আগামী ১৪ অক্টোবর চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসছেন। এটা কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় বাংলাদেশ সফর। তবে বর্তমান চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে এর আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট চীন স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এর ঠিক ১১ বছর পর প্রথম চীনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন লি সি আননিয়ান। মাঝখানে ৩০ বছর পার হয়ে গেলেও কোনো চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসেননি। এখন শি চিনপিং বাংলাদেশে আসছেন। তবে শি চিনপিং সম্ভবত চীনা নেতাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, যিনি উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা রাখেন। তিনি এর আগে ভারত সফর করে গেছেন। শ্রীলঙ্কায়ও তিনি গিয়েছিলেন। পাকিস্তানেও তিনি গিয়েছিলেন। এখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে আসছেন। তবে তাঁর এবারের সফর শুধু বাংলাদেশের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং ঢাকা থেকে তিনি যাবেন ভারতের গোয়ায়; সেখানে তিনি অষ্টম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন। গোয়ায় ১৫ থেকে ১৬ অক্টোবর ব্রিকসের যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, তাতে ভারত ও চীনের পাশাপাশি ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধানরাও যোগ দেবেন। মজার ব্যাপার, প্রায় একই সময় গোয়ায় বিমসটেক-ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। শেখ হাসিনা এই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন। বিমসটেক বা ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন’ হচ্ছে সাত জাতির সমন্বয়ে গঠিত একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভুটান ও নেপাল এই সংস্থার সদস্য। তবে ভারত ব্রিকস-বিমসটেক যৌথ সম্মেলনে আফগানিস্তান ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রপ্রধানকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ সার্কের সদস্য। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত পাকিস্তানকে এই যৌথ শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানায়নি। অনেকেরই জানার কথা এরই মধ্যে ইসলামাবাদে যে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে আঞ্চলিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে ব্রিকস-বিমসটেক যৌথ শীর্ষ সম্মেলনটি যে গুরুত্ব পাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাদেশে চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সফরের গুরুত্ব অনেক। চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে বাংলাদেশে। ব্যবসায়িক স্বার্থের পাশাপাশি চীনের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থও রয়েছে। চীনা নেতারা বরাবরই চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে গিয়েছিলেন। তখন তিনি শি চিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা যখন বিরোধী দলের নেতা ছিলেন তখনো চীন সরকার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে এবার শি চিনপিংয়ের ঢাকা তথা গোয়া সফরের তাত্পর্য অনেক। বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, চীন কর্তৃক পাকিস্তানকে সমর্থন, ভারতীয় মহাসাগরে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব বৃদ্ধিতে ভারতীয় উদ্বেগ, ভারত-মার্কিন সামরিক সহযোগিতা ও চীনকে ঘিরে ফেলার মার্কিনি উদ্যোগ ইত্যাদি কারণের পরিপ্রেক্ষিতে চীনা প্রেসিডেন্ট ভারতে আসছেন। এমনকি অতি সম্প্রতি চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা ও চীনা সৈন্যদল কর্তৃক ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ কিংবা চীন কর্তৃক ব্রহ্মপুত্রের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া ভারত-চীন সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। একসময় ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে প্রশ্ন ছিল। বলা হচ্ছিল, বিশ্বব্যাপী মার্কিন একক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতেই চীন ও ভারত এবং সেই সঙ্গে রাশিয়া একটি ‘ঐক্য’ গড়ে তুলছে। তবে চীন ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলেও এই দুটি দেশের মাঝে যে এক ধরনের ‘অবিশ্বাসের’ জন্ম হয়েছিল, তা লক্ষ করা যায়। এই ‘অবিশ্বাস’ বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। প্রথমত, চীন কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ২০১৪ সালে চীন সফরের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা স্বাক্ষরিত হয়নি। কারণ ভারত এই সমুদ্রবন্দরকে, যার পরিচালনার ভার থাকার কথা ছিল চীনাদের হাতে (গাওদারের সমুদ্রবন্দর চীনারা পরিচালনা করে), তা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা অভিমত দিয়েছিলেন। একই অভিমত ছিল শ্রীলঙ্কার হামবানতোতায় চীনারা যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছিল, সে ব্যাপারেও। হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতিকে ভারত তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেছিল। সুতরাং সোনাদিয়ায় যদি চীনারা একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করত, তা ভারতের জন্য এক ধরনের নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি করত বলে ভারতের ধারণা। কিন্তু এই গভীর সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতও লাভবান হতে পারত। ভারতীয় সাত বোন রাজ্যগুলোর পণ্য রপ্তানির একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করত। