তিনি শি জিনপিং। চীনের প্রেসিডেন্ট এবং চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি ২২ ঘণ্টার সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তার সফরের সময়। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে তিনি যাননি বটে কিন্তু সাভারে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন অথচ এই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল চীন। এখন আর বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চীনের ভূমিকা নিয়ে কথা বলে না। কেননা চীন আমাদের উন্নয়নের অংশীদার। তাই প্রশ্ন থেকে গেল একটাই শি জিনপিং আসলেন, দেখলেন কিন্তু জয় করতে পারলেন কি? চীনকে এখন বলা হচ্ছে বাংলাদেশের ‘কৌশলগত অংশীদার।’ ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। দুই লাখ কোটি টাকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। বেসরকারি পর্যায়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি। ৬টি প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়েছে। সাদা চোখে দেখলে দেখা যাবে এটা একটা বিশাল পাওনা আমাদের জন্য। কিন্তু প্রশ্নও আছে অনেক। কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণ, চট্টগ্রাম ও খুলনায় দু’ দুটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, সারকারখানা স্থাপন এসবই আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় চীনের সহযোগিতা, সামুদ্রিক সহযোগিতা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুটি বিষয়ে আমার এক ধরনের আশঙ্কা থেকেই গেল। একটি হচ্ছে বাংলাদেশে ‘চীনের ওয়ান বেল্ট ও ওয়ান রোড’ কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছে। তবে আমি নিশ্চিত নই এর ধরন কী হবে? দ্বিতীয়ত, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর বাস্তবায়নের কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে (কুনমিং) বাংলাদেশের কক্সবাজারকে সংযুক্ত করা। আমি নিশ্চিত নই কিভাবে এটি বাস্তবায়ন হবে।
‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে চীনের বড় আগ্রহ রয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এই মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোও উপকৃত হতে পারে। ইতোমধ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মধ্য এশিয়া, মস্কো ও পাকিস্তানও সফর করেছেন তার মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করতে। চীনের প্রেসিডেন্টের আফ্রিকা সফরও এই আলোকে রচিত হয়েছিল। চীনের ইতোমধ্যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বাস্তবায়নের জন্য একটি সিল্ক রোড ফান্ড গঠন করেছে। এই ফান্ডের পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন ডলার। চীন-পাকিস্তান যে ইকোনমিক করিডর গড়ে উঠছে তাতে ব্যয় রাখা হয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার, যার মাঝে ১১ বিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে। এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত দেশ এই ফান্ড থেকে সাহায্য পাবে এবং তা দিয়ে মূলত সড়ক ও রেলপথ তৈরি করা হবে। অর্থাৎ অবকাঠামো খাতে চীন এই অর্থ বরাদ্দ করছে। বাংলাদেশের জন্য এখন এই ফান্ড উš§ুক্ত হবে।
বাংলাদেশ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনায় এখন সংযুক্ত হয়েছে। তবে এতে করে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। ভারত এই মহাপরিকল্পনাটি খুব সহজভাবে নিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা ইতোমধ্যে ভারত মহাসাগরে চীন-ভারত বৈরী পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভারত-চীন বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় ভারত মহাসাগরভুক্ত বিভিন্ন দেশে এই দুটি দেশ নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। জিবুতি, গাওদার, হামমানতোতা (শ্রীলঙ্কা), মিয়ানমার, ইয়েমেন, মুজাম্বিক, মাদাগাস্কার, ওমান কিংবা কেনিয়াতে চীন নৌঘাঁটি নির্মাণের আগ্রহের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। জিবুতি ও মাদাগাস্কারে নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। ভারত একইভাবে সিসিলি ও মৌরিতুসে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে। ২০১৫ সালের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই দীপ রাষ্ট্র দুটি সফরের সময় এই নৌঘাঁটি নির্মাণের কথা প্রথমবারের মতো জানা যায়। ভারত এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সখ্য গড়ে উঠছে, যা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করবে আগামীতে। ফলে চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রুট’ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। তবে আমরা বাংলাদেশের ‘জাতীয় স্বার্থ’কে অবশ্যই বিবেচনায় নেব। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে তেলের পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। পারস্য অঞ্চলের জ্বালানি তেল চীন এ পথে খুব অল্প সময়ে এবং মধ্য এশিয়ার তেল চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এই জ্বালানি তেলের ওপর চীন নির্ভরশীল। চীনের অর্থনৈকি উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। একই সঙ্গে চীন এই অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে চীনের ইউনান প্রদেশকেও সংযুক্ত করতে চায়। এটা করতে হলে কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক পথ (যাতে পরে কলকাতা সংযুক্ত হবে) নির্মাণ শেষ করতে হবে। ২০১৩ সালে চারটি দেশ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছিল এই সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ২০১৪ সালে চীন যান তখন তিনি কুনমিংয়ে এক বৈঠকে বলেছিলেন বাংলাদেশ কুনমিং-কক্সবাজার সড়কপথ নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী। অতি সম্প্রতি সৈয়দ আশরাফও বলেছেন চীনের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপানের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে। এখন যৌথ ইশতিহারে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর বাস্তবায়নের জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের লাভ হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পথে চীনা পণ্য আমদানি করতে পারবে। তাতে সময় বাঁচবে ও পণ্যের মূল্য কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হতে পারে। এতে করে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এই অর্থনৈতিক করিডর ব্যবহার করে এশিয়া থেকে জ্বালানি (তেল ও গ্যাস) আমদানি করতে পারে। সুতরাং চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি চীনের স্বার্থে রচিত ও বাস্তবায়িত হলেও বাংলাদেশের স্বার্থকে একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে কক্সবাজারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হলে চীনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। চীন কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। এতে করে আমরা লাভবান হতে পারতাম। কিন্তু ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলায় শ্রীলঙ্কার হামমামতোতায় নির্মিত গভীর সমুদ্র বন্দরের ব্যাপারেও চীন নিরাপত্তার প্রশ্নটি তুলেছিল। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি এবং সর্বশেষ চীন-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা সব মিলিয়ে চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’-এর ব্যাপারে একটা প্রশ্ন রেখে গেল। চীনে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় (২০১৪) সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু তখন তা হয়নি। তখন এর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে মতান্তরের কথা পত্রিকায় ছাপা হলেও মূল বিষয় ছিল ভারতের আপত্তি।
আরো বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। এক. যে সব প্রকল্পে এই চীনা ঋণ নেয়া হয়েছে তা আমাদের উন্নয়নের কতটুকু কাজে লাগবে? প্রশ্ন এ কারণেই যে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতার বিশদ বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি। দুই. চীনা ঋণের শর্ত ও সুদের হার কতটুকু? এক্ষেত্রে এসব প্রকল্পে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে কোনো সহযোগিতা নিতে পারতাম কিনা? আমরা আদৌ বিশ্বব্যাংকের কাছে এ ব্যাপারে এপ্রোচ করেছিলাম কিনা এটাও এটা প্রশ্ন। কেননা আমরা এটা মোটামুটিভাবে সবাই জানি যে, বিশ্বব্যাংক সাধারণত সহজ শর্তে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। চীনা ঋণে চীনের ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। বিশ্বব্যাংকও তাই করে। কিন্তু চীনা ঠিকাদারদের ক্ষেত্রে কতটুকু সততা ও ‘ট্রান্সপারেন্সি’ থাকবে সেটা একটা প্রশ্ন বটে। তিন. পদ্মা সেতুতে রেল যোগাযোগ স্থাপনে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এটা ভালো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ‘তৃতীয় কোনো দেশ’ এটা থেকে ফায়দা নেবে কিনা। কিংবা এটা ব্যবহার করলে এর ‘মডালিটি’ কি হবে। চার. পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা সহযোগিতা আদৌ নেয়া হবে কিনা। কেননা এটি একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘আদানি’ গ্রুপ নির্মাণ করছে বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে চীনও এই প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়। সুতরাং পায়রা বন্দর নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই।
শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হলো। এখন দেখতে হবে আগামী দিনগুলোতে আমরা এই সফরকে আমাদের স্বার্থে কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছি। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। ১১ দশমিক ৩৯২ ট্রিলিয়ন ডলারের যে অর্থনীতি, সেই অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি সংযুক্ত হয় তাহলে তা থেকে বাংলাদেশেরই লাভবান হওয়ার কথা।
নিউইর্য়ক, যুক্তরাষ্ট্র
Daily Manobkontho
25.10.2016
0 comments:
Post a Comment