এই আচরণ সামরিক জান্তাকেও লজ্জা দেবে |
সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব পাস হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে বিশেষ কমিটির পক্ষ থেকে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়ে বিএনপি যৌক্তিক প্রস্তাব দিলে আবার সংবিধান সংশোধন করা হবে।' এমনকি দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফও বলেছেন, বিএনপি সংসদে এসে নতুন প্রস্তাব দিতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে 'অন্তর্বতী সরকার' তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প কি-না? দুই. এ ধরনের প্রস্তাবে বিএনপি তথা চারদল রাজি হবে কি-না? তিন. যদি কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে কী?
অনেক সম্ভাবনা নিয়ে এখন বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। মতামতও প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদপত্রে। একটা জিনিস এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়, পঞ্চদশ সংশোধনী এখন সংবিধানের অংশ। এটা বাদ দেয়া যাবে না। অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে (যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষ পুনঃপ্রবর্তন, জাতীয় পরিচয় বাঙালি ও নাগরিক হিসেবে বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম তফসিল বামে অন্তর্ভুক্তি, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ইত্যাদি), এসব পরিবর্তন এখন সংবিধানের অংশ। এগুলো পরিবর্তনের আর সুযোগ নেই। রাজনীতি করতে হলে সংবিধানকে সামনে রেখেই রাজনীতি করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবর্তিত সংবিধানকে অস্বীকার করা যাবে না। সংবিধানের পরিবর্তনে বিএনপি তথা চারদলের আপত্তি রয়েছে। এর পেছনে যুক্তি যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই পরিবর্তনগুলো এখন সংবিধানের অংশ। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে; কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' এখন বাদ দেয়া হয়েছে। এটা নিয়ে ইসলামিক দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে ও গত ৩ জুলাই অর্ধদিবস হরতালও পালন করেছে; কিন্তু এটা নিয়ে আর খুব বেশি দূর এগোনো যাবে না। ইচ্ছে করলেও ইসলামিক দলগুলো সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে না। কেননা সংবিধান পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া আছে। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন না থাকলে সংবিধান সংশোধন করা যায় না। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের সংসদে এই আসন আছে। তারা দ্বিতীয়বার সংবিধান সংশোধন করবে, এটা বিশ্বাস হয় না। সুতরাং স্পষ্টতই দেশ আজ এক গভীর সংকটে পতিত হলো। যেখানে সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে নূ্যনতম ঐক্যের প্রয়োজন ছিল, তা পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে হয়নি।
গণতন্ত্রের অভিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরাকরের কোনো বিধান থাকতে পারে না_ এটা সত্য; কিন্তু আমরা গুলিয়ে ফেলি এক জায়গায়_ উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রের চর্চার সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের চর্চাকে একসঙ্গে মেলান যাবে না। পশ্চিমা ইউরোপে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। আমরা সে স্তরে এখনো পেঁৗছতে পারিনি। আমাদের সমাজে গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো একটি ব্যবস্থা থাকা ছিল বাঞ্ছনীয়। এ জন্য সংবিধান যে পরিবর্তন করতে হয়েছিল, সেটাও অমূলক ছিল না। জিম্বাবুয়েতে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সেখানে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সমাধান হয়েছিল বিরোধী দলনেতা সাভাঙ্গিরাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির মধ্য দিয়ে। অথচ জিম্বাবুয়ের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। এর আগে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে একই ধরনের ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম কেনিয়াতে। প্রেসিডেন্ট কিবাকি ও বিরোধী দল নেতা রাইলা ওডিংগার মধ্যকার দ্বন্দ্বে সেখানে অনেক লোক মারা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিদেশিদের মধ্যস্থতায় ওডিংগাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের মধ্য দিয়ে কেনিয়ার গণতন্ত্র একটা সমাধান খুঁজে পেয়েছিল। কেনিয়ার সংবিধানেও কোনো প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল না। প্রথমে কেনিয়া ও পরে জিম্বাবুয়ের ঘটনাবলি প্রমাণ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে কোনো কোনো রাষ্ট্রকে কখনো কখনো সংবিধানবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এমন সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী হলেও, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তা নেয়া হয়েছিল। আমি এরকম অনেক দৃষ্টান্ত দিতে পারবো, যেখানে গণতন্ত্রের স্বার্থেই রাষ্ট্র এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা প্রকারন্তরে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা ছিল এমন একটি সিদ্ধান্ত, যা বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করেছিল। এ ব্যবস্থা বিদেশে প্রশংসিতও হয়েছিল। তবে ওই ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। তিনটি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরই ত্রুটিগুলো আরো স্পষ্ট হয়েছিল। যদি এই ত্রুটিগুলো দূর করা যেতো, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এতে করে আরো শক্তিশালী হতো।
নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা যায়_ এটা তত্ত্বের কথা। বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হলেও, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারে না। কেননা বর্তমান সরকারই সিইসি তথা নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবে। ফলে প্রশ্ন উঠবে তাদের আনুগত্য নিয়ে। এখন তো শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই 'রাজনীতি' করেন না, আমলারাও রাজনীতি করেন। কেউ বিএনপির আমলা, কেউ আবার আওয়ামী লীগের আমলা। রাজনৈতিক বিবেচনায় সচিব নিয়োগ হচ্ছে। কেউবা আবার বঞ্ছিত হচ্ছেন। বিএনপির আমলে প্রমোশন না হওয়া ব্যক্তিরা বর্তমান সরকারের আমলে হুট করে সচিব পর্যন্ত হয়ে গেছেন_ এমন দৃষ্টান্তও আছে। তাই যাদের নিয়োগ দেয়া হবে, তাদের নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। আর সরকার যে তাদের স্বার্থেই এসব পদে নিয়োগ দেবে, এটা বলাই বাহুল্য। তাহলে নিরপেক্ষতা থাকলো কই? নির্বাচন কমিশনকে অর্থের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। তাদের নিজস্ব তেমন জনবল নেই। গ্রাম পর্যায়ে তারা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল। সেখানে 'ম্যানিপুলেশনের' সম্ভাবনা বেশি। তাই নির্বাচন যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে_ তার গ্যারান্টি কে দেবে? আমরা ভারতের দৃষ্টান্ত দেই বটে; কিন্তু সেখানকার রাজনীতিবিদরা আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করে। আর আমাদের এখানে আমলারা নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতিবিদদের। ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
খালেদা জিয়া গত ১৬ জুন সংবাদ সম্মেলন করে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তিনি অন্য কোনো সিদ্ধান্ত মানবেন না এবং নির্বাচনে অংশও নেবেন না। পাঠক, ১৯৯৬ সালের ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের আগের দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে চেষ্টা করুন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। ফলে ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এমনকি ১৯৯৬ সালে এরশাদ সাধারণ নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগকে ওই নির্বাচনে নিয়ে এলেও তৃতীয় জাতীয় সংসদ স্থায়ী হয়নি বিএনপির অংশগ্রহণ না করার কারণে। ৫ম, ৭ম, ৮ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল একটি কারণেই_ কারণ দুটি বড় দল ওইসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে আগাম মন্তব্য করা সঠিক নয়। নির্বাচন হবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। অনেক সময় বাকি। কিন্তু স্থিতিশীলতার স্বার্থে একটা সমঝোতা প্রয়োজন। বিএনপিকে সংসদে এসে নতুন করে প্রস্তাব দিতে বলেছে আওয়ামী লীগ। এর কী আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? বেগম জিয়া দুটি জিনিস পরিষ্কার করেছিলেন। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে অন্তত আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচনের জন্য, দুই. সংবিধানের ৫৮গ(৩) ধারায় সংশোধনী এনে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টার পদে নিযুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পরও সংসদে যে কেউ এ ব্যাপারে প্রস্তাব আনতে পারেন। সরকার যে কাউকে উৎসাহিত করতে পারেন এ ধরনের একটি প্রস্তাব আনতে। এমনকি একমাত্র নির্দলীয় সদস্যও এ প্রস্তাব আনতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি এমপিরাও সেই প্রস্তাব সমর্থন করে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। উচ্চ আদালতের রায় ও অভিমতের অনুসরণ করেও এ ধরনের প্রস্তাব আনা যায়। তবে সেটা সংবিধানের অংশ হবে না।
আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে চলে, তাহলে আওয়ামী লীগ ভুল করবে। দেয়ালের লিখন বড় কঠিন, বড় বাস্তব। আর দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউ শিখি না। কেউ শিক্ষাও নেই না। হরতাল কোনো সমাধানের পথ নয়। অতীতে হরতালের পর হরতাল আহ্বান করে আওয়ামী লীগ বাধ্য করেছিল ক্ষমতাসীন বিএনপিকে তাদের সিদ্ধান্ত মানতে। আজ বিএনপি একই স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছে। বিএনপি, চারদল কিংবা ইসলামী দলগুলো কতটুকু সফল হবে, ভবিষ্যৎই এটা নির্ধারণ করবে; কিন্তু দেশটির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। দেশটি তো সবার। সংবিধান সংশোধনের পেছনে জনগণের মঙ্গল কতটুকু নিহিত আছে, আগামী দিনে তা বিচার হবে; কিন্তু রাজনীতিতে এ ধরনের বৈরিতা জাতির জন্য মঙ্গল নয়। আজ ও আগামীকাল লাগাতার হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি তথা চার দল। সরকার পতনের কথা বলছে বিরোধী দল। সরকার গঠিত হওয়ার আড়াই বছরের মাথায় আমরা বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছি। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সমাধানের পথ বের করতে হবে রাজনীতিবিদদের। আর উদ্যোগটা আসতে হবে সরকারের পক্ষ থেকেই।