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তির কারণে বন্দরটি শেষ পর্যন্ত নির্মিত হলো না। এখন তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে পায়রাবন্দরে, যেখানে একটি ভারতীয় সংস্থা এটি নির্মাণ করছে। অভিযোগ আছে, ভারতীয় ওই সংস্থার এ ধরনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তার পরও চীন এ প্রজেক্টে ভারতের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এরই মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময় বিষয়টি কোনো পর্যায়ে আলোচনা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের সময় চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এই ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ প্রকল্প বর্তমান চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ‘ব্রেইন চাইল্ড’। এ প্রকল্পের আওতায় ৬১টি রাষ্ট্রকে চীন এক পতাকাতলে নিয়ে আসতে চাইছে। সামুদ্রিক পথকেও চীন সংযুক্ত করতে চাইছে। চীন ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির জন্য ব্যয় বরাদ্দ করেছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার। চীন-পাকিস্তান যে অর্থনৈতিক করিডর তৈরি হচ্ছে, যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ বিলিয়ন ডলার, তা এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। বেলুচিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরটি এই কর্মসূচির অন্তর্গত। এই অর্থনৈতিক করিডর বেলুচিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের পাশ দিয়ে গেছে, যাতে ভারতের আপত্তি রয়েছে। বেলুচিস্তানেরও এ ব্যাপারে অসন্তোষ আছে। এই অর্থনৈতিক করিডর চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়ান প্রদেশের খাসগর শহরের সঙ্গে গাওদার সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করছে। এতে আরব সাগরে চীনের প্রবেশাধিকার সহজ হবে। চীন এই অর্থনৈতিক করিডরে রেলপথ, সড়কপথ ও তেলের পাইপলাইন সংযুক্ত করছে। জ্বালানি তেলের ওপর চীনের নির্ভরশীলতা ও চীনা পণ্য ইউরোপসহ যুক্তরাষ্ট্রে পরিবহনের প্রশ্নে এই করিডর একটি বড় ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে চীনের জন্য। চীন বর্তমানে ৬০০ মাইল দূরে অবস্থিত ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ প্রণালি (যেখান থেকে বিশ্বের ৩৫ শতাংশ জ্বালানি তেল সরবরাহ হয়) ব্যবহার করছে। এই অর্থনৈতিক করিডর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চীন সময় বাঁচাতে পারবে। এতে পণ্যের দামও কমে যাবে। বাংলাদেশ এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি দিয়ে উপকৃত হতে পারে ভবিষ্যতে। এমনকি ভারতও এই কর্মসূচি থেকে উপকৃত হতে পারে বলে অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক (যেমন—শ্যাম শরণ, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব) মন্তব্য করেছেন। ২০১৩ সালে বিসিআইএস (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতি চারটি দেশ তাদের সমর্থন জানিয়েছে। এই বিসিআইএস সহযোগিতা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য এই বিসিআইএস সহযোগিতা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এরই মধ্যে চীন সরকারিভাবে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর যে ম্যাপ প্রকাশ করেছে, তাতে কলকাতা সমুদ্রবন্দরকে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হলেও তাতে বাংলাদেশের কোনো সমুদ্রবন্দরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সুতরাং এ ব্যাপারে বাংলাদেশে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তবে অতি সাম্প্রতিককালে চীন ও ভারতের মধ্যে যে ‘আস্থার’ ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ভারত চীনের এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির সঙ্গে কতটুকু সম্পৃক্ত হবে সেটা একটা প্রশ্ন বটে। আর বাংলাদেশ ভারতকে উপেক্ষা করে এই প্রকল্পে যোগ দিতেও পারবে না। সুতরাং ভারতের অংশগ্রহণটা এই মুহূর্তে জরুরি।
তবে একটি আশার কথা আমাদের শুনিয়েছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সড়ক ও রেল যোগাযোগ হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীরও আগ্রহ ছিল। তবে সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্য সরকারের কোনো নীতিগত অবস্থান কি না তা স্পষ্ট নয়। চীন-ভারত সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সৈয়দ আশরাফের এই ‘পরিকল্পনা’ নিয়ে এগিয়ে যাবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে মূলত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক। ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও চীন একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। বিমানবাহিনী বহুলাংশে চীনা যুদ্ধবিমান সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামও আসে চীন থেকে। ফলে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চীনের ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা আছে, যা ভারতের নীতিনির্ধারকরা খুব ভালো চোখে দেখেন না। সাম্প্রতিককালে অনিশ্চিত এই নির্ভরশীলতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করছে। এতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে। এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক চীনের অনুকূলে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করে ৪৫৮ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। কিন্তু আমদানি করেছিল ছয় হাজার ৩২৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
