রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি (দৈনিক আমার দেশে প্রকাশিত দুই পর্বের প্রথম পর্ব)

পরিসর ছোট হয়ে এখন বৈদিশিক নীতি ভারতেই আটকে গেছে
কোনো রাষ্ট্র তার নিজের প্রয়োজনে এবং আকাঙ্ক্ষা পূরণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা, জাতীয় নীতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং সেই সঙ্গে নিজের অর্থনীতি বিকাশের প্রয়োজনে তার বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করে থাকে। এক্ষেত্রে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জাতীয় স্বার্থই প্রাধান্য পায় বেশি। বাংলাদেশের গত চার দশকের বৈদেশিক নীতি পর্যালোচনা করলে এই জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি বারবার ফিরে আসে। এক্ষেত্রে সবসময় যে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে তা বলা যাবে না। বাংলাদেশের গত চার দশকের বৈদেশিক নীতি যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে বাহ্যত তিনটি ধারা আমরা প্রত্যক্ষ করি। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা অব্যাহত থাকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। বৈদেশিক সম্পর্কের বর্তমান ধারায় কিছু কিছু পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যাকে কোনো কোনো বিশ্লেষক ‘ভারতীয় মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই মডেলের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল : ১. সংসদীয় গণতন্ত্র, ২. সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতায় দলীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা, ৩. সমাজতান্ত্রিক সমাজকাঠামো ও ৪. ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি। মুজিবের বৈদেশিক নীতিতেও এই নীতি প্রতিফলিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে যেসব দেশ তাকে সহযোগিতা করেছিল, সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরপরই তাদের সঙ্গে একটা ‘বিশেষ সম্পর্ক’ গড়ে তোলে। মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির কতগুলো বৈশিষ্ট্য আমরা উল্লেখ করতে পারি। এগুলো হচ্ছে— ১. সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন, ২. ভারতের নির্ধারক ভূমিকা। তবে আদর্শ হিসেবে জোটনিরপেক্ষতা অনুসরণ করা, ৩. অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, ৪. চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অনীহা ইত্যাদি। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ৪৩ মাস। ওই সময় ব্রেজনেভ (সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান) প্রণীত ‘যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি’র প্রতি সমর্থন, তত্কালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারের ৭-দফা দাবির প্রতি সমর্থন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা শীর্ষক সম্মেলনের প্রতি সমর্থন ইত্যাদি কারণে বহির্বিশ্বে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তুলছে। বহির্বিশ্বে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণেই বাংলাদেশ সোভিয়েত শিবিরে অবস্থান করছিল। অভ্যন্তরীণভাবে একটা ‘চাপ’ও ছিল। শেখ মুজিবের সময় ১৯৭২ সালের মার্চে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ছিল বিতর্কিত। তিনি ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিলেও, ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দেন তিনি। চীনের সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগের একটি উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি।

আগস্ট, ১৯৭৫-পরবর্তী বৈদেশিক নীতি
মুজিবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতেও পরিবর্তন আসে। সৌদি আরব ও চীন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এসব স্বীকৃতির ব্যাপারে নতুন সরকারের (খন্দকার মোশতাক) আগ্রহ দেখে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলাদেশ ‘ভারত-সোভিয়েত অক্ষ’ থেকে বের হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সালের আগস্ট-পরবর্তী ঘটনার মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি প্রথমে নিজেকে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে উন্নীত করেন (২৯ নভেম্বর ১৯৭৬) ও পরে বিচারপতি সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হন (২১ এপ্রিল ১৯৭৭)।

