রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও নতুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

 

                
প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছেন ২১ সেপ্টেম্বর। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বিশ্বের ১৯৩টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা এ  শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। এবারের শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলো এমন এক সময়, যখন বিশ্ব এই মুহূর্তে বড় দুইটি সমস্যার সম্মুখীন। প্রথমটি, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং দ্বিতীয়টি ব্যাপকভাবে অভিবাসন ও শরণার্থী সমস্যা। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে এই দুইটি সমস্যার সমাধানে বিশ্ব নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের মাত্রা কীভাবে বেড়েছে, তার বড় প্রমাণ পাওয়া যায় যখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বড় শহরে (নিউইয়র্ক, মিনোসোটা, নিউজার্সি) সন্ত্রাসীরা ‘প্রেসারকুকার’ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এতে মানুষ মারা যায়নি সত্য; কিন্তু দুইটি ঘটনায় (নিউইয়র্ক ও মিনোসোটায়) আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন এবং অন্তত একটি ক্ষেত্রে ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। মিনোসোটায় যে জঙ্গি আটজনকে ছুরিকাঘাত করেছিল, সে পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার আগে আইএসের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন এবং আইএস এটা স্বীকারও করেছিল যে, ‘ইসলামিক খেলাফতের’ সৈনিকরা এ কাজটি করেছে। চলতি বছরের মাঝামাঝি ওরল্যান্ডের সমকামী ক্লাবে ওমর মতিন নামে এক আফগান-আমেরিকান আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেছিল। ওমর মতিনও মৃত্যুর আগে আইএসের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। ফলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও এখন আইএস বড় আতঙ্ক। আইএসের সদস্যরা এরই মধ্যে অভিবাসীদের মাঝে কতটুকু ‘প্রবেশ’ করতে পেরেছে, তার কোনো সুস্পষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও এটা তো সত্য, এখানে আইএসের এজেন্ট আছে। এই এজেন্টরা নতুন এক ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্ম দিয়েছে, যাকে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে বলেছেন, ‘নতুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। বাংলাদেশও যে ‘নতুন সন্ত্রাসের’ দ্বারা আক্রান্ত, এটাও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সন্ত্রাসীদের অর্থ, অস্ত্র ও নৈতিক সমর্থন না দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি যে আহ্বান জানিয়েছেন, তার গুরুত্ব অনেক। কেননা এরই মধ্যে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পেছনে অর্থ একটি ফ্যাক্টর। যেখানেই সন্ত্রাসী কর্মকা- হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ফ্রান্স কিংবা যুক্তরাষ্ট্র সব জায়গাতেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাকায় হলি আর্টিজানে যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল অর্থ এসেছিল। সুতরাং অর্থ একটি ফ্যাক্টর। বিশ্ব সম্প্রদায় যদি এই অর্থ আদান-প্রদানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও বাস্তবায়ন করতে না পারে, তাহলে সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ হবে না। ১৫ বছর আগে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার হামলা সংঘটিত করতে সন্ত্রাসীদের কাছে কয়েক লাখ ডলার সরবরাহ করা হয়েছিল।