এই যে বাণিজ্য ঘাটতি, তা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ২০১৩ সালে চীন পাঁচ হাজার বাংলাদেশি পণ্যের চীনে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু তাতেও বাণিজ্য ঘাটতি কমেনি। চীনের বিনিয়োগও বাড়ছে। ২০১৩ সালে ১৮৬ জন চীনা উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছিলেন ৩২০ মিলিয়ন ডলার। প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় ধারণা করা হচ্ছে, ২৫টি প্রজেক্টে চীন ২০ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের কথা ঘোষণা করবে। সুতরাং চীনা প্রেসিডেন্টের এই সফর যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী দেশ। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের মনীষী অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য চীনে গিয়েছিলেন দশম শতাব্দীতে এবং ১০৫৩ সালে তিব্বতের লেখান গ্রামে ৭৩ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তাঁর দেহভস্ম ঢাকায় আনা হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির আলোকে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারে না। বাংলাদেশ এই সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। এখন চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।
Daily Kalerkontho
09.10.2016
বাংলাদেশে চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সফরের গুরুত্ব অনেক। চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে বাংলাদেশে। ব্যবসায়িক স্বার্থের পাশাপাশি চীনের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থও রয়েছে। চীনা নেতারা বরাবরই চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে গিয়েছিলেন। তখন তিনি শি চিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা যখন বিরোধী দলের নেতা ছিলেন তখনো চীন সরকার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে এবার শি চিনপিংয়ের ঢাকা তথা গোয়া সফরের তাত্পর্য অনেক। বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, চীন কর্তৃক পাকিস্তানকে সমর্থন, ভারতীয় মহাসাগরে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব বৃদ্ধিতে ভারতীয় উদ্বেগ, ভারত-মার্কিন সামরিক সহযোগিতা ও চীনকে ঘিরে ফেলার মার্কিনি উদ্যোগ ইত্যাদি কারণের পরিপ্রেক্ষিতে চীনা প্রেসিডেন্ট ভারতে আসছেন। এমনকি অতি সম্প্রতি চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা ও চীনা সৈন্যদল কর্তৃক ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ কিংবা চীন কর্তৃক ব্রহ্মপুত্রের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া ভারত-চীন সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। একসময় ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে প্রশ্ন ছিল। বলা হচ্ছিল, বিশ্বব্যাপী মার্কিন একক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতেই চীন ও ভারত এবং সেই সঙ্গে রাশিয়া একটি ‘ঐক্য’ গড়ে তুলছে। তবে চীন ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলেও এই দুটি দেশের মাঝে যে এক ধরনের ‘অবিশ্বাসের’ জন্ম হয়েছিল, তা লক্ষ করা যায়। এই ‘অবিশ্বাস’ বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। প্রথমত, চীন কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ২০১৪ সালে চীন সফরের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা স্বাক্ষরিত হয়নি। কারণ ভারত এই সমুদ্রবন্দরকে, যার পরিচালনার ভার থাকার কথা ছিল চীনাদের হাতে (গাওদারের সমুদ্রবন্দর চীনারা পরিচালনা করে), তা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা অভিমত দিয়েছিলেন। একই অভিমত ছিল শ্রীলঙ্কার হামবানতোতায় চীনারা যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছিল, সে ব্যাপারেও। হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতিকে ভারত তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেছিল। সুতরাং সোনাদিয়ায় যদি চীনারা একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করত, তা ভারতের জন্য এক ধরনের নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি করত বলে ভারতের ধারণা। কিন্তু এই গভীর সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতও লাভবান হতে পারত। ভারতীয় সাত বোন রাজ্যগুলোর পণ্য রপ্তানির একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করত। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তির কারণে বন্দরটি শেষ পর্যন্ত নির্মিত হলো না। এখন তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে পায়রাবন্দরে, যেখানে একটি ভারতীয় সংস্থা এটি নির্মাণ করছে। অভিযোগ আছে, ভারতীয় ওই সংস্থার এ ধরনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তার পরও চীন এ প্রজেক্টে ভারতের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এরই মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময় বিষয়টি কোনো পর্যায়ে আলোচনা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের সময় চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এই ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ প্রকল্প বর্তমান চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ‘ব্রেইন চাইল্ড’। এ প্রকল্পের আওতায় ৬১টি রাষ্ট্রকে চীন এক পতাকাতলে নিয়ে আসতে চাইছে। সামুদ্রিক পথকেও চীন সংযুক্ত করতে চাইছে। চীন ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির জন্য ব্যয় বরাদ্দ করেছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার। চীন-পাকিস্তান যে অর্থনৈতিক করিডর তৈরি হচ্ছে, যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ বিলিয়ন ডলার, তা এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। বেলুচিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরটি এই কর্মসূচির অন্তর্গত। এই অর্থনৈতিক করিডর বেলুচিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের পাশ দিয়ে গেছে, যাতে ভারতের আপত্তি রয়েছে। বেলুচিস্তানেরও এ ব্যাপারে অসন্তোষ আছে। এই অর্থনৈতিক করিডর চীনের পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়ান প্রদেশের খাসগর শহরের সঙ্গে গাওদার সমুদ্রবন্দরকে সংযুক্ত করছে। এতে আরব সাগরে চীনের প্রবেশাধিকার সহজ হবে। চীন এই অর্থনৈতিক করিডরে রেলপথ, সড়কপথ ও তেলের পাইপলাইন সংযুক্ত করছে। জ্বালানি তেলের ওপর চীনের নির্ভরশীলতা ও চীনা পণ্য ইউরোপসহ যুক্তরাষ্ট্রে পরিবহনের প্রশ্নে এই করিডর একটি বড় ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে চীনের জন্য। চীন বর্তমানে ৬০০ মাইল দূরে অবস্থিত ‘স্ট্রেইট অব হরমুজ’ প্রণালি (যেখান থেকে বিশ্বের ৩৫ শতাংশ জ্বালানি তেল সরবরাহ হয়) ব্যবহার করছে। এই অর্থনৈতিক করিডর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে চীন সময় বাঁচাতে পারবে। এতে পণ্যের দামও কমে যাবে। বাংলাদেশ এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি দিয়ে উপকৃত হতে পারে ভবিষ্যতে। এমনকি ভারতও এই কর্মসূচি থেকে উপকৃত হতে পারে বলে অনেক ভারতীয় বিশ্লেষক (যেমন—শ্যাম শরণ, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব) মন্তব্য করেছেন। ২০১৩ সালে বিসিআইএস (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতি চারটি দেশ তাদের সমর্থন জানিয়েছে। এই বিসিআইএস সহযোগিতা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য এই বিসিআইএস সহযোগিতা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এরই মধ্যে চীন সরকারিভাবে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর যে ম্যাপ প্রকাশ করেছে, তাতে কলকাতা সমুদ্রবন্দরকে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হলেও তাতে বাংলাদেশের কোনো সমুদ্রবন্দরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সুতরাং এ ব্যাপারে বাংলাদেশে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তবে অতি সাম্প্রতিককালে চীন ও ভারতের মধ্যে যে ‘আস্থার’ ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ভারত চীনের এই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির সঙ্গে কতটুকু সম্পৃক্ত হবে সেটা একটা প্রশ্ন বটে। আর বাংলাদেশ ভারতকে উপেক্ষা করে এই প্রকল্পে যোগ দিতেও পারবে না। সুতরাং ভারতের অংশগ্রহণটা এই মুহূর্তে জরুরি।
তবে একটি আশার কথা আমাদের শুনিয়েছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সড়ক ও রেল যোগাযোগ হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীরও আগ্রহ ছিল। তবে সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্য সরকারের কোনো নীতিগত অবস্থান কি না তা স্পষ্ট নয়। চীন-ভারত সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সৈয়দ আশরাফের এই ‘পরিকল্পনা’ নিয়ে এগিয়ে যাবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে মূলত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক। ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও চীন একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। বিমানবাহিনী বহুলাংশে চীনা যুদ্ধবিমান সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামও আসে চীন থেকে। ফলে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চীনের ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা আছে, যা ভারতের নীতিনির্ধারকরা খুব ভালো চোখে দেখেন না। সাম্প্রতিককালে অনিশ্চিত এই নির্ভরশীলতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করছে। এতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে। এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক চীনের অনুকূলে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করে ৪৫৮ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। কিন্তু আমদানি করেছিল ছয় হাজার ৩২৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
এই যে বাণিজ্য ঘাটতি, তা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ২০১৩ সালে চীন পাঁচ হাজার বাংলাদেশি পণ্যের চীনে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু তাতেও বাণিজ্য ঘাটতি কমেনি। চীনের বিনিয়োগও বাড়ছে। ২০১৩ সালে ১৮৬ জন চীনা উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছিলেন ৩২০ মিলিয়ন ডলার। প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় ধারণা করা হচ্ছে, ২৫টি প্রজেক্টে চীন ২০ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের কথা ঘোষণা করবে। সুতরাং চীনা প্রেসিডেন্টের এই সফর যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী দেশ। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের মনীষী অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য চীনে গিয়েছিলেন দশম শতাব্দীতে এবং ১০৫৩ সালে তিব্বতের লেখান গ্রামে ৭৩ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তাঁর দেহভস্ম ঢাকায় আনা হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির আলোকে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারে না। বাংলাদেশ এই সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। এখন চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।
Daily Kalerkontho
09.10.2016
0 comments:
Post a Comment