জেনারেল জিয়া তার বৈদেশিক নীতিতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবের আমলে এই দিকটি ছিল উপেক্ষিত। জিয়া ধর্মীয় বন্ধনের কারণে ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইসলামের ব্রিজস্বরূপ। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করে। জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানে গঠিত আল কুদ্স কমিটি কিংবা ১৯৮১ সালে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী কমিটিরও অন্যতম সদস্য ছিল বাংলাদেশ। জিয়ার আমলেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদের একটিতে নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ সম্পর্কিত এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। জেনারেল জিয়া ভারতের ভূমিকার ব্যাপারে কঠোর হয়েছিলেন। গঙ্গার পানি বণ্টনে ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী ভারত ১১ থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের পানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪ হাজার থেকে ৪৯ হাজার কিউসেক। কিন্তু মুজিবের মৃত্যুর পর ভারত গঙ্গা নদী থেকে একতরফাভাবে ৪০ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে নেয়। বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে ও একই বছরে ৪২-জাতি ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ফারাক্কা প্রশ্ন উত্থাপন করে। পরে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ৩১তম অধিবেশনে প্রশ্নটি উত্থাপনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু কয়েকটি বন্ধুরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ফলে প্রশ্নটি শেষ পর্যন্ত উত্থাপিত হয়নি এবং ভারতের সঙ্গে একটি সমঝোতার শর্তে বাংলাদেশ ফারাক্কা প্রশ্নটি জাতিসংঘে আর তোলেনি। জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনেও (অক্টোবর ’৯৫) সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া ফারাক্কা প্রশ্নটি আবার উত্থাপন করেন। ১৯৭৭ সালে ভারতে জনতা সরকারের আমলে একটি চুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশ ৩৪ হাজার ৭০০ কিউসেক পানি পেয়েছিল। এই চুক্তির মেয়াদ ছিল পাঁচ বছরের। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো চুক্তি হয়নি। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানির ভাগাভাগির প্রশ্নে নতুন আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে কাগজে-কলমে বাংলাদেশের পানির পরিমাণ বাড়লেও বাস্তব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরের পর অনেক কম পানি পাচ্ছে। সোভিয়েত ধাঁচের সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে জেনারেল জিয়ার অপছন্দ ছিল। তিনি যেভাবে ‘মস্কো টাইপ সমাজতন্ত্র’, ‘বিদেশতন্ত্র’ কিংবা ‘বাকশালতন্ত্রে’র কথা উল্লেখ করেছিলেন, তাতে করে পরোক্ষভাবে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি তার অপছন্দের কথা তিনি বলতে চেয়েছিলন। অপরদিকে চীনে বেশ কয়েকবার রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে তিনি চীনের সঙ্গে শুধু সম্পর্কই বৃদ্ধি করেননি; বরং বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে চীনের উপস্থিতিকে প্রয়োজনীয় করে তুলেছিলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগান আগ্রাসনের (১৯৭৮) ব্যাপারেও বাংলাদেশ অত্যন্ত কঠোর ভূমিকা নিয়েছিল। জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রথম সৌদি আরব সফরে গিয়েছিলেন। এটা ছিল জেনারেল জিয়ার বৈদেশিক নীতিরই ধারাবাহিকতা।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
জেনারেল এরশাদ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে জেনারেল এরশাদ জিয়াউর রহমানের প্রণীত নীতিই প্রধানত মেনে চলেন। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে তার পতনের আগপর্যন্ত তিনি তার বৈদেশিক নীতিতে কোনো বৈচিত্র্য আনতে পারেননি। বরং ১৯৭৫ সালের আগস্ট-পরবর্তী যে রাজনৈতিক ধারা, সেই রাজনৈতিক ধারাই তিনি অনুসরণ করে গেছেন। এরশাদের বৈদেশিক নীতির কতগুলো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— ১. ইসলামিক বিশ্ব তথা সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া, ২. চীনের প্রতি রাজনৈতিক তথা সামরিক নির্ভরশীলতা, ৩. সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রতি কঠোর মনোভাব, ৪. সার্ককে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার উদ্যোগ, ৫. ভারতের প্রতি নমনীয় মনোভাব ও স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা।

এরশাদের আমলেই ফারাক্কায় পানি সরবরাহের ব্যাপারে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া সম্ভব হয়নি। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ তালপট্টি এবং ভারতে আশ্রিত উপজাতীয়দের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারেও এরশাদ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ৯ মে ভারতীয় নৌবাহিনী দক্ষিণ তালপট্টিতে অবতরণ করেছিল। সেই থেকে দক্ষিণ তালপট্টি অন্যতম ‘ইস্যু’ হয়ে থাকলেও জেনারেল এরশাদ এ ব্যাপারে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে পারেননি। যেমনি পারেননি ভারতে আশ্রিত চাকমাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণের লক্ষ্যে একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে। তার শাসনামলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম আরও অশান্ত হয়। ভারতের ব্যাপারে জেনারেল এরশাদের এই নমনীয় মনোভাব অভ্যন্তরীণভাবে নিন্দিত হয়েছিল। তবে জেনারেল এরশাদের বৈদেশিক নীতির একটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ইসলামিক বিশ্ব তথা সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া। ক্ষমতা দখল করার এক মাসের মধ্যে তার সৌদি আরব সফর এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক সাহায্যের ব্যাপারটিও এর সঙ্গে জড়িত। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে জেনারেল এরশাদের আমলে। ১৯৮৩ সালে ১৪ জন সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক গঠিত হয় তার আমলে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে। তবে উদ্যোগটি নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।