অনেক সম্ভাবনা নিয়ে এখন বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। মতামতও প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদপত্রে। একটা জিনিস এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়, পঞ্চদশ সংশোধনী এখন সংবিধানের অংশ। এটা বাদ দেয়া যাবে না। অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে (যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষ পুনঃপ্রবর্তন, জাতীয় পরিচয় বাঙালি ও নাগরিক হিসেবে বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম তফসিল বামে অন্তর্ভুক্তি, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ইত্যাদি), এসব পরিবর্তন এখন সংবিধানের অংশ। এগুলো পরিবর্তনের আর সুযোগ নেই। রাজনীতি করতে হলে সংবিধানকে সামনে রেখেই রাজনীতি করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবর্তিত সংবিধানকে অস্বীকার করা যাবে না। সংবিধানের পরিবর্তনে বিএনপি তথা চারদলের আপত্তি রয়েছে। এর পেছনে যুক্তি যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে এই পরিবর্তনগুলো এখন সংবিধানের অংশ। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে; কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' এখন বাদ দেয়া হয়েছে। এটা নিয়ে ইসলামিক দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে ও গত ৩ জুলাই অর্ধদিবস হরতালও পালন করেছে; কিন্তু এটা নিয়ে আর খুব বেশি দূর এগোনো যাবে না। ইচ্ছে করলেও ইসলামিক দলগুলো সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে না। কেননা সংবিধান পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া আছে। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন না থাকলে সংবিধান সংশোধন করা যায় না। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের সংসদে এই আসন আছে। তারা দ্বিতীয়বার সংবিধান সংশোধন করবে, এটা বিশ্বাস হয় না। সুতরাং স্পষ্টতই দেশ আজ এক গভীর সংকটে পতিত হলো। যেখানে সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে নূ্যনতম ঐক্যের প্রয়োজন ছিল, তা পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে হয়নি।
গণতন্ত্রের অভিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরাকরের কোনো বিধান থাকতে পারে না_ এটা সত্য; কিন্তু আমরা গুলিয়ে ফেলি এক জায়গায়_ উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রের চর্চার সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রের চর্চাকে একসঙ্গে মেলান যাবে না। পশ্চিমা ইউরোপে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। আমরা সে স্তরে এখনো পেঁৗছতে পারিনি। আমাদের সমাজে গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো একটি ব্যবস্থা থাকা ছিল বাঞ্ছনীয়। এ জন্য সংবিধান যে পরিবর্তন করতে হয়েছিল, সেটাও অমূলক ছিল না। জিম্বাবুয়েতে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সেখানে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সমাধান হয়েছিল বিরোধী দলনেতা সাভাঙ্গিরাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির মধ্য দিয়ে। অথচ জিম্বাবুয়ের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। এর আগে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে একই ধরনের ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম কেনিয়াতে। প্রেসিডেন্ট কিবাকি ও বিরোধী দল নেতা রাইলা ওডিংগার মধ্যকার দ্বন্দ্বে সেখানে অনেক লোক মারা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিদেশিদের মধ্যস্থতায় ওডিংগাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের মধ্য দিয়ে কেনিয়ার গণতন্ত্র একটা সমাধান খুঁজে পেয়েছিল। কেনিয়ার সংবিধানেও কোনো প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল না। প্রথমে কেনিয়া ও পরে জিম্বাবুয়ের ঘটনাবলি প্রমাণ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে কোনো কোনো রাষ্ট্রকে কখনো কখনো সংবিধানবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এমন সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী হলেও, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তা নেয়া হয়েছিল। আমি এরকম অনেক দৃষ্টান্ত দিতে পারবো, যেখানে গণতন্ত্রের স্বার্থেই রাষ্ট্র এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা প্রকারন্তরে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা ছিল এমন একটি সিদ্ধান্ত, যা বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করেছিল। এ ব্যবস্থা বিদেশে প্রশংসিতও হয়েছিল। তবে ওই ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। তিনটি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরই ত্রুটিগুলো আরো স্পষ্ট হয়েছিল। যদি এই ত্রুটিগুলো দূর করা যেতো, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এতে করে আরো শক্তিশালী হতো।
নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা যায়_ এটা তত্ত্বের কথা। বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হলেও, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারে না। কেননা বর্তমান সরকারই সিইসি তথা নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবে। ফলে প্রশ্ন উঠবে তাদের আনুগত্য নিয়ে। এখন তো শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই 'রাজনীতি' করেন না, আমলারাও রাজনীতি করেন। কেউ বিএনপির আমলা, কেউ আবার আওয়ামী লীগের আমলা। রাজনৈতিক বিবেচনায় সচিব নিয়োগ হচ্ছে। কেউবা আবার বঞ্ছিত হচ্ছেন। বিএনপির আমলে প্রমোশন না হওয়া ব্যক্তিরা বর্তমান সরকারের আমলে হুট করে সচিব পর্যন্ত হয়ে গেছেন_ এমন দৃষ্টান্তও আছে। তাই যাদের নিয়োগ দেয়া হবে, তাদের নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। আর সরকার যে তাদের স্বার্থেই এসব পদে নিয়োগ দেবে, এটা বলাই বাহুল্য। তাহলে নিরপেক্ষতা থাকলো কই? নির্বাচন কমিশনকে অর্থের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। তাদের নিজস্ব তেমন জনবল নেই। গ্রাম পর্যায়ে তারা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল। সেখানে 'ম্যানিপুলেশনের' সম্ভাবনা বেশি। তাই নির্বাচন যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে_ তার গ্যারান্টি কে দেবে? আমরা ভারতের দৃষ্টান্ত দেই বটে; কিন্তু সেখানকার রাজনীতিবিদরা আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করে। আর আমাদের এখানে আমলারা নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতিবিদদের। ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
খালেদা জিয়া গত ১৬ জুন সংবাদ সম্মেলন করে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তিনি অন্য কোনো সিদ্ধান্ত মানবেন না এবং নির্বাচনে অংশও নেবেন না। পাঠক, ১৯৯৬ সালের ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের আগের দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে চেষ্টা করুন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। ফলে ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এমনকি ১৯৯৬ সালে এরশাদ সাধারণ নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগকে ওই নির্বাচনে নিয়ে এলেও তৃতীয় জাতীয় সংসদ স্থায়ী হয়নি বিএনপির অংশগ্রহণ না করার কারণে। ৫ম, ৭ম, ৮ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল একটি কারণেই_ কারণ দুটি বড় দল ওইসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে আগাম মন্তব্য করা সঠিক নয়। নির্বাচন হবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। অনেক সময় বাকি। কিন্তু স্থিতিশীলতার স্বার্থে একটা সমঝোতা প্রয়োজন। বিএনপিকে সংসদে এসে নতুন করে প্রস্তাব দিতে বলেছে আওয়ামী লীগ। এর কী আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? বেগম জিয়া দুটি জিনিস পরিষ্কার করেছিলেন। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে অন্তত আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচনের জন্য, দুই. সংবিধানের ৫৮গ(৩) ধারায় সংশোধনী এনে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টার পদে নিযুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পরও সংসদে যে কেউ এ ব্যাপারে প্রস্তাব আনতে পারেন। সরকার যে কাউকে উৎসাহিত করতে পারেন এ ধরনের একটি প্রস্তাব আনতে। এমনকি একমাত্র নির্দলীয় সদস্যও এ প্রস্তাব আনতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি এমপিরাও সেই প্রস্তাব সমর্থন করে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। উচ্চ আদালতের রায় ও অভিমতের অনুসরণ করেও এ ধরনের প্রস্তাব আনা যায়। তবে সেটা সংবিধানের অংশ হবে না।
আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে চলে, তাহলে আওয়ামী লীগ ভুল করবে। দেয়ালের লিখন বড় কঠিন, বড় বাস্তব। আর দেয়ালের লিখন থেকে আমরা কেউ শিখি না। কেউ শিক্ষাও নেই না। হরতাল কোনো সমাধানের পথ নয়। অতীতে হরতালের পর হরতাল আহ্বান করে আওয়ামী লীগ বাধ্য করেছিল ক্ষমতাসীন বিএনপিকে তাদের সিদ্ধান্ত মানতে। আজ বিএনপি একই স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছে। বিএনপি, চারদল কিংবা ইসলামী দলগুলো কতটুকু সফল হবে, ভবিষ্যৎই এটা নির্ধারণ করবে; কিন্তু দেশটির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। দেশটি তো সবার। সংবিধান সংশোধনের পেছনে জনগণের মঙ্গল কতটুকু নিহিত আছে, আগামী দিনে তা বিচার হবে; কিন্তু রাজনীতিতে এ ধরনের বৈরিতা জাতির জন্য মঙ্গল নয়। আজ ও আগামীকাল লাগাতার হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি তথা চার দল। সরকার পতনের কথা বলছে বিরোধী দল। সরকার গঠিত হওয়ার আড়াই বছরের মাথায় আমরা বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছি। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সমাধানের পথ বের করতে হবে রাজনীতিবিদদের। আর উদ্যোগটা আসতে হবে সরকারের পক্ষ থেকেই।
ড. তারেক শামসুর রহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
0 comments:
Post a Comment