দুই সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্র ‘১১ সেপ্টেম্বর’ (২০০১) সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ১৫ বছর পার করেছে। ২০০১ সালের ওই হামলা সারা বিশ্বের রাজনীতিকে বদলে দিয়েছিল। সারা বিশ্বের মানুষ প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ করেছিল সন্ত্রাসীরা কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। এত বছর পরও ৯/১১-কে নিয়ে যে ‘মিথ’, যে ‘বিতর্ক’, তার কোনো সমাধান হয়নি। ১১ সেপ্টেম্বর বিকালবেলা আমি ‘গ্রাউন্ড জিরো’তে গিয়েছিলাম। একসময় এখানে ‘টুইন টাওয়ার’ ছিল, যা ৯/১১ এর হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে নতুন একটি ভবন ‘ফ্রিডম টাওয়ার’। কারা হামলা করেছিল বিমান হাইজ্যাক করে, তাদের পরিচয় পাওয়া গেছে সত্য (১৫ জন ছিলেন সৌদি নাগরিক); কিন্তু কে তাদের প্ররোচিত করেছিল, আল কায়দা এর সঙ্গে কতটুকু জড়িত ছিলÑ এ বিতর্কের আজও কোনো সমাধান হয়নি। একটি কমিশন গঠিত হয়েছিল সত্য; কিন্তু কমিশনকে  কোনো তথ্য দিয়ে সহায়তা করেনি সরকার। চার-চারটি প্লেন কীভাবে একসঙ্গে হাইজ্যাক হলো, কেন চারটি বিমানের ‘ব্ল্যাক বক্স’ খুঁজে পাওয়া গেল না, কেন হাইজাকার কিংবা বিমানযাত্রীদের ডিএনএ টেস্ট করা হলো না এর কোনো সঠিক জবাব মানুষ আজও পায়নি। টুইন টাওয়ারের মতো সুউচ্চ ভবন কীভাবে একসঙ্গে ভেঙে পড়ল এটা নিয়েও বিতর্ক আছে। ইউরোপের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এটা ছিল ‘Controlled Demolition’, অর্থাৎ ‘নিয়ন্ত্রিত ধ্বংস’। আরও স্পষ্ট করলে বলা যায়, অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ভবন দুইটি ধ্বংস করা হয়েছিল। সাধারণত বড় বড় ভবন এভাবে ধ্বংস করা হয়, যাতে করে পাশের ভবনের কোনো ক্ষতি না হয়। একটি বিমান কোনো ভবনে আঘাত করলে, পুরো ভবনটি একসঙ্গে নিচের দিকে ভেঙে পড়ার কথা নয়। ‘টুইন টাওয়ার’ এর ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। পাশের তৃতীয় একটি ভবন ভেঙে গিয়েছিল অনেক পরে। কিন্তু সেখানে কোনো বিমান হামলা হয়নি। সুতরাং ৯/১১ নিয়ে বিতর্ক আছে এবং বিতর্ক থাকবেই। কিন্তু যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, ৯/১১ এর হামলাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এর কর্মসূচি গ্রহণ করে, যা দীর্ঘ ১৫ বছরেও শেষ হয়নি। একদিকে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া আর সিরিয়ার মতো দেশ যখন পরিপূর্ণ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, অন্যদিকে আফ্রিকায় জন্ম হয়েছে নতুন নতনু ফ্রন্টের। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এর নামে আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নয়া কমান্ড ‘আফ্রিকম’ (AFRICOM)। দক্ষিণ এশিয়ায়ও এ ধরনের অপর একটি কমান্ড প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় চলছে। কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকা- নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। বরং বেড়েছে। ৯/১১-কে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বের মানুষ জেনেছিল আল কায়দার কথা। আর এখন মানুষ জানছে ইসলামিক স্টেটের কথা। কিন্তু সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। এরই মধ্যে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের করদাতারা জনপ্রতি হাজার হাজার ডলার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পরিশোধ করে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউট একটি গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেছে, তাতে দেখান হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এর পেছনে। তাদের তথ্য মতে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত খরচ করে ফেলেছে ৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। এই অর্থ আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও পাকিস্তান যুদ্ধে ব্যয় হয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালের বাজেটে আরও যুক্ত হচ্ছে ৬৫ বিলিয়ন ডলার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য, ৩২ বিলিয়ন হোমল্যান্ড সিকিউরিটির জন্য, এবং যুদ্ধাহত সৈন্যদের জন্য আরও খরচপাতি। সব মিলিয়ে যুদ্ধের পেছনে খরচ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৪ দশমিক ৭৯ ট্রিলিয়ন ডলার। এ অর্থ বিভিন্ন সূত্র থেকে ধার করা হয়েছে। রাষ্ট্রকে তা পরিশোধ করতে হবে সুদসহ। বছরের পর বছর সুদের পরিমাণ বাড়বে এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতে, ২০৫৩ সালে (যখন সব ঋণ পরিশোধ হবে) যুদ্ধের খরচ গিয়ে দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। জুয়ান কোল একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন, ন্যূনতম ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে কী করা যেত (Juan Cole what did we buy with $5 trillion that the Iraq and Afganistan wars have cost us? Truth dig, Sept. 13, 2016)। তিনি দেখিয়েছেন, প্রতিদিন যদি ১০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা যায়, তাতেও এ টাকা শেষ হতে সময় নেবে ২৭৩ বছর। এ যুদ্ধে ৭ হাজার মার্কিন সৈন্য মারা গেছেন। ৫২ হাজার সৈন্য আহত হয়েছেন। আর ইরাকি ও আফগান জনগণের মৃত্যুর হিসাব কয়েক লাখ। ৪০ লাখ মানুষ নিজ বাসভূমি ছেড়ে দেশান্তরিত হয়েছেন। জোয়ান কোলের মতে, আল কায়দা যুক্তরাষ্ট্রেরই সৃষ্টি। ইরাকে কোনো আল কায়দা ছিল না। এমনকি সিরিয়ায়ও নেই। এই দুইটি দেশে ধর্মনিরপেক্ষ ও লিবারেলরা ক্ষমতায় ছিলেন এবং আছেন (সাদ্দাম হোসেন এবং আসাদ)। কিন্তু ‘যুদ্ধ’ সেখানে ইসলামিক জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছে। দেশ দুইটি ধ্বংস হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ কোনো ফল বয়ে আনেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্য বেড়েছে। আয়বৈষম্য বেড়েছে। করপোরেট হাউসগুলো এ যুদ্ধ থেকে লাভবান হয়েছে। এ করপোরেট হাউসগুলোর স্বার্থেই এ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ অব্যাহত থাকবে। যুদ্ধ মানেই ব্যবসা। এ ব্যবসায় সাধারণ মানুষ লাভবান হয় না। লাভবান হয় বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। করপোরেট হাউসগুলো। আজ যখন নিউইয়র্ক, মিনোসোটা আর নিউজার্সিতে সন্ত্রাসী কর্মকা- হয়, তখন এসব প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সাধারণত মিডিয়ায় এ নিয়ে আলোচনা হয় কম। কিছু ওয়েবসাইট এবং অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্র রয়েছে, যেখানে বিষয়গুলো আলোচিত হয় বেশি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। এ সময় খোদ নিউইয়র্ক শহরে শত নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেও যখন বোমা বিস্ফোরিত হয়, তখন এটা স্পষ্ট, যারাই এ কাজটি করেছে, তারা বিশ্ব নেতাদের একটি মেসেজ দিতে চায় আর তা হচ্ছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এখনও শেষ হয়নি। তাহলে এর শেষ কোথায়? ১৫ বছর পার হয়েছে। যুদ্ধ এখনও চলছে। এক নয়া মধ্যপ্রাচ্যের জন্ম হতে যাচ্ছে। তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্রের এরই মধ্যে জন্ম হয়েছে। সেখানেই ‘যুদ্ধ’ জিইয়ে রাখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের লাভটা এখানেই। দুঃখজনক হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো কিংবা মুসলিম বিশ্ব আজ দ্বিধাবিভক্ত। সেখানে কোনো ঐক্য নেই। সিরিয়া সংকটের আদৌ কোনো সমাধান হবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিমান হামলার পর দীর্ঘ এক বছর পার হয়েছে। আইএসকে উৎখাত করা যায়নি।
সুতরাং প্রধানমন্ত্রী যখন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ’ শুরু করার কথা বলছেন, এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো একটি দেশের পক্ষে সন্ত্রাস দমন করা সম্ভব নয়। সন্ত্রাসীদের কোনো সীমান্ত নেই। এদের কর্মকা- আজ আর শুধু সিরিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং ইউরোপ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাও আজ হুমকির মুখে। সুতরাং ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসী কর্মকা- মোকাবিলা করা জরুরি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সে কথাটাই উঠে এসেছে। অর্থ সরবরাহ বন্ধ ও সেই সঙ্গে একটি প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করাও দরকার। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রশ্নটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ এ ব্যাপারে বড় ভূমিকা নেবে এটাই প্রত্যাশা সবার।
Daily Alokito Bangladesh
02.10.2016
 

0 comments:

Post a Comment