সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক একাধিকবার আলোচনায় এসেছে। এসব আলোচনায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ খবর আমরা পেয়েছি। এক. প্রায় তিন দশক পর ১৪ অক্টোবর একজন চীনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে শি জিনপিং ঢাকায় আসছেন। দুই. চীন অন্য যেকোনো দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সোনাদিয়া কিংবা পায়রায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায়। চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনার কথা ঢাকায় এসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন চীনা সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং জোয়াইনইউ। গত ১৩ এপ্রিল ঢাকায় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এর আগে তিনি ওইদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। চীনা প্রেসিডেন্ট এরই মধ্যে ভারত সফর করে গেছেন। তখন তিনি বাংলাদেশে আসেননি। তবে বাংলাদেশে এসেছিলেন যখন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি বাংলাদেশে আসেননি। অন্যদিকে গত ২১ মার্চ কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাবের অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত মা সিং জিয়াং বলেছিলেন, চীন বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী। প্রয়োজনে অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চীন এ কাজটি করতে চায়। এখানে বলা ভালো, চলতি বছরের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪১ বছর পার করবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীন বিরোধিতা করেছিল এটা সত্য। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পর থেকে ধীরে ধীরে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নত হতে থাকে। বিশেষ করে চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু চীন। একসময় ছিল, যখন চীন শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধী দলের নেতা ছিলেন, তখন চীন সরকারিভাবে তাকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে চীনে গিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীকেও চীন গুরুত্ব দেয়। চীনা সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং জোয়াইনইউ ঢাকায় এসে খালেদা জিয়ার সঙ্গেও দেখা করেছিলেন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে চীনে গিয়েছিলেন। তার ওই সফর ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ওই সফরের সময় বঙ্গোপসাগরের অদূরে সোনাদিয়ায় চীনের সহযোগিতায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল। সে প্রস্তুতিও আমাদের ছিল। কিন্তু তা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে গভীর সমুদ্রবন্দর (নির্মিতব্য) পরিচালনার ভার বাংলাদেশ কোনো বিদেশী কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায় না। চীনা সরকার এটি পেতে চেয়েছিল। উল্লেখ্য, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির পাশাপাশি ইউএই, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ক সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু একটি বাছাই কমিটি প্রথমে চায়না হারবারকে যোগ্য বলে অভিমত দিয়েছিল। চায়না হারবারের প্রস্তাব অনুযায়ী তিন ধাপে ১০ বছরের মধ্যে এ নির্মাণ সম্পন্ন হবে। ব্যয় হবে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ৩ বছরে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। বড় জাহাজগুলো এখানে নোঙর করতে পারবে (এখন চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট ছোট জাহাজে পণ্য আনতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর)। প্রথম পর্যায়ে বন্দরে ২০ লাখ টিইইউস (কনটেইনার টার্মিনাল) কনটেইনার ধারণ করতে পারবে। আর সাধারণ কার্গোর (খোলা পণ্য) ধারণ সক্ষমতা হবে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এখানে এখন অনেকগুলো দেখার বিষয় রয়েছে। আমার বিবেচনায় বাছাই কমিটির চায়না হারবারকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল সঠিক। কেননা চীনারা এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। এ অঞ্চলে অন্তত তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দরের খবর জানা যায়, যা চীনা অর্থে ও চীনা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্মিত ও পরিচালিত হচ্ছে। শ্রীলংকায় দুটো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। একটি হাম্বানতোতায়, অন্যটি কলম্বোতে। কিছুদিন পূর্বেও হাম্বানতোতায় ছিল গভীর জঙ্গল। ছোট্ট একটা শহর, যেখানে কোনো ভালো হোটেল ছিল না। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জন্মস্থান এখানে। চীন এখানে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ফলে পুরো হাম্বানতোতার দৃশ্যপট বদলে গেছে। হাম্বানতোতা আজ একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা পেয়েছে। নামকরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে এখানে। ২০১৮ সালে এখানে কমনওয়েলথ গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কলম্বোতে যে বন্দরটি নির্মিত হয়েছে, তাতে বছরে ৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা একটাই— এখানে ‘মেগা শিপ’ অর্থাৎ বড় জাহাজগুলো ভিড়তে পারে এবং পণ্য খালাস করতে পারে। বলা হচ্ছে, বন্দর পরিচালনা কার হাতে থাকবে— এটা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। যদি সর্বশেষ কলম্বোর সিআইসিটি অর্থাৎ কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা দেখি, তাহলে দেখতে পাব শতকরা ৮৫ ভাগ মালিকানা চীনের হাতে। ১৫ ভাগের মালিকানা শ্রীলংকা সরকারের হাতে। যদি পাকিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা বলি, তাহলে শতকরা একশ ভাগ মালিকানাই চীনাদের হাতে। একসময় সিঙ্গাপুরের হাতে দায়িত্ব ছিল এর পরিচালনার। এখন চীনাদের হাতে রয়েছে এর পরিচালনার ভার। যেখানে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেখানে পরিচালনার ভার থাকলে আপত্তি কোথায়? সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত না হয়, তাহলে চীনাদের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার দেয়া যেতে পারত। সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের বন্দর পরিচালনায় যে অভিজ্ঞ জনশক্তি প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। বরং চীনাদের সঙ্গে থেকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতাম। ডিজাইন তৈরিতেও অভিজ্ঞ চীনারা। তাই তাদের ওপর আস্থা রাখা যেত। কিন্তু এখন তা আর হচ্ছে না।
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ-সংক্রান্ত চুক্তি না হওয়া ছিল নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে যত দ্রুত আমরা সোনাদিয়ায় একটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারব, ততই আমাদের জন্য তা মঙ্গল। কেননা দেরি হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। শুধু তা-ই নয়, এ অঞ্চলের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএসের কর্মকর্তাকে স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে যে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠছে, তার উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থেই এ সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এ বন্দর দিয়েই তাদের পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে সোনাদিয়ায় কোনো গভীর সমুদ্রবন্দর করছে না। করছে পায়রায়, সেখানে একটি ভারতীয় কোম্পানি (আদানি) এ গভীর সমুদ্রবন্দরটি করবে। তার পরও চীন সোনাদিয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ হারায়নি। প্রয়োজনে কোনো ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গেও যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী চীন।
চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে যে আগ্রহী, তার বড় প্রমাণ চীনা প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য বাংলাদেশ ভ্রমণ। নিঃসন্দেহে তার এই সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে। চীন বাংলাদেশে অনেকগুলো সেতু নির্মাণ করে দিয়েছে, যা বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নামে পরিচিত। বাণিজ্যিক সম্পর্ক চীনের দিকে ঝুঁকে পড়লেও আমাদের স্বার্থেই এই সম্পর্ক আরো উন্নত করা প্রয়োজন। এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক চীনের অনুকূলে। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য চীনে রফতানি করে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রায় ১৩ দশমিক ৮ গুণ পণ্য আমদানি করে। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশ রফতানি করেছিল ৪৮ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছিল ৫৯২ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০০১-০২ সময়সীমায় প্রায় ৬১ গুণ বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করতে হয়েছিল (১১ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন-এর বিপরীতে ৭০৮ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন!) ২০১২-১৩ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৮ দশমিক ১২ মিলিয়ন (রফতানি) ও ৬৩২৪ মিলিয়ন (আমদানি)। অন্যদিকে চীনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ তেমন বেশি নয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চীন ঋণ দিয়েছিল ১৮১ মিলিয়ন ডলার, যা ছিল সুদমুক্ত। একই সঙ্গে ৭৫ মিলিয়ন কম সুদে, ৭৬৪ মিলিয়ন সাপ্লায়ার ক্রেডিট ও ৩২ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন অনুদান দিয়েছিল। ২০১৩ সালে চীন তার নিজ দেশে পাঁচ হাজার আইটেমের বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ মূলত ফ্রোজেন ফুড, পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া, তৈরি পোশাক চীনে রফতানি করে। চীনা বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই, তাতে দেখা যায় ২০০৯ সালে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৮৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৩ সালে এসে ১৮৬ জন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৩২০ মিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা খাতের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ব্যবহূত সমরাস্ত্রের শতকরা ৭৫ ভাগের উৎস হচ্ছে চীন। চীন থেকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, আর বিমানবাহিনীর জন্য ফাইটার প্লেন চীন থেকে ক্রয় করা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগেই বাংলাদেশ-চীন সামরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জীবদ্দশায় জিয়াউর রহমান একাধিকবার চীন সফর করেছেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীনের ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের বাংলাদেশ সফর ছিল নিয়মিত। এখন এ প্রবণতা কিছুটা কম। ২০০২ সালে খালেদা জিয়ার সময়সীমায় বাংলাদেশ ও চীন একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।
ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। আর চীন আমাদের নিকট-প্রতিবেশী। আমাদের সীমান্ত থেকে চীনের সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। চীন এই মুহূর্তে এশিয়ায় অর্থনীতিতে এক নম্বরে এবং ভারতের অবস্থান তৃতীয়। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এ দেশ দুটি যে একটি ফ্যাক্টর, তা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ এ দুটি দেশের সঙ্গে একটি ভারসাম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে আসছে। যেখানে ‘জাতীয় স্বার্থ’র প্রশ্ন জড়িত, সেখানে বাংলাদেশ একটি পজিটিভ নীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। এক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে সাহায্য করবে।
Daily Bonik Barta
14.10.2016
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে চীনে গিয়েছিলেন। তার ওই সফর ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ওই সফরের সময় বঙ্গোপসাগরের অদূরে সোনাদিয়ায় চীনের সহযোগিতায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল। সে প্রস্তুতিও আমাদের ছিল। কিন্তু তা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে গভীর সমুদ্রবন্দর (নির্মিতব্য) পরিচালনার ভার বাংলাদেশ কোনো বিদেশী কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায় না। চীনা সরকার এটি পেতে চেয়েছিল। উল্লেখ্য, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির পাশাপাশি ইউএই, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ক সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু একটি বাছাই কমিটি প্রথমে চায়না হারবারকে যোগ্য বলে অভিমত দিয়েছিল। চায়না হারবারের প্রস্তাব অনুযায়ী তিন ধাপে ১০ বছরের মধ্যে এ নির্মাণ সম্পন্ন হবে। ব্যয় হবে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ৩ বছরে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। বড় জাহাজগুলো এখানে নোঙর করতে পারবে (এখন চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট ছোট জাহাজে পণ্য আনতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর)। প্রথম পর্যায়ে বন্দরে ২০ লাখ টিইইউস (কনটেইনার টার্মিনাল) কনটেইনার ধারণ করতে পারবে। আর সাধারণ কার্গোর (খোলা পণ্য) ধারণ সক্ষমতা হবে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এখানে এখন অনেকগুলো দেখার বিষয় রয়েছে। আমার বিবেচনায় বাছাই কমিটির চায়না হারবারকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল সঠিক। কেননা চীনারা এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। এ অঞ্চলে অন্তত তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দরের খবর জানা যায়, যা চীনা অর্থে ও চীনা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্মিত ও পরিচালিত হচ্ছে। শ্রীলংকায় দুটো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। একটি হাম্বানতোতায়, অন্যটি কলম্বোতে। কিছুদিন পূর্বেও হাম্বানতোতায় ছিল গভীর জঙ্গল। ছোট্ট একটা শহর, যেখানে কোনো ভালো হোটেল ছিল না। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জন্মস্থান এখানে। চীন এখানে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ফলে পুরো হাম্বানতোতার দৃশ্যপট বদলে গেছে। হাম্বানতোতা আজ একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা পেয়েছে। নামকরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে এখানে। ২০১৮ সালে এখানে কমনওয়েলথ গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কলম্বোতে যে বন্দরটি নির্মিত হয়েছে, তাতে বছরে ৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা একটাই— এখানে ‘মেগা শিপ’ অর্থাৎ বড় জাহাজগুলো ভিড়তে পারে এবং পণ্য খালাস করতে পারে। বলা হচ্ছে, বন্দর পরিচালনা কার হাতে থাকবে— এটা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। যদি সর্বশেষ কলম্বোর সিআইসিটি অর্থাৎ কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা দেখি, তাহলে দেখতে পাব শতকরা ৮৫ ভাগ মালিকানা চীনের হাতে। ১৫ ভাগের মালিকানা শ্রীলংকা সরকারের হাতে। যদি পাকিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা বলি, তাহলে শতকরা একশ ভাগ মালিকানাই চীনাদের হাতে। একসময় সিঙ্গাপুরের হাতে দায়িত্ব ছিল এর পরিচালনার। এখন চীনাদের হাতে রয়েছে এর পরিচালনার ভার। যেখানে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেখানে পরিচালনার ভার থাকলে আপত্তি কোথায়? সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত না হয়, তাহলে চীনাদের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার দেয়া যেতে পারত। সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের বন্দর পরিচালনায় যে অভিজ্ঞ জনশক্তি প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। বরং চীনাদের সঙ্গে থেকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতাম। ডিজাইন তৈরিতেও অভিজ্ঞ চীনারা। তাই তাদের ওপর আস্থা রাখা যেত। কিন্তু এখন তা আর হচ্ছে না।
