রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

পদ্মার ইলিশ আর ‘জামদানি কূটনীতি’র কাহিনি

পশ্চিমবঙ্গে পদ্মার ইলিশের একটা বড় চাহিদা রয়েছে, এটা মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি। এই পদ্মার ইলিশ একাধিকবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। আমাদের নেতা-নেত্রীরা যখনই দিল্লি গেছেন, সঙ্গে গেছে পদ্মার ইলিশ। সেই সঙ্গে মিষ্টি, দইও গেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়। আবার চালু হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজে পদ্মার ইলিশের ভক্ত। তিনি তো একাধিকবার দাবি করেছেন, ইলিশ রপ্তানি বাড়ানো হোক। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে ঢাকা শহরে পদ্মার ইলিশ পাওয়াই এখন দায়। ইলিশ চলে যায় চোরাইপথে। সেই ইলিশ আবার আলোচনায় এল ভারতের নয়াপররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের প্রাক্কালে। ঢাকায় আসার আগে সুষমা ফোন করেছিলেন ‘তার মমতাদি’কে। পরিচয়টা অনেক পুরনো। বয়সে মমতা ছোট হলেও এক সময় দুজনই এনডিএ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। এখন দুজনার পথ দুদিকে। তাতে কী? মোদি সরকারের এখন প্রয়োজন মমতাকে। বাংলাদেশ বলে কথা। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে হলে মমতা একটা ফ্যাক্টর। তিস্তার পানি বণ্টন, বাংলাদেশের যা এক নম্বর এজেন্ডা, তাতে আবার মমতা ব্যানার্জির আপত্তি। সুষমার ফোনটা তাই জরুরি ছিল। সুষমা মমতার মনোভাব জানেন। উদ্দেশ্য হয়তো ছিল তিস্তা নিয়ে কথা বলবেন। মমতা সেই সুযোগ দিলেন না। বললেন, ঢাকায় যেন সুষমা পদ্মার ইলিশ চেখে আসেন! সংবাদটা আমাদের দিয়েছিল আনন্দবাজারই। এরপর সুষমা স্বরাজ ঢাকা এলেন। ৪০ ঘণ্টা থাকলেন। সরকারি দাওয়াতে ইলিশ অবশ্যই ছিল। কিন্তু মমতার মতো মাছে-ভাতে বাঙালি নন সুষমা স্বরাজ। হরিয়ানায় তার জন্ম। মাছভক্ত নন খুব স্বাভাবিক কারণেই। সেই ইলিশ মাছ তিনি চেখে দেখেছেন কি না বলতে পারব না। কোনও সংবাদপত্র অবশ্য আমাদের এ তথ্যটি দেয়নি। কিন্তু সব সময়ে শাড়িপরুয়া সুষমা স্বরাজের ভাগ্যে জুটেছে ৭টি জামদানি। এর পাঁচটি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং, আর দুটি দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। আমাদের নারী নেতৃত্ব তো তিনজন। ভাগ্য খারাপ এরশাদের। তিনি এখন সাইডলাইনে। নেতৃত্ব ‘হাইজ্যাক’ হয়ে গেছে। মূল নেতা এখন রওশন। তিনি এখন সংসদে বিরোধী দলনেত্রী! সংবাদপত্রগুলো অবশ্য আমাদের জানায়নি, রওশন কী দিয়েছেন সুষমাকে। কিছু একটা তো দিয়েছেনই! ভারতের এক সংবাদপত্র আবার লিখল ‘জামদানি কূটনীতি’। এখন প্রশ্ন একটাই- এই জামদানি কূটনীতিতে আমরা কী পেলাম? বাংলাদেশিরা অতিথিকে সম্মান দিতে জানে। যখনই কোনও অতিথি এসেছেন, তাকে উপহার সামগ্রী দিতে আমরা কার্পণ্য করিনি। আর ভারত বলে কথা! সুষমা স্বরাজ তো ক্যাবিনেটের দুই অথবা তিন নম্বর ব্যক্তি। তাকে বাংলাদেশ অস্বীকার করে কীভাবে? কিন্তু সুষমা স্বরাজের সফরে ফলটা কী? আমরা কী পেলাম? ভারতই বা কী পেল? অনেকগুলো সিদ্ধান্তে আমরা আসতে পারি এই সফরের পর। এক. ভারতে সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ যে তাদের বৈদেশিক নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে, তা কার্যত ভারত স্বীকার করে নিল। দুই. ভারত ‘জি টু জি’ সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। অর্থাৎ ‘সরকার টু সরকার’ সম্পর্ক। কোনও বিশেষ দলকে তারা সমর্থন করবে না। তবে ভারতের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি ‘বিশেষ সম্পর্ক’ স্থাপন করেছিল ভারতীয় কংগ্রেস। এ ক্ষেত্রে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অতীতে কংগ্রেস-আওয়ামী লীগ সম্পর্ক থেকে কোনও পার্থক্য থাকবে না। তিন. বিজেপি দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে তাদের বৈদেশিক নীতিতে অন্যতম এজেন্ডাভুক্ত করেছে। ভুটান সফরের পর প্রকাশিত যৌথ ইশতেহার পর্যালোচনা করলে এই নিরাপত্তার বিষয়টি বোঝা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্কের প্রশ্নে এই নিরাপত্তা ইস্যুটি প্রাধান্য পাবে। বিশেষ করে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অংশগ্রহণ ও ব্যবস্থাপনায় চীনের ভূমিকা ভারতের নিরাপত্তাকে বিঘœ করবে কি না, এটা ভারত নিশ্চিত হতে চায়। চার. এক মাস যে সরকারের বয়স, সেই সরকার হুট করে কোনও চুক্তি করতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারকে বোঝার প্রয়োজন রয়েছে তাদের। সুষমা স্বরাজ সে কাজটিই করেছেন। পাঁচ. তার সফরে কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ব্যাপারে কোনও কমিটমেন্ট পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে আশ্বাস। এ ধরনের আশ্বাস আমরা অতীতেও পেয়েছি। ছয়. ঢাকা-শিলং-গৌহাটি বাস চালুর সিদ্ধান্ত, মৈত্রী এক্সপ্রেসের ট্রেন সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন ৪টি বর্ডার হাট চালু কিংবা ৬৫ বছরের বেশি ও ১৩ বছরের কম বয়সীদের ৫ বছরের মাল্টিপল ভিসা ইস্যুর যে নীতিগত সিদ্ধান্ত, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ খুব বেশি রক্ষিত হয়নি। সাত. তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে কোনও ‘কমিটমেন্ট’ নেই। সীমান্তহত্যা বন্ধে কোনও পদক্ষেপ নেই। অন অ্যারাইভাল ভিসা প্যাকেজ ঘোষিত হয়নি। অশুল্ক বাণিজ্য বাধা অপসারণে কিছু হয়নি। ভারতে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল প্রচারে কোনও উদ্যোগের কথা বলে যাননি সুষমা। এগুলো সবই বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল। আট. খালেদা-সুষমা বৈঠকের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল মোদি সরকার খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর বলে মনে করে। এমনকী খালেদা জিয়া স্বপ্রণোদিত হয়ে যে সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করার মধ্য দিয়ে ভারত যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর তা বিএনপি স্বীকার করে নিয়েছে। নয়. যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, প্রতিটি দেশ বাংলাদেশে ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচনের কথা বলেছে, সেখানে সুষমা স্বরাজ এ ধরনের কোনও কথা বলেননি। বরং বলা হয়েছে, ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান জনগণকেই করতে হবে।’ এতে করে সরকারের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থনই প্রকাশ পায়। দশ. ‘দেশে কোনও গণতন্ত্র নেই’- বেগম খালেদা জিয়ার এ ধরনের উক্তির একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এ রকম- বিএনপি চায় ভারত বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুক! সরকারি দলের পক্ষ থেকে এ রকম একটি অভিযোগই উঠেছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি দৈন্য। আমরা আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারি না। আমাদের দারস্থ হতে হয় বিদেশিদের কাছে। এবারই যে এ রকমটি হল তা নয়। এর আগেও হয়েছে। এগারো. সুষমার এই সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনার নয়াদিল্লি সফর নিশ্চিত হল। এটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বার. সুষমার এই সফর বাংলাদেশের স্থিতিশীল রাজনীতির জন্য কোনও মেসেজ নেই। বেগম জিয়া ইতোমধ্যে কোরবানির পর-পরই আন্দোলনের কথা বলেছেন। ফলে বছর না ঘুরতেই হয়তো আমরা আবারও ‘হরতালের রাজনীতি’ প্রত্যক্ষ করব।এক কথায় সুষমা স্বরাজের এই সফরের মধ্য দিয়ে বড় কিছু অর্জিত হয়নি। আগামী ৫ বছর বিজেপি ক্ষমতায় থাকবে। অর্থাৎ ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই সময়সীমায় তিস্তা চুক্তি হবে কিংবা সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধন হবে, এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। তিস্তার পানি-বণ্টন পশ্চিমবঙ্গে একটি রাজনৈতিক ইস্যু। মমতা ব্যানার্জি এটা হাতছাড়া করতে চাইবেন না। কেননা ২০১৬ সালে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। নির্বাচনে পানি বিষয়টি তিনি দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করবেন। আর সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে আসাম বিজেপি। সুতরাং বিজেপির পক্ষে এটি রাজ্যসভায় পাস করিয়ে আইনে পরিণত করা সহজ হবে না। একই সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো কিংবা সীমান্তহত্যা বন্ধের বিষয়টি একান্তই মানসিকতার ব্যাপার। ভারতের ব্যুরোক্রেসি বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। ফলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ (সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং) সীমান্তে হত্যাকা- হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেও হত্যাকা- হচ্ছে। কাজ হচ্ছে না। তবে একটা কথা এখানে বলা দরকার। সুষমা স্বরাজকে যে সম্মান বাংলাদেশ দিয়েছে, তাতে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে আরও ইতিবাচক হওয়া। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ত্রিপুরায় ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছে। কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ হয়ে আগরতলা যাবে এই খাদ্যশস্য। এর জন্য রাস্তাঘাট ও ব্রিজও বাংলাদেশ তৈরি করে দেবে। বাংলাদেশের এই ‘উদ্যোগ’-এর প্রতিদান হিসেবে ভারত আমাদের কী দেবে, সেটাই দেখার বিষয় এখন। বাংলাদেশ শুধু দেবে, আর ভারত তার স্বার্থে বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে, এই মানসিকতায় ভারতের নেতৃবৃন্দ যদি পরিবর্তন না আনেন, তাহলে দুদেশের সম্পর্ক উন্নত হবে না। সুষমা স্বরাজ চলে গেছেন। কিন্তু জয় করে যেতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। Daily Amader Somoy 01.07.14

চ্যানেল আই টকশো....

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক ও সুষমা সরাজের সফর প্রসঙ্গ....



ইতিবাচক কিছু ঘটবে কি?