বেগম জিয়া
১৯৯১ সালের অক্টোবরে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে ফেব্রুয়ারির (১৯৯১) নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেছিলেন। বেগম জিয়া মূলত তার পূর্ববর্তী বিএনপি সরকার তথা জেনারেল জিয়ার বৈদেশিক নীতিই অনুসরণ করেন। বেগম জিয়ার বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে— ১. চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া, ২. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের আরও উন্নতি করা, ৩. আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা ‘সার্ক’কে আরও কার্যকর করা, ৪. ইসলামিক বিশ্বের নেতা হিসেবে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রাখা ও সৌদি-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া এবং ৫. ভারতের সঙ্গে একটা সমঝোতায় উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টা।
বেগম জিয়া একাধিকবার বেইজিং, ওয়াশিংটন ও সৌদি আরব সফর করেন। প্রতিটি স্থানেই তিনি উষ্ণ সংবর্ধনা পান ও বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়। তিনি ভারতও সফর করেন (২৬-২৮ মে ’৯২)। ভারত সফরের পর তিনি বলেছিলেন, এই দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। তবে তিনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গঙ্গার পানির ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারেননি। পানির ব্যাপারে কোনো চুক্তিতে উপনীত হতে না পারার ব্যর্থতা বেগম জিয়ার বৈদেশিক নীতির জন্য ছিল একটি দুঃখজনক ঘটনা। বেগম জিয়া এপ্রিল (’৯৩) অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সভানেত্রীত্ব করেন এবং সার্কের নেতৃত্ব দেন। এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক বিশ্বাসের একটি পরিবেশ তৈরি করা ছিল অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু তার সময়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। বেশকিছু অমীমাংসিত বিষয়ে কোনো সমাধান হয়নি বেগম জিয়ার আমলে।

বেগম জিয়ার সময়ে নিবারক কূটনীতির কথা বলা হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটা একটা নতুন উপাদান। বিশ্ব রাজনীতি থেকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যে গুণগত পরিবর্তন এসেছে, তারই ফলশ্রুতিতে এসেছে নিবারক কূটনীতির এই ধারণা। নিবারক কূটনীতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ সমাধান করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের মাটিতে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করলেও বাংলাদেশ বার বার মিয়ানমারের সঙ্গে বড় ধরনের সংঘর্ষ এড়িয়ে যায়। মিয়ানমারের উস্কানিমূলক তত্পরতা অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশ মূলত নিবারক কূটনীতির মূলনীতি অনুসরণ করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে চাইছে। কিন্তু নীতিগতভাবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার রাজি হলেও রোহিঙ্গারা আজও তাদের বাসভূমে ফিরে যায়নি।

বেগম জিয়ার সময়সীমায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ বাংলাদেশের এই ভূমিকার প্রশংসা করে। বেগম জিয়ার সময়ে মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন বেসরকারিভাবে বাংলাদেশ সফর করেন। বেগম জিয়ার সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ প্রকটভাবে অনুভূত হয়। বিরোধী দলের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে বেগম জিয়া যখন ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারছিলেন না, তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভূমিকা লক্ষ করা যায়। মার্কিন প্রশাসন এ সময় গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখা, সহিংসতা পরিহার করা ইত্যাদি প্রশ্নে বেশকিছু মন্তব্য করে। ১৫ ফেব্রুয়ারির (’৯৬) বিতর্কিত নির্বাচন সম্পর্কেও যুক্তরাষ্ট্র নেতিবাচক মন্তব্য করেছিল।

শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘ঐকমত্যের সরকার’ পাঁচ বছরের টার্ম শেষ করে গত জুলাই ২০০১-এ। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সরকার গঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে তখন তিনটি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে— ক. সার্বভৌম ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন, খ. বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তি নবায়ন না করা, গ. দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা সমস্যার স্থায়ী সমাধান। অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টনের প্রশ্নেও বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিতকরণ। এর বাইরে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, সার্ক ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা বিশ্বায়ন সম্পর্কে মেনিফেস্টোতে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে শেখ হাসিনা সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিল। যে কারণে আমরা দেখতে পাই, ১৯৯৬ সালের শেষদিকে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রীচুক্তি আর নবায়ন করেনি। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ১৯৯৭ সালের ১৯ মার্চ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কোনো পক্ষ থেকেই চুক্তিটি নবায়ন করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি, যদিও চুক্তির ১১ নং ধারায় বলা হয়েছিল, দুটি দেশ ইচ্ছে করলে চুক্তি নবায়ন করতে পারবে। চুক্তি নবায়ন না করে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করেছিল। ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। এই চুক্তিটি করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করেছিল। ওই চুক্তিটির বৈশিষ্ট্য ছিল : ১. এটি ৩০ বছর মেয়াদি ও ২. শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। কিন্তু চুক্তিটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। বলা হয়েছে, ১৯৭৭ সালের চুক্তির চাইতে বর্তমান চুক্তিতে বাংলাদেশ কম পানি পাবে। ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ অবশ্য ছিল, যা ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে নেই। ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে কলকাতা বন্দরের জন্য ৪০ হাজার কিউসেক পানি নিশ্চিত করা হয়েছিল, যা ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে ছিল না। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে কি-না, তা নিয়েও সন্দেহ ছিল। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রী একবার সংসদে স্বীকার করেছিলেন চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পায়নি (ভোরের কাগজ, ১১ জুলাই ১৯৯৭)। কিন্তু নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার অন্যান্য নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহমান নদীর সংখ্যা ৫৪টি। ভারত শুধু গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়েই সমস্যা সৃষ্টি করেনি; বরং একই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের কথাও বলছে। ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশে যমুনা নামে পরিচিত। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ভারত অভিন্ন ২৫টি নদীর ৪০টি স্থানে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো, যেমন বাঁধ, গ্রোয়েন, স্পার নির্মাণ করেছে বা নির্মাণকাজ শেষ করে এনেছে। বাংলাদেশের যে কোনো সরকারের জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং আগামীতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সেই সরকারকে ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ফলে প্রায় ৫০ হাজার পাহাড়ি শরণার্থী ভারতের আশ্রয় থেকে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল। পরবর্তীকালে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি শান্তিচুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমস্যার একটি সমাধানও পাওয়া গিয়েছিল। শান্তিচুক্তি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল এবং শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিকভাবে শান্তি পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন। এটা তার সরকারের একটি সাফল্য সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু শান্তিচুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। ইতোমধ্যে বিদেশিদের সেখানে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের উদ্যোগের ঘটনায় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও নষ্ট হয়েছে। শান্তিচুক্তি নিয়ে খোদ পাহাড়িদের মধ্যেই দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটলেও এপ্রিলে (২০০১) ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম, সীমান্ত সংঘর্ষে ১৬ বিএসএফ ও ৩ বিডিআর সদস্যের মৃত্যুতে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে। উপরন্তু ভারতীয় সংসদে বিডিআর সদর দফতরে বোমাবর্ষণের হুমকি ও ঊর্ধ্বতন বাংলাদেশী সেনা অধিনায়কদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য এবং এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিবাদ না করার ঘটনায় শেখ হাসিনার সরকার সমালোচিত হয়েছিল। সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে বাজপেয়ি-হাসিনা শীর্ষ বৈঠকের একটি সম্ভাবনা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত ওই শীর্ষ বৈঠকটি আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে দুটি বিষয় তখন বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। এর একটি হচ্ছে, উপ-আঞ্চলিক জোটের সিদ্ধান্ত; দ্বিতীয়টি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার বাংলাদেশ সফরের সময় (জানুয়ারি ’৯৭) এটা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে, ভারত ও বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনে রাজি হয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপাল। উপ-আঞ্চলিক জোটটি তখন উন্নয়নের চতুর্ভুজ বা South Asian Growth Quadrangle (SAGQ) নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এপ্রিলে (১৯৯৭) কাঠমান্ডুতে চারদেশীয় (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান) পররাষ্ট্র সচিবদের যে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ঝঅএছ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, যা পরে আর কার্যকর হয়নি।

বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি স্পর্শকাতর জায়গা হচ্ছে আন্তঃবাণিজ্য। বাংলাদেশ ভারতে যা রফতানি করে, আমদানি করে তার অনেক বেশি। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে ঘাটতি বাড়ছেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী শেখ হাসিনার সময়সীমার পাঁচ বছরে ভারতীয় পণ্য আমদানি বেড়েছে তিনগুণ। বাণিজ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ হচ্ছে ভারতীয় নীতি। সাপটা চুক্তিতে বেশ কয়েকটি পণ্যের ব্যাপারে শুল্ক হ্রাস করার কথা বলা হলেও ভারত তা মানেনি। বাজপেয়ি বাংলাদেশ সফরের সময় ২৫ শ্রেণীতে ১০৯টি বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কছাড়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ ভারতকে ওই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে রাজি করাতে পারেনি। এটা একটা ব্যর্থতা।

(বাকি অংশ আগামী পরবর্তী পোস্টে)।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com

1 comments: