেনে নিয়ে যেতে। এতে সরকার কতটুকু সফল হবে, তা নির্ভর করছে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কতটুকু সংগঠিত করতে পারবে তার ওপর। সম্ভবত বিএনপি তথা ১৮ দলের স্ট্র্যাটেজি সঠিক ছিল না। এটা সত্য নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। যেখানে ১৫৩ আসনে কোনো নির্বাচন হয়নি এবং অন্য আসনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম, সেখানে বিএনপির প্রতি জনসমর্থন থাকলেও বিএনপি আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন বাংলাদেশে কায়রোর তাহরির স্কয়ার কিংবা ব্যাংককের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে! সেটা হয়নি। বিএনপিকে এখন বিগত দিনের আন্দোলনের হিসাব মেলাতে হবে। আন্দোলনে বিএনপি কর্মীদের মাঠে না থাকা, জেলের ভয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পালিয়ে বেড়ানো ইত্যাদি ঘটনা সরকারবিরোধী আন্দোলনকে বিএনপি চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই নতুন করে ‘হিসাবের খাতা’ খুলতে হবে। জামায়াত কৌশলী। তারা আপাতত ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাবে। তবে তারা চূড়ান্তভাবে হারিয়ে যাবে এটা আমার মনে হয় না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও (?) তারা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে। তুরস্কের ইতিহাস আমাদের সামনে আছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা নব্বইয়ের শেষের দিকে নেকমাতিন এরবাকানের নেতৃত্বে ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল তুরস্কে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইসলামপন্থি হিসেবে পরিচিত ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী ট্র– পাথ পার্টির একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল তুরস্কে ১৯৯৬ সালে। এরবাকান ছিলেন ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। যদিও সেই সরকার স্থায়ী হয়নি। একপর্যায়ে ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হলে তারা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির ব্যানারে সংগঠিত হন এবং পর পর তিনবার সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন। সুতরাং জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও এরা হারিয়ে যাবে, এটা আমার মনে হয় না। বেগম জিয়া নতুন করে কোনো কঠোর কর্মসূচি না দেয়ায়, স্পষ্টতই সংকটের জট খোলার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। এমনকি গত ২১ জানুয়ারি রেলমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারও বলেছেন দ্রুত সংলাপে যাওয়ার। কিন্তু সিনিয়র মন্ত্রীদের কথাবার্তা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেগম জিয়াকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান, আমাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে, প্রত্যাশিত এই সংলাপটি নাও হতে পারে। তাই একটি সংলাপ হবে কিংবা একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন ২০১৪ সালেই অনুষ্ঠিত হবে সে ব্যাপারে এখনই কিছু বলা কঠিন। এখন অনেক সম্ভাবনার জন্ম হবে। এক. যারা নতুন করে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন (?) তারা চাইবেন ৫ বছরের টার্ম পূরণ করতে। দুই. জাতীয় পার্টির সুবিধাভোগীরা জানে ক্ষমতা হারালে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই সংসদ ভেঙে যাক এটা তারা চাইবেন না। তিন. সরকারি দলের অনেক নেতাকর্মী আছেন, যারা মনে করেন আগামী ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারলে বিএনপি ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ক্ষমতা আরো দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হবে। চার. আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন, আগামীতে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হবে (রাজনৈতিকভাবে) জামায়াতকে, জামায়াত যে নামেই আত্মপ্রকাশ করুক না কেন। জামায়াতের তরুণ প্রজšে§র নেতৃত্বেই একটি আধুনিক ইসলামিক ফোর্সের (অনেকটা তুরস্কের মডেলে) আত্মপ্রকাশ ঘটবে এবং তারাই হবে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিএনপি অনেকটা ‘রণে ভঙ্গ দিয়েছে’। সুতরাং আওয়ামী লীগ খুব অনায়াসে ৫ বছর ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারবে। এটা স্পষ্ট যে, বিএনপি নয়া সংসদ ও নয়া সরকারের ব্যাপারে একটা ‘সফট অ্যাটিচিউড’ গ্রহণ করেছে। অনেকের ধারণা ছিল ২৯ জানুয়ারি (যেদিন দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসছে) বিএনপি হরতাল দেবে। কিন্তু বিএনপি তা দেয়নি। এর মধ্য দিয়ে মেসেজটি পরিষ্কার, বিএনপি এক ধরনের সমঝোতা চায়। আগামী মাসে উপজেলা নির্বাচন। এই নির্বাচন দলীয়ভাবে হয় না। তবে সমর্থকরা অংশ নেন। বিএনপির সমর্থকরা এই নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে আমার ধারণা। এই নির্বাচনে অংশ না নিলে স্থানীয়ভাবে বিএনপির যে ভিত্তি তাও হারাতে পারে দলটি। তাই বেগম জিয়াকে এখন পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণ করে এগোতে হবে। তার উচিত হবে এখন জেলাপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা। বেগম জিয়া এখন প্রতিটি বিভাগীয় শহরে যাবেন এই সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। নিশ্চয়ই বিগত আন্দোলন থেকে তিনি শিখেছেন। জনসমর্থন থাকলেও সরকারের যে পতন ঘটানো যায় না, তা এবার প্রমাণিত হলো। তবে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ চায়। আর এটা নিশ্চিত করতে হলে দুটি বড় দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঝে সহাবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। এই মুহূর্তে এই সহাবস্থানটি নেই। ফলে খুব দ্রুত একটি সংলাপ হবে, মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে-তা এখনই দৃঢ়ভাবে বলা কঠিন। Daily Manobkontho 24.01.14

0 comments:

Post a Comment