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় আসছেন আজ। এককভাবে এটা তার প্রথম বিদেশ সফর। এর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তিনি ভুটানে গিয়েছিলেন। যে প্রশ্নটি এখন অনেকের মনেই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, সুষমা স্বরাজের এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিদ্যমান জটিলতা কতটুকু কাটবে? আমরা, বাংলাদেশের আমজনতা তার এই সফরের মধ্য দিয়ে কতটুকু আশাবাদী হতে পারি? এখানে কতগুলো বিষয় আমাদের বিবেচনায় নেয়া উচিত। এক. সুষমা স্বরাজের সঙ্গে আমাদের জাতীয় নেতাদের একটি ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। আমাদের জাতীয় নেতাদের তিনি চেনেন, জানেন এবং তাদের রাজনীতি সম্পর্কে তিনি ভালো ধারণা রাখেন। কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই, ব্যক্তিগত সখ্য বা পরিচয় সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে কোনো বড় ভূমিকা পালন করে না। দুই. জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতীয় নেতাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রশ্নে সাবেক ইউপিএ সরকারের প্রণীত নীতি থেকে মোদি সরকার ইউটার্ন নেবে- যারা এই মনোভাব পোষণ করেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তিন. সুষমা স্বরাজের এই সফর মূলত একটি রুটিন ওয়ার্ক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মনোভাব জানার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এটাও বিবেচনায় নিতে হবে যে, মোদি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। যে কারণে আমরা দেখি মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। মোদি নিজে ভুটান প্রথম সফর করে এই মেসেজটাই দিলেন যে, তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে চান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সম্পর্কের ভিত্তি কী? শুধু ভারতের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা? নাকি দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়ন? তাই খুব সঙ্গত কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় আগামী দিনে ভারতের ভূমিকা কী হবে, সে ব্যাপারে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের আগেই কোনো কোনো সংবাদ বাংলাদেশে যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে আসাম থেকে তথাকথিত বাংলাদেশীদের খেদাও অভিযান শুরু করেছেন। বিষয়টি আমাদের জন্য উদ্বেগের। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল ভারতের ডেকান হেরাল্ড পত্রিকায়। বাংলাদেশের একটি টেবলয়েড পত্রিকাও সংবাদটি ছেপেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ভারত সরকারের একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় আগামী কিছুদিনের মধ্যে অবৈধ বাংলাদেশীদের আসাম ছাড়তে আলটিমেটাম দিয়েছে আসামের রাজ্য বিজেপি। যদিও কেন্দ্রে মোদি সরকারের এতে সমর্থন রয়েছে কি-না তা স্পষ্ট নয়। ভারতের কেন্দ্রীয় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী সর্বানন্দ সান্যাল ডেকান হেরাল্ডকে বলেছেন, আসাম থেকে অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়নে নতুন করে আরও ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল বসবে। তিনি ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরন রিজুর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। সর্বানন্দ সান্যাল নিজে আসাম বিজেপির সভাপতি আর কিরণ রিজু অরুণাচল প্রদেশ থেকে নির্বাচিত লোকসভার সদস্য ও বিজেপির ন্যাশনাল সেক্রেটারি। সুষমার ঢাকা সফরের আগে এ ধরনের সংবাদ যখন প্রকাশিত হয়, তখন দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি! আসাম রাজ্য বিজেপির এ হুমকিটি এসেছিল নয়াদিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার গঠন করার এক সপ্তাহের মধ্যে। অথচ মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী। মোদির সঙ্গে তিনি দেখাও করেছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি এমন আশাবাদও ব্যক্তি করেছিলেন যে, মোদির শাসনামলে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। কিন্তু এখন বিজেপি সরকার যদি সত্যি সত্যিই বাংলাদেশী খেদাও অভিযান শুরু করে, তাহলে তা দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে বাধ্য। শপথ গ্রহণ করার আগেই মোদি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবকে ডেকে (২০ মে) তথাকথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে পৃথক একটি দফতর গঠন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখন মোদির সেই নির্দেশ আসাম বিজেপি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে কি-না সেটাই দেখার বিষয়। নির্বাচনের আগেও মোদি এ ধরনের কথাবার্তা বলেছিলেন। এ নিয়ে খোদ পশ্চিমবঙ্গে বড় বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। বাংলায় কথা বললেই যে তিনি বাংলাদেশী হবেন, তেমনটি নয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বাংলাভাষী রাজ্য। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, আসাম, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা ও ঝাড়খণ্ডের একটা অংশের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের সময় দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এ প্রশ্নে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থান নেয়া উচিত। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আটকে আছে। তিস্তার পানি চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে বিজেপির অবস্থান আমরা মোটামুটি জানি। চূড়ান্ত বিচারে নরেন্দ্র মোদিকে যদি মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে বিভিন্ন জাতীয় প্রশ্নে কোনো কমপ্রোমাইজ করতে হয়, তাহলে মোদি মমতার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না। এতে করে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি চলে যাবে ডিপ ফ্রিজে। আন্তঃনদী সংযোগের কথাও তিনি বলেছেন। মনে রাখতে হবে, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন। তিস্তা একটা ইস্যু সেখানে। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারেও বিজেপির প্রচণ্ড আপত্তি রয়েছে। বিজেপির বিরোধিতার কারণেই কংগ্রেস সরকারের আমলে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। চুক্তিটি ভারতীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছিল। একটি বিল লোকসভায় উপস্থাপিতও হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির আপত্তির কারণে এ নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। এখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে, এটা আমার মনে হয় না। এর বাইরে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ট্রানজিট প্রশ্নেœ দুদেশের মাঝে আস্থার যে ঘাটতি রয়েছে, সে ব্যাপারে নতুন সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব মার্চের শেষদিকে নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নির্বাচনের আগে আমাদের পররাষ্ট্র সচিব যখন নয়াদিল্লি যান, তখন বুঝতে হবে বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি যাচাই করছে। স্পষ্টতই তিনি কোনো সুখবর নিয়ে আসতে পারেননি। এটা মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি, কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ বেশ কিছু চুক্তি করেছিল। ভারত গেল পাঁচ বছর বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সে অর্থে তেমন সুবিধা পায়নি। এখন নয়াদিল্লিতে সদ্য গঠিত মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা দেখার বিষয়। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট করেই বলা যায়, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের নীতির পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালনে করিডোর পেতে যাচ্ছে ভারত। অরুণাচল থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে বিহারে। একই সঙ্গে চলতি বছরেই বহুল বিতর্কিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে ভারত। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং নয়াদিল্লিতে মোদি সরকার এসব প্রকল্প বাতিল করবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ এখন তার স্বার্থ আদায়ে কতটুকু উদ্যোগ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। চূড়ান্ত বিচারে মোদি ক্ষমতা পেয়েছেন। অনেক কিছুই তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। কারণ সরকার পরিচালনা করতে হলে তাকে আঞ্চলিক দলগুলোর সহযোগিতা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলো এক ধরনের চেকস ব্যান্ড ব্যালেন্স হিসেবে কাজ করবে। ক্ষমতায় আসার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক কথা বলতে হয়। বিজেপিও বলেছে। ভারত একটি বিশ্বশক্তি হতে চলেছে। ২০৩০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবস্থান হবে দ্বিতীয়। ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে চায়। ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিশ্বে একটি মডেল। কিন্তু প্রতিবেশীর ব্যাপারে ভারতের যে মনোভাব, যাকে অনেকে সম্প্রসারণবাদী নীতি বলে মনে করেন, সেই নীতিতে যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে বহির্বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। এখানে সুষমা স্বরাজের একটি বক্তব্য আমরা উল্লেখ করতে পারি। ভুটানে মোদির সফরসঙ্গী হওয়ার সময় সাংবাদিকদের (যাদের কেউ কেউ বাংলাদেশী পত্রিকাগুলোর প্রতিনিধি) বলেছেন, মোদি সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত স্থল সীমান্ত ও তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান করবে। একই সঙ্গে নতুন একটি প্রস্তাবের কথাও তিনি বলেছেন- সেটা হচ্ছে তেঁতুলিয়া করিডোর। উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে ভারত এই করিডোর চাইবে। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে চার কিলোমিটার তেঁতুলিয়া করিডোর ভারত অনুমতি পেলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার কমে যাবে। গত ১৮ জুন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রভাবশালী পত্রিকা দৈনিক যুগশঙ্খ এ খবরটি দিয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মনোভাব জানা যায়নি। আসলে ভারত একের পর এক সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। এর আগে প্রথমে আমরা ত্রিপুরায় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতকে ট্রানজিট (করিডোর) দিয়েছিলাম। এটা করতে গিয়ে আমরা নদীতে বাঁধ পর্যন্ত দিয়েছিলাম। যেখানে সারা বিশ্বে নদীর প্রবাহকে সংরক্ষণ করা হয়, সেখানে ২৪ চাকার ভারতীয় হেভি ট্রাকগুলো পার করার সুবিধার্থে আমরা নদীতে বাঁধ দিয়েছিলাম। এরপর অনেকটা একই প্রক্রিয়ায় ত্রিপুরায় খাদ্যশস্য পরিবহনের অনুমতি আমরা দিয়েছি। কিন্তু ট্রানজিটের জন্য কোনো ফি নির্ধারিত হয়নি। বিদ্যুতের জন্য করিডোর দিতেও আমরা সম্মত হয়েছি। কিন্তু আমাদের প্রাপ্তির খাতা শূন্য। আমাদের অনেক ন্যায্য দাবিও পূরণ করা হয়নি। আমরা অতীতেও দেখেছি, আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া ভারত বাংলাদেশকে এতটুকু ছাড় দেয়নি। অনেকের স্মরণ থাকার কথা- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারত একতরফাভাবে ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ফলে বাংলাদেশ বাধ্য হয় ফারাক্কা প্রসঙ্গ আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরতে। ১৯৭৬ সালে ইস্তাম্বুলে ইসলামী দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে প্রসঙ্গটি বাংলাদেশ উত্থাপন করায় সদস্য দেশগুলো তা সমর্থন করে। একই বছরের আগস্টে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে বাংলাদেশ ফারাক্কা প্রসঙ্গ আবারও উত্থাপন করে। পরে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ৩১তম অধিবেশনে প্রসঙ্গটি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেনেগাল, অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলংকার অনুরোধে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক কমিটি বাংলাদেশ ও ভারতকে অনুরোধ করে বিষয়টি নিজেরাই মীমাংসা করে ফেলার জন্য। পরে সিরিয়া, মিসর, শ্রীলংকা, আলজেরিয়া ও গায়ানার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও ভারত ফারাক্কা প্রশ্নে জরুরি আলোচনার জন্য ঢাকায় একটি বৈঠকে বসতে রাজি হয়েছিল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এক বিবৃতিতে ওই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে ঢাকায় ফারাক্কায় পানি বণ্টন সংক্রান্ত প্রথম চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীকালে ফারাক্কা প্রশ্নে আরও দুটো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তাতে করে পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি। কারণ ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহের গড় ধরে পানির হিস্যা নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু ফারাক্কায় পানির প্রবাহ বাড়েনি। চুক্তি অনুযায়ী যতটুকু পানি পাওয়ার কথা, তাও আমরা পাচ্ছি না। ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, পানি না থাকার কারণে শুকিয়ে গেছে পদ্মাসহ এর ৪টি শাখা নদী। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর। বেকার হয়ে পড়েছেন নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। এছাড়া পানিতে লবণাক্ততার আশংকায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে খনন করা হচ্ছে গড়াই নদী। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী পদ্মা নদীর শাখা নদী হিসেবে গড়াই, হিসনা, কালীগঙ্গা ও মাথাভাঙ্গা নদী প্রায় পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে (যায়যায়দিন, ১৪ এপ্রিল ২০১৪)। আজ তিস্তার ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রসঙ্গ আবারও উত্থাপন করেছেন মোদি। নির্বাচন প্রচারণায় তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, আন্তঃনদী সংযোগের কারণে গুজরাট খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষ যে একটা শংকার মধ্যে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন সুষমা স্বরাজের ঢাকা আগমনের মধ্য দিয়ে এ শংকা কতটুকু দূর হবে বলা মুশকিল। ধারণা করছি, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের পথ প্রশস্ত হবে। বাংলাদেশ এটাই চাইছে। চলতি বছর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করতে পারেন। ভারতীয় নেতারা আমাদের বারবার আশার বাণী শোনাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যাগুলো ঝুলে থাকছে। সমাধান হচ্ছে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি শক্ত অবস্থানে যেতে না পারে, তাহলে সেটা আমাদের দুর্বলতারই লক্ষণ হবে। বিগত ইউপিএ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো সুষমা স্বরাজও বলেছেন, শিগগিরই সীমান্ত ও তিস্তা সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এতে আশ্বস্ত হবে না। বাংলাদেশের মানুষ দেখতে চায় বাস্তব সমাধান। সুতরাং সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে আমি তেমন কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। ভারতীয় নেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না। Daily Jugantor 25.06.14

কালশীর ঘটনা ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

ঢাকার মিরপুরের কালশীর বিহারি ক্যাম্পের ৯ জন মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? ওই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলো না, তখন এ ধরনের প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে কালশীর ঘটনা কি সত্যিই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল? স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তো এমন একটি আভাসই দিয়েছিলেন যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা! আগুনে পুড়ে নারী-শিশুসহ ৯ জন মানুষ মারা গেল। আর পুলিশের গুলিতে মারা গেল একজন। কোনো সভ্য সমাজে একসঙ্গে এতগুলো মানুষ মারা গেলে কি তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়! যাঁরা রাজনীতি করেন, সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিয়ে যাঁদের কাজ করার কথা, তাঁরা যখন 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' হিসেবে হত্যাকাণ্ডকে চালিয়ে দিতে চান, তখন আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। কালশী কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যেমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের অপহরণোত্তর সাত খুনের ঘটনা কিংবা ২০ মে ফেনী শহরে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এগুলো সবই মূলত একসূত্রে গাঁথা। আমাদের নষ্ট রাজনীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। আর এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সুশাসনের অভাব প্রচণ্ডভাবে অনুভূত হচ্ছে দেশে। যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা সুশাসনের এই অভাবটি অনুভব করেন কি না জানি না, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে এবং প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়ভাবে সরকারদলীয় কর্তাব্যক্তিরা। আর প্রশাসন পালন করছে নির্লিপ্ত ভূমিকা। দেশে সুস্থ গণতন্ত্রচর্চা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আমাদের কোনো আশার বাণী শোনায় না। কালশীর ঘটনা ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের সংবিধানে দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার স্বীকৃত। সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।' এখন যে ঘটনা কালশীতে ঘটল, যেখানে শিশু ও নারীকে পুড়িয়ে মারা হলো, সেখানে সংবিধান বর্ণিত মানবসত্তার মর্যাদা থাকল কোথায়! বিহারিরা উর্দুভাষী। কিন্তু আমাদের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সংগঠনের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তাতে করে উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতেই পারে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৩ বছর পরও উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মূলধারায় আসেনি। এখানে ব্যর্থতা কার, সে প্রশ্ন খুব সহজেই উঠতে পারে। বিহারিরা নিজেদের এখনো পাকিস্তানি মনে করে এবং পাকিস্তানে যেতে চায়। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় যেসব সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে পুনর্বাসন। অতীতে বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা হলেও অগ্রগতি হয়েছে কম। মাত্র একটি ব্যাচ পাকিস্তানে ফিরে গেছে। গত ১০ বছরে এ নিয়ে তেমন আলোচনার খবর আমাদের জানা নেই। একসময় নওয়াজ শরিফ তাদের পাকিস্তানে নিয়ে যেতে রাজি হলেও প্রচণ্ড আপত্তি ছিল বেনজির ভুট্টোর। বেনজির তাদের পাকিস্তানি না বলে বিহারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন তারা বাংলাদেশের নাগরিক! আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে প্রায় পাঁচ-ছয় লাখ পাকিস্তানি নাগরিককে (সরকারিভাবে এ সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার) আমরা পাকিস্তানে যেতে অথবা পাকিস্তানকে গ্রহণ করতে 'বাধ্য' করতে পারিনি। এসব পাকিস্তানি নাগরিক বিভিন্ন ক্যাম্পে (ঢাকা ও সৈয়দপুর) মানবেতর জীবন যাপন করে। শিক্ষা-দীক্ষাহীন এসব নাগরিকের কেউ কেউ সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। এখন কালশীর যে এলাকায় তারা থাকে ও যেটা তাদের স্থায়ী ঠিকানা, এটা তাদের অপরাধ হতে পারে না। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এদের অনেকেই জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। নিজস্ব জমি থেকে তাদের উচ্ছেদের একটা ষড়যন্ত্রের কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আর এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বিহারিরা প্রকাশ্যেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। সত্য-মিথ্যা আমরা জানি না। যে তদন্ত হচ্ছে, তাতে প্রকৃত সত্য আদৌ বেরিয়ে আসবে কি না, আমার মতো অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে তাতে। তবে এই সংসদ সদস্য সম্পর্কে কালের কণ্ঠ আমাদের যে তথ্য দিয়েছে (১৮ জুন), তাতে করে তাঁর বিহারিদের ওই জমির ওপর লোলুপ দৃষ্টি থাকা অমূলক নয়। এই ব্যক্তি, যিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন তাঁর এসব অপকর্ম ঢাকতে। আমাদের দুঃখ এখানেই যে এসব 'ভূমিখোরকে' আমরা রাজনীতিতে সক্রিয় রেখেছি। দলের ছত্রচ্ছায়ায় ও প্রভাবে তাঁরা নিজেদের পরিণত করেছেন এক-একজন 'ফ্রাংকেনস্টাইন দানবে'। একজন ব্যক্তি কী করে মিরপুরের গৃহায়ণের দুয়ারীপাড়ার ৪৭৪টি প্লট, চিড়িয়াখানার ৩০০ কোটি টাকার সম্পত্তি, এমডিসি মডেল স্কুল, তুরাগ নদ কিংবা দুয়ারীপাড়ার জলাশয়ের জমি দখল করেন (কালের কণ্ঠ, ওই), ভাবতেই অবাক হতে হয়। তাঁর ক্ষমতার উৎস কোথায়? এই নষ্ট রাজনীতিই তাঁকে আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। একজন ইলিয়াস মোল্লা, নিজাম হাজারীর উত্থান তাই একই সূত্রে গাঁথা। তাঁরা রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন তাঁদের সব অপকর্মের একটা সিঁড়ি হিসেবে। আর রাজনীতির কারণেই হয়তো দেখা যাবে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও সবাই পার পেয়ে যাবেন! এই নষ্ট রাজনীতি আমাদের দেশে ত্যাগী রাজনীতিবিদদের জন্ম দিতে পারেনি। একুশ শতক-উপযোগী যে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ আমাদের দরকার, সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি আমাদের তা উপহার দিতে পারছে না। রাজনীতি বেশি মাত্রায় পেশি ও সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে যাচ্ছে! নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত নূর হোসেন কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। যাঁরা 'ষড়যন্ত্র তত্ত্বে' বিশ্বাস করেন, তাঁরা নূর হোসেনের গ্রেপ্তারের একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে পারেন। তিনি জেনেশুনেই কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। যাতে করে তাঁকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো সহজ না হয়। এটা সত্য, তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া জটিল। এর সঙ্গে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া জড়িত। ভারতীয় আইনে তাঁর বিচার হবে। শাস্তি হবে। তিনি সেখানে শাস্তি ভোগ করবেন। তারপর ফেরত পাঠানোর প্রশ্ন। তাই সাত খুনের বিচার হবে, খুনিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে- এটা আমরা আশা করতেই পারি। কিন্তু বাস্তবতা বড্ড কঠিন! আমার দুঃখবোধ ফেনীর ফুলগাজীর প্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হকের জন্য। তাঁর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত নিজাম হাজারী এখন সৌদি আরবে। আর কালশী হত্যাকাণ্ডে যাঁর দিকে আঙুল নির্দেশ করা হয়েছে, সেই ইলিয়াস মোল্লাও যদি এখন ধর্মীয় অথবা ব্যবসায়িক কারণে বিদেশ যান, আমি অবাক হব না। কালশী হত্যাকাণ্ড আমাদের আস্থার জায়গায় একটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধিরা নানা বিতর্কে নিজেদের জড়িত করে একটা বড় ধরনের আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছেন। এর বিচার যদি না হয়, তাহলে 'আরেকটা কালশী'র জন্ম হবে। আরো একটা হত্যাযজ্ঞ হবে, যা আমরা রোধ করতে পারব না! কালশী হত্যাকাণ্ড আমাদের বেশ কিছু আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। এক. বিহারিরা বাংলাদেশে থাকলেও এরা পাকিস্তানি নাগরিক। ফলে পাকিস্তানের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হতে পারে! এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশবিরোধী একটি প্রপাগান্ডায় নামতে পারে। তাতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। দুই. বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও সেখানকার মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেক দিন থেকেই সোচ্চার। এখন কালশীর হত্যাকাণ্ডকে তারা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসে বিষয়টি যদি বাংলাদেশবিরোধী শক্তিগুলো উত্থাপনের চেষ্টা করে, আমি তাতে অবাক হব না। তিন. যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশের যে সাহায্য পাওয়ার কথা, তাতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। চার. কালশী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংসদের যে ভূমিকা পালন করার কথা, সংসদ তা পালন করেনি। ফলে নয়া নির্বাচনের পক্ষে জনমত আরো শক্তিশালী হবে। পাঁচ. সরকারি দলে একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তি থাকায় সরকারি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এখন ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। দলটির জনপ্রিয়তা ইতিমধ্যে অনেক হ্রাস পেয়েছে। দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা যত দ্রুত এ বিষয়টি উপলব্ধি করবেন, ততই দলের জন্য মঙ্গল। কালশী হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। অন্তত একটি ক্ষেত্রে হলেও যেন আমরা বলতে পারি 'আমরা পেরেছি'। শুধু বিহারি বলে, ভিন্ন ভাষায় কথা বলে বিধায়, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার যদি না হয়, তাহলে তা হবে চরম মানবতা লঙ্ঘনের শামিল। আর একজন ব্যক্তি যখন দলকে তাঁর স্বার্থে ব্যবহার করেন, তখন দল এ ক্ষেত্রে উপকৃত হয় না। দলের জন্য তিনি হয়ে যান বোঝা- দলের নীতিনির্ধারকরা দ্রুত যদি এটা বোঝেন, তাতে সবার মঙ্গলই নিহিত। Daily Kaler Kontho 25.06.14