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ-সংক্রান্ত চুক্তি না হওয়া ছিল নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে যত দ্রুত আমরা সোনাদিয়ায় একটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে পারব, ততই আমাদের জন্য তা মঙ্গল। কেননা দেরি হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। শুধু তা-ই নয়, এ অঞ্চলের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএসের কর্মকর্তাকে স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে যে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠছে, তার উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থেই এ সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এ বন্দর দিয়েই তাদের পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে সোনাদিয়ায় কোনো গভীর সমুদ্রবন্দর করছে না। করছে পায়রায়, সেখানে একটি ভারতীয় কোম্পানি (আদানি) এ গভীর সমুদ্রবন্দরটি করবে। তার পরও চীন সোনাদিয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ হারায়নি। প্রয়োজনে কোনো ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গেও যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী চীন।
চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে যে আগ্রহী, তার বড় প্রমাণ চীনা প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য বাংলাদেশ ভ্রমণ। নিঃসন্দেহে তার এই সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে। চীন বাংলাদেশে অনেকগুলো সেতু নির্মাণ করে দিয়েছে, যা বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নামে পরিচিত। বাণিজ্যিক সম্পর্ক চীনের দিকে ঝুঁকে পড়লেও আমাদের স্বার্থেই এই সম্পর্ক আরো উন্নত করা প্রয়োজন। এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক চীনের অনুকূলে। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য চীনে রফতানি করে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রায় ১৩ দশমিক ৮ গুণ পণ্য আমদানি করে। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশ রফতানি করেছিল ৪৮ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছিল ৫৯২ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০০১-০২ সময়সীমায় প্রায় ৬১ গুণ বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করতে হয়েছিল (১১ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন-এর বিপরীতে ৭০৮ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন!) ২০১২-১৩ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৮ দশমিক ১২ মিলিয়ন (রফতানি) ও ৬৩২৪ মিলিয়ন (আমদানি)। অন্যদিকে চীনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ তেমন বেশি নয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চীন ঋণ দিয়েছিল ১৮১ মিলিয়ন ডলার, যা ছিল সুদমুক্ত। একই সঙ্গে ৭৫ মিলিয়ন কম সুদে, ৭৬৪ মিলিয়ন সাপ্লায়ার ক্রেডিট ও ৩২ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন অনুদান দিয়েছিল। ২০১৩ সালে চীন তার নিজ দেশে পাঁচ হাজার আইটেমের বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ মূলত ফ্রোজেন ফুড, পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া, তৈরি পোশাক চীনে রফতানি করে। চীনা বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই, তাতে দেখা যায় ২০০৯ সালে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৮৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৩ সালে এসে ১৮৬ জন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৩২০ মিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা খাতের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ব্যবহূত সমরাস্ত্রের শতকরা ৭৫ ভাগের উৎস হচ্ছে চীন। চীন থেকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, আর বিমানবাহিনীর জন্য ফাইটার প্লেন চীন থেকে ক্রয় করা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগেই বাংলাদেশ-চীন সামরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জীবদ্দশায় জিয়াউর রহমান একাধিকবার চীন সফর করেছেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীনের ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের বাংলাদেশ সফর ছিল নিয়মিত। এখন এ প্রবণতা কিছুটা কম। ২০০২ সালে খালেদা জিয়ার সময়সীমায় বাংলাদেশ ও চীন একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।
ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। আর চীন আমাদের নিকট-প্রতিবেশী। আমাদের সীমান্ত থেকে চীনের সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। চীন এই মুহূর্তে এশিয়ায় অর্থনীতিতে এক নম্বরে এবং ভারতের অবস্থান তৃতীয়। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এ দেশ দুটি যে একটি ফ্যাক্টর, তা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ এ দুটি দেশের সঙ্গে একটি ভারসাম্যমূলক নীতি অনুসরণ করে আসছে। যেখানে ‘জাতীয় স্বার্থ’র প্রশ্ন জড়িত, সেখানে বাংলাদেশ একটি পজিটিভ নীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। এক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে সাহায্য করবে।
Daily Bonik Barta
14.10.2016
very nice write up
ReplyDelete