সুষমা স্বরাজের বক্তব্যে কতটুকু আস্থা রাখা যায়

ভারতের নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের প্রাক্কালে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। আগামী ২৫ জুন থেকে তার ঢাকা সফর শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তিনি ভুটানে গিয়েছিলেন। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক আলোচনায় বলেছেন বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা ও সীমান্ত সমস্যার সমাধান করা হবে। যে কোনো বাংলাদেশি এই বক্তব্যে খুশি হবেন, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু বাস্তবতা কী তা বলে? তিস্তা চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে অতীতে কম কথা হয়নি। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি সর্বশেষ বিমসটেক সম্মেলনেও (২০১৪) মনমোহন সিং আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। ভারতের নয়া সরকারই এই সিদ্ধান্তটি নেবে। এর আগে আমাদের সাবেক পানি সম্পদমন্ত্রী একটি কূটনৈতিক তৎপরতার কথা আমাদের শুনিয়েছিলেন। অনেকের স্মরণ থাকার কথা তিস্তায় পানির প্রবাহ ৫০০ কিউসেক নেমে এসেছিল। এর ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। আমরা লক্ষ্য করছি, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের একটা বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, আমরা দর কষাকষিতে শক্তভাবে আমাদের অবস্থান তুলে ধরতে পারি না। অতি সাম্প্রতিককালে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অতিমাত্রায় ভারতকেন্দ্রিক। ভারত আমাদের কোন 'কর্মকা-ে' অসন্তুষ্ট হয়। সে রকম কোনো 'কাজ' আমরা করতে চাই না। এটা যে তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা নয়। বরং দেখা গেছে ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্টের প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমরা কোনো 'শক্ত' অবস্থানে যেতে পারিনি। ভারত আমাদের ভূমি ব্যবহার করছে তথাকথিত 'কানেকটিভিটি'র নামে। কিন্তু কোনো ফি প্রদান করছে না। উপরন্তু নেপাল কিংবা ভুটানও সুবিধা পাচ্ছে না। অতি সম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়েছে ভারত বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করে ভারতের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে (অরুণাচল থেকে বিহার) বিদ্যুৎ নেবে। এক্ষেত্রে ভারত আদৌ কোনো শুল্ক বা ফি দেবে কি-না, এটা স্পষ্ট নয়। তিস্তার ক্ষেত্রেও তাই সরকার খুব প্রতিবাদী নয়। খুব কঠোর অবস্থানেও যায়নি সরকার। শুধু সরকারের কথা কেন বলি? এচই এম এরশাদের জাতীয় পার্টিও তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে কোনো জোরাল অবস্থানে যায়নি। অথচ জাতীয় পার্টির একটা বড় ভোটব্যাংক রয়েছে উত্তরবঙ্গে। এরশাদ নিজে রংপুরের বাসিন্দা। সরকারের অংশীদার জাসদ, কিংবা ওয়ার্কার্স পার্টিরও কোনো ভূমিকা নেই। তবে বাসদ কিংবা সিপিবি তারাও আলাদাভাবে তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে বিএনপির পাশাপাশি লংমার্চ করেছে। তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। যেখানে ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হওয়ার কথা, সেখানে পানির অভাবে চাষাবাদ হয়েছে মাত্র ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। রোদে ওই শস্যও পুড়ে গেছে। পানির অভাবে একদিকে যেমনি খাদ্য উৎপাদনের ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে তেমনি বাড়ছে মরুকরণ প্রবণতা। উত্তরবঙ্গের মানুষ জানে পানির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। ১৯৭২ সালেই তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। মাঝখানে ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে ও ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তিই হয়নি। এই নদীর পানি বণ্টন আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে হতে হবে। মমতার 'পাগালামো'র জন্য পানি বণ্টন বন্ধ থাকতে পারে না। পানি দেয়া, না দেয়ার সঙ্গে তার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশ পানি পাবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। আর পশ্চিমবঙ্গ যদি বাধা দেয়। তার দায়ভার গিয়ে বর্তাবে ভারত সরকারের উপর। এতে করে আন্তর্জাতিক আসরে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। ভারত বিশ্ব সভায় বিশেষ করে জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে চায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর প্রতি তার আচরণ যদি ন্যায়সঙ্গত না হয়। যা জাতিসংঘের আইনে বলা আছে। তাহলে তার নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে। এমনিতেই ভারতের আচরণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকে। এক্ষেত্রে তিস্তার পানি না দিয়ে উজানে পানি প্রত্যাহার করা হলে, তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে ঠেলে দেবে মরুময়তার দিকে। পানির অভাবে যে সঙ্কটের সৃষ্টি হবে। তা বাংলাদেশকে ঠেলে দেবে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন। তাহলে এদেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সঙ্কটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে তিস্তার পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি_ এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুঁড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর গাড়ি বাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্দা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ব্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দু'দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু'দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখন যুক্ত হয়েছে মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরো একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা কিসিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি 'রাজনৈতিক ইস্যু'। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ব্যয়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই যুক্তি ও ব্যয়ের ভিত্তিটি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেতে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জলপ্রবাহ কনভেনশন নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই 'যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার' ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরো আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমি বিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণিসমূহের সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগে-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এসব কিছু করতে পারে না। তা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আমন্ত্রণ করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই। তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায়, বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে থাকল। ভারত কখনই বাংলাদেশের এই নিরাপত্তা ঝুঁকিটি বিবেচনায় নেয়নি। আমরা বার বার লক্ষ্য করেছি ভারত তার স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে বেশি। ত্রিপুরায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করা হয়েছে। এখন ত্রিপুরায় খাদ্য সরবরাহেরও আমরা অনুমতি দিলাম। ভারত 'বিদ্যুৎ কানেকটিভি'র নামে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। অথচ কোনো একটি ক্ষেত্রেও আমাদের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে ভারত নজর দেয়নি। শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর হয়নি। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি ভারত। ফারাক্কায় পানির প্রবাহ কমে গেছে। এ ব্যাপারেও আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেই। টিপাইমুখ ও ফুলেরতল ব্যারাজ নিয়ে একটি ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে মোদি সরকার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পও বাস্তবায়ন করবে। তাই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান হবে। 'কিন্তু তাতে আস্থা রাখি কীভাবে? কেননা পশ্চিমবঙ্গে ২০১৫ সালে পৌরসভার নির্বাচন ও ২০১৬ সালে বিধানসভার নির্বাচন। তিস্তার পানি মমতারও দাবি ভারতের সংবিধানে রাজ্য সরকারকে উপেক্ষা করে কেন্দ্র কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাই সুষমা স্বরাজ যখন তিস্তার পানি বণ্টনের কথা বলেন, তাতে হাজারটা প্রশ্ন এসে যায় বৈকি! এটা কথার কথা। তিনি ঢাকায় আসছেন ভারতের স্বার্থ নিয়ে। ভারত নতুন কয়েকটি 'এজেন্ডা' যুক্ত করেছে আলোচনায়। তারা এখন 'তেতুলিয়া করিডোর' দাবি করছে, যাতে করে উত্তর পূর্বাচলে তাদের পণ্য সরবরাহের দূরত্ব হ্রাস পায়। সোনাদিয়ায় যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হতে যাচ্ছে, তাতে চীনের ভূমিকা তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ্একই সঙ্গে ভারতের একটি ভূমিকা নিশ্চিত করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হয়নি। এখন সুষমা স্বরাজ ঢাকায় আসছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমরা যেন আমাদের স্বার্থকে ভুলে না যাই। আমাদের শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। আমরা যেন সব সময় ভারতের চাপের কাছে নতি শিকার না করি। Daily Jai Jai Din 25.06.14

সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফর ও মোদির পররাষ্ট্রনীতি

ভারতের নয়াপররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ আজ ঢাকা আসছেন। এটা তার দ্বিতীয় বিদেশ সফর। এর ংআগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সফরসঙ্গী হয়ে ভুটানে গিয়েছিলেন তিনি। নরেন্দ্র মোদির ভুটান সফর নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মোদির প্রথম বিদেশ সফর ছিল ভুটান। চীন কিংবা ইইউ’র অন্তর্ভুক্ত কোনও দেশকে বাদ দিয়ে মোদি যখন ভুটানে যান, তখন এই সফরকে হালকাভাবে দেখার কোনও সুযোগ নেই। এই সফরকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে এবং পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে চীন ও বাংলাদেশ এই সফর থেকে একটা মেসেজ পেতে পারে। অতীতে ভারতে কোনও সরকারপ্রধানই ভুটানকে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। ভুটান-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। তবে ভুটানের একটা স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে। আর এটা বিবেচনায় নিয়েই মোদি ভুটানে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ভুটান সফরের পর যেসব সিদ্ধান্তের কথা জানা গেছে, তার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। যেমন- ভুটানে মোদির সফরের পর-পরই ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোগবে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ভুটানে দূতাবাস খুলতে চীনকে অনুমতি দেওয়া হবে না। উল্লেখ্য, ভুটানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সম্প্রতি খুব তোড়জোড় শুরু করেছে চীন। চীনের এই উদ্যোগে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন ভারত। শুধু তাই নয়, সফর শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় স্বার্থে দুদেশ (ভারত ও ভুটান) একে অপরকে সাহায্য করবে।’ মোদির ভুটান সফর ও যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ভুটান ও ভারতের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ একই। ভারতের সীমান্তে চীনের আগ্রাসন আর ভুটানের উত্তরেও চীনের ‘আগ্রাসন’ একই রকমের উদ্বেগের কারণ। চীনের সম্ভাব্য আগ্রাসন রোধে ভারত ও ভুটান একে অপরকে সাহায্য করবে বলেও যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভারতের জি নিউজ আমাদের জানাচ্ছে, চীন সীমান্তে ভারত দ্বিগুণ সেনা মোতায়েন করছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর চীন শক্তি বৃদ্ধি করছে এবং চীনা হামলা বাড়ছে। বলা ভালো, ভারত-চীন সীমান্তে ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশের ৪০টি ঘাঁটি রয়েছে। মোতায়েন রয়েছে ১৫ হাজার সেনা। এখন দ্বিগুণ সেনা মোতায়েনের বিষয়টি এবং ভুটানে চীনা দূতাবাস না খোলার সিদ্ধান্ত ভারত-চীন সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। অথচ বলা হয়েছিল, মোদির জমানায় চীন-ভারত সম্পর্কে উন্নতি হবে। এমনকী মোদির শপথ নেওয়ার পর-পরই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর এই আভাসই দিয়েছিল যে, এই দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে।ভারতের নয়া সরকারের একটা বড় জায়গা হচ্ছে তার বৈদেশিক সম্পর্ক। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে, বিশেষ করে ইউক্রেনের পরিস্থিতির পর নতুন করে যে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হতে যাচ্ছে, তাতে ভারতের অবস্থান মোদি নিশ্চিত করবেন। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও ক্রিমিয়া প্রশ্নে ভারতের অবস্থান ছিল রাশিয়ার পক্ষে। সাবেক ইউপিএ জোট আমলে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত থেকে ভারত সরে আসতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একটা বড় জায়গা হচ্ছে ভারত-চীন সম্পর্ক। ইউপিএ জোট সরকারের সময় এই সম্পর্ক যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। দুদেশের প্রধানমন্ত্রীরা দুদেশের রাজধানী সফর করেছেন। বাণিজ্য হচ্ছে এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি। ২০১১ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন। কিন্তু ২০১৩ সালে এটা কমে এসে দাঁড়ায় ৬৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারে। ভারতের পক্ষে ঘাটতি ৩১ বিলিয়ন ডলার। ভারতের রপ্তানির পরিমাণ কমেছে (১৭ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার। শতকরা হারে কমেছে ০.৪ ভাগ হারে আগের বছরের তুলনায়)। এই ঘাটতি কমানো হবে মোদির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দুটি দেশই অর্থনৈতিক জোট ‘ব্রিকস’-এর সদস্য। ব্রিকস-এ রাশিয়াও আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেই ব্রিকস-এর জন্ম। ব্রিকস আগামীতে অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এবং মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। ফলে মোদির জমানায় চীন-ভারত সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে- এটাই প্রত্যাশিত ছিল। এটা অনেকেই এখন স্বীকার করেন যে, চীনের উন্নয়নের ব্যাপারে মোদির একটা দুর্বলতা আছে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি তিন-তিনবার (২০০৫, ২০১০, ২০১১) চীন সফর করেন এবং গুজরাটে চীনের বিনিয়োগ বাড়ান। কিন্তু সর্বভারতীয় যে ‘মাইন্ড সেটআপ’ তার বাইরে তিনি এখন যেতে পারলেন না। চীনকে ভারত স্ট্র্যাটেজিস্টরা বন্ধু নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। ফলে চীন-ভারত সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেদিকে দৃষ্টি থাকবে এখন পর্যবেক্ষকদের।
তেলেগু দেশম পার্টির সভাপতি (বিজেপি মিত্র) চন্দ্রবাবু নাইডু সম্প্রতি বলেছেন, মোদির নেতৃত্বে ভারত হয়ে উঠবে ‘সুপার পাওয়ার’। মিথ্যা বলেননি নাইডু। মোদির এই ‘ভিশন’ আছে। তিনি ভারতকে বিশ্বশক্তি হিসেবে পরিণত করার উদ্যোগ নেবেন। এ জন্য তিনি চীনকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখবেন। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব কমানোর উদ্যোগ নেবেন। অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি একজন দক্ষ প্রশাসক। তিনি জানেন অর্থনীতিই বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তার কাছে চীনের পর জাপান ও সিঙ্গাপুর মডেল বেশি আকৃষ্ট হয়েছিল। চীনের ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) মডেলে তিনি বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এখন ভারতে এই মডেলের প্রয়োগ তিনি করবেন। নতুন নতুন ইপিজেড এখন তৈরি হবে, যাতে করে কর্মসংস্থান হবে। মোদি জানেন, ভারত ও চীনের যৌথ জাতীয় আয় ২০১৫ সালে জি-৭ এর একত্রিত জাতীয় আয়কে ছাড়িয়ে যাবে (২০১০ সালে ছিল অর্ধেক)। আর ২০৩০ সালে এই যৌথ আয় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের যৌথ আয়কে (একত্রিত) ছাড়িয়ে যাবে। ৪২ জাতিভুক্ত ওসিইডির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতে চীন ও ভারতের অবদান গিয়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ২৮ ও ১১ ভাগ (তখন যুক্তরাষ্ট্রের অবদান থাকবে ১৮ ভাগ, জাপানের ৮ ভাগ)। সুতরাং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে যে তিনি গুরুত্ব দেবেন, এটা এক কথায়ই বলে দেওয়া যায়। চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলেও দক্ষিণ এশিয়া তথা বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় চীনের সামরিক উপস্থিতিকে ভারত খুব হালকাভাবে নেবে না। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার অলিখিত কর্তৃত্ব বজায় রাখবে। নেপালের পর ভুটানে এখন তার কর্তৃত্ব বাড়ল। একটি ‘নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের’ আওতায় এই দেশগুলোকে একত্রিত করতে চায় ভারত। সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের সময়ও এই বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে। ২৫ জুন সুষমা ঢাকায় আসছেন। আগামীকাল ২৬ জুন দুদেশের মধ্যে আলোচনা হবে। আলোচনায় কোন কোন বিষয় স্থান পাবে, সে ব্যাপারে একটা ধারণা পেলেও, মূল বিষয়গুলো এবং নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয়টি ‘গোপন’ই থাকবে। অতি সম্প্রতি ভুটানে সুষমা স্বরাজ বলেছেন, তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে নয়া সরকার উদ্যোগ নেবে। ঢাকায় এ প্রসঙ্গে আলোচনা হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সমাধান কিংবা কোনও চুক্তি হবে বলে মনে হয় না।তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি বহুল আলোচিত। ফারাক্কা নিয়েও পুনঃআলোচনার সময় এসেছে। মোদি ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে তার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। টিপাইমুখ ও ফুলেরতল ব্যারাজ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কোনও একটি ক্ষেত্রেও আমরা পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারিনি। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। সেই আশ্বাস আশ্বাসই থেকে গেছে। বাস্তবতায় আমরা দেখেছি ভিন্ন জিনিস। সুতরাং দিল্লিতে বিজেপি সরকার এই নীতিতে পরিবর্তন আনবে এটা মনে হয় না।নিঃসন্দেহে নির্বাচন-পরবর্তী ভারতীয় সরকারের দিকে দৃষ্টি থাকবে আমাদের। মোদি সরকার গঠন করেছেন। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী হবে? মোদি কি তাদের আস্থায় নিতে পারবেন? ভোল পাল্টে মমতা ব্যানার্জি (পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ প্যাকেজের প্রস্তাব দিয়েছেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং) কিংবা জয়ললিতা যে মোদিকে সমর্থন করবেন না- এটাও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তাই দুদেশের বিশ্লেষকরা যখন বলেন, ‘পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক জোরদার করা যেতে পারে, তিস্তা সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত’, ‘রাজনৈতিক অবিশ্বাস রয়েছে’, ‘নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে ভারতকে’, তখন এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায় এসব বক্তব্য কাগজ-কলমেই থেকে যাবে। ভারতীয় নীতিনির্ধাকরা আমাদের সব সময় আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই। মনমোহন সিংয়ের মতো একজন প্রধানমন্ত্রী যখন কথা দিয়ে যান- ‘কোনও সীমান্ত হত্যা হবে না’, সে কথার প্রতিও সম্মান দেখায়নি ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা চাইলেও (?), ভারতীয় আমলারা বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেন না। তারা বাংলাদেশ থেকে কীভাবে সুবিধা আদায় করে নেওয়া যায়, সেদিকেই দৃষ্টি দেন বেশি। অথচ ভারতীয় উন্নয়ন থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। আমরাও হতে পারি ভারতের উন্নয়নের অংশীদার। কিন্তু ভারতের নীতি-মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের যে তিক্ততা তা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। এটা সত্য, ভারতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দের অনেকের ব্যক্তিগত সখ্য রয়েছে। এই সখ্য সার্বিক উন্নয়নে অতীতে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। অন্যদিকে মোদির সঙ্গে বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দের পরিচয় তেমন একটা নেই। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির নেতৃবৃন্দ অতীতে বিজেপির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটা ‘চ্যানেল ওপেন’ করেছেন- এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে নিঃসন্দেহে বীণা সিক্রি, যিনি কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন, তিনি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। তার এই ভূমিকা কতটুকু ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’, সে প্রশ্ন থাকবেই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোদিকে পাঠানো এক অভিনন্দন বার্তায় জানিয়েছিলেন- ‘বাংলাদেশ হচ্ছ তার (মোদির) দ্বিতীয় বাড়ি।’ এখন মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কতটুকু সম্মান দেন, সেটা দেখার বিষয়। ইতোমধ্যে তথাকথিত অনুপ্রবেকারীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানের উদ্যোগ নিয়েছে মোদি সরকার। তাই দুদেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এটা সত্য, মোদি তার বৈদেশিক নীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এখানে নিরাপত্তা ইস্যুটি যে প্রধান, তা তিনি প্রমাণ করেছেন। এখন দেখার পালা বাংলাদেশিদের তিনি কতটুকু আশ্বস্ত করতে পারেন। সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ আসছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। Daily Amader Somoy 25.06.14

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ও সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর

বহুল আলোচিত প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর সফল হলো, নাকি ব্যর্থ হলো? চীন সফরের ওপর ১৪ জুন ঢাকায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা তার নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরের সময় ৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু বহুল আলোচিত সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। অথচ বাংলাদেশের জন্য এই চুক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুধু বাংলাদেশ বলি কেন, এ অঞ্চলের উন্নয়নে প্রস্তাবিত এই সমুদ্রবন্দরটি একটি বড় অবদান রাখতে পারত। বিশেষ করে নয়া অর্থনৈতিক করিডোর বিসিআইএমের যে ধারণার জন্ম হয়েছে, তাতে করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ব্যাপারে এই গভীর সমুদ্রবন্দর বড় অবদান রাখতে পারত। এখন এ সম্পর্কে কোনো চুক্তি না হওয়ায় বিশাল এক সম্ভাবনার ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিশ্চয়তা এলো। আমার বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়টি অগ্রাধিকার তালিকায় এক নম্বরে ছিল। বাকি যেসব বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর মতো ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। বিশেষ করে একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, চীনের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, জাতীয় আইসিটি নেটওয়ার্কের আওতায় ইউনিয়ন পর্যন্ত সরকারি দফতরকে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, রাজশাহী পানি পরিশোধনাগার প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর ওপর দ্বিতীয় রেল ও সড়ক নির্মাণ ইত্যাদি চুক্তির গুরুত্ব থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর মতো ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। তবে আশার কথা, চীন ও বাংলাদেশ এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। যতটুকু জানা যায়, চীন সরকার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে নমনীয় ঋণ বা প্রিফারেন্সিয়াল বার্য়াস ক্রেডিট না দিয়ে বাণিজ্যিক ঋণ দিতে আগ্রহী। এ কারণে সমঝোতা চুক্তিতে ঋণের ধরন উল্লেখ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে চীন সরকার। বলা ভালো, প্রিফারেন্সিয়াল বার্য়াস ক্রেডিট সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয় ডলারে। অন্যদিকে, নমনীয় ঋণ বা জিসিএলের ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হয় দৈনিক মুদ্রা আরএমপিতে। উভয় ক্ষেত্রে সুদের হার ২ শতাংশ, সেই সঙ্গে দশমিক ০২ শতাংশ হারে ব্যবস্থাপনা ফি দিতে হয়। তুলনামূলক বিচারে বাণিজ্যিক ঋণের সুদের হার বেশি, ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ডিজাইন, নির্মাণ ও বন্দর পরিচালনার ব্যাপারেও দু'পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। বাংলাদেশ বন্দর পরিচালনার ভার অন্য কোনো বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায় না। চীন সরকার এটি পেতে চায়। উল্লেখ্য, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির পাশাপাশি ইউএই, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্ক সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু একটি বাছাই কমিটি চায়না হারবারকে যোগ্য বলে অভিমত দিয়েছিল। চায়না হারবারের প্রস্তাব অনুযায়ী, তিন ধাপে ১০ বছরের মধ্যে এই নির্মাণ সম্পন্ন হবে। ব্যয় হবে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ৩ বছরে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। বড় জাহাজগুলো তখন এখানে নোঙর করতে পারবে (এখন চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট জাহাজে পণ্য আনতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর)। প্রথম পর্যায়ে বন্দরে ২০ লাখ টিইউইউএস (কনটেইনার টার্মিনাল) কনটেইনার ধারণ করতে পারবে। আর সাধারণ কার্গোর (খোলা পণ্য) ধারণক্ষমতা হবে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এখানে এখন অনেকগুলো বিষয় দেখার রয়েছে। এক. বাছাই কমিটির চায়না হারবারকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক। কেননা চীনারা এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে। এ অঞ্চলে অন্তত তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দরের খবর জানা যায়, যা চীনা অর্থে ও চীনা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে। শ্রীলংকায় দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। একটি হামবানতোতায়, অপরটি কলম্বোতে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত হামবানতোতায় ছিল গভীর জঙ্গল। ছোট্ট একট শহর, সেখানে কোনো ভালো হোটেল ছিল না। প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জম্মস্থান এখানে। চীন এখানে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ফলে পুরো হামবানতোতার দৃশ্যপট বদলে গেছে। হামবানতোতা আজ একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা পেয়েছে। নামকরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে এখানে। আগামী ২০১৮ সালে এখানে কমনওয়েলথ গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কলম্বোতে যে বন্দরটি নির্মিত হয়েছে, তাতে বছরে ৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা একটাই এখানে 'মেগা শিপ' অর্থাৎ বড় জাহাজগুলো ভিড়তে পারে এবং পণ্য খালাস করতে পারে। দুই. বন্দর পরিচালনা কার হতে থাকবে_ এটা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। যদি সর্বশেষ কলম্বোর সিআইসিটি অর্থাৎ কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা দেখি, তাহলে দেখতে পাব, শতকরা ৮৫ ভাগ মালিকানা চীনের হাতে। ১৫ ভাগের মালিকানা শ্রীলংকা সরকারের হাতে। যদি পাকিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা বলি, তাহলে শতকরা ১০০ ভাগ মালিকানাই চীনাদের হাতে। এক সময় সিঙ্গাপুরের হাতে দায়িত্ব ছিল এর পরিচালনার। এখন চীনাদের হাতে রয়েছে পরিচালনার ভার। যেখানে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেখানে পরিচালনার ভার থাকলে আপত্তি কোথায়? সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি বিঘি্নত না হয়, তাহলে চীনাদের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার দেওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের বন্দর পরিচালনায় যে অভিজ্ঞ জনশক্তি প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। বরং চীনাদের সঙ্গে থেকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারব। ডিজাইন তৈরিতেও অভিজ্ঞ চীনারা। সুতরাং তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত চুক্তি না হওয়া নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে যত দ্রুত আমরা একটা সমঝোতায় পেঁৗছব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। কেননা দেরি হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএমের কর্মকাণ্ডকে স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে যে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠছে, তার উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থেই এই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই বন্দর দিয়েই তাদের আমদানি-রফতানি পরিচালনা করতে পারবে। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় যে ৫০ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে এই বন্দর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। এমনকি চীনেরও স্বার্থ রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে ইউনান প্রদেশ তাদের অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য এই বন্দরের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে রফতানি করতে পারবে। এতে তাদের অর্থ ও সময় বেঁচে যাবে। কেননা এখন ইউনান সাংহাই বন্দর ব্যবহার করে, কুনমিং থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৮৮০ কিলোমিটার। অথচ কুনমিং থেকে সোনাদিয়ার দূরত্ব বাড়বে মাত্র ৪৮০ কিলোমিটার। কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি মহাসড়ক নির্মাণের ব্যাপারে চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার নীতিগতভাবে রাজি। এ প্রকল্পে কাজও কিছুটা এগিয়েছে। প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়কের নির্মাণকাজ শেষ হলে তা কুনমিংয়ের সঙ্গে এই সড়ককে সংযুক্ত করবে। এই সড়কের দৈর্ঘ্য ১৩০ কিলোমিটার ও এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬৩৩ কোটি টাকা। ২০০৪ সালের ৫ এপ্রিল মিয়ানমারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থিন নিয়ন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় কক্সবাজারের রামুতে এই মৈত্রী সড়কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। এই ১৩০ কিলোমিটার সড়ক তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে ১৪টি ছোট-বড় সেতু নির্মাণ করতে হবে। এসব সেতু নির্মাণ করা হলে ইয়াঙ্গুন, থাইল্যান্ডসহ চীনের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ হবে। তবে মিয়ানমারের আগ্রহ এ ক্ষেত্রে কম। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই মৈত্রী সড়ক নিয়ে দু'পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের গুরুত্ব অনেক কমে গেছে। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের পাশাপাশি চীনাদেরও যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে এই সমুদ্রবন্দরটির ব্যাপারে। সাধারণত এ ধরনের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনাদের স্ট্র্যাটেজিক ইন্টারেস্ট কাজ করে। গাওদারে চীন গভীর সমুদ্রবন্দরটি আরও উন্নত করেছে। বিনিয়োগ করেছে। কারণ এই পোর্টের মাধ্যমে চীন গালফের তেল তার পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে যেতে চায় (দুবাই-গাওদার-উরমকি)। আর এ জন্য পাকিস্তানের কারাকোরাম পার্বত্যাঞ্চলের মধ্য দিয়ে চীন তেলের পাইপলাইন নির্মাণ করছে। উরমকি পর্যন্ত এই পাইপলাইনের দূরত্ব হবে মাত্র ৩৬০০ কিলোমিটার। আগে চীনকে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে (দুবাই-সাংহাই-উরমকি) পশ্চিমাঞ্চলে তেল নিতে হতো। তখন তারা সময় বাঁচাবে। ঠিক একই ধরনের স্বার্থ রয়েছে সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে। ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত তেলের পাইপলাইন তারা নিয়ে যাবে সোনাদিয়া দিয়ে। সুতরাং চীনের স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত চীনের সঙ্গে বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান প্রয়োজন। এ বছরই চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ঢাকায় আসছেন। তখন যাতে চুক্তিটি হয়, সে লক্ষ্যে এখন এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভারতের আপত্তি এতে থাকবে না। ভারতও চাইবে এই বন্দরের ব্যবহার। Daily SAMAKAL 18.06.14

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও চীন সফর প্রসঙ্গে

প্রধানমন্ত্রী তার চীন সফর শেষ করে ঢাকায় ফিরে এসে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন। জাপান সফর শেষ করেও তিনি একইভাবে বক্তব্য রেখেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন তার সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, তার গুরুত্ব পায় বৈকি। যারা বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে এ সফরের গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন সে কথা। বলেছেন তার চীন সফর সফল হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, চীন বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। তিনি চারবার চীন সফর করেছেন। ১৯৯৩ সালে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে প্রথম, পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬, ২০১০ ও ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। আর এ ব্যাপারে তিনি চীনের সহযোগিতা চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, 'চারদেশীয় একটি ইকোনমিক করিডোর হবে। প্রধানমন্ত্রী এর মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত বিসিআইএম নামে যে উপআঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে (বাংলাদেশ, চীনের ইউনান প্রদেশ, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে), সে কথাটাই বলতে চেয়েছেন। পটুয়াখালীতে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক এবং কারিগরি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথাও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে একটি টানেল নির্মাণ ও মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় একটি গার্মেন্টপল্লী নির্মাণ সংক্রান্ত যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, সে কথাও প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর একটা ব্যাপক প্রত্যাশার সৃষ্টি করলেও এ সফর নিয়ে প্রশ্ন যে নেই, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের চীনের প্রতি 'ঝুঁকে পড়ার' এ প্রবণতাকে ভালো চোখে দেখছে না ভারতের নীতিনির্ধারকরা। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক 'দি হিন্দু' এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শেখ হাসিনা চীনা প্রধানমন্ত্রী লি চেলিয়াংয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে 'চীনা নেতৃত্বাধীন' শতাব্দীতে বাংলাদেশের 'সক্রিয়' অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারকরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। যদিও সরাসরি কোনো ভারতীয় নেতার মন্তব্য এতে পাওয়া যায়নি। চলতি জুন মাসের ২৫ তারিখে ঢাকা সফরে আসছেন নয়া ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ধারণা করছি, ওই সময় ভারতীয় নেতা এ বিষয়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে আরও ব্যাখ্যা চাইতে পারেন! তবে একটা কথা বলা প্রয়োজন। বেশক'টি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও বাংলাদেশের জন্য অগ্রাধিকার তালিকায় যে প্রকল্পটি প্রথমে ছিল, সেই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। বিভিন্ন ইস্যুতে দু'পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। বাংলাদেশ বন্দর পরিচালনার ভার কোনো বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায় না। চীনা সরকার এটি পেতে চায়। উল্লেখ্য, চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির পাশাপাশি ইউএই, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ক সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু একটি বাছাই কমিটি চায়না হারবারকে যোগ্য বলে অভিমত দিয়েছিল। চায়না হারবারের প্রস্তাব অনুযায়ী তিন ধাপে ১০ বছরের মধ্যে এ নির্মাণ সম্পন্ন হবে। ব্যয় হবে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ৩ বছরে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। বড় জাহাজগুলো তখন এখানে নোঙর করতে পারবে (এখন চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট জাহাজে পণ্য আনতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর)। প্রথম পর্যায়ে বন্দরে ২০ লাখ টিইইউএস (খোলা পণ্য) ধারণক্ষমতা হবে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এখানে এখন অনেক দেখার বিষয় রয়েছে। আমার বিবেচনায় বাছাই কমিটির চায়না হারবারকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক। কেননা চীনারা এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। এ অঞ্চলে অন্তত তিনটি গভীর সমুদ্রবন্দরের খবর জানা যায়, যা চীনা অর্থে ও চীনা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে এবং পরিচালিত হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। একটি হামবানটোটায়, অপরটি কলম্বোতে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত হামবানটোটায় ছিল গভীর জঙ্গল। ছোট্ট একটা শহর, যেখানে কোনো ভালো হোটেল ছিল না। প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের জন্মস্থান এখানে। চীন এখানে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর ফলে পুরো হামবানটোটার দৃশ্যপট বদলে গেছে। হামবানটোটা আজ একটি আন্তর্জাতিক নগরীর মর্যাদা পেয়েছে। নামকরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে এখানে। ২০১৮ সালে এখানে কমনওয়েলথ গেমস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কলম্বোতে যে বন্দরটি নির্মিত হয়েছে, তাতে বছরে ৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা একটাই এখানে 'মেগা শিপ' অর্থাৎ বড় জাহাজগুলো ভিড়তে পারে এবং পণ্য খালাস করতে পারে। বলা হচ্ছে, বন্দর পরিচালনা কার হাতে থাকবে- এটা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। যদি সর্বশেষ কলম্বোর সিআইসিটি অর্থাৎ কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা দেখি, তাহলে দেখতে পাব শতকরা ৮৫ ভাগ মালিকানা চীনের হাতে। ১৫ ভাগের মালিকানা শ্রীলঙ্কা সরকারের হাতে। যদি পাকিস্তানের গাওদার গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা বলি, তাহলে শতকরা ১০০ ভাগ মালিকানাই চীনাদের হাতে। এক সময় সিঙ্গাপুরের হাতে দায়িত্ব ছিল এর পরিচালনার। এখন চীনাদের হাতে রয়েছে পরিচালনার ভার। যেখানে তাদের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেখানে পরিচালনার ভার থাকলে আপত্তি কোথায়? সোনাদিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত না হয়, তাহলে চীনাদের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার দেয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের বন্দর পরিচালনায় যে অভিজ্ঞ জনশক্তি প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। বরং চীনাদের সঙ্গে থেকে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারব। ডিজাইন তৈরিতেও অভিজ্ঞ চীনারা। সুতরাং তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত চুক্তি না হওয়া নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে যত দ্রুত আমরা একটা সমঝোতায় পৌঁছব, ততই আমাদের জন্য তা মঙ্গল। কেননা দেরি হলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা, বিসিআইএম-এর কর্মকান্ড কে স্বাগত জানিয়েছি। বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে যে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে উঠছে, তার উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থেই এ সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এ বন্দর দিয়েই তাদের পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারবে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব থাকলেও, চুক্তিটি হলো না কেন? একটা ধারণা দেয়া হয়েছে যে, চীনা ঋণের ধরন নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ সহজ শর্তে ঋণ চেয়েছিল। এতদিন একটা ধারণা ছিল, এ প্রকল্পে চীন নমনীয় ঋণ দেয়। এ ঋণের সুদের হার কম, মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু পরে জানা গেল, চীন এ ঋণকে বাণিজ্যিক ঋণে পরিণত করতে চায়, যেখানে সুদের হার ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এখানে একটি বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। প্রথমত, বাংলাদেশ অতীতে বিভিন্ন চীনা প্রকল্পে যে ঋণ দিয়েছে, তার ধরন কী? তা কী বাণিজ্যিক ঋণ? দ্বিতীয়ত, এ প্রকল্প নিয়ে চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনা চলে আসছিল। ওই আলোচনায় কী বাণিজ্যিক ঋণের প্রশ্নটি এসেছিল? তৃতীয়ত, কোনো সমঝোতা ছাড়াই কেন বলা হলো প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে। চতুর্থত, বাংলাদেশের আলোচনাকারীরা কী চীনা অর্থে নির্মিত ও পরিচালিত গাওদার, হামবানটোটা ও কলম্বো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং পরিচালনায় কী ধরনের চুক্তি হয়েছিল, তা পর্যালোচনা করেছিলেন? এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ মূলত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনা অর্থায়নের বিষয়টি ভারত কীভাবে দেখছে, এটা বিবেচনায় নিতে চায়। এজন্য বাংলাদেশ কিছুটা সময়ক্ষেপণ করছে। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের পর এ 'জটিলতা' কেটে যাবে। গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হলে তাতে ভারতেরও লাভ। কেননা ভারতের 'সাত বোন' রাজ্যগুলো এ বন্দরটি ব্যবহার করতে পারবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা এরই মধ্যে হয়েছে। তবে ভারতের একটা উৎকণ্ঠা আছে। চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে তার 'মুক্তার মালা' বা 'String of Pearls' এর যে নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, তাকে ভারত খুব স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এ 'মুক্তার মালা' নীতির মাধ্যমে চীন ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। চীন এ কাজটি করেছে শুধু তার জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার স্বার্থে। এটা এখন অনেকেই জানেন, চীনে যে ব্যাপক শিল্প বিপ্লব ঘটেছে, তার জন্য তাকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করতে হয়। আর জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার স্বার্থেই চীন ভারত মহাসাগর এলাকায় তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়েছে। গাওদার কিংবা হামবানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনাদের আগ্রহের পেছনে কাজ করছে এ 'জ্বালানি ক্ষুধা'র চাহিদা। গাওদারের মাধ্যমে চীন পারস্য উপসাগরের তেল তার পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে নিয়ে যেতে চায়। দুবাই-গাওদার উরমকি দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মাণ করছে। আর এজন্য পাকিস্তানের কারাকোবাম পর্বাঞ্চলের মধ্য দিয়ে চীন তেলের পাইপলাইন নির্মাণ করছে। উরমকি পর্যন্ত এ পাইপলাইনের দূরত্ব হবে মাত্র ৩৬০০ কিলোমিটার। আগে চীনকে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে (দুবাই-সাংহাই-উরমকি) পশ্চিমাঞ্চলে তেল নিতে হতো। এখন তারা সময় বাঁচাবে গাওদার বন্দর ব্যবহার করে। চীন তার জ্বালানি চাহিদা মেটাতে মধ্য এশিয়ার বিশাল গ্যাস রিজার্ভের দিকেও নজর দিয়েছে। জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ মধ্য এশিয়ার কাসগার থেকে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পসমৃদ্ধ প্রদেশগুলোতে গ্যাস নিতে সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে (কাসগার থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৫০০ কিলোমিটার। অথচ চীনের পূর্বাঞ্চলের শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চলে কাসগার থেকে দূরত্ব ৩৫০০ কিলোমিটার)। চীনের সদূরপ্রসারী আরেকটি পরিকল্পনা আছে মধ্য এশিয়ার এ গ্যাস ও তেল সোনাদিয়ার মাধ্যমে ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়ার। মিয়ানমারের গভীর সমুদ্র থেকে চীন গ্যাস উত্তোলন করছে। এ গ্যাস যাচ্ছে পাইপলাইনের মাধ্যমে কুনমিংয়ে। চীনের পরিকল্পনা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে মিয়ানমার-কুনমিং পাইপলাইনকে সোনাদিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা, যাতে করে মধ্য এশিয়ার তেল/গ্যাসও আগামীতে এ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা যায়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে চীনের আগ্রহ রয়েছে। এখন এ আগ্রহকে আমাদের স্বার্থে আমরা কতটুকু ব্যবহার করতে পারব, প্রশ্ন সেখানেই। চলতি বছরই চীনের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসছে। ধারণা করছি, এ সময়ের মধ্যে তিনটি কাজ সম্পন্ন হবে। এক. সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের মধ্যে দিয়ে ভারতের মনোভাব আমরা জানতে পারব। বলা ভালো সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত হতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক সাহায্য করবে। এখন ভারত যদি বন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়ায় সব ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়নে নিজেদের জড়িত করে, তাহলে তাদের সেই সুযোগটি দেয়া উচিত। দুই. চীনা ঋণের বিষয়টিও আমরা এরই মধ্যে ফয়সালা করতে পারি। তিন. যে বাকি তিনটি প্রস্তাব আছে, সেই প্রস্তাবগুলোও আমরা এরই মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। তবে আমাদের ধারণা, নির্মাণ খরচ অন্য প্রস্তাবগুলোতে অনেক বেশি থাকবে। তবুও প্রস্তাবগুলো বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'যে দ্রুত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দেবে, তাদের সহযোগিতা নেব।' এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। আমাদের স্বার্থ এখানেই নিহিত। মনে রাখতে হবে, ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম বন্দর অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। পলি পড়ে জাহাজ চলাচল বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বেড়েছে। আগামীতে আরও বাড়বে। এমনিতেই নানা জটিলতায় চট্টগ্রাম বন্দরের 'উৎপাদনশীলতা' মারাত্মক হ্রাস পেয়েছে। রাজনৈতিক সঙ্কট তথা শ্রমিক রাজনীতির কারণে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ থাকার ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। সুতরাং আমরা যত দ্রুত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব বেশি। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশী। আমাদের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন বিক্রমপুরের বৌদ্ধ মনীষী অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য অষ্টম শতকে তিব্বতে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই তিনি দেহত্যাগ করেন। তার দেহভস্ম তিব্বতে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত ছিল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় ওই দেহভস্ম বাংলাদেশে আনা হয় এবং কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরে এখন তা সংরক্ষিত রয়েছে। অন্যদিকে ইতিহাস থেকেও জানা যায়, এ অঞ্চলের ব্যাপারে চীনেরও আগ্রহ ছিল। একজন চীনা নাবিক, যিনি এডমিরাল ঝেং হে নামে পরিচিত, তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইউনান প্রদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তার প্রকৃত নাম মা হে। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সালের মধ্যে দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর উপকূল পর্যন্ত ৩৩টি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দেশ সফর করেন। ১৪২১ থেকে ১৪৩১ সালে পর্যন্ত তিনি দু'বার আজকের অধুনালুপ্ত বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ ভ্রমণ করেন এবং এ অঞ্চলের সঙ্গে ইউনান রাজ্যের সম্পর্ক স্থাপন করেন। সুতরাং ঐতিহাসিক সম্পর্কের সূত্র ধরেই প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করলেন। তার এ সফরের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে আরও চীনের কাছাকাছি নিয়ে গেলেন। Daily ALOKITO BANGLADESH 18.06.14

প্রধানমন্ত্রীর চীন ও জাপান সফর থেকে প্রাপ্তি

মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান ও চীন সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও, যে প্রশ্নটি উঠেছে তা হচ্ছে তার এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী? ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর ওই নির্বাচন সারা বিশ্বেই গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে বিতর্কিত হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর জাপান ও চীন সফর এই গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে একটি প্লাস পয়েন্ট। দাতা দেশগুলো যে বর্তমান সরকারকে সর্বান্তকরণে মেনে নিয়েছে, এটা তার বড় প্রমাণ। তবে এই দুই সফর নিয়ে প্রশ্ন যে নেই, তা বলা যাবে না। বাংলাদেশের পূর্বমুখী কূটনীতি ও অর্থনৈতিক কূটনীতির আলোকে এই দুই সফরের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র এখন এশিয়া, বিশেষ করে চীন, জাপান ও ভারত। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, চীন এরই মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল। ২০১১ সালে এসে ভারত জাপানকে পিছে ফেলে দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও শীর্ষ অবস্থানটা ধরে রেখেছে। ইন্টারন্যাশনাল কম্পারিজন প্রোগ্রাম (আইসিপি) এ তথ্য প্রকাশ করেছে। আর বিশ্বব্যাংক গ্র“পের ডেভেলপমেন্ট ডাটা গ্র“প এ কর্মসূচির আয়োজন করেছিল। ফলে প্রধানমন্ত্রীর জাপান ও চীন সফরের যে গুরুত্ব থাকবে, তা কাউকে বলে দিতে হয় না।বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুব আশাব্যঞ্জক নয়। বিশ্ব বাণিজ্যের মাত্র ১ ভাগ জাপান সম্পন্ন করে ঢাকার সঙ্গে। এটা আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য কোনো আশাব্যঞ্জক খবর নয়। যেখানে ২০১২-১৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৯৬০ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলার, সেখানে জাপানে এই রফতানির পরিমাণ মাত্র ৬৭৯ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলার। জাপানের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক ঘাটতির পরিমাণ ৬৪৬ মিলিয়ন ডলার। তবে এটা সত্য, গেল ৫ বছরে জাপানে বাংলাদেশী রফতানি বেড়েছে আড়াইগুণ, আর তৈরি পোশাকের রফতানি বেড়েছে ২০ গুণ। বাংলাদেশের ১১তম পণ্যের বাজার হচ্ছে জাপান। এই রফতানির পরিমাণ আরও বাড়ানো যায়। আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির একটা বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, আমরা জাপানি বিনিয়োগকে বাংলাদেশে আকৃষ্ট করতে পারিনি। যেখানে ২০০২ সালে জাপানি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার, ২০০৯ সালে তা বেড়েছে ৫৮ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন ডলার। অথচ জাপান ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করেছে ৪ বিলিয়ন ডলার। জাপান আমাদের যে ঋণ দেয়, তাও খুব বড় অংকের নয়। ২০০৪ সালে ঋণ দিয়েছিল ৭৯ মিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩১৮ মিলিয়ন ডলারে। জাপান বাংলাদেশে যে পরিমাণ ঋণ দেয়, তা এলডিসিভুক্ত দেশগুলোকে দেয়া ঋণের মাত্র ২৬ ভাগ। এ পরিমাণ অর্থ শুধু কম্বোডিয়ার পরেই। বিনিয়োগ কিংবা বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে জাপানে আমাদের দূতাবাস কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এমনকি আমরা নিজ দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতিরও উন্নতি করতে পারিনি। একাধিক সেমিনারে কিংবা আন্তর্জাতিক পরিসরে বিনিয়োগের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগ সংক্রান্ত পরিস্থিতির খুব যে একটা উন্নতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি, তার কাঠামোগত উন্নয়ন, লাল-ফিতার দৌরাত্ম্য- কোনো একটি ক্ষেত্রেও আমরা শতভাগ সফলতা অর্জন করতে পারিনি। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। নিঃসন্দেহে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক বেড়েছে। এখানে দায়বদ্ধতার প্রশ্ন আছে। চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমরা নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারিনি। ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে পারিনি আমরা। এমনকি তথাকথিত ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রবর্তন করলেও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বিনিয়োগকারীদের জন্য হতাশার অন্যতম একটি কারণ। জাপানি বিনিয়োগকারীরা কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েতনামে যে সহযোগিতা পান, বাংলাদেশে তারা পান না। ফলে জাপানি বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জাপানের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব আশাব্যঞ্জক নয়। রফতানির দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে রয়েছে (শতকরা ২৪ ভাগ)। এমনকি জাপানের অবস্থান স্পেনেরও নিচে (স্পেনে রফতানি হয় ৪ দশমিক ২ ভাগ)। অন্যদিকে বাংলাদেশের আমদানির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে চীন, শতকরা ১৭ ভাগ। এরপর ভারতের অবস্থান ১৫ দশমিক ৭ ভাগ। জাপানের অবস্থান কুয়েত ও সিঙ্গাপুরেরও পরে। অর্থনৈতিক কূটনীতিতে সফলতা পেতে হলে এদিকে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী জাপান সফরের সময় ৬০০ কোটি ডলারের সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে গত ৩৫ বছর বাংলাদেশ জাপান থেকে যে ঋণ সহায়তা পেয়েছে, তার পরিমাণ এর চেয়ে কম। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটা প্রতিশ্র“তি। এই ঋণ প্রতিশ্র“তি শর্তমুক্ত নয়। শর্তযুক্ত। আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে এই ঋণ খরচ করতে হবে। জাপানিরা যেসব প্রকল্পে এই ঋণ ব্যবহৃত হবে, তা মনিটর করবে। এর সঙ্গে দুর্নীতির প্রশ্ন যদি থাকে, বাস্তবায়নে যদি শ্লথ গতি আসে, তাহলে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ার ইতিহাস আছে। সুতরাং ৬০০ কোটি ডলারের আশ্বাসে উৎফুল্ল হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর সফর শেষে যে যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে কিছু কিছু বক্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে একটা বক্তব্য ছিল এ রকম : ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন হিসেবে মেনে নেয়নি জাপান। সবার উচিত জনগণের ভোটদানের সুযোগ সৃষ্টি করা। এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জাপানের মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। এখন জাপানি ঋণের ব্যাপারে এই মনোভাব আদৌ প্রতিফলিত হয় কিনা, সেটা দেখার বিষয়। প্রতিশ্র“তি পাওয়াই সব কথা নয়। প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করে আমরা কতটা দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে এই ঋণ ব্যবহার করছি তার ওপর। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং একটু বেশিই।বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে চীনের বিরোধিতা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দুই কুকুরের লড়াই-এর তত্ত্ব উপস্থাপন, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর স্বীকৃতি এবং তারও পরে ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে জেনারেল জিয়ার প্রথম চীন সফরের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো চীনের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ জুন তার চীন সফর শুরু করেন। তবে মূল সফর শুরু হয় ৮ জুন থেকে, যখন তিনি চীনা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা শেষ করেন ও একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও, সেই পঞ্চম শতাব্দী থেকে আজকের যে বাংলাদেশ, এই অঞ্চলটির সঙ্গে চীনা সাম্রাজ্যের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। ওই সময় চীনা ধর্মগুরু Yijing এবং Xuanzang বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এসেছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। তবে বহুল আলোচিত বৌদ্ধ ধর্মগুরু অতিশ দীপংকরের ৮ম শতাব্দীতে তিব্বতে ধর্ম প্রচারের জন্য গমন ও দেহত্যাগ ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। চীনারাও তার এই অবদানকে স্মরণ করেন। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই অতিশ দীপংকরের দেহভস্ম বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়েছিল। যারা চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন এডমিরাল ঝোং হে (আসল নাম মা হে) ইউনান রাজ্যের প্রতিনিধি হয়ে ১৪২১-১৪৩১ সময়সীমায় দুদুবার বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে এসেছিলেন। তিনি ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল এই ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরভুক্ত বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ইউনান রাজ্যের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। চীন এখন এডমিরাল বেনাং-এর সেই অবদানকে স্মরণ এবং সম্মান করে। এখন প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর সেই পুরনো সম্পর্ককেই আবার স্মরণ করিয়ে দিল।স্পষ্টতই প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মধ্য দিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট জি জিং পিং-এর বাংলাদেশ সফরের একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হল। বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জি জিং পিং ভালো ধারণা রাখেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তার ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ও খালেদা জিয়ার চীন সফরের পরপরই ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসেননি। ভারতের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এরই মধ্যে চীনা প্রেসিডেন্টকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং ধারণা করছি চলতি বছরের যে কোনো এক সময় এই সফর হতে পারে। এই সুযোগটি বাংলাদেশ নিতে পারে এবং ওই সময় প্রেসিডেন্ট জি জিং পিংও যাতে ঢাকা সফর করতে পারেন, সে ব্যাপারে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। মোদির ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেও চীন তথা ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে গুরুত্ব দেবে বেশি। বাংলাদেশ এই পরিবর্তনের বাইরে থাকতে পারে না। তাই প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ছিল সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ।চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশের বেশ কটি বড় প্রজেক্টে চীন অর্থায়ন করেছে। বেশ কটি ব্রিজও চীন তৈরি করে দিয়েছে, যা চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের সময় চীনের কাছ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো ও বিশেষ ছাড়ের দাবি বাংলাদেশ উত্থাপন করেছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে চীনের ঋণের ক্ষেত্রে পরিশোধের মেয়াদ ১০ থেকে ১৩ বছর, এছাড়া আরও ৩ বছর গ্রেস পিরিয়ড দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী এই ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০ বছরের পাশাপাশি গ্রেস পিরিয়ড ৫ বছর বৃদ্ধি করার অনুরোধ করেছেন। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাণিজ্য চীনের অনুকূলে। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য চীনে রফতানি করে, তার চেয়ে প্রায় ১৩ দশমিক ৮ গুণ পণ্য বেশি আমদানি করে। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশ রফতানি করেছিল ৪৮.৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানি করেছিল ৫৯২.৬৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০০১-২০০২ সময়সীমায় প্রায় ৬১ গুণ বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করতে হয়েছিল (১১.৬৭ মি.-এর বিপরীতে ৭০৮.৯৪ মি.)। ২০১২-১৩ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৮.১২ মি. (রফতানি) ও ৬৩২৪ মি. (আমদানি)। অন্যদিকে চীনের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ তেমন বেশি নয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চীন ঋণ দিয়েছিল ১৮১ মি. ডলার, যা ছিল সুদমুক্ত। একই সঙ্গে ৭৫ মি. কম সুদে, ৭৬৪ মি. সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট ও ৩২.৯৪ মি. অনুদান দিয়েছিল। ২০১৩ সালে চীন তার নিজ দেশে ৫০০০ আইটেমের বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ মূলত ফ্রজেন ফুড, পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া, তৈরি পোশাক চীনে রফতানি করে। চীনা বিনিয়োগের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই, তাতে দেখা যায় ২০০৯ সালে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৮৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১৩ সালে এসে ১৮৬ জন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ৩২০ মিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা সেক্টরের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ব্যবহৃত সমরাস্ত্রের ৭৫ ভাগের উৎস হচ্ছে চীন। চীন থেকে ট্যাংক, সাঁজোয়াযান, আর বিমান বাহিনীর জন্য ফাইটার প্লেন ক্রয় করা হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগেই বাংলাদেশ-চীন সামরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জীবদ্দশায় জিয়া একাধিকবার চীন সফর করেছেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীনের ঊর্ধ্বতন জেনারেলদের বাংলাদেশ সফর ছিল নিয়মিত। এখন ওই প্রবণতা কিছুটা কম। ২০০২ সালে খালেদা জিয়ার সময়সীমায় বাংলাদেশ ও চীন একটি সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, চীনের সঙ্গে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত চুক্তি না হওয়ায় আমাদের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য তা একটি দুঃখজনক সংবাদ। যদিও উভয় পক্ষই বলেছে তারা এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা আরও চালিয়ে যাবে। এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে। চীন ও ভারত এ সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রচুর। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাওদারে, শ্রীলংকার হামবানতোতা ও কলম্বোতে একাধিক সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে চীন। এসব ক্ষেত্রে চীন কী ধরনের ঋণ দিয়েছে কিংবা বন্দর পরিচালনা কাদের হাতে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালানো উচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেও যখন চুক্তিটি হল না, তখন এটা নিয়ে নানা কথা উঠবে এখন এবং প্রধানমন্ত্রীর সফরের সাফল্যকে কিছুটা হলেও তা ম্লান করেছে। চীনের সঙ্গে অন্য যেসব চুক্তি হয়েছে, তা অত্যন্ত সাধারণ।বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে জাপান ও চীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, ২০১৮ সালে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদে জাপানের প্রার্থিতাকে সমর্থনের বিনিময়ে বাংলাদেশ জাপান থেকে প্রচুর সাহায্যের আশ্বাস পেল। বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদে জাপান ও ভারতের স্থায়ী সদস্যপদের যুক্তিকেও সমর্থন করে। তবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার আদৌ সম্পন্ন হবে কিনা, সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। অস্থায়ী সদস্য পদে জাপানের প্রার্থিতাকে বাংলাদেশ সমর্থন করতেই পারে। জাপান বৈদেশিক সাহায্যের অবমুক্তির সময় দুর্নীতি আর স্বচ্ছতাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। আর চীন প্রাধান্য দেয় ব্যবসাকে। সুতরাং আগামীতে বাংলাদেশ কতস্বচ্ছতার ভিত্তিতে জাপানি ঋণ ব্যবহার করতে পারবে, সে প্রশ্নটি থেকেই গেল। Daily JUGANTOR ১৬ জুন, ২০১৪

শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ও কিছু প্রশ্ন

প্রস্তাবিত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতের জন্য উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাত মিলিয়ে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ১৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ১১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা, আর এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত টাকার পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। এর অর্থ- সরকার প্রতি বছরই শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে। ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার যে বিশাল বাজেট তাতে সর্বোচ্চ ব্যয় হবে জনপ্রশাসন খাতে অর্থাৎ ১৫ দশমিক ৩ ভাগ। এর পরই শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত, ১৩ দশমিক ১ ভাগ। শিক্ষা খাতে এই ব্যয় বরাদ্দ আশার কথা সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু অনেকগুলো খারাপ খবরও আছে আমাদের জন্য। ইকোনমিস্ট (লন্ডন) পত্রিকার ‘ইকোনমিক ইনটেলিজেন্ট ইউনিট’ তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে ৪৭ ভাগ বেকার। একমাত্র আফগানিস্তান বাদে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারদের হার বেশি। শ্রীলংকায় যেখানে এ হার মাত্র ৭ ভাগ, নেপালে ২০ ভাগ, পাকিস্তানে ২৮, আর ভারতে ৩৩ ভাগ, সেখানে বাংলাদেশে এ হার ৪৭ ভাগ। এটা নিঃসন্দেহে একটা উদ্বেগজনক বিষয়। যেখানে প্রতি বছর ১৩ থেকে ১৬ লাখ জনশক্তি চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে, সেখানে বিভিন্ন কারণে (রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অন্যতম) এ দেশে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বাড়ছে বেকারত্ব। এই বেকারত্বের মধ্যে আবার আছে কিছু ‘ছায়া বেকারত্ব’। এদের দেখা যায় না বটে। কিংবা কোনও পরিসংখ্যানেও তারা আসেন না। কিন্তু ছোটখাটো, অর্ধবেলা কাজ করে তারা জীবিকা নির্ভর করছেন। আমরা দেশে ইতোমধ্যে ৩৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৯টি। সব মিলিয়ে ১১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানসম্মত দক্ষ গ্রাজুয়েট আমরা তৈরি করেছি? এর জবাব অত্যন্ত হতাশাজনক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন অনেকটা সার্টিফিকেটসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাব্যবস্থার একটি অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১০ থেকে ১৫ লাখ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় পড়াশোনা করে। কিন্তু এখানে কি আদৌ পড়াশোনা হয়? শত-শত কলেজে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। ঢাকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কিংবা ইউজিসির কর্তাব্যক্তিরা জানেন না এই অনার্স কোর্সগুলো শত-শত শিক্ষকের জন্য একটা ‘ব্যবসার’ সুযোগ করে দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আমি অনেক কলেজের খবর জানি, সেখানে আদৌ কোনও কাস হয় না। শিক্ষকরা কলেজে শিক্ষাদানের পরিবর্তে বাসায় ব্যাচের পর ব্যাচ ‘প্রাইভেট’ পড়ান। অথচ ওই শিক্ষকের কলেজে থাকার কথা। অনার্সপর্যায়ে কোনও ছাত্র প্রাইভেট পড়ে, অথবা শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন। এটা আমাদের জমানায় আমরা না শুনলেও, এটা হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন সরকারি কলেজগুলোর একটি বাস্তব চিত্র। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আসেন, ভিসি যান। কিন্তু সংস্কার কেউ করেন না। এটা এখন মূলত একটি সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ভর্তি হয়ে চার বছর পর মেলে একখানা সার্টিফিকেট। কাস না করে, সংসার ধর্ম পালন করে, কোনও টেস্কট বই না পড়েও যে একখানা অনার্স সার্টিফিকেট পাওয়া যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর বড় উদাহরণ। এই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশে উচ্চশিক্ষায় বড় অঙ্কের বেকারত্ব সৃষ্টি করছে। দুঃখ লাগে শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি এদিকে পড়েনি। তিনি আদৌ ভেবেছেন কি না, তাতেও রয়েছে আমার সন্দেহ। একুশ শতকে একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরকে শক্তিশালী করতে হবে। সনাতন শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি জোর দিতে হবে প্রযুক্তিগত তথা আইটিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এই আইটিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা একদিকে যেমনি বেকার সমস্যা সমাধানে বড় ভূমিকা রাখবে, ঠিক তেমনি বহির্বিশ্বে মানবসম্পদের একটা সুষ্ঠু ব্যবহারও হবে। আর তাই শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরকে ঢেলে সাজাতে হবে, সিলেবাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে এবং শিক্ষা কাঠামোয়ও আনতে হবে পরিবর্তন। এ জন্যই গ্রামপর্যায়ে স্কুল বাড়িয়ে, সরকারি অনুদান বাড়িয়ে প্রতিটি স্কুলকে মানবসম্পদ গড়ার এক একটি ‘কারখানা’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সিঙ্গাপুর এ কাজটি করেছিল বিধায় ছোট্ট এ দেশটি আজ উন্নয়নশীল বিশ্বে একটি আদর্শ। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে আমরা এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছি কম। শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছে সরকার। তাতে করে উপকৃত হয়েছে কারা? বেতন খাতেই তো চলে যায় পুরো টাকা। সরকারি কলেজগুলোয় (সরকারি) অবকাঠামো খাতে কিছু উন্নয়ন হয়। কিন্তু এখানে মানসম্মত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন না কেউ। আর শিক্ষকরা এখন গুরুত্ব দেন ‘প্রাইভেট পড়ানোর’ ওপর। মানসম্মত শিক্ষা তাদের কাছে মুখ্য নয়। এসব দেখারও যেন কেউ নেই। আজ অর্থমন্ত্রী যখন নতুন বাজেট উপস্থাপন করলেন, তখন এ কথাটাই আবার মনে হল। নিয়ম রক্ষার্থে তিনি শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হচ্ছে এই বিশাল ব্যয় দিয়ে আমরা উচ্চশিক্ষার কতটুকু মানোন্নয়ন করতে পারব? বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষার মানোন্নয়ন, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় গবেষণা, আইটি সেক্টরের উন্নয়ন- এই বরাদ্দ দিয়ে আদৌ সম্ভব নয়। কেননা এই অর্থের মধ্যে ১৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে। আর ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ব্যয় হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য যে বরাদ্দ, তাতে আমাদের উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কেননা এই টাকার খুব সামান্যই ব্যয় হয় উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের মাঝে একটা অংশ বরাদ্দ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। ২০০১-০২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৯৩.৫৭ কোটি টাকা, আর ২০১০-১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০২.২৪ কোটি টাকা। জাতীয় বাজেটের মাত্র ০.৭৫ ভাগ বরাদ্দ থাকে শিক্ষা খাতে (২০০১-০২)। এ পরিসংখ্যান বেড়েছে ০.৮৪ ভাগ ২০১০-১১ সালে। আবার যদি শুধু শিক্ষা খাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বরাদ্দের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে এ বরাদ্দ মাত্র ৭.৮৫ ভাগ (২০০১-০২) থেকে ৮.২২ ভাগ (২০১০-১১)। অর্থাৎ পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে, বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও। যদিও তুলনামূলক বিচারে উন্নয়নশীল অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। তারপরও কথা থেকে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে এর চেয়ে বেশি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভেবে দেখতে হবে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় বাড়ানো যায় এবং সরকারের ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা কমানো যায়। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন- আর তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে টাকা বরাদ্দ করা হয়, তার খুব কম অংশই ব্যয় হয় গবেষণার কাজে। বরাদ্দকৃত টাকার একটি সিংহভাগ চলে যায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উপাচার্য মহোদয়রা উন্নয়ন খাতে কিংবা গবেষণায় যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেই টাকা নতুন শিক্ষকদের বেতন দিতে ব্যয় করেছেন। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা দলীয় কোটায়, স্থানীয় কোটায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নিজের মেয়ে, ভাই, আপন ভায়রা, শ্যালিকার মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়েকে শিক্ষক তথা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এই প্রবণতা প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। অভিযোগ জাহাঙ্গীরনগর ইতোমধ্যে একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নয়ন বাজেট থেকে টাকা গুনে শিক্ষক তথা কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ২০১১-১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুরি কমিশন (শিক্ষক) কর্তৃক বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২২২.৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬৫.১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে শুধু শিক্ষকদের বেতন দিতে। বিমক যে টাকা বরাদ্দ করে, তা দিয়ে বেতন, পেনশন, সাধারণ খরচ, শিক্ষা খরচ, যানবাহন মেরামত ও মূলধনের চাহিদা মেটানো হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় বেতন পরিশোধের পর যা থাকে, তা দিয়ে অন্যকিছু করা আর সম্ভব হয় না। ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান হয় না। তাদের ন্যূনতম চাহিদাও মেটাতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও খারাপ। তারা অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশন দিতে পারে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। একুশ শতকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোপুরিভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত হবে, এই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশ একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি কল্যাণকামী অর্থনীতিও নয়। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপের কোনও কোনও রাষ্ট্রে (যেমন জার্মানি), কিংবা নরডিকভুক্ত রাষ্ট্রগুলোয় রাষ্ট্র সব নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ সেই পর্যায়ে যেতে পারেনি। ওইসব রাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা একদম ফ্রি। আমরা সেখানে পড়াশোনা করেছি কোনওরকম টিউশন ফি ছাড়াই (শুধু ছাত্র সংসদের জন্য কিছু অর্থ দিতে হয়)। স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরিভাবে ফ্রি না হলেও বেকার ভাতা সেখানে রয়েছে। জার্মানি বা সুইডেনের অর্থনীতির পক্ষে সম্ভব সাধারণ নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি সে পর্যায়ে নেই। তবে যে পর্যায়ে রাষ্ট্র শিক্ষা খাতকে প্রমোট করে, তা ঠিক আছে। রাষ্ট্র শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ দেবে। তবে এখানে উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে। একুশ শতকে এসে একটা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ছাত্র বেতন না বাড়িয়েও আয় বাড়ানো যায়। এ জন্য কতগুলো বিকল্প নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারেন। প্রয়োজন পিপিপি অথবা বেসরকারি খাতকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। যেমন ব্যবসা প্রশাসন, অর্থনীতি, প্রযুক্তিবিদ্যা, ফার্মেসিতে বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বেসরকারি পুঁজিতে ল্যাব হতে পারে, ছাত্রাবাস নির্মিত হতে পারে, ট্রেনিং প্রোগ্রাম হতে পারে। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী রয়েছেন। প্রয়োজন একটি নীতি প্রণয়ন ও যোগাযোগ। একই সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেকেন্ড ক্যাম্পাস কিংবা সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম (শুধু ব্যবসা প্রশাসন কোর্সই নয়) চালু করে তাদের আয় বাড়াতে পারে। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় এ উদ্যোগ নিতে পারে। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা তেজগাঁওয়ে অবস্থিত টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। আর সেই বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে দক্ষ জনশক্তি পেতে পারেন বড় বড় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। গার্মেন্টের পর আমাদের একটা সম্ভাবনার খাত হচ্ছে ওষুধ শিল্প। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়েই ফার্মেসি, বায়োটেকনোলজি বিভাগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো বড় বিনিয়োগ করতে পারে। মোট কথা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয় চলবে। কিন্তু এখানে বিনিয়োগে বেসরকারি খাতকে আমরা উৎসাহিত করতে পারি। বেসরকারি উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে বেশ কটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করছে। ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো শিক্ষকও রয়েছেন। উদ্যোক্তারা যদি সেখানে বিনিয়োগ করতে পারেন, তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করবেন না কেন? আসলে এ জন্য যা দরকার তা হচ্ছে, সুস্পষ্ট একটি নীতিমালা। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা যায় না। দলবাজ উপাচার্যরা এটা ব্যবহার করবেন তাদের স্বার্থে। দলবাজ শিক্ষকের সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি বাড়বে না। Daily AMADER SOMOY 13.06.14

বিষয়টি উদ্বেগের এবং চিন্তারও

বিষয়টি উদ্বেগের এবং চিন্তারও। বিষয়টি হচ্ছে ভারতে তথাকথিত বাংলাদেশিদের(?) পুশব্যাক করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে ভারতের 'ডেকান হেরার্ল্ড' পত্রিকায়। বাংলাদেশের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকাও সংবাদটি ছেপেছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারত সরকারের একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় আগামী ১৫ দিনের মধ্যে 'অবৈধ বাংলাদেশিদের' আসাম ছাড়তে আল্টিমেটাম দিয়েছে আসামের রাজ্য বিজেপি। যদিও এটা স্পষ্ট নয়, মোদি সরকারের এতে সমর্থন রয়েছে কিনা। ভারতের কেন্দ্রীয় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী সর্বানন্দ সান্যাল 'ডেকান হেরার্ল্ড'কে বলেছেন, আসাম থেকে অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়নে নতুন করে আরো ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল বসবে। তিনি ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজুর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। সান্যাল বাবু নিজে আসাম বিজেপির সভাপতি আর কিরণ রিজু অরুণাচল প্রদেশ থেকে নির্বাচিত লোকসভার সদস্য ও বিজেপির ন্যাশনাল সেক্রেটারি। আসাম রাজ্য বিজেপির এই হুমকিটি এলো নয়াদিলি্লতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের এক সপ্তাহের মধ্যে। অথচ মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী। মোদির সঙ্গে তিনি দেখাও করেছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে, মোদির শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো উন্নত হবে। কিন্তু এখন বিজেপি যদি ১৫ দিন পর 'বাংলাদেশি খেদাও' অভিযান শুরু করে, তাহলে তা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে বাধ্য। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, শপথ গ্রহণের আগেই মোদি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবকে ডেকে (২০ মে) তথাকথিত 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের' ঠেকাতে পৃথক একটি দপ্তর গঠন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখন মোদির সেই 'নির্দেশ' আসাম বিজেপি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। নির্বাচনের আগেও মোদি এ ধরনের কথাবার্তা বলেছেন। এ নিয়ে খোদ পশ্চিমবাংলায় বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল এবং পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ মাত্রই বাংলাদেশি নন। শুধু পশ্চিম বাংলাই নয়, বরং আসাম, ত্রিপুরা, ওড়িশা এবং ঝাড়খ-ের একটি অংশের মানুষও বাংলা ভাষায় কথা বলেন। যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষ ভারতের ওইসব রাজ্যে যাতায়াত করেন। সেখানে তাদের আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে অনেকে সেখানে চলে গেছেন স্থায়ীভাবে। যারা গেছেন, তাদের অনেকেই ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন। তিন-চার পুরুষ ধরে তারা সেখানে বসবাস করছেন। তাদের এখন বাংলাদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে কোন যুক্তিতে? মোদি যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, তা হচ্ছে উন্নয়ন। তার দৃষ্টি এখন এদিকে থাকা উচিত। মোদি নিঃসন্দেহে একটি ইমেজ তৈরি করতে পেরেছেন। আর তার ইমেজটি হচ্ছে, তিনি সারা ভারতে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবেন। গুজরাটে যেভাবে তিনি উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, ঠিক একইভাবে তিনি ভারতের সর্বত্র উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি এতে কতটুকু সফল হবেন, এই প্রশ্ন আছে। কেননা, এক গুজরাটকে দিয়ে সারা ভারতবর্ষকে বিচার করা যাবে না। গুজরাটের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি আর ওড়িশা কিংবা ঝড়খ-ের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এক নয়। ভারতের দারিদ্র্য একটি বড় সমস্যা। ২০১০ সালে দারিদ্র্য যেখানে ছিল ২৭.৫০ ভাগ, এখন তা বেড়েছে ৩৭.০২ ভাগে (২০১৩)। ২০১৪ সালের রিপোর্ট নিলে দেখা যাবে, এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। প্রতি বছর বয়স ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৮ দশমিক ৩ লাখ শিশু মারা যায়। উত্তর ও মধ্য প্রদেশে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৯১ ও ৯২টি। ভারত বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতি। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হলেও ভারতে ৫৩ ভাগ মানুষের কোনো টয়লেট সুবিধা নেই। যেখানে-সেখানে-রাস্তাঘাটে তারা মূত্র পরিত্যাগ করে। অথচ ৫৩ ভাগ মানুষের হাতে রয়েছে মোবাইল ফোন, ৪৭ ভাগ মানুষের রয়েছে টিভি, ৯ ভাগ মানুষের রয়েছে কম্পিউটার। শতকরা ৩৯ ভাগ মানুষের কোনো পাকঘর নেই। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন আনার কাজটি খুব সহজ নয়। মোদি কতটুকু সফল হবেন, এই প্রশ্ন থাকবেই। একটি ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি গুজরাটের অবকাঠামোতে পরিবর্তন এনে গুজরাটের উন্নয়ন সাধন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর ভারতের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অত সহজ নয়। উপরন্তু ভারতে রাজ্যের সংখ্যা এখন ২৯টি। প্রতিটি রাজ্যেই, বলা যেতে পারে, আঞ্চলিক শক্তিগুলো ক্ষমতা পরিচালনা করছে। এসব দলের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক যে ভালো, তা বলা যাবে না। বিজেপিবিরোধী আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে (যেমন_ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, ওড়িশায় বিজু জনতা দল, উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি, বিহারে নীতীশ কুমারের দল) কেন্দ্রের দ্বন্দ্ব শুধু উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করবে না, বরং বলা যেতে পারে, নতুন এক ধরনের 'রাজনৈতিক সংকট' সৃষ্টি হতে পারে। মোদি বিজয়ী হলেও তার সমস্যা এখন অনেক। উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় (আসন ২৫০টি) কংগ্রেস তথা ইউপিএ জোটের আসন ৮২টি। এনডিএ জোটের রয়েছে ৬১টি আসন। কংগ্রেসের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তাদের সমর্থন না পেলে তিনি কোনো বিল পাস করাতে পারবেন না। তাই কংগ্রেসের সঙ্গে তাকে সহাবস্থানে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক দল তথা বিজেপিবিরোধী রাজ্যগুলো (মোট ১২টি রাজ্য) কেন্দ্রের বিরোধিতা করলে তিনি উন্নয়নের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। মুসলমানরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছেন। তাদের আস্থায় নিতে হবে। এমন আইন তৈরি করার উদ্যোগ তিনি নেবেন না, যাতে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কংগ্রেসের পরাজয় ঘটেছে। নিঃসন্দেহে এর পেছনে কারণ রয়েছে। তবে রাহুল গান্ধীর জন্য এটা একটা বড় পরাজয়। তিনি পারলেন না। তিনি তার দাদির মতো (ইন্দিরা গান্ধী) আবার কি 'লাইম লাইটে' ফিরে আসতে পারবেন? ১৯৭৭ সালে ক্ষমতা হারানো ইন্দিরা গান্ধী ফিরে এসেছিলেন ১৯৮০ সালে। তবে কংগ্রেস এখন রাহুলের পরিবর্তে প্রিয়াংকা গান্ধীকেও নেতৃত্বের সারিতে নিয়ে আসতে পারে। ভারতের মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে। আর ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই পরিবর্তনটুকু সাধিত হলো। কিন্তু মোদি যদি হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তাকে বিতর্কিত করবে মাত্র। রাহুল গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। এটাই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ভোটাররা যদি কোনো দলকে নির্বাচনে পরিত্যাগ করে, দলের নেতৃবৃন্দ তখন সরে দাঁড়ান। কারণ, তারা মনে করেন, জনগণ তাদের প্রণীত নীতি গ্রহণ করেনি। তাই সোনিয়া ও রাহুল সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দল তা গ্রহণ করেনি। এর অর্থ, নেতৃত্বের সারিতে তারা থেকে যাচ্ছেন। কংগ্রেসের কাছে নেহেরু পরিবারের বাইরে কোনো বিকল্প নেই। মানুষ বার বার নেহেরু-গান্ধী পরিবারের ওপর আস্থা রেখেছে। অতীতে কংগ্রেস ক্ষমতা হারিয়েও আবার ফিরে এসেছে। ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। ভারতের দীর্ঘ ৬৬ বছরের রাজনীতিতে কংগ্রেস এককভাবেই ক্ষমতায় ছিল প্রায় ৫৪ বছর। এই ৫৪ বছরের মধ্যে নেহেরু পরিবারের তিন প্রজন্ম ক্ষমতায় ছিলেন। নেহেরু নিজে, কন্যা ইন্দিরা গান্ধী, নাতি রাজীব গান্ধী। নেহেরু ক্ষমতায় ছিলেন ৬ বছর ২৮৬ দিন। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ছিলেন দুইবার_ ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭, আবার ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪, নিজ দেহরক্ষীদের হাতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। প্রথমবার ছিলেন ১১ বছর ৫৯ দিন, আর দ্বিতীয়বার ৪ বছর ২৯১ দিন। আর রাজীব গান্ধী ছিলেন ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। এর বাইরে কংগ্রেসের পক্ষ হয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন (প্রধানমন্ত্রী) তিনজন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ১ বছর ২১৬ দিন (১৯৬৪-১৯৬৬ জানুয়ারি)। আর তামিল টাইগারদের হাতে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর হঠাৎ করেই ক্ষমতা পান নরসীমা রাও (১৯৯১ সালের ২১ জুন থেকে ১৯৯৬ সালের ১৬ মে)। এরপর নেহেরু পরিবারের বাইরে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন মনমোহন সিং, ২০০৪ সালের ২২ মে। মোদির ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ১০ বছর, দুই টার্ম। পুনরায় নেহেরু-গান্ধী পরিবারের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু রাহুল গান্ধী ব্যর্থ হলেন। তবে নেহেরু-গান্ধী পরিবার ছাড়া যে কংগ্রেসের কোনো বিকল্প নেই, সেটা আবারো প্রমাণিত হলো। কংগ্রেসের বাইরে জনতা দল একবার (১৯৮৯), এর আগে জনতা পার্টি (১৯৭৭) এবং বিজেপি (১৯৯৬, ১৩ দিন; ১৯৯৮, ৬ বছর) ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। তবে নিঃসন্দেহে এবারকার বিজেপির সঙ্গে আগের বিজেপির তুলনা করা যাবে না। এবারকার বিজেপি অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক। তাই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী কিংবা বেগম জিয়ার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার পরও প্রশ্ন থাকবে অনেক। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের। বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন, বিগত কংগ্রেস সরকার ঢাকার আওয়ামী লীগ সরকারকে গুরুত্ব দিয়েছিল বেশি। এখন বিজেপি সরকার কোনো দলকে নয়, বরং রাষ্ট্র পর্যায়ে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেবে বেশি। এক কথায় যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয় তার জাতীয় স্বার্থের আলোকে। ফলে নয়া সরকার তাদের জাতীয় স্বার্থের আলোকেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পরিচালনা করবে। তাই সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ মুহূর্তে যা স্পষ্ট, তা হচ্ছে, তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তিটি এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে গেল। কেননা, মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কোনো ধরনের বিবাদে যাবে না কেন্দ্র। ছিটমহল বিনিময়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। অতীতে বিজেপি এর বিরোধিতা করেছিল। ফলে ২০১১ সালে ঢাকায় একটি চুক্তি স্বাক্ষর, কংগ্রেসের ক্যাবিনেটে তা অনুমোদন এবং পরবর্তীকালে ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের জন্য তা রাজ্যসভায় উত্থাপিত হলেও বিজেপির আপত্তির কারণে ঝুলে গেছে। সংবিধান সংশোধন করা যায়নি। এখন বিজেপি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে, তা মনে হয় না। ইতোমধ্যে আসামের নির্বাচিত বিজেপির সংসদ সদস্যদের প্রায় সবাই জানিয়ে দিয়েছেন, বিজেপি ছিটমহল বিনিময় করবে না। বলা ভালো, ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের কথা। বাংলাদেশের ৭১১০ একর জমি ফেরত পাওয়ার কথা, যার একটি বড় অংশ আসামে। তাই আসামের সাংসদদের বিরোধিতায় খুব সহজেই বোঝা যায় 'বাংলাদেশিদের' খেদানোর কথা। অতীতে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কোনো শক্ত অবস্থানে যায়নি। বরং দেখা গেছে, ভারতকে সমীহ করে চলছিল সরকার। বর্তমানে নতুন সরকার এসেছে। তাদের কর্মকা- দেখে মনে হচ্ছে, তারা এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। বাংলাদেশকেও এখন শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আসাম রাজ্য বিজেপির সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত জানতে হবে। দীর্ঘ ৪০ বছর কিংবা তারও আগে থেকে যারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করে আসছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তারা ওই দেশের নাগরিক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। জার্মান কিংবা ব্রিটেনের মতো দেশেও দীর্ঘদিন কেউ থাকলে তিনি ওই দেশের নাগরিক হয়ে যান। এখন মোদি সরকার ১০০ দিনের কাজের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছেন। অহেতুক 'বাংলাদেশি খেদাও' অভিযান শুরু করে মোদি সরকার শুরুতেই একটা বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাইছে। এই প্রবণতা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাবে না। Daily JAI JAI DIN 11 June 2014

মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা কার স্বার্থে?

দুসপ্তাহ ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। গত ২৮ মে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির গুলিতে বিজিবির নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানের মৃত্যুর পর দুপক্ষের মাঝে গুলিবিনিময় বন্ধ হলেও গত ৩ জুন ওই সীমান্তে ফের গোলাগুলি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন মিয়ানমারের মংডুতে বিজিবি ও বিজিপির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সুবেদার মিজানের হত্যার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করলেও পর দিন সীমান্তে আবারও গুলিবর্ষণ করেছে বিজিপি (যুগান্তর, ৭ জুন ২০১৪)। এ পরিস্থিতিতে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, হঠাৎ করে সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ল কেন? কেনইবা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কোনো ধরনের হুশিয়ারি ছাড়াই গুলি করে বিজিবির সদস্যকে হত্যা করল? এটা কি নিছক একটি দুর্ঘটনা নাকি ভুল বোঝাবুঝির ফল? প্রকৃতপক্ষে এটা ভুল বোঝাবুঝির ফল নয়। ভুল বোঝাবুঝি হলে দ্বিতীয়বার বিজিপি বাংলাদেশী সীমান্তরক্ষীদের ওপর গুলি করত না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুদুবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এর প্রতিবাদ করেছে। কূটনৈতিক নিয়মে এটা ঠিক আছে। তবে এর পেছনে কী কারণ কাজ করছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কেননা বাংলাদেশ যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে, তাতে এ প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না থাকলে তা কোনো ফল বয়ে আনবে না। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বিমসটেকের সদস্য এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে মিয়ানমার একটা বড় অবদান রাখতে পারে। উপরন্তু বিসিআইএম নামে যে উপআঞ্চলিক জোটের ধারণা বাংলাদেশ প্রমোট করে, মিয়ানমার সে জোটে আছে। মিয়ানমারের পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী নীতিতে সফলতা পাবে না। তাই সীমান্তে যদি উত্তেজনা থাকে, তাহলে দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলবে, যাতে প্রকারান্তরে বাংলাদেশেরই ক্ষতি। কুনমিং-কক্সবাজার সড়কের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে। দুদেশের মাঝে অবিশ্বাস থাকলে মিয়ানমার এই সড়কের ব্যাপারে তার সম্মতি দেবে না। প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়ক নির্মাণ শেষ হলে তা কুনমিংয়ের সঙ্গে এই সড়ককে সংযুক্ত করবে। ফলে কুনমিং থেকে সড়কপথে কক্সবাজারে আসা সম্ভব হবে। চীন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করছে। প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান চীন সফরে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। চীন এই গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করবে। এ ক্ষেত্রে এ সড়কের গুরুত্ব অনেক বেশি। চীন আগামীতে এ পথেই তার পণ্য রফতানি করবে। এতে তাদের সময় অনেক বাঁচবে। চীনের ইউনান প্রদেশ এখন তার পণ্য রফতানি করে ৮০০ কিলোমিটার দূরে সাংহাই বন্দরের মাধ্যমে। যেহেতু মিয়ানমারের সম্মতি ছাড়া এ সড়ক নির্মাণ শেষ হবে না, সেহেতু দুদেশের মাঝে সম্পর্কের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
আমি মিয়ানমারের সাম্প্রতিক অনলাইন সংবাদপত্রগুলো সার্চ করে দেখেছি এই সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায় কি-না। কিন্তু তেমন কোনো প্রতিবেদন চোখে পড়েনি। তবে একটি সংবাদ একাধিক সংবাদপত্রে গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে- তা হচ্ছে মিয়ানমারের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিভিন্ন রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী তৎপরতাকে আগের চেয়ে বেশি হুমকি বলে মনে করছে। এসব তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণেই কাজ করে। ফলে তাদের এই মূল্যায়ন কতটুকু গ্রহণযোগ্য, এ প্রশ্ন থাকবেই। সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দুটি বিষয় জড়িত রয়েছে বলে আমার ধারণা। এক. গত জানুয়ারি থেকে মিয়ানমারে গণশুমারি চলেছে। কারা কারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং কাদের ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করা হবে, সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কক্সবাজারে হাজার হাজার বৈধ ও অবৈধ রোহিঙ্গা যাতে নিবন্ধনভুক্ত হতে না পারে, সেজন্য সীমান্তে উত্তেজনা জিইয়ে রেখে রোহিঙ্গাদের আরাকান রাজ্যে ফিরে আসার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হতে পারে। দুই. কিছু রোহিঙ্গা সংগঠনের উগ্র ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। বিজিপির পক্ষ থেকে এর আগে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) কথা বলা হয়েছিল। এটা এখন সবাই জানে যে, প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে আরাকান রাজ্যে বসবাস করে। তারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। গত ১০ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত সেখানে গণশুমারি চলেছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করার অংশ হিসেবেই এই গণশুমারির আয়োজন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক এই গণশুমারিতে অংশ নেয়নি। ফলে কার্যত এই গণশুমারি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে, যদিও সময়সীমা জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের যে অভিযোগ উঠেছে, তা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার হয়ে একসময় মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। ১৯৪৭ সালেই রোহিঙ্গা মুজাহিদিনরা আরাকান প্রদেশকে স্বাধীন করার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। তাদের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম অব্যাহত থাকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত। এরপর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মুজাহিদিনদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সিএনএনের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের মাঝে আল কায়দার অনুপ্রবেশ এবং ১৯৯১ সালে কার্টিল লিন্টনারের এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি কানেকশনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও কখনও এটা প্রমাণিত হয়নি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও বলা হয়নি যে, রোহিঙ্গাদের আল কায়দা কানেকশন আছে।
যারা মিয়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটাকে মূলত একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। তারা অত্যন্ত সুকৌশলে মুসলমানদের উৎখাত করে সেখানে এক ধরনের বৌদ্ধরাজ কায়েম করতে চায়। ইতিহাস বলে, জেনারেল নে উইনের আমলে আরাকানে জাতিগত আন্দোলন দমনের জন্য ১৯৭৮ সালে নাগামিন ড্রাগন অপারেশন চালানো হয়েছিল। আরাকান ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টির সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সম্পৃক্ততার অভিযোগে নির্বিচারে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। নাগামিন ড্রাগন অপারেশনের ফলে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান উদ্বাস্তু হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। উদ্বাস্তু সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তখন আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ কামনা করে। ফলে ১৯৭৯ সালে দুদেশের মাঝে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির বিনিময়ে কিছু শরণার্থী (রোহিঙ্গা) নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের পর মিয়ানমারে আগত রোহিঙ্গাদের ভাসমান নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সম্পত্তি অর্জন, রাজনৈতিক অধিকার ও অবাধ চলাচল নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এমনকি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অন্য প্রদেশে গিয়েও বসবাস করতে পারে না। উচ্চশিক্ষার কোনো সুযোগ তাদের নেই। দুই সন্তানের বেশি তারা গ্রহণ করতে পারে না। এমনকি তাদের বিয়েতেও এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ আছে। আরাকান রাজ্যে অনেকটা ব্যারাক জীবনযাপন করতে হয় তাদের। রোহিঙ্গাদের ওপর আবার নির্যাতন শুরু হলে ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সংকটের সৃষ্টি হয়। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯১ সালের ২৬ জুনের মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন রোহিঙ্গা মুসলমান আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে কক্সবাজারে ১৯টি শরণার্থী শিবিরে ও শিবিরের বাইরে আরও ২ লাখ ৫০ হাজার ৬৬১ জন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। দুদেশের সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির ফলে ১৯৯২ সালের ১৫ মে থেকে ৬ মাসের মধ্যে মিয়ানমার সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা একটিই- মিয়ানমার সরকার মাত্র ২২ হাজার শরণার্থীকে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে। বাকিদের স্বীকার করে না। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সমস্যাটি দুদেশের সম্পর্কের মাঝে অন্যতম একটি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাও চাচ্ছে না রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক চক্র তৎপর। তারা রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি করছে। আফগান যুদ্ধে রোহিঙ্গারা তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে- এমন খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের টাকার বিনিময়ে রিক্রুট করছে- এমন অভিযোগও রয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুটি রাজনৈতিক এবং মিয়ানমার সরকারকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এ সমস্যার অংশ হতে পারে না। রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্ট, আরাকান ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন- এসব সংগঠন মিয়ানমারে বৈধ নয়। এরা ইসলামিক ভাবধারা ও জঙ্গিবাদী রাজনীতির অনুসারী। কোনো কোনো শক্তি এদের ব্যবহার করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে স্থায়ী উত্তেজনা বজায় রাখতে চায়। এদের যে কোনো তৎপরতা আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। আফগানিস্তানে তালেবানদের এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, সেই তালেবানরাই এখন মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। কক্সবাজারে অবস্থানরত হাজার হাজার রোহিঙ্গা, যারা অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, তাদের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থার অবস্থান বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে। ক্যাম্পে যারা নিবন্ধিত, তাদের রেশন জোগায় এ সংস্থা। এই লোভে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে এখনও আসছে এবং মালয়েশিয়াতে যাওয়ার জন্য (সমুদ্রপথে) বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটা সমস্যা। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ সমস্যার দায় বহন করতে হবে। জাতিসংঘের মাধ্যমে চাপ দিতে হবে। বাংলাদেশ তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে এ কাজে ব্যবহার করতে পারে। এদের পৃথিবীর অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করতে পারে জাতিসংঘ। যতদিন রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে অবস্থান করবে, ততদিন আন্তর্জাতিক চক্র সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য এদের ব্যবহার করবে। অর্থ এখানে একটি বড় ফ্যাক্টর। চোরাই পথে এ অঞ্চলে অস্ত্র আসছে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। তাই সীমান্ত হত্যাকাণ্ড কিংবা রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়টি তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। দুদেশ এক সঙ্গে অথবা আন্তর্জাতিক তদারকিতে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তদন্ত করে দেখতে পারে। যেসব সংগঠনের নাম উচ্চারিত হয়েছে, তাদের বাংলাদেশে কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা উচিত। মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিতে হবে প্রথমে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করা যায়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশের স্বার্থেই যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। তবে একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং নির্যাতন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ইতিহাস ও এর পরিণতি আমাদের জানা আছে। আমরা চাই না বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত আরেকটি সন্ত্রাসী আশ্রয়স্থলে পরিণত হোক।
Daily JUGANTOR
০৯ জুন, ২০১৪